- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশ পরিচ্ছেদ
- একবিংশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিধবা
“যুবরাজ! আমি প্রতিশ্রুত ছিলাম যে, একদিন আপনার পরিচয় দিব। এখন তাহার সময় উপস্থিত হইয়াছে।
ভরসা করিয়াছিলাম, আমার তিলোত্তমা অম্বরের সিংহাসনরূঢ়া হইলে পরিচয় দিব। সে সকল আশাভরসা নির্মূল হইয়াছে। বোধ করি যে, কিছু দিন মধ্যে শুনিতে পাইবেন, এ পৃথিবীতে তিলোত্তমা কেহ নাই, বিমলা কেহ নাই। আমাদিগের পরমায়ু শেষ হইয়াছে।
এই জন্যই এখন আপনাকে এ পত্র লিখিতেছি। আমি মহাপাপীয়সী, বহুবিধ অবৈধ কার্য করিয়াছি, আমি মরিলে লোকে নিন্দা করিবে, কত মত কদর্য কথা বলিবে, কে তখন আমার ঘৃণিত নাম হইতে কলঙ্কের কালি মুছাইয়া তুলিবে? এমন সুহৃদ্ কে আছে?
এক সুহৃদ্ আছেন, তিনি অচিরাৎ লোকালয় ত্যাগ করিয়া তপস্যায় প্রস্থান করিবেন। অভিরাম স্বামী হইতে দাসীর কার্যোদ্ধার হইবে না। রাজকুমার! একদিনের তরেও আমি ভরসা করিয়াছিলাম, আমি আপনার আত্মীয়জনমধ্যে গণ্যা হইব। একদিনের তরে আপনি আমার আত্মীয়জনের কর্ম করুন। কাহাকেই বা এ কথা বলিতেছি? অভাগিনীদের মন্দ ভাগ্য অগ্নিশিখাবৎ, যে বন্ধু নিকটে ছিলেন, তাঁহাকেও স্পর্শ করিয়াছে। যাহাই হউক, দাসীর এই ভিক্ষা স্মরণ রাখিবেন। যখন লোকে বলিবে বিমলা কুলটা ছিল, দাসী বেশে গণিকা ছিল, তখন কহিবেন, বিমলা নীচ-জাতি-সম্ভবা, বিমলা মন্দভাগিনী, বিমলা দুঃশাসিত রসনা-দোষে শত অপরাধে অপরাধিনী; কিন্তু বিমলা গণিকা নহে। যিনি এখন স্বর্গে গমন করিয়াছেন, তিনি বিমলার অদৃষ্ট-প্রসাদে যথাশাস্ত্র তাহার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। বিমলা এক দিনের তরে নিজ প্রভুর নিকটে বিশ্বাসঘাতিনী নহে।
এতদিন একথা প্রকাশ ছিল না, আজ কে বিশ্বাস করিবে? কেনই বা পত্নী হইয়া দাসীবৎ ছিলাম, তাহা শ্রবণ করুন–
গড় মান্দারণের নিকটবর্তী কোন গ্রামে শশিশেখর ভট্টাচার্যের বাস। শশিশেখর কোন সম্পন্ন ব্রাহ্মণের পুত্র; যৌবনকালে যথারীতি বিদ্যাধ্যয়ন করিয়াছিলেন। কিন্তু অধ্যয়নে স্বভাবদোষ দূর হয় না। জগদীশ্বর শশিশেখরকে সর্বপ্রকার গুণ দান করিয়াও এক দোষ প্রবল করিয়া দিয়াছিলেন, সে যৌবনকালের প্রবল দোষ।
গড় মান্দারণে জয়ধরসিংহের কোন অনুচরের বংশে একটি পতিবিরহিণী রমণী ছিল। তাহার সৌন্দর্য অলৌকিক। তাহার স্বামী রাজসেনামধ্যে সিপাহী ছিল, এজন্য বহুদিন দেশত্যাগী। সেই সুন্দরী শশিশেখরের নয়নপথের পথিক হইল। অল্পকাল মধ্যেই তাঁহার ঔরসে পতিবিরহিতার গর্ভসঞ্চার হইল।
অগ্নি আর পাপ অধিক দিন গোপনে থাকে না। শশিশেখরের দুষ্কৃতি তাঁহার পিতৃকর্ণে উঠিল। পুত্র-কৃত পরকুল-কলঙ্ক অপনীত করিবার জন্য শশিশেখরের পিতা সংবাদ লিখিয়া গর্ভবতীর স্বামীকে ত্বরিত গৃহে আনাইলেন। অপরাধী পুত্রকে বহুবিধ ভর্ৎসনা করিলেন। কলঙ্কিত হইয়া শশিশেখর দেশত্যাগী হইলেন।
শশিশেখর পিতৃ-গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কাশীধামে যাত্রা করিলেন, তথায় কোন সর্ববিৎ দণ্ডীর বিদ্যার খ্যাতি শ্রুত হইয়া, তাঁহার নিকট অধ্যয়নারম্ভ করিলেন। বুদ্ধি অতি তীক্ষ্ণ; দর্শনাদিতে অত্যন্ত সুপটু হইলেন, জ্যোতিষে অদ্বিতীয় মহামহোপাধ্যায় হইয়া উঠিলেন। অধ্যাপক অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া অধ্যাপনা করিতে লাগিলেন।
শশিশেখর একজন শূদ্রীর গৃহের নিকটে বাস করিতেন। শূদ্রীর এক নবযুবতী কন্যা ছিল। ব্রাহ্মণে ভক্তিপ্রযুক্ত যুবতী আহারীয় আয়োজন প্রভৃতি শশিশেখরের গৃহকার্য সম্পাদন করিয়া দিত। মাতৃপিতৃদুষ্কৃতিভারে আবরণ নিক্ষেপ করাই কর্তব্য। অধিক কি কহিব, শূদ্রীকন্যার গর্ভে শশিশেখরের ঔরসে এ অভাগিনীর জন্ম হইল।
শ্রবণমাত্র অধ্যাপক ছাত্রকে কহিলেন, ‘শিষ্য! আমার নিকট দুষ্কর্মান্বিতের অধ্যয়ন হইতে পারে না। তুমি আর কাশীধামে মুখ দেখাইও না।’
শশিশেখর লজ্জিত হইয়া কাশীধাম হইতে প্রস্থান করিলেন।
মাতাকে মাতামহ দুশ্চারিণী বলিয়া গৃহ-বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।
দুঃখিনী মাতা আমাকে লইয়া এক কুটীরে রহিলেন। কায়িক পরিশ্রম দ্বারা জীবনধারণ করিতেন; কেহ দুঃখিনীর প্রতি ফিরিয়া চাহিত না। পিতারও কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। কয়েক বৎসর পরে, শীতকালে একজন আঢ্য পাঠান বঙ্গদেশ হইতে দিল্লী নগরে গমনকালে কাশীধাম দিয়া যান। অধিক রাত্রিতে নগরে উপস্থিত হইয়া রাত্রিতে থাকিবার স্থান পান না; তাঁহার সঙ্গে বিবি ও একটি নবকুমার। তাঁহারা মাতার কুটীরসন্নিধানে আসিয়া কুটীরমধ্যে নিশাযাপনের প্রার্থনা জানাইয়া কহিলেন, ‘এ রাত্রে হিন্দুপল্লীমধ্যে কেহ আমাকে স্থান দিল না। এখন আমরা এ বালকটিকে লইয়া আর কোথা যাইব? ইহার হিম সহ্য হইবে না। আমার সহিত অধিক লোকজন নাই, কুটীরমধ্যে অনায়াসে স্থান হইবে। আমি তোমাকে যথেষ্ট পুরস্কার করিব।’ বস্তুতঃ পাঠান বিশেষ প্রয়োজনে ত্বরিতগমনে দিল্লী যাইতেছিলেন; তাঁহার সহিত একমাত্র ভৃত্য ছিল। মাতা দরিদ্রও বটে; সদয়চিত্তও বটে; ধনলোভেই হউক বা বালকের প্রতি দয়া করিয়াই হউক, পাঠানকে কুটীরমধ্যে স্থান দিলেন। পাঠান স-স্ত্রী-সন্তান নিশাযাপনার্থ কুটীরের এক ভাগে প্রদীপ জ্বালিয়া শয়ন করিল – দ্বিতীয় ভাগে আমরা শয়ন করিলাম।
ঐ সময়ে কাশীধামে অত্যন্ত বালকচোরের ভয় প্রবল হইয়াছিল। আমি তখন ছয় বৎসরের বালিকামাত্র, আমি সকল স্মরণ করিয়া বলিতে পারি না। মাতার নিকটে যেরূপ শুনিয়াছি, তাহাই বলিতেছি।
নিশীথে প্রদীপ জ্বলিতেছিল; একজন চোর পর্ণকুটীরমধ্যে সিঁদ দিয়া পাঠানের বালকটি অপহরণ করিয়া যাইতেছিল; আমার তখন নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল; আমি চোরের কার্য দেখিতে পাইয়াছিলাম। চোর বালক লইয়া যায় উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিলাম। আমার চীৎকারে সকলেরই নিদ্রাভঙ্গ হইল।
পাঠানের স্ত্রী দেখিলেন, বালক শয্যায় নাই। একেবারে আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন। চোর তখন বালক লইয়া শয্যাতলে লুক্কায়িত হইয়াছিল। পাঠান তাহার কেশহর্ষণ করিয়া আনিয়া বালক কাড়িয়া লইলেন। চোর বিস্তর অনুনয় বিনয় করাতে অসি দ্বারা কর্ণচ্ছেদ মাত্র করিয়া বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।”
এই পর্যন্ত লিপি পাঠ করিয়া ওসমান অন্যমনে চিন্তা করিতে করিতে বিমলাকে কহিলেন, “তোমার কখন কি অন্য কোন নাম ছিল না?”
বিমলা কহিলেন, “ছিল, সে যাবনিক নাম বলিয়া পিতা নাম পরিবর্তন করিয়াছেন।”
“কি সে নাম? মাহরু?”
বিমলা বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “আপনি কি প্রকারে জানিলেন?”
ওসমান কহিলেন, “আমিই সেই অপহৃত বালক।”
বিমলা বিস্মিত হইলেন। ওসমান পুনর্বার পাঠ করিতে লাগিলেন।
“পরদিন প্রাতে পাঠান বিদায়কালে মাতাকে কহিলেন, ‘তোমার কন্যা আমার যে উপকার করিয়াছে, এক্ষণে তাহার প্রত্যুপকার করি, এমত সাধ্য নাই; কিন্তু তোমার যে কিছুতে অভিলাষ থাকে আমাকে কহ; আমি দিল্লী যাইতেছি, তথা হইতে আমি তোমার অভীষ্ট বস্তু পাঠাইয়া দিব।’ অর্থ চাহ, তাহাও পাঠাইয়া দিব।’
মাতা কহিলেন, ‘আমার ধনে প্রয়োজন নাই। আমি নিজ কায়িক পরিশ্রম দ্বারা স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করি, তবে যদি বাদশাহের নিকট আপনার প্রতিপত্তি থাকে,—’
এই সমস্ত কথা হইতে না হইতে পাঠান কহিলেন, ‘যথেষ্ট আছে। আমি রাজদরবারে তোমার উপকার করিতে পারি।’
মাতা কহিলেন, ‘তবে এই বালিকার পিতার অনুসন্ধান করাইয়া আমাকে সংবাদ দিবেন।’
পাঠান প্রতিশ্রুত হইয়া গেলেন। মাতার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দিলেন; মাতা তাহা গ্রহণ করিলেন না। পাঠান নিজ প্রতিশ্রুতি অনুসারে রাজপুরুষদিগকে পিতার অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু অনুসন্ধান পাওয়া গেল না।
ইহার চতুর্দশ বৎসর পরে রাজপুরুষেরা পিতার সন্ধান পাইয়া পূর্ব প্রচারিত রাজাজ্ঞানুসারে মাতাকে সংবাদলিপি পাঠাইলেন। পিতা দিল্লীতে ছিলেন। শশিশেখর ভট্টাচার্য নাম ত্যাগ করিয়া অভিরাম স্বামী নাম ধারণ করিয়াছিলেন। যখন এই সংবাদ আসিল, তখন মাতা স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন। মন্ত্রপূতি ব্যতীত যাহার পাণিগ্রহণ হইয়াছে, তাহার যদি স্বর্গারোহণে অধিকার থাকে, তবে মাতা স্বর্গারোহণ করিয়াছেন সন্দেহ নাই।
পিতৃসংবাদ পাইলে আর কাশীধামে আমার মন তিষ্ঠিল না। সংসার মধ্যে কেবল আমার পিতা বর্তমান ছিলেন; তিনি যদি দিল্লীতে, তবে আমি আর কাহার জন্য কাশীতে থাকি, এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি একাকিনী পিতৃদর্শনে যাত্রা করিলাম। পিতা আমার গমনে প্রথমে রুষ্ট হইলেন, কিন্তু আমি বহুতর রোদন করায় আমাকে তাঁহার সেবার্থ নিকটে থাকিতে অনুমতি করিলেন। মাহরু নাম পরিবর্তন করিয়া বিমলা নাম রাখিলেন। আমি পিত্রালয়ে থাকিয়া পিতার সেবায় বিধিমতে মনোভিনিবেশ করিলাম; তাঁহার যাহাতে তুষ্টি জন্মে, তাহাতে যত্ন করিতে লাগিলাম। স্বার্থসিদ্ধি কিম্বা পিতার স্নেহের আকাঙ্ক্ষায় এইরূপ করিতাম, তাহা নহে; বস্তুতঃ পিতৃসেবায় আমার আন্তরিক আনন্দ জন্মিত; পিতা ব্যতীত আমার আর কেহ ছিল না। মনে করিতাম, পিতৃসেবা অপেক্ষা আর সুখ সংসারে নাই। পিতাও আমার ভক্তি দেখিয়াই হউক বা মনুষ্যের স্বভাবসিদ্ধ গুণবশতঃই হউক, আমাকে স্নেহ করিতে লাগিলেন। স্নেহ সমুদ্রমুখী নদীর ন্যায়; যত প্রবাহিত হয়, তত বর্ধিত হইতে থাকে। যখন আমার সুখবাসর প্রভাত হইল, তখন জানিতে পারিয়াছিলাম যে, পিতা আমাকে কত ভালবাসিতেন।”