» » দুঃসাহসিক

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুঃসাহসিক

আট

আধ ঘণ্টা আগেই গিয়ে পৌঁছল মাসুদ রানা।

চারদিকে তুমুল হৈ-চৈ হট্টগোল। পৃথিবীর সর্বত্র যেমন হয়, এখানেও তেমনি। মাথার ওপর কড়া রোদ্দুর, ঘামের দুর্গন্ধ, নেশার ঝোঁকে সর্বস্ব খোয়ানো পরাজিত মুখ। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের হাতেই একটা করে পুস্তিকা। দৌড় আরম্ভ হতে যাচ্ছে—এইমাত্র মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট শেষ হলো।

আশা-নিরাশা, লোভ আর ক্ষোভের আলোছায়া দেখল রানা জুয়াড়ীদের চোখেমুখে, আর আবার একবার মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করল সে জুয়া খেলাকে; এবং সাধারণ মানুষের লোভকে নিজ স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে যারা ব্যবহার করে তাদেরকে।

হংকং রেসকোর্স হচ্ছে পৃথিবীর সেরা রেসকোর্সগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিটা দৌড়ে বিশ-পঁচিশ লক্ষ ডলার খেলা হচ্ছে। ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশনে প্রতিটা ঘোড়ার গতিবিধি দেখা হচ্ছে—প্রয়োজনমত ছবি তুলে নেয়া হচ্ছে মুভি ক্যামেরায়। অত্যাধুনিক চলমান সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে চারতলা দর্শকের গ্যালারিতে ওঠানামার জন্যে।

দোতলা-তিনতলায় বসবার সুযোগ পায়নি রানা। চারতলার খোলা ছাতে জায়গা নিতে হয়েছে ওকে। সোজা চাঁদির ওপর উত্তাপ বর্ষণ করছেন সূর্যদেব নির্বিকার চিত্তে। বিশ মিনিটেই কোকাকোলার জন্যে প্রাণটা আকুলি-বিকুলি করে উঠল রানার। বাচ্চা ফেরিওয়ালাকে ডেকে ঠাণ্ডা এক বোতল কোক খেলো সে, তারপর আবার মন দিল রেস খেলায়। হাতের পুস্তিকা উল্টেপাল্টে দেখল সপ্তম দৌড়ের ফোরকাস্ট। ৩ নম্বর আর ৫ নম্বরের মধ্যেই হবে আসল প্রতিযোগিতা। ও নম্বর হচ্ছে থাণ্ডার স্পীড, ৫ নম্বর ব্ল্যাক টর্পেডো। হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের সম্ভাবনা লিখেছে পনেরো ভাগের এক ভাগ—অর্থাৎ লাস্ট। ওর নম্বর হচ্ছে ১১—জকি, টিয়েন হং।

রানা ভাবছে, ফু-চুং কি সত্যি সত্যিই পারল হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের জকিকে রাজি করাতে? গতকাল সন্ধ্যায় শেষ দেখা হয়েছে ওর সাথে। হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের পুরো ইতিহাস জোগাড় করে ফেলেছে সে। যে ঘোড়া আজ দৌড়াচ্ছে আসলে সেটা হোয়াইট অ্যাঞ্জেলই নয়। আসল হোয়াইট অ্যাঞ্জেল এ-বছর বেশ অনেকগুলো বাজিতে দৌড়েছে। একটাতেও পাঁচজনের মধ্যে থাকতে পারেনি ওটাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে ক’দিন আগে।

‘তা কি করে হয়? জোচ্চুরি এড়াবার জন্যে ঘোড়াগুলোর ঠোঁটে টাট্টু করা থাকে না?’ রানা জিজ্ঞেস করেছিল।

‘আরে দূর, ওসব এখন পুরানো হয়ে গেছে। নতুন চামড়া লাগিয়ে তার ওপর হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের মার্ক দেয়া হয়ে গেছে ছ’মাস আগে। একে পিকা পেপার বলে। খুরগুলো এবং আরও দু’একটা জায়গা অদল বদল করা হয়েছে দক্ষ হাতে বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছে ব্যাটারা। এক বছর ধরে তৈরি হয়েছে ওরা আগামী কালকের এই সপ্তম ঘোড়দৌড়ের জন্যে। সব টাকা ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাবে এই এক দৌড়েই। আমার মনে হয় কমপক্ষে পনেরো গুণ তো হবেই।’

‘এত খবর পেলি কোত্থেকে?’

‘ঘুষ।’

‘তারপর? এখন কি করবি? জকির সাথে দেখা করেছিস?’

সব সেরে তবেই এসেছি। আবার যাচ্ছি এখন। কিন্তু দোস্ত দু’হাজার ডলার অগ্রিম দেব কথা দিয়েছি—টাকা যে নেই আমার কাছে।’

‘কুছ পরোয়া নেই। আমি দিচ্ছি,’ রানা বলল। ‘কিন্তু টাকা নিয়ে ও আবার বিট্রে করবে না তো?’

‘আরে না। সোজা আমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েছি। বলেছি, হোয়াইট অ্যাঞ্জেল যদি জেতে তাহলে আর রক্ষা নেই। স্টুয়ার্ডদের কাছে গিয়ে সব খুলে বলব। ফলে ওর জকিগিরি ঘুচে যাবে জন্মের মত। একটা মাত্র পথ খোলা আছে ওর। আমার কথামত কাজ করলে এই জোচ্চুরির কথা তো বেমালুম চেপে যাবই, তার ওপর নগদ পাঁচ হাজার ডলার দেব। বুদ্ধিমান লোক। বিনা বাক্যব্যয়ে এক কথায় রাজি হয়ে গেছে টিয়েন হং। আজ দু’হাজার দেব বলেছি, বাকিটা পাবে ঘোড়দৌড়ের পর।’

‘কিভাবে হারাবে হোয়াইট অ্যাঞ্জেলকে?’ জিজ্ঞেস করেছিল রানা।

‘ওদের মাথায় একশো এক বুদ্ধি। ও-ই বাতলে দিল। হোয়াইট অ্যাঞ্জেল জিতবে ঠিকই, নইলে ওর গর্দান নিয়ে নেবে লিউঙ, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফাউল করে ডিস্কোয়ালিফাইড হয়ে যাবে। এমন কায়দা করে করবে সেটা যে কেউ বুঝবে না ও এটা ইচ্ছে করে করেছে—সবাই এটাকে ব্যাড লাক মনে করবে। দুই কুলই রক্ষা পাচ্ছে টিয়েন হং-এর।

কিন্তু সত্যিই কি কথামত কাজ করবে টিয়েন হং?

প্রতি সিকি মাইল অন্তর অন্তর উঁচু পোস্টের ওপর অটোমেটিক ক্যামেরা ফিট করা আছে। সেগুলোর দিকে চাইল রানা। কোন ক্যামেরাটা হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের ফাউল দেখতে পাবে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল সে। উত্তেজনা অনুভব করল ভেতর ভেতর। সপ্তম দৌড়ের অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। রানার অল্প দূরেই স্টার্টিং পয়েন্ট। পুরো এক চক্কর দিয়ে এক ফারলং গেলেই উইনিং পোস্ট। পরিষ্কার দেখতে পাবে রানা সবকিছু।

একে একে স্টার্টিং গেটের কাছে জমা হতে থাকল ঘোড়াগুলো। ৩ নম্বর আর ৫ নম্বর এসে দাঁড়াতেই হর্ষধ্বনি উঠল দর্শকের মধ্যে থেকে। ১১ নম্বর দর্শকদের কোনও রকম সহানুভূতি পেল না। আবার অ্যানাউন্সমেন্ট হলো লাউড স্পীকারে।

ডিং করে বেল বেজে উঠতেই হৈ-হৈ করে উঠল দর্শকবৃন্দ। চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘোড়াগুলো বিদ্যুৎগতিতে। নম্বর দেখতে পেল না রানা, গগলস পরা জকিদের মধ্যে চিনতেও পারল না টিয়েন হং-কে। ক্ষিপ্রবেগ আর ধূলির ঝড় গোলমাল করে দিল সবকিছু।

একটু দূরে যেতেই ধূলি সরে যাওয়ায় পরিষ্কার দেখা গেল, আগে ভাগেই রয়েছে ১১ নম্বর। প্রথম বাঁক নিচ্ছে ঘোড়াগুলো। ৮ নম্বর ঘোড়াটা দৌড়াচ্ছে সবচেয়ে আগে। নতুন ঘোড়া। বাইরে থেকে এসেছে। ব্যাপার কি? এটাই কি শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করবে নাকি? না। ৩ নম্বর ধরে ফেলল ওকে, তারপর এগিয়ে গেল ওকে ছাড়িয়ে। ৫ নম্বরও এবার ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৮ কে। এইবার হোয়াইট অ্যাঞ্জেলও ধরে ফেলল। এই চারটে ঘোড়াই সবচেয়ে আগে আছে—বাকিগুলো বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল সবচেয়ে আগে আছে থাণ্ডার স্পীড, তারপর ব্ল্যাক টর্পেডো, তারপর সমান সমান দৌড়াচ্ছে ৮ নম্বর আর হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। তৃতীয় বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল এগিয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাক টর্পেডো ক্রমেই থাণ্ডার স্পীডের কাছাকাছি, আর ব্ল্যাক টর্পেডোর ঠিক পেছন পেছন চলছে হোয়াট অ্যাঞ্জেল ৮ নম্বরকে ছাড়িয়ে এসে। আবার ঘুরতেই দেখল রানা আগে আগে ছুটছে ব্ল্যাক টর্পেডো, দ্বিতীয় হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। থাণ্ডার পিছিয়ে পড়েছে এক লেংথ। হৈ-হৈ করছে মাঠের সমস্ত লোক। হোয়াইট অ্যাঞ্জেল এগিয়ে আসছে এইবার। এই সমান সমান হয়ে গেল। শেষ বাঁকটা ঘুরছে এখন। শ্বাস রুদ্ধ করে বসে রইল রানা। এইবার, এইবার! হোয়াইট অ্যাঞ্জেল এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রেলিং-এর দিকে ছিল ব্ল্যাক টর্পেডো, তাই সোজা হতেই দেখা গেল আবার সমান হয়ে গেছে ওরা। অগণিত লোক চিৎকার করে ব্ল্যাক টর্পেডোকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। এবার রানা পরিষ্কার উপলব্ধি করল হোয়াইট অ্যাঞ্জেল এখন এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি করে সরে আসছে ব্ল্যাক টর্পেডোর দিকে। মাথাটা নিচু করে রেখেছে টিয়েন হং ঘোড়ার গলার ওপাশে, যেন না দেখে ঘটছে ঘটনাটা। ধীরে ধীরে প্রায় গায়ে গায়ে লেগে গেল দুটো ঘোড়া। হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের মাথা দিয়ে আড়াল হয়ে গেল ব্ল্যাক টর্পেডোর মাথা। তারপর হাত দুয়েক এগিয়ে গেল হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের মাথা। ক্ষমতা থাকলেও আর আগে বাড়তে পারবে না ব্ল্যাক টর্পেডো।

রানার সমস্ত মাংসপেশী টান হয়ে গেল উত্তেজনায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে যেন কেউ। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল ব্ল্যাক টর্পেডোর জকি। মাঠের সবাই বুঝল এটা ফাউলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পরমুহূর্তেই হোয়াইট অ্যাঞ্জেল ব্ল্যাক টর্পেডোকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তাঁর কণ্ঠে আপত্তির ঝড় উঠল দর্শকবৃন্দের মধ্যে। হুলস্থুল কাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেল দর্শক গ্যালারিতে।

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সচেতন হয়ে পেশীগুলো ঢিল করল রানা। ওর সামনে দিয়ে উইনিং পোস্ট ছাড়িয়ে চলে গেল হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। দশগজ পেছনে ব্ল্যাক টর্পেডো এবং প্রায় সাথে সাথেই থাণ্ডার স্পীড।

ভালই অভিনয় করেছে টিয়েন হং। ঘোড়াগুলো সব ফিরে এল। বুক ফুলিয়ে আগে ভাগে আসছে সে। দর্শকের গালাগালি যেন ও মনে করছে প্রশংসা। মাথার টুপি খুলে আকর্ণ হাসি হেসে প্রত্যাভিবাদন করছে সে দর্শকদের।

মস্ত বোর্ডে রেজাল্ট উঠেছিল। হঠাৎ দর্শকদের হর্ষধ্বনিতে চেয়ে দেখল রানা হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের পাশে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘অবজেক্‌শন’, লাউড স্পীকারে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘আপনাদের টিকেট নষ্ট করবেন না। এই প্রতিযোগিতায় হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের নামে আপত্তি তোলা হয়েছে ব্ল্যাক টর্পেডোর পক্ষ থেকে। আবার বলছি—আপনারা আপনাদের টিকেট নষ্ট করে ফেলবেন না।’

রুমাল বের করে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নিয়ে সোজা হয়ে বসল রানা।

অল্পক্ষণ পরেই মাইকে ঘোষণা করা হলো:

‘একটি ঘোষণা। এই প্রতিযোগিতায় হোয়াইট অ্যাঞ্জেলকে ডিসকোয়ালিফায়েড বলে রায় দেয়া হলো। ব্ল্যাক টর্পেডোকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। আবার বলছি…

ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রানা একটা বাজে।

ফিরে এল সে হোটেলে।

অপারেটার জানাল সি.ওয়াই. লিউঙের লাইন এনগেজড। রানা বুঝল, এতদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করবার পর সোনার ফসল ঘরে তুলতে না পেরে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লিউঙ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। বহু টাকা ঢেলেছিল ওরা এই দৌড়ের পেছনে।

অপারেটারকে বারবার চেষ্টা করবার অনুরোধ করে বাথরূমের দরজা খোলা রেখেই স্নান সেরে নিল রানা। ক্লেদসিক্ত দেহ থেকে সূর্যের উত্তাপ আর রেসকোর্সের ধুলো দূর করে আরাম করে বসল সে ইজি চেয়ারে। ঢিল করে দিল সমস্ত শরীর।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে আগাগোড়া সবটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখল কোথাও ভুল-ভ্রান্তি বা খুঁত রয়ে গেছে কিনা। মনে পড়ল গতকাল ম্যাকাও যাবার আগে মায়া ওয়াং-এর আকুল মিনতি— সাবধানে থেকো রানা। তোমাকে হারাতে চাই না আমি। তোমার জন্যে যে কতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে আছি তা তুমি বুঝবে না। এরা গোক্ষুরের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সাবধানে থেকো, প্লীজ।’

ফোন বেজে উঠল।

‘মি. মাসুদ রানা?’

‘হ্যাঁ।’

‘লাইনে থাকুন। এক্ষুণি ৯০৩২১-২৩ দিচ্ছি।’

‘ধন্যবাদ।’

দুই সেকেণ্ড পরেই লিউঙের মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘ইয়েস। কে বলছেন?’

‘মাসুদ রানা।’

‘বলুন?’

‘হোয়াইট অ্যাঞ্জেল ধরে হেরেছি।’

‘জানি। জকি হারামীপনা করেছে। তা, এখন কি বলছেন?’

‘টাকা,’ নরম গলায় বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ হয়ে গেল লিউঙ। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। আবার প্রথম থেকে শুরু করা যাক। পাঁচটার মধ্যে দু’হাজার ডলার পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। সেই যে টস করে জিতেছিলেন আপনি আমার কাছে—মনে আছে?’

‘আছে।’

দুপুরে ঘরে থাকুন আজ। পাঁচটার মধ্যে লোক যাবে আপনার কাছে টাকা আর লিখিত ইনসট্রাকশন নিয়ে।’

ফোন ছেড়ে দিল লিউঙ। রানা নামিয়ে রাখল রিসিভারটা।

কিছুক্ষণ পায়চারি করে বেড়াল সে। তাহলে এবার কি আরেক রকম জুয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে? আইন থেকে আত্মরক্ষার জন্যে প্রতিটা কাজে, প্রতিটা পদক্ষেপে এরা যে যত্ন আর সাবধানতা অবলম্বন করছে, তাতে রানা বিস্মিত না হয়ে পারল না। ঠিকই তো। খালি হাতে হংকং এসে জুয়া ছাড়া আর কোন্ উপায়ে দশ হাজার ডলার উপার্জন করতে পারত সে? এবারে কেমন জুয়া খেলতে হবে কে জানে!

খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে বিশ্রাম নিল রানা ঘণ্টা দুয়েক। ঘুম এল না চোখে। মনের মধ্যে ভিড় করে এল রাজ্যের যত আবোল-তাবোল চিন্তা। ফু চুং-এর কাছে কয়েকটা কথা গোপন করে কি সে ঠিক করল? ওরা চায়, রানা এই স্মাগলিং দলটাকে শুধু চিনিয়ে দিক—বাকি কাজ ওরা করবে। রেড লাইটনিং টং-এর কথা, চ্যাঙের কথা, লিউঙের আসল পরিচয় ইত্যাদি ওদের জানালেই রানার ছুটি। কিন্তু ওরা যে পুরো দলটার সঙ্গে নির্দোষ মায়া ওয়াং-কেও ধ্বংস করে দেবে বিনা দ্বিধায়। তাছাড়া এমন সুন্দর খেলা জমিয়ে তুলে হঠাৎ কেটে পড়তেও সায় দিচ্ছে না ওর মন। সবটাই যদি না দেখতে পেল, প্রাণের ভয়ে যদি পিছিয়েই পড়ল সে, তাহলে মজাটা আর থাকল কোথায়? চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিস চায় না ওর কোনও বিপদ হোক। মায়ার কাছ থেকে শোনা তথ্যগুলো ওদের জানালেই ওরা তৎক্ষণাৎ ওকে সরিয়ে ফেলবে হংকং থেকে। তাই কোনও কথা বলেনি ওদের। তাড়াহুড়োর কি আছে, ধীরে সুস্থে বললেই হবে পরে।

কিন্তু আশ্চর্য! জলজ্যান্ত একজন লোক দু’দিন ধরে গায়েব হয়ে গেল বেমালুম, অথচ এদের ভাবে-ভঙ্গিতে কোনও পরিবর্তন এল না কেন? অন্তত লিউঙ তো জানত, রানার পেছনেই লাগানো হয়েছিল ল্যাং-ফু-কে। ওর অন্তর্ধানের ব্যাপারে রানার হাত আছে এটা ধরে নেয়াই তো স্বাভাবিক। অথচ কারও কাছে কোনও আভাস পেল না সে এই দু’দিন। যেন ল্যাঙ ফু বলে কেউ ছিলই না কোনদিন। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল রানার কাছে। তাছাড়া ওর পরিচয়ের সত্যতা যাচাইয়ে ওরা কতদূর এগোল সে জানে না। আর ক’দিন সে এভাবে টিকতে পারবে?

মাথা ঝাড়া দিয়ে এসব চিন্তা দূর করে দিল রানা। প্রতীক্ষা করতে ওর বড় খারাপ লাগে। সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। জামা-কাপড় পরে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল সে ঘরের মধ্যে। ভাবল, যে করে হোক আগে ম্যাকাও পৌঁছতে হবে। ছুটিয়ে আনতে হবে মায়াকে চ্যাঙ-এর কবল থেকে, তারপর এই দস্যুদলের যা হয় হোক। কফির অর্ডার দিল সে, তা-ও কারও দেখা নেই।

শেষ চুমুক দিয়ে কফির কাপটা টিপয়ের ওপর নামিয়ে রাখতেই ঠকঠক করে শব্দ হলো দরজায়।

‘ভেতরে আসুন।’

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল লোবো। ঘামে ভিজে সপসপ করছে গায়ের শার্ট। একটা নোংরা তোয়ালের মত রুমাল বের করে মোটা ঘাড়ে ও মুখে বুলাল সে। ঠাণ্ডা ঘরে ইজি চেয়ারে মূল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রানাকে বসে থাকতে দেখে বোধহয় পিত্তি জ্বলে গেল ওর। রানা বসতে বলল, কিন্তু বসল না। প্রথম দিন থেকেই অসম্ভব বিরক্ত হয়ে আছে রানা লোকটার ওপর। বিরক্তি চেপে ভদ্রতা করে বলল, ‘বসুন না। কফি দিতে বলি এক কাপ?’

‘পরের পয়সায় খুব আতিথেয়তা হচ্ছে, না?’ গর্জে উঠল লোবো।

মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল রানার। বলল, ‘তা কফি না হয় না-ই খেলেন। বসতে আপত্তি কি? মোটা মানুষ—ঘেমে তো একেবারে—’

‘শাট আপ!’ চিৎকার করে উঠল লোবো। তারপর সাঁ করে এক তোড়া নোট ছুঁড়ে মারল রানার দিকে। খপ করে ধরে না ফেললে সোজা এসে লাগত রানার নাকে-মুখে।

আর সহ্য করতে পারল না রানা। দ্বিগুণ জোরে ছুঁড়ে মারল সেটা মোটার মুখের ওপর। চটাস করে চপেটাঘাতের মত শব্দ তুলে লাগল গিয়ে নোটগুলো লোবোর গালে।

এটা যে সম্ভব, কল্পনাও করতে পারেনি লোবো। অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে রানার দিকে।

তারপর লাফিয়ে এগিয়ে এল বাঘের মত। রানা উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। কিন্তু প্রস্তুত হয়ে নেবার আগেই বাঘের থাবা এসে পড়ল চুলের ওপর। বাম হাতে মুঠি করে ধরল লোবো রানার চুল, ডান হাতে তুলল তিনমণী কিল।

দুইহাতে মাথার ওপর মুঠিটা ধরল রানা শক্ত করে, তারপর ঝপ করে বসে পড়ল। এটা জুজুৎসু ক্লাসে প্রথম দিনেই শেখানো হয়েছিল ওদের। অতি সাধারণ অথচ কার্যকরী একটা কৌশল।

হাতটা বেকায়দা মতন মচকে যেতেই ‘আউ’ করে একটা শব্দ বেরোল মোটার মুখ থেকে। ওর পকেট থেকে আলগোছে রিভলভারটা বের করে ফেলে দিল রানা ঘরের এক কোণে। তাজ্জব বনে গেল লোবো। এত বড় স্পর্ধা! উঠে দাঁড়িয়ে হাসছে আবার!

এবার ভীমের গদার মত ডান হাতটা চালাল সে। তার আগেই গোটা দুই ঘুসি চালিয়ে দিয়েছে রানা ওর নাক বরাবর। দরদর করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক থেকে। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না সে। দড়াম করে কাঁধের ওপর ডান হাতটা এসে পড়তেই পড়ে গেল রানা মাটিতে। হাঁটুটা ভাঁজ করে রানার বুকের ওপর লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছিল লোবো—ঝটাং করে মোক্ষম মার মারল রানা। নইলে গুঁড়ো হয়ে যেত ওর বুকের পাঁজর। জায়গা মত লাথিটা লাগিয়ে দিয়েই কার্পেট বিছানো মেঝের ওপর এক গড়ান দিয়ে সরে গেল রানা।

অসহ্য বেদনায় নীল হয়ে গেল লোবোর মুখটা। দুই হাত দুই ঊরুর মাঝখানে চেপে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে মেঝেতে। মুখ হাঁ করে শ্বাস নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে কপালে।

‘যেমন আছ তেমনি পড়ে থাকো। নইলে এক লাথি দিয়ে নাকটা সমান করে দেব,’ বলল রানা।

ইচ্ছে করলে প্রাণ ভরে কিলিয়ে হাতের সুখ মিটিয়ে নিতে পারত রানা ওর ওপর। কিন্তু তা না করে মাটি থেকে রাবারব্যাণ্ডে জড়ানো নোটের তোড়াটা তুলে নিল সে। একটা শাদা কাগজ দেখা যাচ্ছে নোটের সাথে। টেনে বার করল ওটা। খাম একটা।

‘খবরদার!’

চমকে চাইল রানা দরজার দিকে। নিঃশব্দে দু’জন পিস্তলধারী লোক এসে কখন ঢুকেছে ঘরের মধ্যে টের পায়নি সে। দুটো পিস্তলই ওর দিকে ধরা।

‘এক্ষণি লিউঙকে ফোন করা দরকার। যদি বাধা দাও তাহলে বিপদে পড়বে, বাছা,’ যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাবে বলল রানা।

একবার রানার হাতে ধরা নোটের বাণ্ডিল আর খামটার দিকে, আর একবার আহত লোবোর দিকে চেয়ে পিস্তলের ইশারায় ফোন করতে বলল একজন।

রিসিভার তুলে নিয়ে লিউঙের নম্বর দিল রানা অপারেটারকে। এতক্ষণে বোধহয় লাইনটা হালকা হয়েছে—দুই সেকেণ্ড পরই কানেকশন পাওয়া গেল লিউঙের।

‘ইয়েস। কে বলছেন?’

‘মাসুদ রানা।’

‘আবার কি?’

‘আপনি যে মোটা গর্দভটাকে পাঠিয়েছেন, তাকে কি টাকাটা আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারবার আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন?’

‘না। কেন, কি হয়েছে?’

‘কি আবার হবে? ওর প্রকাণ্ড ধড়টা এখন মেঝেয় পড়ে হাঁসফাঁস করছে।’

‘আপনি মেরেছেন ওকে? হোটেল কর্তৃপক্ষ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে?’ উত্তেজিত শোনা গেল লিউঙের কণ্ঠস্বর। শেষের কথাটা প্রায় আপন মনেই উচ্চারণ করল সে।

‘হ্যাঁ, মেরেছি।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। আর আপনার হোটেল কর্তৃপক্ষ ও জেগেই আছে। দু’জন গুণ্ডা চেহারার লোক ঘরে ঢুকে পিস্তল ধরে আছে আমার দিকে। অতিথিদের আপ্যায়নের এই কি রীতি নাকি আপনাদের?’

পনেরো সেকেণ্ড চুপ করে থাকল লিউঙ। তারপর ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার কপাল মন্দ। লোবো আর ল্যাংফু বাল্যবন্ধু। এদের কারও সঙ্গে লাগা মানেই মৃত্যু। অযাচিত এই বীরত্ব প্রদর্শন আপনার পক্ষে অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সব কথা না শুনে কিছু বলা যাচ্ছে না। টেলিফোনটা দিন লোবোকে।’

ইশারা করতেই উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফোনের কাছে এগিয়ে এল লোবো। অনর্গল চীনা ভাষায় কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। এদিকে পিস্তলধারীদের একজন ঘরের কোণ থেকে তুলে নিল লোবোর রিভলভারটা। তারপরই ওর চোখ পড়ল পাশের ঘরের দরজায় ফুটোর দিকে। দ্রুতপায়ে গিয়ে দাঁড়াল সে দরজার সামনে। বল্টু খুলে ধাক্কা দিল। বন্ধ ওদিক থেকে। ভাল করে পরীক্ষা করল ছিদ্রটা। তারপর লোবোর কানে কানে কি যেন বলল। কথা থামিয়ে মোটা ঘাড় ফিরিয়ে ছিদ্রটা দেখল একবার লোবো, একবার চাইল রানার দিকে, তারপর সংবাদটা দিল লিউঙ-কে।

কিছুক্ষণ রিসিভার ধরে চুপচাপ শুনল লোবো লিউঙের মেয়েলী কণ্ঠস্বর। তারপরই রিসিভারটা দিল রানার কাছে।

‘ছিদ্রটা কে করেছে?’ খনখনে নিউঙের গলা।

‘জানি না। প্রথম দিন থেকেই দেখছি ওটা।’

‘সাবধান থাকবেন, আমরা খুব শিগগিরই বিপদ আশঙ্কা করছি। খুব সাবধান!’ ছেড়ে দিল লিউঙ টেলিফোন। রানা ঘুরে দেখল পিস্তলধারী দুজন অদৃশ্য হয়ে গেছে ঘর থেকে লোবোর নীরব ইঙ্গিতে। চিঠিটা পড়ে ফেরত দিল রানা মোটার হাতে। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লোবো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘দিন ঘনিয়ে এসেছে তোমার। প্রস্তুত থেকো। শীঘ্রি শোধ নেব আমি।’

কোনও জবাব দিল না রানা। কাল্পনিক সিগারেটে একটা টান দিয়ে ফুঁ দিয়ে ধোঁয়াটা ছাড়ল মোটার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল লোবো।

রানার মাথার মধ্যে চলছে দ্রুত চিন্তা। এখনও সময় আছে। কেটে পড়বে?

নিজেকে এভাবে বিপদের মধ্যে জড়াচ্ছে কেন সে? পরিষ্কার বোঝা গেল ল্যাংফুর রহস্যজনক অন্তর্ধানের ব্যাপারে যে ওর হাত আছে তাতে ওদের সন্দেহমাত্র নেই। তার ওপর আজ বেরোল দরজার ছিদ্র। ফু-চুং-ও জড়িয়ে পড়ল ওদের সন্দেহ-জালে। সতর্ক হয়ে যাবে ওরা, এখন যে-কোনও মুহূর্তে আঘাত হানবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই থাকবে। সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল না তো?

দুইবার পড়ে মুখস্থ করে ফেলা চিঠিটার কিছু কিছু অংশ মনে মনে আওড়াল রানা: হোটেল সিসিল-ম্যাকাও। রাত আটটায় স্টীমার। আগামীকাল রাত সাড়ে আটটায় হোটেল সিসিলের সপ্তম তলায় বারের সঙ্গে লাগা ‘ব্ল্যাকজ্যাক’ টেবিলে পরপর চারবার খেলতে হবে। প্রতিবার দু’হাজার করে।

সবশেষে লাল কালিতে লেখা ছিল: পত্রবাহকের হাতেই চিঠিটা ফেরত দেবেন। নিজ স্বার্থেই গোপনীয়তা রক্ষা করবেন—কারণ, ভুল আমরা পছন্দ করি না।

রানার মনের মধ্যে একটা অ্যালার্ম বেল বেজে উঠল। ম্যাকাও কেন? টাকা পেমেন্টের জন্যে কি হংকং-এ কোনও কায়দা পেল না ওরা? ওদের ঘাঁটিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কি উদ্দেশ্যে? মায়াকে পাঠিয়ে দিয়েছে গতকালই। মায়া কি ওদের টোপ হিসেবে কাজ করছে? ওরা কি সবকিছু টের পেয়ে গেল এরই মধ্যে?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানবার কোনও উপায় নেই। দুটো মাত্র পথ খোলা আছে রানার সামনে। মায়াকে রক্ষার জন্যে এগিয়ে যাওয়া অথবা মায়াকে সন্দেহ করে পিছিয়ে আসা।

এগিয়ে যাবে সে—স্থির করল রানা।