দুঃসাহসিক
সাত
‘আমার মা-ই আমার সর্বনাশটা করল, রানা। আর আমি করলাম তোমার। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না, বিশ্বাস করো।’
সাগরের দিকে মুখ করে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে ওরা ডিনার শেষ করে। চমৎকার করে ছাঁটা ঝাউগাছ আড়াল করেছে ওদেরকে রিপালস্ বে হোটেলের আলোকোজ্জ্বল আঙিনার মত্ত কোলাহল থেকে। দূরে জেলেদের কয়েকটা সাম্পান থেকে আলো পড়েছে সাগরের জলে। ভূতুড়ে লাগছে দেখতে।
গতকালই হোটেলটা একপাক ঘুরে দেখে গেছে মাসুদ রানা। বিল্টমোর হোটেল থেকে দ্বীপের অপর দিকে এই রিপালস্ বে হোটেল ঝাড়া আধঘণ্টার পথ। হোটেলের সামনে চমৎকার একটা বাগান, ঝোপঝাড়ের আড়ালে সুন্দর বসবার ব্যবস্থা; সরু পীচঢালা রাস্তা চলে গেছে সাগরের তীর পর্যন্ত, পথের শেষে চলনসই একটা বীচ—সবই দেখেছে সে ঘুরে ফিরে। প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছে মনে মনে। আজ তাই ঘণ্টাখানেক আগে মায়া ওয়াং পৌছুতেই তাকে নিয়ে সোজা চলে এসেছে হোটেলের শেষ প্রান্তের নিচু প্রাচীর ঘেঁষা নির্জন টেবিলটায়। গেটের কাছে কোকাকোলার বোতল হাতে দাঁড়ানো একজন চীনা লোকের সাথে রানার চোখে চোখে কি ইঙ্গিত বিনিময় হলো জানতেও পারেনি মায়া ওয়াং। বেল বাজাতেই বয় এসেছে, মায়ার পছন্দ মত ডিনার দিয়ে গেছে, খাওয়া দাওয়ার পর সরিয়ে নিয়ে গেছে এঁটো বাসনপত্র। সে-ও প্রায় আধঘণ্টার কথা।
এতক্ষণ বিস্ময়ে হতবাক রানা শুনেছে মায়ার অবিশ্বাস্য কাহিনী।
আবার গ্লাস দুটো ভর্তি করে দিল রানা। ছিপি বন্ধ করে নামিয়ে রাখল কোকের বোতলটা ঘাসের ওপর। তারপর বলল, ‘আমার কি ক্ষতি করেছ জানি না। সেটা পরে শুনব। কিন্তু তোমার মা যখন আর নেই তখন চ্যাঙের সাথে সম্পর্কও নেই তোমার। তুমি কোন্ অপরাধে শুধু শুধু ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওদের হয়ে কাজ করবে?’
‘চ্যাঙ-এর গুপ্তধনের সন্ধান জানার অপরাধে।’
‘তুমি কি করে জেনেছিলে?’
‘আমার মা-র কাছে। ঘরে যে মাইক্রোফোন ছিল সে কথা মা-র জানা ছিল না। মা-তো আত্মহত্যা করেই খালাস— আমি বাঁধা পড়লাম চ্যাঙ-এর হাতে চিরকালের জন্যে।’
‘তোমার মা কি জেনেশুনেই বিয়ে করেছিলেন দস্যু চ্যাঙকে?’
‘না। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ যাচ্ছিল। বাবা মারা যাবার পর জানা গেল প্রচুর টাকা ঋণ রেখে গেছেন তিনি। বন্ধকীর মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যেতেই উচ্ছেদ করে দেয়া হলো আমাদের বাড়ি থেকে সাত দিনের নোটিশে। থাকা খাওয়ার ঠিক ছিল না। এমনি সময় চ্যাঙ মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। হংকং-এর সেরা সুন্দরী ছিলেন তিনি। চ্যাঙের টাকা পয়সার মোহে পড়ে রাজি হয়ে গেলেন আমার মা। আমরা চলে গেলাম ম্যাকাও। পরে ধীরে ধীরে জানা গেল কতবড় ভুল হয়ে গেছে। পৃথিবার হীনতম দস্যুদল রেড লাইটনিং টং-এর দলপতির স্ত্রী তখন তিনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রানা। ধীরে-সুস্থে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে এক-একটা। মায়া ওয়াং-এর কথাগুলো আবার মনে মনে উল্টে পাল্টে দেখল সে। কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে সবকিছু। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই মেয়েটি তাকে এসব কথা বলছে কেন? নিজের পরিচয়, দলের পরিচয় এবং সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার—গপ্তধনের সন্ধান দিল কেন মেয়েটি এমন অসঙ্কোচে একজন প্রায়-অপরিচিত লোকের কাছে? কি প্ল্যান ঘুরছে ওর মাথায়? কোনও ট্র্যাপ? কিছুই বুঝতে পারে না সে।
‘চ্যাঙ-এর ছেলেমেয়ে নেই?’
‘না। আমিই ওর সমস্ত সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, ওর এতো সম্পত্তির মালিক হওয়ার চেয়ে মুক্ত স্বাধীন পথের ভিখারি হলেও আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করতাম।’
‘বুঝলাম। কিন্তু তুমি পুলিসের সাহায্য নাওনি কেন, মায়া?’
‘পুলিস?’ হাসল মায়া ওয়াং। ‘পুলিস কি করবে? চ্যাঙের বিরুদ্ধে একটা আঙুল উঁচু করতেও সাহস পাবে না পুলিস।’
‘তুমি সাংহাইয়ে গিয়ে আর না ফিরলেই পারো?’
‘তোমাকে তো বলেছি, সাংহাইয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আমার ওপর নজর রাখা হয়। সাইলেন্সার ফিট করা একটা পিস্তল চব্বিশ ঘণ্টা নির্নিমেষে চেয়ে থাকে আমার হৃৎপিণ্ডের দিকে। একটু এদিক-ওদিক হলে বিনাদ্বিধায় খুন করা হবে আমাকে। নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে প্রাণধারণের অনুমতি দিয়েছে আমাকে চ্যাঙ। কিন্তু তার হুকুম ছাড়া কারও সঙ্গে মেলামেশা তো দূরের কথা, কথা বলাও বারণ। চারদিক দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে আমাকে। মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নেই। কতদিন মায়ের মত আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমি বড় ভীতু, মি. রানা। তুমি বুঝতে পারবে না কত কাঙালের মত মুক্তি চাই আমি।’
টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল মায়ার কোলের ওপর। সবুজ একটা চিয়োং সাম পরেছে মায়া। চিক চিক করছে গালের ওপর অশ্রুর ধারা। রানার কাছে অতুলনীয় মনে হলো ওকে। ওর একটা হাত তুলে নিল সে নিজের হাতে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দু’জন। একটা রুমাল বের করে আলগোছে মুছে নিল মায়া গাল দুটো। রানা বলল, ‘একটা কথা সত্যি করে বলবে?’
কি কথা? বলব।’
‘আমাকে এসব কথা কেন বললে?’
‘এ ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না বলে। কাউকে না কাউকে আমার বলতে হতই। এত লোক থাকতে তোমার ওপরই নির্ভর করতে চাইলাম কেন তা বলতে পারব না। হয়তো তোমার মধ্যে কিছু দেখতে পেয়েছি আমি, কিংবা হয়তো তোমার অমন বলিষ্ঠ ঋজু স্বাস্থ্য আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারাই এর কারণ হতে পারে। কিন্তু আসল কথা, আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। আমি নিজের স্বার্থে অন্ধ হয়ে গিয়ে এই কাজটা করেছি।’
মৃদু হাসল রানা।
কিন্তু আমার উদ্দেশ্যটা জানলে ভয়ে শুকিয়ে যাবে তোমার মুখ। তবু স্পষ্টই বলব সব কথা। আমি জানি একবার সব কথা বলতে পারলে আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না তুমি। পৃথিবীতে মাত্র দু’জন মানুষ জানত এই গুপ্তধনের কথা—চ্যাঙ আর আমি। এখন তুমিও জেনেছ। আমার কথামত আমাকে যদি এই দলের খপ্পর থেকে বের করে না আন, তাহলে আমার সাথে সাথে তোমাকেও বরণ করে নিতে হবে নিশ্চিত মৃত্যু। আমাকে সাহায্য করতেই হবে তোমার।’
মুচকে হাসল রানা। ‘ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছ আমাকে?’
‘তা যদি মনে করো, তাহলে তাই। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, পৃথিবীতে এত লোক থাকতে তোমাকেই বেছে নিলাম কেন? আর তো কাউকে বলতে সাহস পাইনি। তোমার ওপরই কেবল নির্ভর করা যায় মনে করলাম কেন?’
‘কেন?’
‘তোমাকে আমার ভাল লেগেছে, রানা।’
এমনি সময় কাছেই একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া গেল। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মাসুদ রানা। এক লাফে দেয়ালের পাশে চলে এল সে। দেখল পেছন থেকে সাপটে ধরেছে ফু-চুং সেই জুজুৎসু চ্যাম্পিয়নকে। হাত ছাড়াবার জন্যে ধস্তাধস্তি করছে লোকটা। হঠাৎ যেন যাদুমন্ত্রের বলে ছিটকে পড়ল ফু-চুং কয়েক হাত দূরে। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল আবার, কিন্তু দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে সে।
বেড়ালের মত নিঃশব্দ অথচ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল জুজুৎসু ব্ল্যাক-বেল্ট হোল্ডার। দাও চালনোর মত করে বিদ্যুৎগতিতে ডান হাতটা চালাল একবার ফু-চুং-এর বাঁ কাঁধের ওপর। ঝুলে পড়ল ফু-চুং-এর বাম হাত। এবার আবার মারল সে আঙুলগুলো সটান সোজা রেখে সেই মার ফু-চুং-এর পেটের ওপর। অবর্ণনীয় ব্যথায় কুঁকড়ে গেল ওর দেহ…বেঁকে গেল সামনের দিকে। হাঁটু দিয়ে থুতনিতে একটা আপার কাট মারতেই চিত হয়ে পড়ে গেল ফু-চুং মাটিতে। কোমর থেকে টান দিয়ে একটা ছোরা বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটা ওর বুকের ওপর।
সমস্ত ঘটনাটা ঘটে গেল তিন চার সেকেণ্ডের মধ্যে। এক লাফে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এল রানা বাইরে। ছুটে গিয়ে দড়াম করে লাথি মারল লোকটার শিরদাঁড়ার ওপর। রানা বুঝে নিয়েছে এ-লোক জুজুৎসুর ব্ল্যাক বেল্ট নয়, পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম নিরস্ত্র-যুদ্ধ ‘কারাতে’র ওস্তাদ। একে কোনও রকম সুযোগ দেয়া চলবে না। স্টীলের পাত বসানো জুতোর প্রচণ্ড লাথি শিরদাঁড়ায় পড়তেই বাঁকা হয়ে গেল লোকটার দেহ পিছন দিকে, ছুরিটা পড়ে গিয়েছে হাত থেকে খসে। নির্মম ভাবে আবার লাথি চালাল রানা ওর পাঁজর লক্ষ্য করে। তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ফু-চুং-এর বুকের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল সে মাটিতে। কিন্তু আশ্চর্য! এই আঘাতের পরেও বাঁ পায়ে সে একটা প্রচণ্ড লাথি মারল রানার উরুর ওপর, আর সেই সাথে ডান পা দিয়ে রানার হাঁটুর নিচে বাধিয়ে টান দিল সামনের দিকে। মুহূর্তে ধরাশায়ী হলো রানাও। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল লোকটা। রানাও উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। ঝাঁপিয়ে পড়ল দু’জন দু’জনের ওপর। রানা জানে ওর অল্পবিস্তর জুজুৎসু জ্ঞান টিকবে না লোকটার কাছে। ফু-চুং পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। কাজেই এখন একমাত্র ভরসা ওর হেভি ওয়েট বক্সিং—কুস্তির কায়দায় পারবে না এর সাথে। কাছে আসতেই গোটা দুই বিরাশি সিক্কা চালিয়ে দিল সে নাক বরাবর। কুস্তিগীর বোধহয় এমন আচমকা এই বিলেতী জিনিস আশা করেনি। দুই হাতে মুখ ঢাকল সে। সাথে সাথেই তলপেট বরাবর পড়ল রানার ফাইনাল লাথি। বিচিত্র এক টুকরো শব্দ বেরোল ওর মুখ থেকে তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে মুখ থুবড়ে।
ফু-চুং ততক্ষণে উঠে বসেছে। ওর পকেট থেকে নাইলনের কর্ড বের করে হাত-পা বেঁধে ফেলল রানা লোকটার। নিজের রুমালটা ঢুকিয়ে দিল ওর মুখের ভেতর, ফু-চুং-এর রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলল মুখটা বাইরে থেকে। তারপর ফিরে এল ফু-চুং-এর কাছে।
‘কেমন বোধ করছিস এখন?’
জবাব দিল না ফু-চুং কোনও। ঘুরে বসে গলগল করে বমি করে ফেলল। রানা ধরে থাকল ওকে। বেশ খানিকটা বমি হয়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়াল ফু-চুং। মাটি থেকে ছুরিটা তুলে পকেটে রাখল।
‘এখন ঠিক হয়ে গেছে। ব্যাটা আড়ি পেতে তোদের সব কথা শুনছিল। তুই যা, আমি এখন লাশটা নিয়ে কেটে পড়ি।’
‘মরেনি। জানটা আছে। শুধু পিটিয়ে লাশ করেছি। নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু দোস্ত, সাবধান, একা নিতে চেষ্টা করিস না আবার। তোর লোকজন কোথায়?’
‘আছে, এক্ষুণি এসে পড়বে। তুই যা এখন, আমি সব ব্যবস্থা করে নেব।’ বাম কাঁধটা ডলতে থাকল ফু-চুং।
হোটেলের দিকে ফিরে রানা দেখতে পেল দেয়ালের ওপর দিয়ে একজোড়া ভয়ার্ত বিস্ফারিত চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে। মায়া ওয়াং। রানার পিছু পিছু সে-ও এসে দাঁড়িয়েছিল দেয়ালের ধারে।
দেয়াল টপকে এদিকে চলে এল রানা। বলল, ‘এই হারামজাদা আমার পেছনে লেগেছিল ক’দিন ধরে আঠার মত। ছাড়াতে পারছিলাম না কিছুতেই। তাই এ ব্যবস্থা করেছিলাম।’
‘বমি করল, ওই লোকটা কে?’ তীব্র উৎকণ্ঠা মায়ার কণ্ঠে।
‘ও আমার এক বন্ধু।’
‘ল্যাং ফু-কে নিয়ে এখন কি করবে?’
‘ল্যাং ফু? ওর নাম ল্যাং ফু নাকি? তা যে ফু-ই হোক, বাছাধনকে ক’দিন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।’
‘এই ঘটনাটা টং-এর কেউ জানতে পারলে তোমার কি অবস্থা হবে জানো?’
‘জানি। চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে লিউঙ। তোমাকেও তাই করবে।’
‘এখন উপায়? জানাজানি তো হবেই।’
‘হবে না। লোকটাকে বেমালুম গায়েব করে দিচ্ছি। আমি করলাম, না অন্য কেউ করল কে জানে। ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। আমার ওপর নির্ভর করতে চেয়েছ, নিশ্চিন্তে নির্ভর করো। মরলে দু’জন এক সাথে মরব।’
‘তুমি লিউঙকে চেনো না, তাই এমন হালকাভাবে কথাগুলো বলতে পারলে। কিছুতেই তুমি ওর কাছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারবে না। ধরা পড়বেই।’
‘কি করবে লিউঙ? সাধারণ একটা…’
‘সাধারণ? তোমার দেখছি অনেক কিছু জানতে বাকি আছে। চ্যাঙ-এর ডানহাত। টং-এর সমস্ত জুয়ার ভার ওর ওপর। সাঙ্ঘাতিক মানুষ! ওর সাথে হ্যাণ্ডশেক করলে লোকে হাতের আঙুল গুণে দেখে সব ঠিক আছে, না এক-আধটা খোয়া গেছে। আর তুমি বলছ সাধারণ। হংকং-এ সবাই ওকে যমের মত…’
‘আর ভয় দেখিও না, মায়া। এমনিতেই তোমার ব্ল্যাকমেইলিং-এর কথা শুনে ভয়ে আধমরা হয়ে আছি—এখন আবার লিউঙের ভয় দেখালে ঠিক হার্টফেল করব। তারচেয়ে বলো কি ধরনের সাহায্য আশা করছ তুমি আমার কাছ থেকে। একটা বিরাট দস্যুদলের বিরুদ্ধে কি করতে পারি আমি?’
‘তার আমি কি জানি? সে ভার তোমার ওপর। ল্যাঙ ফু-কে আজ বন্দী না করলে আমাদের কি অবস্থা হত তাই ভাবছি। ভাগ্যিস তুমি বুদ্ধি করে… যাক, যে করে হোক আমরা দু’জন পালিয়ে যাব এখান থেকে। পালিয়ে গিয়ে আমরা…
বেধে গেল মায়ার মুখের কথা। লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল নিচে ‘বলো, বলো,’ রানা বলল, ‘পালিয়ে গিয়ে আমরা? কি করব বলো?’
‘যাহ্, তুমি ভারি পাজি। তোমার যা খুশি করবে, আবার কি?’
‘যদি কোথাও ফেলে পালাই? তাহলে?’ দুষ্টামির হাসি হাসল রানা।
‘তা তোমরা পারো। পুরুষ মানুষকে দিয়ে বিশ্বাস কি? কিন্তু ভুলে যেয়ো না; আমি আর দশটা মেয়ের মত নই।’
‘বেশ, বেশ। কিন্তু যদি সত্যিই কখনও তোমার হাত ধরে বলি, চলো, যাবে?’
‘বলেই দেখো না যাই কিনা। বিশ্বাস করো, রানা, তোমার ভরসাতেই সাহস পেয়েছি আজ চ্যাঙের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার। তুমি নেবে আমাকে সাথে? সত্যিই?’
মৃদু চাপ দিল রানা মায়ার হাতে। চোখে চোখে চেয়ে রইল দু’জন। মৃদু হাসি ফুটে উঠল মায়ার অধরে। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়েই চমকে উঠল। ‘এক্ষুণি যেতে হবে আমাকে, রানা। দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে টেরই পাইনি।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মায়া। রানাও উঠল চেয়ার ছেড়ে। হঠাৎ দুই হাতে গলা সাপটে ধরল মায়া রানার। ওর বুকে কপাল ঘষল। হেসে ফেলল রানা।
‘হাসছ কেন?’ জিজ্ঞেস করল সে রানাকে ছেড়ে দিয়ে।
‘তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। তাই।’
উত্তপ্ত রক্তিম হয়ে উঠল মায়ার গাল।
‘ছেলেমানুষ না কচু। আমার বয়স কত জানো?’
‘না তো!’
‘পঁচিশ!’ চোখ পাকিয়ে বলল মায়া—যেন অনেক বয়স। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে জোর করে যেন বিচ্ছিন্ন করল মায়া নিজেকে রানার মোহজাল থেকে, হাঁটতে থাকল গেটের দিকে।
রানাকে পিছু পিছু আসতে দেখে বলল, ‘তুমি থাকো। গোপনে এসেছি, গোপনেই যেতে হবে আমাকে। আধ ঘণ্টা পরে এসো তুমি। ভাল কথা, বিল্টমোরে তোমার পাশের ঘরেই কিন্তু আছি আমি।’
চলে গেল মায়া ওয়াং।