দুঃসাহসিক
ছয়
পৌনে দুটোর সময় বেরিয়ে এল রানা রাস্তায়। খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে পেট। বাইরে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। লিউঙের এয়ার-কণ্ডিশন্ড ঘর থেকে বেরিয়ে অসম্ভব গরম লাগল ওর। হাঁটতে থাকল সে ফুটপাথ ধরে বাড়িগুলোর ছায়ায় ছায়ায়। ট্যাক্সি পেলেই উঠে পড়বে। কিন্তু পাশ দিয়ে কয়েকটা খালি ট্যাক্সি চলে গেল, তবু উঠল না সে। চিন্তাম্বিত ভঙ্গিতে হাঁটতেই থাকল। বেশ খানিকদূর হাঁটার পর যখন সে পরিষ্কার বুঝতে পারল কেউ অনুসরণ করছে না ওকে, তখন একটাকে ডেকে বলল, ‘বিল্টমোর হোটেল।’
পিছনের সীটে বসে দোকান-পাট দেখতে দেখতে চলেছে রানা, হঠাৎ চোখ পড়ল রিয়ার ভিউ মিররের ওপর। দেখল ওই আয়না দিয়ে ওকে এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল ড্রাইভার, চাইতেই চোখ ফিরিয়ে নিল। এক সেকেণ্ড মাত্র দেখল রানা ড্রাইভারের চোখ। কিন্তু এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট। চিনে ফেলল রানা ওকে। এখন জামা কাপড় বদলে এসেছে, কিন্তু এই লোকটাই এসেছে আজ সাংহাই থেকে হংকং ওর সাথে একই প্লেনে। সেই জুজুৎসু চ্যাম্পিয়ান।
তাহলে ওদের সম্পূর্ণ আওতার মধ্যেই রয়েছে সে এখনও। ওর প্রতিটি কার্যকলাপের ওপর লক্ষ রাখছে ওরা। সন্দেহমুক্ত করতে পারেনি সে নিজেকে।
আর একটি বারও আয়নাটার দিকে চাইল না রানা। যেন কিছুই বোঝেনি, কিছুই টের পায়নি এমনি ভাব নিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল নির্বিকার মুখে। হোটেলে পৌঁছতেই নেমে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল ড্রাইভার। ভাড়ার সাথে বকশিসও দিল রানা, মাথা নুইয়ে সালাম করে গাড়িতে উঠে বসল ড্রাইভার। কিন্তু রানা হোটেলে না ঢোকা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকল গেটের সামনে। রানা চোখের আড়াল হতেই পঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে গিয়ে একটা বাড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকল মিনিট বিশেক। তারপর গাড়ি থেকে নেমে একটা ওষুধের দোকানে ঢুকে তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভার।
প্রকাণ্ড হোটেল। পরিচয় দিতেই কী-বোর্ডের হুক থেকে খুলে ওর কামরার চাবি এগিয়ে দিল সুশ্রী এক যুবতী। চাবির সাথে একটা কালো চাকতিতে সাদা কালি দিয়ে লেখা:
৩য় ফ্লোর
রূম ৩১০
আধ ঘণ্টার মধ্যে খাবার পাঠাবার আদেশ দিয়ে উঠে এল রানা চার তলায়। চাবি ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা।
চমৎকার কার্পেট বিছানো প্রশস্ত ঘর। সাথে অ্যাটাচ্ড বাথ। ডাবলবেড খাটের মাথার কাছে ছোট একটা টেবিলের ওপর টেলিফোন, দামী একখানা অল-ওয়েভ ট্র্যানজিসটার সেট আর একটা ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। বিছানায় শুয়েই হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়না সাদা নাইলন নেটে ঢাকা। আলনার পাশে একটা তাকের ওপর তোবড়ানো সুটকেসটা সযত্নে রাখা। ঘরের এক কোণে একটা রাইটিং টেবিল—তার ওপর একটা সুদৃশ্য টেবিল ল্যাম্প। একটা চেয়ার রাখা সে টেবিলের সামনে। এক কোণে একটা আরাম কেদারা। সব কিছুই টিপ-টপ, রুচি সম্মত। রানা আন্দাজ করল এই কামরার দৈনিক ভাড়া কমপক্ষে পঁচাত্তর হংকং-ডলার হবে।
এয়ার কুলারের ‘হাই কূল’ লেখা বোতামটা টিপে দিল রানা। তারপর টাওয়েল আর সাবানটা বের করে নিয়ে ছুটল বাথরূমের দিকে।
মিনিট দশেক শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানিতে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে স্বৰ্গীয় সুখ অনুভব করল সে—তারপর বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে খাবারের জন্যে বেল বাজিয়ে দিল। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। ইজি চেয়ারে শুয়ে আজকের সমস্ত ঘটনাগুলো মনে মনে খুঁটিয়ে দেখল রানা। না, ভুল হয়নি কোথাও।
এঁটো বাসন পেয়ালা এবং মোটা বকশিস নিয়ে খুশি মনে চলে গেল বেয়ারা। দরজা বন্ধ করে বিছানায় উঠতে যাচ্ছিল রানা, এমন সময় খুট করে শব্দ হলো একটা। সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখল রানা দেয়ালের গায়ে দরজা খুলে গেছে একটা। পাশাপাশি দুই ঘরের মাঝের দরজা। খোলা দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লিউ ফু-চুং। চায়নিজ সিক্রেট সার্ভিসের ক্যালকাটা-চীফ।
বিস্ময়ের ধাকা সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা। ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে চুপ করবার ইঙ্গিত করল ফু-চুং। পা টিপে এগিয়ে এসে ট্র্যানজিসটারটা খুলল সে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতেই ভেসে এল চীনা সঙ্গীত। ভলিউম বাড়িয়ে দিল ওটার। তারপর ইঙ্গিতে খাটের পায়ের দিকে দেখিয়ে টেনে নিয়ে গেল রানাকে বাথরুমের মধ্যে।
‘মাইক্রোফোন আছে, গর্দভ!’ চাপা গলায় বলল ফু-চুং। ইঙ্গিতেই বুঝে নিয়েছিল রানা। কিন্তু হোটেলের মধ্যে মাইক্রোফোন কেন? তবে কি…? উত্তরটা এল ফু-চুং-এর কাছ থেকেই, ‘লিউঙের হোটেল। প্রত্যেক ঘরেই মাইক্রোফোন আছে—রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে ঘরের মধ্যেকার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটা কথাবার্তা।’
‘কিন্তু তুই হঠাৎ কোত্থেকে, দোস্ত?’
ঢাকা থেকে তুই আসছিস জানতে পেরেই হংকং-এর উদ্দেশে ফ্লাই করবার জন্যে আর্জেন্ট সিগন্যাল এসেছিল আমার কাছে। এখানে পৌঁছে সমস্ত ঘটনা শুনলাম। ওদের ধারণা তিনটে অ্যাসাইনমেন্টে আমরা যখন এক সাথে কাজ করে বিজয়ী হয়েছি, তখন এটাতেও হব। কাজেই যেখানে মাসুদ রানা, যাও সেখানে লিউ ফু-চুং। কাল এখানে পৌঁছেই সারাদিনে যতটা পেরেছি খবরাখবর জোগাড় করে ফেলেছি। আজ এখানে তোর জন্যে কত নম্বর রুম রিজার্ভ করা হয়েছে জানতে পেরে পাশের ঘরটা ভাড়া নিয়েছি। এখন তোর খবর বল।’
‘শোন। আমাকে দু’হাজার ডলার দিয়েছে লিউঙ। বাকিটা পাব রেস খেলে।’
‘রেস খেলে?’
‘হ্যাঁ। আগামী শুক্রবার, সপ্তম দৌড়-সাড়ে তিন বছরের ঘোড়াদের জন্যে দুই মাইলের পাল্লা। ঘোড়ার নাম হোয়াইট অ্যাঞ্জেল। কথাটা কাউকে বললে জিভ কেটে নেবে বলেছে।
‘ফ্যান্টাস্টিক!’
‘একদম রিয়েলিস্টিক বাছা, বাস্তব সত্য। এরা কাজ নিয়ে ইয়ার্কি মারে না, কথারও বরখেলাপ করে না। বিশেষ করে আমার মত একজন প্রসপেকটিভ জালিয়াতকে এই ক’টা টাকার জন্যে ঠকিয়ে হাতছাড়া করবে না।’
‘জালিয়াত?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল ফু-চুং রান্নার দিকে।
নোট জালের কথা ভেঙে বলতেই হেসে ফেলল ফু-চুং। বলল, ‘কিন্তু জাল নোট পেলি কোথায়, শালা?’
‘দুত্তোর জাল নোট। আসল নোট দেখিয়ে বলেছি জাল করেছি। ব্যাটা একেবারে তাজ্জব বনে গেছে। ভাবছে কোটিপতি হয়ে যাবে আমাকে হাতে রাখলে। যাই হোক, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের নিশ্চিত জয়টা ভণ্ডুল করে দিতে পারবি?’
‘কি করে?
‘নিশ্চয়ই হোয়াইট অ্যাঞ্জেলে কোনও গোলমাল আছে। নইলে এত কনফিডেন্স পেল কোথায় ওরা? তুই চেষ্টা করে দেখ এর গুমরটা ফাঁক করতে পারিস কিনা। তারপর জকিকে ভয় দেখিয়ে বা ঘুসের লোভ দেখিয়ে কাজ হাসিল করতে পারবি হয়তো। আমি নিজেই করতাম, কিন্তু শালারা ছায়ার মত অনুসরণ করছে আমাকে।’
‘বুঝলাম। কিন্তু হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের জয় ঠেকালে তোর কি সুবিধে?’
‘বলছি। অনেক কথা, সংক্ষেপে বলছি। আমাকে নতুন কাজ দিতে রাজি হয়েছে লিউঙ। কিন্তু ভাল মত যাচাই না করে দলে নেবে না। রেসখেলার ব্যাপারটা নিয়ে ক’দিন খুব ব্যস্ত আছে ওরা। রেসের তিন-চার দিন পর আমাকে ফোন করতে বলেছে। তার মানে এর মধ্যে ভাল করে খোঁজ নেবে আমার সম্পর্কে। মাইক্রোফোনেই যদি ধরা পড়ে যাই তো চুকে গেল, প্রয়োজন হলে অরুণ দত্তের বাড়িতেও লোক পাঠাবে। সাচ্চা যখন নই, ধরা পড়বই। আমাকে বিশ্বাস করেনি ওরা। বোধহয় কাউকেই করে না। এখন আমি চাইছি আমাদের কাজ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ওদের ব্যস্ত রাখতে। হোয়াইট অ্যাঞ্জেল না জিতলে কয়েক লাখ ডলার ক্ষতি হয়ে যাবে ওদের, তখন আমার খোঁজ-খবর স্থগিত রেখে এর কারণ অনুসন্ধানেই জোর দেবে। আমিও সেই সুযোগে চাপ দেব টাকার জন্যে—নতুন কাজের জন্যে। চারপাশের পানিটা ঘোলা করে ফেলতে না পারলে পরিষ্কার দেখে ফেলবে ওরা আমাকে। ঘোলা অবস্থায় যতদূর পারা যায় ডুব সাঁতার দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করব ওদের এলাকার মধ্যে।
‘শয়তানী বুদ্ধি তো বেশ ভাল খেলে তোর মাথায় রে! যাই হোক আমি চেষ্টা করব জকিকে কাবু করতে। যা হয় জানাব তোকে কাল।’
‘ঘরের মধ্যে বয়-বেয়ারা থাকতেই আবার মড়মড় করে সেঁদিয়ে পড়িস না।’ আঙুল দিয়ে দরজার গায়ে একটা ছিদ্র দেখাল ফু-চুং। বলল, ‘অনেক খেটে বানিয়েছি ওটা। বয়-বেয়ারা থাকতে ঢুকে পড়বার ভয় নেই।’
চোখ টিপল লিউ ফু-চুং দুষ্টামির হাসি হেসে, তারপর পা টিপে চলে গেল পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল রানা। রেডিও বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল সে নরম বিছানায়।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে সারা হংকং-ময় লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াল রানা ট্যাক্সি করে। কাউলুন থেকে মাইল চারেক দূরে কার্লটন হোটেলে বসে কাউলুনের বিখ্যাত বাতি আর হংকং জেটির চমৎকার দৃশ্য আর সেই সাথে পিকিং-ডাকের অপূর্ব ঘ্রাণ ও স্বাদ উপভোগ করতে করতে ডিনার সেরে নিল। হোটেলে যখন ফিরে এল তখন ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা।
আঠার মত পিছু লেগে ছিল জুজুৎসু চ্যাম্পিয়ান। এতক্ষণে ছুটি পেয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো সে মনে মনে রানার বাপ-মা তুলে গালি দিতে দিতে।