দুঃসাহসিক
পাঁচ
আবার সেই কাস্টমস্। কিন্তু এবার অপেক্ষাকৃত ঢিলা। স্ট্যাম্প ছিঁড়ে সাঁটিয়ে দিল অফিসার রানার সুটকেস এবং অ্যাটাচি কেসে দু’একটা গতবাধা প্রশ্নের পরই। খুলেও দেখল না সেগুলো। গেটের কাছে দাঁড়ানো ইনস্পেক্টর স্ট্যাম্প দেখেই টিক মার্ক দিয়ে দিল বাক্সের ওপর সাদা চক দিয়ে।
‘মি. মাসুদ রানা?’
খশখশে মোটা কর্কশ গলা শুনতে পেল রানা গেট থেকে বেরিয়েই। ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
বলেই চোখ তুলে দেখল রানা প্রকাণ্ড চেহারার অসম্ভব মোটা একজন লোক পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মেদবহুল মোটা গলায় আর চিবুকের ঝুলে পড়া মাংসে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা। প্রকাণ্ড পেটটা অসংকোচে হাত খানেক বেরিয়ে এসেছে সামনের দিকে। পা দুটো যেন কোনও রকমে খাড়া রেখেছে পাহাড়-প্রমাণ ধড়টিকে। যেন কাঁধে একটা চাপড় দিলেই বসে পড়বে মাটিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘামছিল লোকটা। নীল শার্টের বগলের কাছে বিশ্রী হলুদ দাগ পড়েছে ঘামের।
‘আপনার জন্যে গাড়ি তৈরি।’
কথাটা কোন মতে উচ্চারণ করে সুটকেসটা প্রায় ছিনিয়ে নিল লোকটা রানার হাত থেকে। তারপর ঘুরেই চলতে আরম্ভ করল। যেন আসল জিনিস পেয়ে গেছে সে, রানাকে ওর আর প্রয়োজন নেই কোনও রানার দরকার থাকলে আসতে পারে পেছন পেছন, ইচ্ছে করলে না-ও আসতে পারে। হাতে-পায়ে ধরে প্রফেশনাল কণ্ঠ-শিল্পীকে সঙ্গীতানুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তারা যে ব্যবহার করে, অনেকটা সেরকম।
চারদিকে চেয়ে মায়া ওয়াং-এর ছায়াও দেখতে পেল না রানা। সেই জুজুৎসু চ্যাম্পিয়ানও গায়েব। অগত্যা মটু সিং-এর পেছন পেছন একখানা বুইক গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে। লেফট্ হ্যাণ্ড ড্রাইভ। গাড়ির পেছনের সীটে সুটকেস ছুঁড়ে দিয়ে ড্রাইভিং সীটে চেপে বসল মোটা লোকটা। সাথে সাথেই গাড়ি কাত হয়ে গেল একদিকে। চোখের ইশারায় পাশের সীটে রানাকে বসার ইঙ্গিত করে ইঞ্জিন চালু করে দিল সে।
উঠে বসল রানা সামনের সীটে। সাংহাই থেকে এত দক্ষিণে এসে রীতিমত গরম বোধ করছে রানা। তাছাড়া লোকটার ব্যবহারে বিরক্তও বোধ করছে যার-পর-নাই। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় চলেছি আমরা?’
‘যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানেই,’ মাতব্বরির চালে বলল মোটা।
চটাস্ করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করল রানার লোকটার ফোলা গালে। সামলে নিল। শুরুতেই এদের কুনজরে পড়া ঠিক হবে না। এই লোকটাই সি. ওয়াই. লিউঙ কিনা কে জানে। চুপ করে থাকল সে। যতক্ষণ না কাজ উদ্ধার হচ্ছে ছোট হয়ে থাকতে হবে এদের কাছে।
বিপজ্জনক কয়েকটা টার্ন নিয়ে গাড়ি চলল সোজা ভিক্টোরিয়ার দিকে। গিয়ার চেঞ্জের বালাই নেই—অটোমেটিক গিয়ার। মসৃণ রাস্তার ওপর দিয়ে পঙ্খীরাজের মত উড়ে চলল লেটেস্ট মডেলের দামী আমেরিকান গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে চীনা ভাষায় লেখা অসংখ্য সাইনবোর্ড। তার এক বর্ণও বুঝল না রানা। মাঝে মাঝে আবার ইংরেজি সাইনবোর্ডও আছে। কোকাকোলার বিজ্ঞাপনও দেখল কয়েক জায়গায়। ছোট্ট জায়গার জনসংখ্যা তিরিশ বত্রিশ লাখ—কাজেই সেই পরিমাণই ভিড় রাস্তায়। একবার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিগন্যাল রেড হলে শ তিনেক গাড়ির লাইন লেগে যায়।
একটা প্রকাণ্ড তিরিশতলা স্কাইস্ক্র্যাপারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা জোরে ব্রেক কষে। একজন লোক ছুটে এল গাড়ির পাশে।
‘সব ঠিক আছে, লোবো?’
‘সব ঠিক,’ বলল মোটা। ‘বস আছে অফিসে?’
‘আছে। তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।’ দৌড়ে ফিরে গেল সে আবার বাড়ির ভেতর। বোধহয় বসকে আগে থেকে সংবাদ দিতে।
‘এসে গেছি,’ রানার দিকে চেয়ে বলল লোবো। ‘দয়া করে গাত্রোত্থান করুন।’
সুটকেসটা তুলে নিয়ে দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল লোবো। ওর পেছন পেছন গিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকল রানা হলঘরে। সিঁড়ির পাশেই এলিভেটরের দরজা। টোয়েনটি সেকেণ্ড ফ্লোরের বাটন টিপে দিল লোবো রানা পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই।
একটা প্রশস্ত করিডরে বেরিয়ে এল ওরা লিফ্ট থেকে। কার্পেট বিছানো করিডর। কয়েক পা এগিয়ে হাতের ডানধারে একটা বন্ধ ঘর। বেল টিপতেই খুলে গেল দরজা। ওরা ঢুকতে বন্ধ হয়ে গেল আবার। ক্লিক করে তীক্ষ্ণ একটা ধাতব শব্দ হতেই চমকে ফিরে চাইল রানা দরজার দিকে। হাতল নেই কোনও।
একটা প্রকাণ্ড ডেস্কের ওপাশে বসে পাইপ টানছে এক মাঝবয়েসী লোক। ধবধবে সাদা মাথার চুল। বয়স আন্দাজে বেশি পেকে গেছে। সারা মাথাময় এলোমেলো পাখির বাসা হয়ে আছে চুলগুলো। মুখটা ডিমের মত। নিটোল।
অসম্ভব পুরু ঠোঁট দুটোর নিচেরটা ঝুলে গেছে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে। কোটটা খুলে চেয়ারের পেছনে ঝোলানো। ঢুলুঢুলু চোখে রানার দিকে চাইল সে, তারপর উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
ডেস্কটা ঘুরে রানার দিকে এগিয়ে এল লোকটা। লম্বা বেশি হবে না। পাঁচ ফুট তিন কি চার। বাচ্চাদের নেকারবোকারের মত ফুল প্যান্টের কোমর থেকে দুটো ফিতে বেরিয়ে বুকের কাছে গুণচিহ্ন এঁকে কাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেছে পেছনে। সাদা শার্টের কলারের নিচে লাল টাইয়ের কিছুটা বেরিয়ে আছে।
গম্ভীর মুখে চারপাশে এক পাক ঘুরে নির্বিষ্ট চিত্তে পরীক্ষা করল সে রানাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপর ডেস্কের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানার মুখোমুখি।
‘নতুন লোকদের ভাল মত পরীক্ষা করে দেখতে পছন্দ করি আমি, মি. অরুণ দত্ত।’
‘অরুণ দত্ত নয়, এখন থেকে আমি মাসুদ রানা। অরুণ দত্ত মারা গেছে।’
‘আচ্ছা বেশ, মাসুদ রানা। যা বলছিলাম, পরীক্ষা করে দেখি আমি। বিশেষ করে সে যদি আপনার মত এমন চমৎকার ফিগারের অধিকারী হয়। প্রথম দর্শনেই যদি কাউকে দেখেই মনে হয় যে আমাদের কাজের জন্যেই তার জন্ম হয়েছে, তাহলে সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক। এবং পরীক্ষা করা প্রয়োজন। নয় কি?’ পাতলা গলা; চড়া পর্দায় কথা বলে লোকটা। ফলে চেহারা না দেখলে নারীকণ্ঠ বলে ভুল করবে লোকে।
বিনয়ের হাসি হাসল রানা।
‘সঙ্গে পিস্তল আছে দেখা যাচ্ছে। কি পিস্তল, কত ক্যালিবার?’
চকিতে চাইল রানা লিউঙের ধূর্ত চোখের দিকে। বলল, ‘ওয়ালথার পি. পি. কে, থারটি-টু।’
‘সাংহাই বলছে আপনি একটা খুন করেছেন। আমি বিশ্বাস করি সে কথা। সে ক্ষমতা যে আপনার আছে তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কাছে নতুন কাজ নেবার ইচ্ছে আছে?
রানা ভাবল, প্রস্তাবটা বড় বেশি তাড়াতাড়ি এসে গেল না? সাবধান হতে হবে। বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে বলল, ‘কি কাজ তার ওপর নির্ভর করবে ইচ্ছেটা—আর কত পাচ্ছি সেটাও দেখতে হবে। আসলে কোনও দলে যোগ দেয়ার আগ্রহ নেই আমার। নিজে উপার্জন করবার ক্ষমতা আছে আমার কোনও দলের সাহায্য ছাড়াই।’
খিক খিক করে হেসে উঠল লোকটা মেয়েলী ঢঙে। তারপর বলল, ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেক কাজ করতে হয়, মি. মাসুদ রানা। সে কথা যাক, পরের কথা পরে।’ হঠাৎ ঘুরল সে লোবোর দিকে। ‘তুমি হাঁ করে কি শুনছ, লোবো? টেনিস র্যাকেটটা ভেঙে মাল বের করে ফেলো।’ ডানহাতটা দ্রুত একবার ঝাঁকি দিল লিউঙ। পরমুহূর্তে একটা দুইধারে শান দেয়া ছুরি দেখা গেল ওর হাতে। থ্রোয়িং নাইফ। চ্যাপ্টা বাঁটে স্কচ টেপ জড়ানো। বাহুর সাথে কায়দা করে আটকানো ছিল।
‘এক্ষুণি করছি, বস্।’
সুটকেস থেকে র্যাকেটটা বের করে নিয়ে এল লোবো ডেস্কের কাছে। দুইহাতে হাতল ধরে জোরে একটা চাপ দিতেই মট্ করে ভেঙে গেল শেষের অংশটুকু। লিউঙের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মোম বের করল বেশ খানিকটা। তারপর ঝাঁকাতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল নস্যির কৌটার মত দেখতে গোল একটা অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো। টেবিলের ওপর রাখল সে কৌটোটা।
ততক্ষণে আবার নিজের আসনে ফিরে গেছে সি.ওয়াই, লিউঙ। কৌটোটা খুলে ভেতরের জিনিস দেখল একবার। সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠল ওর কুৎসিত পুরু ঠোঁটে। কৌটোটা বন্ধ করে বলল, ‘লোবো, র্যাকেট আর সুটকেস সব দূর করো এখন আমার চোখের সামনে থেকে। র্যাকেটটা পুড়িয়ে ফেলো, আর সুটকেসটা পাঠিয়ে দাও বিল্টমোর হোটেলে ওখানে ওর জন্যে রুম বুক করা হয়েছে। বলে দিও যেন ওর ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয় সুটকেস। যাও, কুইক।’
‘যাচ্ছি, স্যার।’
সুটকেসটা বন্ধ করে এক হাতে এবং ভাঙা র্যাকেটের টুকরো দুটো অন্যহাতে নিয়ে দরজার দিকে চলল লোবো। রানা লক্ষ করল টেবিলের সাথে ফিট করা একটা বোতাম টিপতেই খুলে গেল দরজা। মোটা লোকটা বেরিয়ে যেতেই ছেড়ে দিল লিউঙ বোতামটা। ক্লিক্ করে আবার লেগে গেল হাতল-বিহীন দরজা।
একটা চেয়ার পায়ে বাধিয়ে টেনে এনে সি.ওয়াই. লিউঙের মুখোমুখি বসল রানা। লিউঙের মেয়েলি মুখের দিকে চোখ তুলে হাসল। ‘এখন আমার পাওনাটা চুকিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করতে যেতে পারি।’
এতক্ষণ পলকহীন চোখে লক্ষ করছিল লিউঙ রানার প্রতিটি কার্যকলাপ। এবার চোখটা নামিয়ে কৌটোর দিকে চাইল সে। ওটাকে রেক্সিন মোড়া টেবিলের ওপর শুইয়ে রাস্তা সমান করবার স্টীম-রোলারের মত সামনে-পেছনে করল কিছুক্ষণ ডান হাতের তালু দিয়ে। তারপর আবার চাইল সোজাসুজি রানার দিকে।
‘তার আগে দু’একটা কথা সেরে নিই। আপনি নোট জাল করতে পারেন?’
‘পারি।’
‘নমুনা দেখাতে পারবেন?’
হাসল রানা। বলল, ‘এদিকেও ইন্টারেস্ট আছে নাকি? বেশ, দেখুন।’
কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা খাম বের করে সযত্নে খুলল সে, তারপর তিনটে পাঁচ ডলারের নোট বের করে রাখল টেবিলের ওপর ঠেলে দিল লিউঙের দিকে। সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল লিউং নোটগুলো। গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করল এক এক করে। চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে নিরাসক্ত রানা।
‘বেশ ভালই নকল হয়েছে। ভাল করে লক্ষ না করলে আমার চোখেও ফাঁকি দিতে পারত।’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইল লিউঙ রানার দিকে। ‘কিন্তু দোষ আছে একটা।’
‘কি দোষ? আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারলে শুধরে নেব।’
‘দোষ, মানে, অন্য কোন দোষ নেই। নোটগুলো বেশ ময়লা দেখাচ্ছে।’
‘ওটাকে দোষ বলছেন কেন, মশাই? ওটা তো গুণ। ময়লা নোট কেউ সন্দেহ করে না। নতুন দেখলেই ভাল করে লক্ষ করে।’ হাসল রানা।
‘তা, কথাটা অবশ্য যুক্তিযুক্ত, স্বীকার করল লিউঙ। আর মনে মনে এটাও স্বীকার না করে পারল না যে তার সামনে বসা লোকটা এক্কেবারে পাকা জালিয়াত। স্থির করল সে, একে হাতছাড়া করা যাবে না। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল সে।
কিছুক্ষণ উসখুস করে রানা বলল, ‘আমার পাওনাটা…’
‘আপনি নিজেই তো টাকার গাছ, পাওনার জন্যে এত তাগাদা দিচ্ছেন কেন?’
‘গাছে খানিক পানি ঢালতে হবে যে। ঠিক পানি নয়, কেমিকেলস্। নইলে ফল ধরবে না। আমার সব কেমিকেলস্ সাংহাইয়ে নষ্ট করে দিয়ে এসেছি—এখানে আবার কিনতে হবে।’
‘পাওয়া যাবে তো সব?’ চট্ করে প্রশ্ন করল লিউঙ। রানা সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘তা দৈনিক এরকম নোট কত প্রোডাকশন দিতে পারেন আপনি?’
‘উপযুক্ত সহকারী পেলে আনলিমিটেড। একা বড় জোর হাজারটা। ওতেই আমার চলে যায়।’
একটা টেলিফোন এল। রিভলভিং চেয়ারটা ডানধারে ঘুরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চীনা ভাষায় কথা বলল লিউঙ। রিসিভার নামিয়ে রেখে ফিরল আবার রানার দিকে।
‘আপনাকে আমরা পুরো টাকাই দেব, মি. অরুণ দত্ত, সরি, মাসুদ রানা। এমন কি বেশিও পেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দুই পক্ষেরই নিরাপত্তার জন্যে টাকা দেয়ার একটা কৌশল বের করতে হবে। সোজাসুজি কোনও পেমেন্ট আমরা করব না। কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। হঠাৎ অনেক টাকা হাতে পড়লে মানুষ দিশা হারিয়ে ফেলে—জাহির করতে চায়। এখানে ওখানে দিলদরিয়ার মত খরচ আরম্ভ করে। এবং যখনই পুলিস ক্যাক করে গর্দান চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে টাকা কোথায় পেলে—উত্তর দিতে পারে না কোনও। বুঝতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ। বুঝলাম।’
‘কাজেই,’ সেই একই পর্দায় একই সুরে বলে চলল লিউঙ, ‘আমি এবং আমার উপরওয়ালা পেমেন্টের ব্যাপারে খুবই হুঁশিয়ার। কদাচিত পেমেন্ট করি। আর করলেও অল্প টাকা দিই। কিন্তু আমরা এমন ব্যবস্থা করে দিই যাতে সেই লোক নিজে উপার্জন করে নিতে পারে বাকিটা। আপনার নিজের কথাই ধরুন না। আপনার পকেটে এখন কত আছে?’
‘পঞ্চাশ ডলার’ বলল বিস্মিত রানা।
‘বেশ। আজ আপনার বহুদিনের পুরানো দোস্ত সি. ওয়াই. লিউঙের সাথে দেখা হয়ে গেল।’ একটা আঙুল নিজের বুকে ঠেকাল লিউঙ। ‘রীতিমত ভদ্রলোক একজন। হংকং-এর বিশিষ্ট সম্মানিত নাগরিক। সাংহাইয়ে পরিচয় হয়েছিল আমাদের সেই যুদ্ধের সময় ১৯৪৭ সালে। মনে নেই?’
‘খুব মনে আছে।’
‘সেই সময় একদিন ব্রিজ খেলায় হেরে গিয়ে আমি আপনার কাছে এক হাজার ডলার দেনা ছিলাম। মনে আছে?’
মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘আচ্ছা। আজ যখন দেখা হলো, আমি প্রস্তাব দিলাম টস করে দেখা যাক। হয় ডবল, নয় কুইটস্। এবং আপনি জিতলেন। বুঝেছেন? কাজেই আপনি দু’হাজার ডলার পেয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে। এবং আমি একজন বিশিষ্ট নাগরিক আপনার এই গল্প সত্যি বলে স্বীকার করব। এই নিন আপনার দু’হাজার ডলার।’
মোটা একখানা মানিব্যাগ বের করল লিউঙ হিপ পকেট থেকে। বিশটা একশো ডলারের নোট গুণে এগিয়ে দিল রানার দিকে। টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে বুক পকেটে রাখল রানা ওগুলো নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে। বলল, ‘বাকিটা?’
‘বলছি,’ মৃদু হাসল লিউঙ, ‘টাকা পেয়ে আপনি আমাকে বললেন রেস খেলতে চান। আমি বললাম, চলুন না, আগামী শুক্রবার হংকং রেসকোর্সে, আমিও যেতে পারি। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। তাই না?’
‘নিশ্চয়। এক কথায় রাজি!’ বলল রানা মৃদু হেসে।
‘এবং আপনি ঝোঁকের মাথায় সব টাকা ধরে বসলেন একটা ঘোড়ার ওপর। ভাগ্যক্রমে জিতে গিয়ে অন্ততপক্ষে পাঁচগুণ টাকা পেয়ে গেলেন। ব্যস, আপনার দশ হাজার পূর্ণ হয়ে গেল। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, এত টাকা কোত্থেকে পেয়েছেন, আপনি বলবেন, আইন সঙ্গত উপায়ে রোজগার করেছি। এবং তার প্রমাণও আছে আপনার কাছে।’
‘খুব তো সহজ পথ বাতলে দিলেন। কিন্তু সে ঘোড়া যদি হারে, তা হলে?’
‘হারবে না।’
চমকে উঠল রানা। আশ্চর্য! এ কোন রাজত্বে এসে পৌঁছল সে? নরকের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যেন সে এখন। পাপের আবর্তের ঠিক মাঝখানে এসে পড়েছে।
‘হারবে না?’ বোকার মত জিজ্ঞেস করল সে।
‘না। হারবে না।’
ততক্ষণে সামলে নিয়েছে রানা। বলল, ‘চমৎকার! আপনারা দেখছি এক মাইল এগিয়ে আছেন আমাদের চেয়ে।’
প্রশংসায় কিছুমাত্র বিচলিত হবার ভাব প্রকাশ পেল না লিউঙের চেহারায়। ঢুলুঢুলু চোখ মেলে চেয়ে থাকল সে রানার দিকে। তারপর যেন একঘেয়েমিতে ভুগছে এমনি কণ্ঠে বলল, ‘এক হাজার মাইল।’
‘আপনাদের সাথে কাজ করবার সুযোগ পেলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। আছে আর কিছু কাজ?’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল লিউঙ চিন্তান্বিত মুখে। হাতের তালু দিয়ে স্টিমরোলার চালাল মগ্ন চিত্তে। তারপর আবার চোখ তুলল রানার মুখের দিকে।
‘থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত কোনও ভুল হয়নি আপনার। কাস্টমসের সামনেও বেশ নার্ভের পরিচয় দিয়েছেন। হয়তো কোনও কাজ দিতে পারব। যা বললাম তাই করুন গিয়ে। আগামী মঙ্গল-বুধবার নাগাদ ফোন করবেন আমাকে। কাজ থাকলে বলব তখন। কিন্তু যা বললাম তার যদি বরখেলাফ করেন, তবে আপনার পেমেন্টের ব্যাপারে আর কোনও দায়িত্বই থাকবে না আমাদের। বুঝেছেন? এবার আমার টেলিফোন নম্বরটা টুকে নিন: ৯০৩৩২১-২৩। ঠিক আছে? এবার আসল কথাটা লিখে নিন। গোপন রাখবেন—নইলে আপনার মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।’ মাথা নেড়ে নিজের কথাটাকেই যেন সমর্থন করল লিউঙ। ‘লিখুন, শুক্রবার; সপ্তম দৌড়; সাড়ে তিন বছরের ঘোড়াদের জন্যে দু’মাইলের পাল্লা। জানালা বন্ধ হবার ঠিক আগের মুহূর্তে জমা দেবেন টাকা। ও. কে?’
‘ও. কে।’
‘মস্তবড় সাদা ঘোড়া। ঘাড়ের কেশর আর চারটে খুরের কাছে কালো। জিততে হলে ওই ঘোড়ায় খেলবেন। নাম: হোয়াইট অ্যাঞ্জেল।’