দুঃসাহসিক
চার
মঙ্গলবার সকাল নয়টার মধ্যেই মালপত্র গোছগাছ করে তৈরি হয়ে নিল মাসুদ রানা। এককালে যার দাম এবং চাকচিক্য ছিল প্রচুর, এমনি একটা পুরানো দুমড়ানো সুটকেস জোগাড় করে ফেলেছে সে। একজন টেনিস খেলোয়াড়ের সুটকেসের মতই দেখতে হয়েছে সেটা। একজোড়া দামী স্যুটের সাথে খেলার পোশাক-পরিচ্ছদ, এমন কি একজোড়া দুর্গন্ধযুক্ত কেড্স্ পর্যন্ত আছে তার মধ্যে। কয়েকটা ডানলপ বল আছে নতুন পুরানো মেশানো। গোটাকতক সাদা শার্ট, একজোড়া নাইলনের মোজা, চারটে আণ্ডারওয়্যার, তার মধ্যে দুটো স্পোর্টস মডেল, ইত্যাদিতে প্রায় ভরে এসেছে সুটকেসটা।
এবারে একটা ছোট অ্যাটাচি কেসে সাবান, টাওয়েল, ইলেকট্রিক শেভ, ‘হাউ টু প্লে পোকারে’র একটা অর্ধেক মলাট ছেঁড়া বই, পাসপোর্ট আর টিকেট রাখল সে সাজিয়ে। এর একটা গোপন কুঠুরিতে ওর ওয়ালথারের জন্যে একটা সাইলেন্সার এবং চারটে এক্সট্রা ম্যাগাজিন ভর্তি বত্রিশ রাউণ্ড থ্রী-টু ক্যালিবারের গুলি রাখা আছে সযত্নে।
টেলিফোন বেজে উঠল। রানা ভাবল গাড়ি এসে গিয়েছে বুঝি—কিন্তু অবাক হয়ে শুনল রিসেপশনিস্ট বলছে : ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন থেকে একজন লোক দেখা করতে চায়। চমকে উঠল রানা। আই.টি.সি! অর্থাৎ পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স! রানা জানে সাংহাইয়ে ওদের ব্রাঞ্চ আছে—কিন্তু তাদের সাথে নিষ্প্রয়োজন বোধে যোগাযোগ করেনি সে ইচ্ছে করেই। তাছাড়া সময়ও কম। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে কি সংবাদ নিয়ে এল পি.সি.আই.? এরাও তাহলে চোখ কান খোলা রেখেছিল?
‘সোজা ওপরে পাঠিয়ে দিন,’ বলল রানা।
কয়েক মিনিট পর ঘরে ঢুকল একজন শান্তশিষ্ট চেহারার বাঙালী ভদ্রলোক। পাতলা, লম্বা একহারা চেহারা—অতিরিক্ত এক ছটাক মাংস নেই গায়ে। ছিমছাম পোশাক পরিচ্ছদ। স্টিফ কলার সাদা শার্ট, লাল বো টাই। মুখে মৃদু হাসি। চোখ দুটোতে শিশুসুলভ সারল্য। পুরু গোঁফটা মুখের সাথে বেমানান।
‘আমার নাম রযাউল করিম।’ মাথা নুইয়ে চীনা কায়দায় অভিবাদন করল সে। বুক পকেট থেকে একটা খাম বের করে দিল। তারপর বলল, বুড়া মিঞা পাঠাইছে এইটা আপনের জইন্য। ঘাবড়াইয়া গেছে গিয়া এক্কেরে। লন, পইরা ফালান।’
বহুদিন পর বাংলা বলবার চান্স পেয়ে একেবারে অরিজিনাল ল্যাংগোয়েজ ছেড়ে দিল উপবাসী রেযাউল করিম। ওকে বসিয়ে খাম খুলে ভেতরের কাগজটা বের করল রানা। ওয়ান এইটথ্ ডাবল ক্রাউন কাগজে ইংরেজিতে টাইপ করা। নিচে বা ওপরে কোনও নাম নেই। বাংলা করলে দাঁড়ায়:
‘আমরা অনেক খোঁজ খবরের পর অনুমান করেছি যে তোমার এই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে বিশ্বকুখ্যাত রেড লাইটনিং টং-এর সাক্ষাৎভাবে জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। এটা কোন ধর্মীয় দল নয়—পুরোপুরি ক্রিমিনাল। হংকং-এ এরাই সর্বশক্তিমান হলেও আসলে এদের হেড কোয়ার্টার হচ্ছে ম্যাকাও। নারকোটিকস্, গোল্ড স্মাগলিং, অরগানাইজ্ড্ প্রসটিটিউশন, বিরাট স্কেলে জুয়া, ইত্যাদি থেকে নিয়ে হেন কাজ নেই যা এরা করে না। এদের বিরুদ্ধে হংকং-এ আইনত কিছুই করা যাবে না। শক্তি দিয়ে দমন করা তো চিন্তারও বাইরে। সরকারী উঁচু মহলে এদের নিজস্ব লোক আছে। দলপতির নাম চ্যাঙ।
‘কাজেই, লাইটনিং টং-এর সাথে যদি সংঘর্ষের উপক্রম হয় বা কোনও রকম খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ হেড অফিসে রিপোর্ট করে কাজ থেকে নিবৃত্ত হবে। ভদ্রতার খাতিরে প্রাণ দেয়ার প্রয়োজন নাই।’
‘এটাকে আমার অফিশিয়াল অর্ডার বলে জানবে।’
রানার চোখের সামনে পরিষ্কার ভেসে উঠল মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খানের চেহারাটা। স্থির, গম্ভীর, তীক্ষ্ণ, ঋজু একটা ব্যক্তিত্ব। হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা আর ভক্তি যার হাতে সমর্পণ করে রানা নিশ্চিন্ত।
আগাগোড়া দু’বার পড়ে আনমনে ভাঁজ করে পকেটে রাখতে যাচ্ছিল রানা কাগজটা—হাত বাড়াল রেযাউল করিম। মুখে মৃদু হাসি।
‘দ্যান দেখি। আমার কাছে দ্যান। পোলাপান মানুষ, হারাইয়া ফালাইবেন দলিলটা।’
‘দলিল?’ অবাক হলো রানা।
‘হ। দলিলই তো। এই দলিল হাতে নিয়া কেস করুম না আমি বুড়া মিঞার নামে আপনের জানাজাটা সাইরা নিয়াই!’
‘কেন? বুড়ো মিঞার দোষ?’ হাসল রানা।
‘দোষ? এইটারে দোষ কন আপনে? এইটা গুনা। আরে, ঘাবড়াইয়া যখন গেলি, তো অখনই ইস্টপ্ কইরা দে না। জাইনা হুইনা পোলাটারে পাঠাস্ ক্যান্ ঠাঠার মুখে?
‘ঠাঠা কি?’
‘ঠাঠা বুঝেন না। আঁই? ঢাকাইয়া পোলা ঠাঠা বুঝলেন না? আরে বাজ, বাজ, বজ্র। লাইটনিং টং-এর কথা কই। একবার ঝলসাইয়া উঠলে আর চারা নাই, মুহূর্তে শ্যাষ। তা যাইবেন যখন, গরীবের একটা কথা ফালায়া দিয়েন না—তেরিবেরি দেখলেই কাইটা পইরেন। নাইলে চিবির মোদে পইরা যাইবেন কোলাম। যা-তা মনে কইরেন না টং-রে।’
বক্তব্য শেষ করে রানার হাত ধরে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল রেযাউল করিম। রানা বুঝল হালকা-পাতলা দেহে শক্তি আছে।
‘আচ্ছা, এই মেসেজের কথা চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিস জানে না?’
‘খুব জানে। ক্রিপটোগ্রাফিতে এক্কেরে হাফেজ হইয়া গেছে না ওরা! এতক্ষণে খবরটা হজম কইরা ফালাইছে লু সান। দুনিয়ার কুনো খবর আর আ-জানা নাই।’
‘ওরা জানে এই রেড লাইটনিং-এর কথা?’
‘তা কইতে পারি না। বুড়ামিঞা কৈত্থেইকা এই খবর বাইর করল তা-ও জানি না। সবই তো অনুমান। কিন্তুক একটা কথা কইয়া দেই, চীনারা এক্কেরে বেদিশা হইয়া গেছে গিয়া। বোম্ সিরিয়াস। জানের পরোয়া নাই। যে-কোনও বিপদের মুখে ঠেইলা দিব আপনেরে। কাজেই নিজে হুঁশিয়ার থাইকেন। একটা মাসুদ রানা গেলে পি.সি.আই. কানা হইয়া যাইব না—আর এরাও ক্রিপটোগ্রাফির একখানা ম্যাজিক ফরটিফোর মেশিন ধরাইয়া দিয়া খুশি কইরা দিব বুড়া মিঞারে। আমরাও সিনা টান কইরা চলুম—আইতে যাইতে দশবার কইরা সেলামালকি দিব লু সান হালায়। কিন্তু ক্ষতিটা হইল কার? ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা কইরা দেইখেন—আর হুঁশিয়ার থাইকেন। আইচ্ছা ভাই, সালামালেকুম। আপনের আবার টাইম হইয়া যাইতেছে।’
‘ওয়ালাইকুম সালাম। এবং সদুপদেশের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।’
বেরিয়ে গেল রেযাউল করিম। হৈ-হৈ করে বেশ জমিয়ে রেখেছিল এতক্ষণ। ঘড়ি দেখল রানা—নয়টা পঁচিশ। হঠাৎ ফাঁকা লাগল ওর চারটা পাশ। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। অসংখ্য গাড়ি, বাস, ট্রাক, মোটর সাইকেল, বাই-সাইকেল, রিকশা আর পথচারী ব্যস্তসমস্ত করে রেখেছে রাস্তাটাকে। সবাই ছুটছে। সবারই কাজ আছে। সে-ই কেবল একাকী দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। এপ্রিলের হলুদ রোদ বিছিয়ে পড়েছে প্রকাণ্ড পার্কের সবুজ ঘাসে। একটা ফোয়ারা অনর্থক জল ছিটাচ্ছে আকাশের দিকে। একজোড়া জংলী কবুতর বিভোর হয়ে আদর করছে পরস্পরকে সাংহাই মিউজিয়ামের কার্নিসে বসে।
প্রতীক্ষা করছে রানা। প্রতীক্ষা করতে ওর কোন দিনই ভাল লাগে না। বিছানায় এসে বসে শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে শেষ বারের মত পরীক্ষা করে নিল রানা। সবগুলো গুলি বের করে নিয়ে ট্রিগারের টেনশনটা অনুভব করল সে বার কয়েক ফাঁকা ফায়ার করে। স্লাইড টেনে দেখে নিল ব্যারেলের ভেতর ময়লা আছে কিনা। তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে রেখে দিল যথাস্থানে।
‘আপনার জন্যে গাড়ি এসে গেছে, স্যার,’ মিনিট দশেক পর টেলিফোনে সংবাদ এল।
জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল আবার রানা। যাত্রা তবে শুরু হলো। পাকস্থলীতে সেই শূন্যতার অনুভূতিটা হলো আবার। ভয় ঠিক নয়—অজানার রোমাঞ্চ। অজানার পথে পা বাড়াতে গেলে এই অনুভূতিটা হয় ওর। প্রায়ই হয়।
করাঘাতের শব্দে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল সে। একটা বয় সুটকেসটা তুলে নিল এক হাতে। অ্যাটাচি কেসটা নিজেই নিয়ে বয়ের পেছন পেছন নেমে এল রানা নিচে। মাথা থেকে দূর করে দিল সব চিন্তা। সামনের দিকে ফেরাল সে তার সন্ধানী দৃষ্টি। হোটেল লঙ কী-র সুইং ডোরের ওপাশে যা ঘটতে চলেছে সেইটুকুই এখন ওর কাছে সত্য। আর কিছুই ভাবার দরকার নেই।
কালো একটা মার্সিডিস্ টু-টোয়েনটি দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। গাড়ির পেছনের সীটে তোলা হলো রানার সুটকেসটা।
‘আপনি সামনে বসুন।’ অনুরোধ নয়, আদেশের সুর ড্রাইভারের কণ্ঠে।
সামনের সীটে গিয়ে বসল রানা। হু-হু করে ছুটে চলল গাড়ি প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে। কিছুদূর গিয়েই ডানদিকে মোড় নিল। এক্সপার্ট ড্রাইভার। চোখে গুগলস্, হাতে গ্লাভস্। মেরুদণ্ড সোজা করে বসে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। মুখের ভাবে কাঠিন্য। রানা ভাবল আলাপ জমাবার চেষ্টা করবে। যেন সেই কথা বুঝতে পেরেই ড্রাইভারটা বলে উঠল, ‘আরাম করে বসে যাত্রাটা উপভোগ করুন, মিস্টার। কথা বললে নার্ভাস ফীল করি আমি।’
হাসল রানা। ভাবল, এত স্পীডে চলতে চলতে যদি নার্ভাস হয়ে যায় তাহলেই সেরেছে। ছাতু হয়ে যাবে গাড়ি। কি দরকার বাবা বাজে আলাপে?
কয়েকটা মোড় ঘুরেই একটা নির্জন রাস্তায় প্রবেশ করল গাড়িটা। আবাসিক এলাকা। স্পীড কমে এল, তারপর হঠাৎ ব্রেক করে থেমে দাঁড়াল গাড়ি। বিনা বাক্যব্যয়ে এঞ্জিন চালু রেখেই নেমে গেল ড্রাইভার গাড়ি থেকে। বুট খুলে বের করল কিছু, তারপর পেছনের দরজা খুলে উঠে বসল গাড়ির পেছনের সীটে! রানা ঘাঁড় ফিরিয়ে দেখল পুরানো ধরনের একটা টেনিস র্যাকেট রাখছে ড্রাইভার সুটকেস খুলে কয়েকটা কাপড়ের তলায়। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আবার ড্রাইভিং সীটে এসে বসল লোকটা। আবার চলতে আরম্ভ করল মার্সিডিস বেঞ্জ।
রানা ভাবছে, এই দল যারাই হোক, মস্ত কোনও মাথা আছে এর পেছনে। অদ্ভুত এদের নেটওঅর্ক। কিন্তু মেয়েটার সাথে এদের কি সম্পর্ক? মায়া ওয়াং কি এদের চাকরি করে? কে সে? হংকং-এ আবার দেখা করবার প্রস্তাবে অমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল কেন সে? এত গোপনীয়তা কেন? বিপদের সময় কোনও রকম সাহায্য আশা করা যায় মেয়েটির কাছে?
সাংহাই এয়ারপোর্টেই গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। কাস্টমস্ পর্যন্ত সাথে সাথেই থাকল ড্রাইভার। সবার মালই পরীক্ষা করা হচ্ছে। সাথে সাথে চলছে প্রশ্নবান। আগের দুই ভদ্রলোকের চেকিং শেষ হতেই এল রানার পালা।
সুটকেস খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল কাস্টমস্ অফিসার গত-বাঁধা প্রশ্ন। ‘নিজস্ব জিনিস ছাড়া আর কিছু আছে?’
‘না।’
মূল্যবান কোনও অলঙ্কার বা আর কিছু?’
‘না।’
‘কত টাকা সাথে আছে আপনার?’
‘পঞ্চাশ ডলার।’
প্রথমেই সুটকেসের এক কোণায় হাত ঢুকিয়ে একটা টেনিস বল বের করল অফিসার।
‘এটা কিসের জন্যে? র্যাকেটও আছে দেখছি?’
‘ওটা টেনিস র্যাকেট।’
‘তাতে আমার কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু বল কেন?’
‘বাড়িতে প্র্যাকটিস করি।’
‘আচ্ছা! তা, এত ভারি কেন র্যাকেটটা?’
ঘাড় ফেরাতেই চোখ পড়ল রানার মায়া ওয়াং-এর রক্ত-শূন্য মুখের ওপর।
‘কত বড় জোয়ানটা তা দেখতে পাচ্ছেন না?’ ঠাট্টা করবার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু ওর হাসিটা দেখাল কান্নার মত। ব্যাপার কি? লু সান ইনফরম করেনি এদের?
‘তা ঠিক। টেনিস খেলোয়াড়ের ফিগারই বটে। কিন্তু একটা কথা ভাবছি, টেনিসে মানুষ যত দুর্বল হয় তত ভারি র্যাকেট ব্যবহার করে—যত শক্তিশালী হয় তত হালকা র্যাকেট। আপনার বেলায় উল্টো কেন?’
এবারে কাগজের মত সাদা হয়ে গেল রানার মুখ। উত্তর খুঁজে পেল না কোনও। এক পা পিছাতেই ধাক্কা লাগল মায়ার সাথে। রানা বলল, ‘সরি।’
কাস্টমস্ অফিসার অন্যদিকে চেয়েছিল। রানার মুখ দেখতে পেল না। আনমনে উত্তরটা সে-ই দিয়ে দিল।
‘অবশ্য যার যেমন প্র্যাকটিস্। কি বলেন? কিছু মনে করবেন না এত কথা জিজ্ঞেস করায়। টেনিসে আমিও ইন্টারেস্টেড। আমি সিক্সটি সিক্সের সাংহাই চ্যাম্পিয়ান। উইশ ইয়ু হ্যাপি হলিডে, মি. মাসুদ রানা।’
‘থ্যাঙ্কস।’
সুটকেস বন্ধ করে ওপরে সই করে দিল অফিসার। ট্রলিতে চড়ে চলে গেল সেটা লোডিং-এর দিকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রানা। ব্যাটা কি অ্যাকটিং করল? সব জেনেও যদি এত কথা বলে থাকে তাহলে ওকে কাস্টমস থেকে ছাড়িয়ে সিনেমায় নামিয়ে দেয়া উচিত, ভাবল রানা। এগিয়ে চলল সে। পাসপোর্ট দেখাতেই প্যাসেঞ্জারস লিস্টে একটা টিক দিয়ে দিল সপ্রতিভ এক ছোকরা। ডিপারচার লাউঞ্জে গিয়ে বসে পড়ল রানা ঠাণ্ডা নরম গদিতে হেলান দিয়ে।
প্লেনে রানা বসল গিয়ে উইং-এর কাছে ইমার্জেন্সী একজিটের পাশে। অ্যাকসিডেন্ট হলে ওই পথে বাঁচবার আশায় নয়—টিকেটে নম্বর দেয়া আছে। ওটাই ওর জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কর্মকর্তারা। নাকি লু সান? কে জানে!
রানা লক্ষ করেছে, ডিপারচার লাউঞ্জ থেকেই মায়া ওয়াং ছাড়া আরও একজন লোক নজর রাখছে ওর ওপর। চোখে চোখ পড়লেই সরিয়ে নিচ্ছে চোখ, কিন্তু বারবার ঘুরে ফিরে ওর দৃষ্টিটা স্থির হচ্ছে এসে রানার মুখের ওপর। রানাও ভাল করে চিনে রাখল চেহারাটা। কিন্তু কে লোকটা? সি. এস. এস. না আর. এল. টি? চীনাম্যান, সন্দেহ নেই। হাফ হাতা সিল্কের হাওয়াই শার্ট টেট্রন প্যান্টের মধ্যে গোঁজা। লোমহীন মসৃণ দুই বাহুতে থোকা থোকা বলিষ্ঠ পেশী। প্রশস্ত উন্নত বুকের গড়ন শার্টের ওপর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পায়ে একটা নীল হকি কেউস্। বক্সিং বা কুস্তি চ্যাম্পিয়ান হতে পারে। রানা বুঝে নিয়েছে আইনের পক্ষে হোক বা বিপক্ষে, লোকটা খুনী। রানার সম্পর্কেও ঠিক এই কথাটাই ভাবছে কিনা ওই লোকটা কে জানে। মুচকে হাসল রানা।
রানার ঠিক পেছনের সীটে এসে বসল লোকটা।
প্রকাণ্ড বোয়িং ছাড়বার আগে টেস্ট করে নিল ক্যাপ্টেন সবকিছু। উইং-ফ্ল্যাপ টেস্টিং ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না রানা। ব্রেক ছেড়ে দিয়ে ধীরে সুস্থে এগোল প্লেনটা টেক-অফ্ রানওয়ের দিকে। থেমে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। তারপর সিগন্যাল পেয়েই তীরবেগে ছুটল সামনের দিকে। দুই মিনিটে উঠে গেল কয়েক হাজার ফুট ওপরে। জানালা দিয়ে সাংহাই নগরীর অট্টালিকাগুলোকে মাটিতে ছড়ানো চিনির দানা মনে হলো। একটা গাড়ির চক্চকে পিঠ ঝিক্ করে উঠল রোদ পড়ে। পনেরো সেকেণ্ডের মধ্যে হারিয়ে গেল সাংহাই। নিচে ফসল ভরা মাঠ সবুজ কার্পেটের মত লাগছে। চোদ্দ হাজার ফুট উঠে গেছে ওরা। ‘হাউ টু প্লে পোকারে’ মনোনিবেশ করল রানা। স্ন্যাক্স আর কফি এল, গেল।
দু’ঘণ্টা পর জ্বলে উঠল লাল লেখা: নো স্মোকিং।
তার নিচে লেখা: ফাসেন ইওর সীট বেল্টস্।
পরমুহূর্তেই প্রথমে চীনা এবং পরে ইংরেজি ভাষায় ক্যাপ্টেনের বিরক্তিকর ঘ্যানর ঘ্যানর আরম্ভ হলো—শেষ হলো থ্যাঙ্ক ইউ দিয়ে।
এসে গেছে হংকং।