» » দুঃসাহসিক

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুঃসাহসিক

তিন

লিফট থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডর ধরে যেতে যেতে রানা স্পষ্ট অনুভব করল লিফটম্যান লক্ষ করছে ওকে। নিচেও গেটের কাছে দাঁড়ানো সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করেছিল রানাকে। আশ্চর্য না হলেও অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করল। কারা এরা? কোন দলের? বুঝবার উপায় যখন নেই, তখন বোকা সেজে থাকাই ভাল। সোজা এসে দাঁড়াল সে একশো সাত নম্বর কামরার সামনে।

দরজার ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠের গুনগুন আওয়াজ পাওয়া গেল। কোনও পপুলার গানের কলি ভাঁজছে মেয়েটি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে শুনল রানা কিছুক্ষণ। তারপর টোকা দিল দরজায় থেমে গেল মৃদু গুঞ্জন।

‘ভেতরে আসুন,’ দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল আদেশের সুর। নিচ থেকে রিসেপশনিস্টের টেলিফোন পেয়ে অপেক্ষা করছিল সে রানার জন্যে।

ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল রানা। ছোট্ট একটা সাজানো গোছানো লিভিং রুম।

‘তালা লাগিয়ে দিন দরজায়,’ আবার কণ্ঠস্বর ভেসে এল পাশের বেডরূম থেকে।

চাবিটা ঘুরিয়ে দিয়ে ঘরের মাঝবরাবর আসতেই বেডরুমের খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল সে মেয়েটিকে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে দরজার সামনে।

শুয়ে রয়েছে মেয়েটা ইজিচেয়ারে। ডান পা-টা তুলে দিয়েছে ইজিচেয়ারের হাতলের ওপর। হাইহিল জুতো পরা সে-পায়ে। পা-টা নাচাচ্ছে সে অল্প-অল্প। দুই বাহু মাথার পেছনে বালিশের কাজ করছে। দেহের প্রতিটি রেখায়, বসবার ভঙ্গিতে, চোখের চাউনিতে একটা উদ্ধত দুর্বিনীত ভাব। অথচ অদ্ভুত সন্দুরী।

কোন কথা না বলে এক মিনিট রানাকে পরীক্ষা করল মেয়েটি পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ওর চোখে চোখে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। কিন্তু কাজ হলো না। গম্ভীর মুখে পর্যবেক্ষণ শেষ করে মেয়েটি বলল, ‘আপনিই বোধহয় আমাদের নতুন হেলপার? আপনার নামই অরুণ দত্ত?’

মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘বেশ। তা বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন কলাগাছের মত? না, না, এই ঘরে নয়—আক্কেল থাকা উচিত, এটা অবিবাহিতা ভদ্রমহিলার শোবার ঘর। ওই ঘরেই বসুন।’

পাশের ঘরে সোফায় বসে পড়ল রানা। এমন জায়গায় বসল যেখান থেকে মেয়েটিকে দেখতে পাওয়া যায়। বসেই চোখ তুলে দেখল তার দিকে চেয়ে আছে মেয়েটি। মুখে দুর্বোধ্য এক টুকরো হাসি। রানাকে চাইতে দেখেই মিলিয়ে গেল হাসিটা।

সাবলীল ভঙ্গিতে ডান পা-টা নামিয়ে নিল মেয়েটি ইজি চেয়ারের হাতল থেকে। একবার আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল। তারপর উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। অবাক চোখে চেয়ে রইল রানা মেয়েটির দিকে। অপূর্ব সুন্দরী।

‘এক মিনিট। আসছি এক্ষুণি,’ বলেই ঘুরে দাঁড়াল মায়া ওয়াং। হাইহিলের খুট খুট শব্দ তুলে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল সে। আবার সুরেলা কণ্ঠের গুনগুন গান ভেসে এল পাশের ঘর থেকে। চীনা সুর। বাঙালী শ্রোতার কানে কেমন বিজাতীয় ঠেকে।

এ-ধরনের একটা মেয়ে যে ছায়ার মত অনুসরণ করবে ওকে হংকং না পৌঁছানো পর্যন্ত ভাবতেও পারেনি রানা। অন্য রকম স্ত্রীলোক আশা করেছিল সে। দুর্দান্ত প্রকৃতির হওয়াটাই স্বাভাবকি— কিন্তু এই ঔদ্ধত্য, এই বন্য সৌন্দর্য যেন এ ধরনের কাজের সাথে ঠিক খাপ খায় না। বিপজ্জনক কাজে এরা বিপদ বৃদ্ধিই করে শুধু, কাজে আসে না। ড্যান্সার হলেই যেন ওকে মানাত বেশি।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা লাল মখমলের চিওংসাম পরে বেডরূমের দরজায় এসে দাঁড়াল মায়া। বাঁ হাতে একটা ছোট্ট সোনার রিস্টওয়াচ কালো বেল্ট দিয়ে বাঁধা। অনামিকায় জলজল করছে হীরের আঙটি। কানে সোনার ঝুমকো। ঠোঁটে ভারমিলিয়ন রেড লিপস্টিক। চুলগুলো পনি টেল করা। প্রশস্ত কপাল, হালকা ভুরু আর ঈষৎ টানা চোখ ছাড়া চীনা মহিলা বলে চিনবার উপায় নেই। নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে রয়েছে মেয়েটি রানার দিকে। রানাও বিস্মিত হয়ে দেখল ওর অতুলনীয় সৌন্দর্যের আরেক দিক।

‘আপনিই তাহলে অরুণ দত্ত?’ ঠাণ্ডা গলায় আবার জিজ্ঞেস করল মায়া।

‘হ্যাঁ। আমার নিজের অন্তত সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’

বাঁকা উত্তর শুনে রানার চোখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড চেয়ে থেকে বিরক্তি বর্ষণ করল মায়া ওয়াং। তারপর রানার মুখোমুখি বসল এসে সোফার ওপর যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সাথে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ডান পা-টা বাম হাঁটুর ওপর তুলে গোড়ালি থেকে সামনেটুকু প্রবল বেগে নাচাতে থাকল রানা।

‘কাজের কথায় আসা যাক,’ কর্তৃত্বের সুর মেয়েটির কণ্ঠে। নিজের লাইন ছেড়ে এই কাজটা নিতে চাইছেন কেন?’

‘খুন।’

একটু চমকে উঠে চট্‌ করে চাইল মায়া রানার চোখের দিকে। ‘ও। আমি শুনেছিলাম আপনি চুরি-চামারি লাইনের লোক।’

‘শুধু চুরি। চামারি নয়,’ আপত্তি জানাল রানা।

‘যাই হোক, খুনটা কি রাগের মাথায়, না ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে?’

‘রাগের মাথায়। মারামারি।’

‘কাজেই এখন ভাগবার মতলবে আছেন?’

‘তা বলতে পারেন। তাছাড়া টাকাও পাওয়া যাচ্ছে অনেক।’

‘কাঠের পা কিংবা বাঁধানো দাঁত আছে?’

‘না। দুঃখিত। সবকিছু সাচ্চা।’

বিরক্তি প্রকাশ পেল মেয়েটির ঠোঁটের দুই কোণে।

‘প্রতিবার বলছি ওদের একজন পা ভাঙা লোক জোগাড় করতে—কিছুতেই পারে না। যাকগে, খেলাধুলায় শখটখ আছে? কিসে করে জিনিসটা নিয়ে যাবেন? ভেবেছেন কিছু? কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন না?’

‘না। গ্রামোফোন আর রেডিও ছাড়া অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র জীবনে ছুঁইনি। তবে তাস খেলতে পারি। তাছাড়া টেনিসেও হাত আছে। কিন্তু আমার ধারণা, এসব জিনিস সুটকেসের হ্যাণ্ডেলের ভেতর বেশ চমৎকার ভরে নিয়ে যাওয়া যায়।

‘কাস্টমসেরও তাই ধারণা।’

এক কথায় রানাকে চুপ করিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল মায়া ওয়াং ভুরু কুঁচকে। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। পাসপোর্ট আছে আপনার?’

‘আছে! কিন্তু ছদ্মনামে।’

‘ছদ্মনাম কি রকম?’ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল মায়া ওয়াং।

‘খুলে বললেই বুঝতে পারবেন। আসলে আমার একটা সাইড বিজনেস আছে, জাল নোট তৈরির। কয়েক জায়গায় প্রায় ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। তাই সময় থাকতে কেটে পড়তে চাই যন্ত্রপাতিসহ। স্বনামে চেষ্টা করলে এদেশ থেকে বেরোতে দেবে না আমাকে। কাজেই পাসপোর্ট জাল করতে হলো। আর পাসপোর্ট যদি জাল করতে হয় তবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করাই সবচেয়ে নিরাপদ। আমার ধারণা, বাংলাদেশী হিসেবে রীতিমত খাতির যত্ন পাব কাস্টমস অফিসারের কাছে। তাই নাম নিয়েছি মাসুদ রানা।’

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রানাকে লক্ষ করছিল এতক্ষণ মায়া ওয়াং। রানার এ গল্পটা কেন জানি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করল সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘সেই পাসপোর্ট তৈরি আছে তো?’

‘সঙ্গেই আছে। দেখাব?’

‘না। তার দরকার নেই। দু’দিনের মধ্যে রওনা হতে পারবেন?’

‘না পারার তো কোন কারণ দেখি না। বিয়ে-শাদী করিনি যে পিছু টান থাকবে। বলেন তো আজই ভেসে পড়তে পারি আপনার সঙ্গে।’

শেষের বাক্যটা বোধহয় শুনতে পায়নি মায়া ওয়াং। দ্বিতীয়টা নিয়েই চিন্তা করছিল। স্থির শান্ত গলায় বলল, ‘বেশ। এখন মন দিয়ে শুনুন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবেন হংকং-এ মিস্টার সি.ওআই লিউঙের কাছে যাচ্ছেন আপনি। বহুদিনের পুরানো বন্ধু সে আপনার। যুদ্ধের সময় থেকে ঘনিষ্ঠতা। গলার স্বর একটু বদলে নিয়ে যোগ করল, ‘আসলে এই নামে সত্যিই আছে একজন। প্রয়োজন হলে সে আপনার এই বানানো গল্প সমর্থন করবে।’

উঠে একটা টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মায়া ওয়াং। ড্রয়ার খুলে এক তাড়া নোট বের করল। রাবার ব্যাণ্ড খুলে আন্দাজের ওপর অর্ধেক করল নোটগুলো। অর্ধেক রেখে দিল ড্রয়ারে। তারপর বাকি অর্ধেকে আবার রাবার ব্যাণ্ডটা পরিয়ে ছুঁড়ে দিল রানার দিকে। নিচু হয়ে মেঝের কাছে ক্যাচ ধরল সেটা রানা।

‘এই টাকা দিয়ে লঙ কী হোটেলে আজই একটা কামরা বুক করবেন। ইমিগ্রেশনে এই ঠিকানাই দেবেন। একখানা পুরানো সুটকেস জোগাড় করে তার মধ্যে গোটাকয়েক পুরানো এবং গোটাকয়েক নতুন টেনিস বল রাখবেন ওপর দিকেই—আর টেনিস র‍্যাকেটের জন্যে জায়গা খালি রাখবেন। আমার ধারে-কাছেও আর ঘেঁষবেন না। পরশু সকাল সাড়ে দশটার ফ্লাইটে হংকং যাচ্ছেন আপনি—কালই টিকেট করে ফেলবেন। পরশু অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় আমাদের গাড়ি তুলে নেবে আপনাকে লঙ কী থেকে। একটা টেনিস র‍্যাকেট দেবে ড্রাইভার আপনাকে। বাক্সে রাখবেন সেটা এবং—’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রানার চোখের দিকে চাইল মায়া ওয়াং, ‘মাল নিয়ে কেটে পড়বার বৃথা চেষ্টা করবেন না। নির্ঘাত মারা পড়বেন তাহলে। আপনার লাগেজ প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত আপনার আশেপাশেই থাকবে ড্রাইভার। আমি থাকব সাংহাই এয়ারপোর্টে। আরও লোক থাকতে পারে। কাজেই কোন রকম চালাকি খাটবে না। বুঝতে পেরেছেন?’

বাঁ হাতের তালু ঘুরিয়ে অবাক হওয়ার ভান করল রানা। ‘ও জিনিস দিয়ে আমি কি করব? ও আমার আওতার বাইরে। যাক, হংকং পৌঁছে কি হচ্ছে?’

‘আরেকজন ড্রাইভার অপেক্ষা করবে সেখানে আপনার জন্যে। সে-ই বলবে কি করতে হবে আপনাকে। আর যদি কাস্টমসে ধরা পড়ে যান, আপনি বলবেন আপনি কিছুই জানেন না। বুঝেছেন? কি করে ওই র‍্যাকেট আপনার সুটকেসে এল আপনি জানেনই না। বোবা বনে যাবেন। তাজ্জব হয়ে যাবেন। দেখবেন, সবকিছু আবার ফাঁস করে দেবেন না। আমি আপনার সমস্ত কার্যকলাপ দেখব—খুব সম্ভব আরও এক-আধজন দেখবে। আমি তাদের চিনি না। তারা আমার এবং আপনার দু’জনের ওপরই নজর রাখবে। যাই হোক, আমরা কেউই কোন সাহায্য করতে পারব না আপনাকে। কাজটায় রিস্ক আছে, সেজন্যেই এত টাকা দেয়া হচ্ছে আপনার মত একজন অপদার্থকে। পরিষ্কার হয়েছে কথাটা? যদি ধরা পড়েন, আমরা ছায়ার মত মিলিয়ে যাব।’

‘রাজি। মিলিয়ে না গেলেও ভয়ের কিছু নেই। আপনি ছাড়া ফাঁসাবার মত কাউকে পাচ্ছি না আমি হাতের কাছে। আর, বিশ্বাস করুন, প্রাণ থাকতে আপনাকে কোন রকম বিপদে ফেলব না আমি।’

‘হয়েছে, হয়েছে’, বিদ্রূপের হাসি হাসল মায়া ওয়াং। ‘আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই। কাজেই আমার জন্যে আপনার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক না ঘামালেও চলবে।’ রানার সামনে এসে দাঁড়াল সে। আর দয়া করে কচি খুকিও ঠাওরাবেন না আমাকে। কাজে নেমেছি যখন, তখন আত্মরক্ষা করবার ক্ষমতাও আমার আছে। কার্যক্ষেত্রে আমার ক্ষমতার পরিচয় পেলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আপনি।’

উঠে দাঁড়াল রানাও। অসহিষ্ণু মায়া ওয়াং-এর জ্বলন্ত চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে মৃদু হাসল। বলল, ‘যে-কোনও কাজ আপনার চেয়ে ভাল পারব আমি। ভাববেন না। আমাকে পেয়ে লাভই হবে আপনার। কিন্তু এক মিনিটের জন্যে আপনার মিলিটারি মেজাজ আর মাতব্বরির ভাবটা ছাড়ুন তো। আপনার বন্ধুত্ব চাই আমি। সব যদি ভালয় ভালয় চুকে যায় তাহলে হংকং পৌঁছে আবার আপনার সাথে দেখা হতে পারে না?’

কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করে ভেতর ভেতর একটু খারাপ লাগল রানার। মেয়েটিকে ভাল লেগেছে ওর। বন্ধুত্ব যদি হয় ভালই। কিন্তু রানার আসল উদ্দেশ্য এই বন্ধুত্বের সুযোগে ওদের দলে ঢোকা। বন্ধুত্বকে স্বার্থের খাতিরে ব্যবহার করতে চিরদিনই ঘৃণা বোধ করে সে। কিন্তু করতেই হবে। কর্তব্য ইজ কর্তব্য।

রানার চোখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে কোমল হয়ে এল মায়ার জ্বলন্ত দৃষ্টিটা। অসহিষ্ণু কর্তৃত্বের ভাবটা চলে গেল চেহারা থেকে। এই প্রথম সে স্পষ্ট অনুভব করল কতখানি শক্তিশালী একটা ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। রানার মধ্যেকার প্রবল পৌরুষ এবং প্রচণ্ড ক্ষমতার বিচ্ছুরণ অভিভূত করে ফেলল ওকে। মেয়েমানুষের এ ব্যাপারে ভুল হয় না। দেরিতে হলেও উপলব্ধি করল মায়া ওয়াং, সত্যিই তার সামনে দাঁড়ানো লোকটির তুলনায় কোনও দিক থেকে সে কিছুই নয়। লোভনীয় ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো একটু। আড়ষ্ট হয়ে এল কথাগুলো।

‘আমি, আমি…মানে, থেমে গিয়ে ঢোক গিলল মায়া। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘বুধবার কোনও কাজ নেই আমার। সন্ধ্যায় ডিনার খেতে পারি আমরা একসাথে। আটটায়। কাউকে কিছু বলতে পারবেন না এ ব্যাপারে। রিপা বে হোটেল। ভিক্টোরিয়া থেকে আধঘণ্টার পথ। আপনার অসুবিধে আছে?’ রানার চোখের দিকে না চেয়ে ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইল মায়া ওয়াং।

‘চমৎকার হবে। অসুবিধে কি? হংকং পৌঁছে আর কাজ নেই আমার। বুধবারের অপেক্ষায় আজ থেকেই আমার দিন কাটতে চাইবে না আর।’ রানা ভাবল আর বেশি ঘাঁটানো ঠিক হবে না। কোনও কিছু ভুল করে বসবার আগেই কেটে পড়তে হবে এখান থেকে। ‘যাক, আর কিছু বলবার আছে?’ আবার কাজের কথায় ফিরে গেল সে।

ঘোরটা কেটে গেল মায়ার। ‘না।’ বলে কি যেন মনে পড়ল ওর। চট করে জিজ্ঞেস করল, ‘কয়টা বাজে এখন?’

একটু আগেই ঘড়ির দিকে চেয়েছিল রানা। তাই নিজের ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে মায়ার সোনার রিস্ট-ওয়াচের দিকে চেয়ে বলল, ‘পৌনে নয়।’

‘ভুলেই গেছিলাম, কাজ আছে আমার।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল মায়া। রানা চলল পেছন পেছন। তালাটা খুলে দরজা খুলবার আগে ঘুরে দাঁড়াল মায়া ওয়াং। চোখের দৃষ্টিতে রানার ওপর বিশ্বাস আর বন্ধুত্বের ভাব। বলল, আপনি পারবেন। শুধু প্লেনে আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকবেন। আর যদি কিছু গোলমাল হয় তাহলে ভয় পাবেন না। এবার যদি ঠিকমত কাজ করতে পারেন, এ ধরনের কাজ আপনাকে আরও জোগাড় করে দেবার চেষ্টা করব। আর,’ একটু হাসল মায়া, ‘আর আমাদের যে আবার দেখা হবে সে-কথাটা গোপন রাখবেন। কোনওভাবে যদি প্রকাশ পায়, তাহলে আর কোনদিনই দেখা হবে না।’

‘কথাটা মনে রাখব। আমার মনের অবস্থা জানলে এতবার করে সাবধান করতেন না।’

কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে দরজা খুলে হাঁ করে দিল মায়া ওয়াং। রানা বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল করিডোরে। ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, অবাক হয়ে দেখল ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করছে মায়া ওকে। মৃদু হাসল রানা। এ হাসিরও কোন প্রত্যুত্তর এল না মায়ার কাছ থেকে। স্থির দৃষ্টিতে রানার চোখে চোখ রেখে ধীরে এবং দৃঢ় হাতে বন্ধ করে দিল সে দরজাটা রানার মুখের ওপর।

লম্বা করিডোর ধরে চলে গেল রানা লিফটের দিকে। চুপচাপ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে রইল মেয়েটি। রানার জুতোর শব্দ মিলিয়ে গেল দূরে। ফিরে এল সে শোবার ঘরে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গুনগুন করে গান ধরল একটা। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই গান থামিয়ে ভাবতে লাগল ওই নিষ্ঠুর চেহারার বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান লোকটার কথা। একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে।

ঠিক যখন ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, বেরিয়ে এল মেয়েটি হোটেল থেকে বাইরে। রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে থাকল দক্ষিণে। নয়টার সময় পৌঁছল সে একটা পাবলিক টেলিফোন বুথে। তিনবার রিং হতেই ওপাশের রিসিভার উঠানোর ক্লিক শব্দ পাওয়া গেল। চুপচাপ শুনতে থাকল সে টেপ রেকর্ডারের খশখশ শব্দ।

পুরো এক মিনিট পর ওপাশ থেকে একটা শব্দ কানে এল।

‘বলো।’

হাতের রুমালটা মুখের ওপর রেখে বলল মেয়েটি, ‘মায়া বলছি। নতুন হেলপার ঠিক আছে। টেনিস খেলে। র‍্যাকেট নেবে সাথে। আই রিপিট। র‍্যাকেট নেবে সাথে। বাকি ব্যবস্থা সব ঠিক। দশটা পাঁচে রিং করব আবার।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে হোটেলে ফিরে এল মায়া ওয়াং। বারবার ওই লোকটার কথা মনে আসছে কেন? বারবার ওর মুখের চেহারাটা ভেসে উঠছে কেন চোখের সামনে?