» » দুঃসাহসিক

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুঃসাহসিক

দুই

‘কাজটা অত্যন্ত বিপজ্জনক সন্দেহ নেই। সবকিছু জানিয়ে আপনাকে আমন্ত্রণ করবার সময় ছিল না। কিন্তু এখনও আপনি ভেবে দেখতে পারেন,’ বলল সাংহাই-চীফ কর্নেল লু সান্।

হোটেলে পৌঁছে লু সানের হাতে রানাকে সমর্পণ করে বিদায় নিয়েছেন অ্যাডমিরাল হো ইন্। স্নানের পর একটা সোফায় এসে বসেছে রানা। পাশের টিপয়ের ওপর ধূমায়িত কফির কাপ তৈরি। সামনাসামনি আরেকটা সোফায় বসে আছে লু সান রানার দিকে উৎসুক নয়নে চেয়ে।

‘কেন মিছেমিছি এইসব কথা তুলে সময় নষ্ট করছেন, মি. লু সান? আমি যে-কোনও অবস্থার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। আপনাদের কোনও কাজে লাগতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। তাছাড়া আপনাদের ক্যালকাটা-চীফ লিউ ফু-চুং আমার বিশেষ বন্ধু—তার কাছে ঋণীও আছি আমি।’

আঙুলের ফাঁকে ধরা মোটা চুরুটটা এক ইঞ্চি পরিমাণ অবশিষ্ট ছিল—সেটাতে শেষ একটা টান দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেলে দিল লু সান অ্যাশট্রেতে। ছ্যাঁৎ করে নিভে গেল আগুনটা। তারপর পকেট থেকে গোটাকয়েক ফটোগ্রাফ বের করে রাখল সামনের টেবিলের ওপর। ঠেলে দিল রানার দিকে।

বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তোলা আজই সকালে দেখা সেই লোকটির ছবি।

‘এই সেই লোক। বাঙালী হিন্দু। যে ওকে চেনে না, কেবল চেহারার বর্ণনা শুনেছে, তার কাছে ওর বদলে আপনাকে অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যাবে। নাম অরুণ দত্ত। দুই পুরুষ থেকে সাংহাইয়ে আছে। ভাল বংশের শিক্ষিত পরিবারের ছেলে। কলেজে উঠেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং নষ্টই রয়ে গেছে। গুণ্ডা বদমাইশের কুসংসর্গে পড়েছিল অল্পবয়সে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবও ওর কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। সৎপথে উপার্জনের শত রাস্তা থাকলেও সে নিত্য-নতুন ঠকবাজি করে বেড়াচ্ছে। এখনও সুযোগ পেলেই চুরি করছে, ট্রেনে ডাকাতি করছে, পকেট মারছে। দুই একবার ধরা পড়েছিল পুলিস এবং ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কাছে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়েছে। গোটাকতক মেয়েকে কৌশলে লাগানো হয়েছিল ওর পেছনে। একজনের সঙ্গে খাতির বেশ ঘন হয়ে উঠেছে ওর ইদানীং। গতকাল হঠাৎ এই ইউরেনিয়াম স্মাগলিং-এর কথা বলে ফেলেছে সে মেয়েটির কাছে। তেমন কোনও গুরুত্ব দেয়নি সে এই কাজের ওপর। আসলে এটা ওর লাইনই নয়।’

‘হ্যাঁ। এক লাইনের কুশলী অন্য লাইনের কাজকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারে না। ওর চুরির কথা হলে কিছুতেই হয়তো বলত না সে কারও কাছে।’

‘মরে গেলেও না। যাক, মেয়েটি খবরটা পাওয়া মাত্রই রীলে করেছে পুলিসের কাছে। কয়েকটা গোপন হাত ঘুরে আমাদের হাতে এসে পৌঁচেছে খবরটা আজই ভোর ছ’টায়।’

এদের কর্মদক্ষতা দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারল না রানা। আজকের মধ্যেই প্ল্যান তৈরি করে দুনিয়াময় তোলপাড় করে ফেলেছে! সেজন্যেই বলে: হুজ্জতে বাঙ্গাল, হেকমতে চীন।

‘ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই রকম,’ আবার আরম্ভ করল লু সান, ‘কোনও এক বন্ধুর বন্ধু ওকে দিয়ে একটা স্মাগলিং-এর কাজ করাতে চায়। সে রাজি হয়ে গেছে। হংকং-এ মাল পৌঁছে দিলেই দশ হাজার হংকং ডলার পাবে সে। তারপর ফিরে এসে খুব মজা করতে পারবে। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল আফিম কিনা। উত্তর এল, না। তাহলে কি সোনা? হেসে বলল, না গো না, গরম জিনিস, ইউরেনিয়াম। মাল হাতে এসে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করায় বলল, না। আগামীকাল আটটায় (অর্থাৎ, আজ রাত আটটায়) হোটেল স্যাভয়ে মায়া ওয়াং নামে একটা মেয়ের সাথে দেখা করবার কথা আছে। সেই মেয়েটিই বলে দেবে কি করতে হবে ওকে।’

রানা চট করে ঘড়িটা দেখে নিল একবার। সাংহাইয়ে নেমেই এখানকার সময়ের সাথে মিলিয়ে নিয়েছিল ঘড়িটা। সোয়া সাতটা বাজে। অর্থাৎ আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই ওকে দেখা করতে হবে সেই মেয়েটির সাথে অরুণ দত্তের ছদ্মবেশে। পাকস্থলীর মধ্যে এক ধরনের বিজাতীয় সুড়সুড়ি অনুভব করল সে। সেই স্মাগলিং, মালবাহক, তার ওপর নজর রাখবার জন্যে আরেকজন, সেই কাস্টম্‌স্ কয়েক বছর আগে পি.সি.আই-এর হয়ে ওকে কিছুদিন এ ধরনের কাজ করতে হয়েছে। সেই হাতের তালু ঘেমে ওঠা। সব মনে পড়ল রানার ছবির মতন।

নতুন আরেকটা চুরুট ধরিয়ে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে লু সান।

‘বুঝলাম,’ বলল রানা। পায়চারি থামিয়ে রানার দিকে ফিরল লু সান। ‘তা আমার কাজটা কি হবে?’

‘প্রথম কাজ, আমাদের বর্ডার ক্রস করবার পর অতি সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করা। কারণ, আমরা জানি না, মাল হাতে পেয়ে ওরা কি করবে। কথামত সত্যি সত্যিই টাকা দেবে, না স্রেফ হাঁকিয়ে দেবে, না মুখ বন্ধ করবার জন্যে সরিয়ে দেবে চিরতরে। কিছুই জানা নেই। তাই আত্মরক্ষার জন্যে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে আপনাকে। যদি টাকা দেয় তাহলে আপনাকে দেখতে হবে কে দিচ্ছে টাকাটা। আবার আপনাকে এই কাজে বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে ওরা রাজি কিনা। যদি আপনাকে ওদের পছন্দ হয় তাহলে ওদের দলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চিনে নিতে আপনার অসুবিধে হবে না। আমাদের জানতে হবে কারা এই কাজটা চালাচ্ছে, কে লীডার, ইত্যাদি সব রকমের তথ্য। অল্পদিনেই ওদের হেডের সঙ্গে দেখা হবে আপনার। কারণ, বড় বড় গ্যাঙে নতুন লোক ভর্তি হলে নেতৃস্থানীয়রা প্রথমেই যাচাই করে নিতে চাইবে ভাল মত।’

‘তা নাহয় হলো। কিন্তু ইউরেনিয়াম নিয়ে যাচ্ছি, ইপেক্টোস্কোপে ধরা পড়ে বেইজ্জত হব না তো আবার?’

‘না। সেদিকে আমরা লক্ষ রাখব।’

‘যাক। বোঝা যাচ্ছে আজকের পরীক্ষায় পাস করলে হংকং-এ প্রথম যার সংস্পর্শে আসব তাকে খুশি করতে পারাটাই আসলে কঠিন হবে। তারপর বাকি কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এখন আগের কথা আগে। প্রথমেই মেয়েটার কাছে ধরা পড়ে যাব না তো?’

‘মনে হয় না।’

‘অরুণ দত্ত সম্পর্কে কিছুই জানে না মেয়েটা?’

‘জানে। নাম আর চেহারার বর্ণনা। আমাদের অনুমান, এর বেশি সে কিছুই জানে না। এমন কি যে লোকটা অরুণ দত্তকে কন্ট্যাক্ট করেছে তাকেও সে চেনে কিনা সন্দেহ। ওদের কাজের ধারাই এই। প্রত্যেকের জন্যে ছোট্ট নির্দিষ্ট কাজ, তার বেশি সে আর কিছুই জানে না। কাজেই, যদি কোনও একজন ধরা পড়ে তাহলে একটা সামান্য লিঙ্ক কাটা পড়ে মাত্র—পুরো চ্যানেল বন্ধ হয় না। কর্তা ব্যক্তিদেরও অসতর্ক মুহূর্তে হাতকড়ার আশঙ্কা থাকে না!

‘মেয়েটির সম্পর্কে কোনও তথ্য বলতে পারবেন?’ হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল রানা।

‘তেমন কিছু নয়। পাসপোর্টে যা পাওয়া গেছে তার বেশি নয়। হংকং-এর ন্যাচারাল সিটিজেন। বয়স পঁচিশ। কালো চুল, কালো চোখ। লম্বা: পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। প্রফেশন: অবিবাহিতা। গত দু’বছরে বার দশেক এসেছে সাংহাইয়ে। অন্য নামে আরও এসে থাকতে পারে। প্রতিবারই হোটেল স্যাভয়ে উঠেছে। হোটেল ডিটেকটিভের কাছে জানা গেছে বিশেষ বাইরে বেরোয় না মহিলা। কদাচিত এক আধজন দর্শনপ্রার্থী আসে ওর ঘরে। আধঘণ্টা থেকেই চলে যায়। সপ্তাহ খানেকের বেশি কোনও বারই থাকে না সে সাংহাইয়ে। হোটেলের শৃঙ্খলা এবং নিয়ম-কানুন কখনও ভঙ্গ করে না—কোনও উৎপাত নেই। ব্যস্। আর কিছুই জানা যায়নি কিন্তু এটা ঠিক যে অত্যন্ত ধুরন্ধর মেয়ে হবে সেটা। ভাল মত বাজিয়ে নেবে আপনাকে। আপনি কেন একাজ করছেন সে-সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য গল্প বানিয়ে বলতে হবে আপনার।’

‘সে দেখা যাবেখন।’

‘আর কিছু জিজ্ঞাসা আছে আপনার?’ বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইল লু সান।

‘না।’

তৈরি হয়ে নিল রানা। ইচ্ছে করেই ওর ওয়ালথারটা নিল না সাথে। হাত ঘড়িতে বাজে পৌনে আটটা। নেমে এল সে নিচে লিফটে করে। অসংখ্য গাড়িঘোড়া চলছে জনাকীর্ণ প্রশস্ত রাস্তায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল সে দৃঢ় পায়ে।