দুঃসাহসিক
চোদ্দ
রাত দশটায় ছাড়ল জাহাজ লম্বা করে সিটি বাজিয়ে।
রিপোর্ট লিখছিল রানা হেড অফিসের জন্যে। এটাকে কোডে পরিণত করে আজই রাতে পাঠিয়ে দেবে জাহাজের ওয়্যারলেসে ঢাকায়। কলম উঁচু করে কান পেতে শুনল রানা জাহাজের বাঁশী। কেঁপে উঠল প্রকাণ্ড জাহাজটা কয়েকবার।
রিপোর্ট শেষ করে টেলিফোন তুলে নিল রানা।
‘কেমন লাগছে, মায়া?’
‘খুব খারাপ! চলার শুরুতেই বমি বমি লাগছে। আরও এগোলে যে কি হবে তা ভেবেই আমি ভয়ে অস্থির।’
প্রথম তিনদিন বমি করে কাটাতেই হবে। তারপর কেটে যাবে এই অবস্থা। এই ক’দিন কেবিনে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকো, আর কিছুই করবার নেই তাছাড়া বাইরে বেরোনো ঠিকও না। যতটা আড়ালে থাকা যায় ততই ভাল। আমাদের পেছনে টং-এর কোনও লোক লেগেছে কিনা কে জানে।
‘তোমার অবস্থা কি রকম?’
‘তোমারই মত।’
‘তাহলে ঠিক আছে। বিছানায় পড়ে থেকেও সান্ত্বনা পাব—তুমি ফুর্তি করে বেড়াতে পারছ না জাহাজময় আমাকে ছাড়া। রোজ টেলিফোন করবে তো?’
‘নিশ্চয়ই।’
খেয়ে নিল রানা। বয় বেরিয়ে যেতেই দরজা লক করে দিল। ভাবল, সাড়ে তিন হাজার যাত্রী নিয়ে একটা ছোটখাট শহর ভেসে চলেছে পানির ওপর দিয়ে। স্বাভাবিক অস্বাভাবিক কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটবে এই কয়দিনের মধ্যে। চুরি হবে, মারামারি হবে, রাগ, হিংসা, মাতলামি, ঠগবাজি, সব হবে। এক আধটা নতুন জন্ম ও হতে পারে, আত্মহত্যা, এমন কি খুনও অসম্ভব নয়।
মুচকি হেসে ভাবল রানা এতগুলো জানোয়ার একসঙ্গে থাকলে কিন্তু এত গোলমাল হত না।
চারদিনের দিন অনেকটা সুস্থ বোধ করল মায়া। টেলিফোনে ঠিক হলো সন্ধের সময় একসাথে লাউঞ্জে বসে ডিনার খাবে ওরা।
কোণের একটা টেবিল বেছে নিল রানা। কথার খৈ ফুটল মায়ার মুখে। অনেকক্ষণ বকর বকর করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল মায়া, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছ, রানা?’
‘আমি কি জানি? তুমিই তো নিয়ে চলেছ আমাকে। তোমার সাথে না গেলে চ্যাঙকে বলে দেবে কেবল সেই ভয়েই না যাচ্ছি আমি!’
‘ঠাট্টা নয়। সত্যি করে বলো তো? এই কয়দিন দিনরাত ভেবেছি আমি। কোনও উত্তর পাইনি। কোথায় চলেছি আমি তোমার সাথে? যে মামা জীবনে দেখেনি আমাকে, কিভাবে গ্রহণ করবে সে আমাকে?’
রানা বুঝল খুব সিরিয়াস হয়ে গেছে মায়া। বলল, ‘আপাতত’রেড লাইটনিং টং-এর খপ্পর থেকে বেরিয়ে দূরে সরে যাচ্ছ তুমি। তারপর তোমার একটা সুব্যবস্থা হয়েই যাবে। নিজের ভেতর থেকেই উত্তর পেয়ে যাবে, মায়া। কারও বলে দিতে হবে না কোথায় যাবে, কি করবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মায়া। রানার একটা হাত তুলে নিল নিজের হাতে। অর্থহীন ভাবে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। সাদা শানটুং সিল্কের শার্ট আর ছাই রঙের স্কার্টে অপূর্ব সুন্দর লাগছে মায়াকে।
‘চিরজীবনের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম তোমার কাছে,’ হঠাৎ বলে ফেলল মায়া। ‘আমি জানতাম না, তোমার মতন মানুষ আছে এই দুনিয়ায়। আমি…’
‘ওরেব্বাপস্!’ আঁৎকে উঠল রানা। বেশি বোলো না, মায়া, পেট ফেটে মরে যাব। আমার আবার প্রশংসা হজম হয় না।’
স্টুয়ার্ড এগিয়ে আসতেই হাতটা ছেড়ে দিল মায়া। ডিনারের কথা বলল রানা। একটা নোট বইয়ে অর্ডার লিখে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে চলে গেল সে অন্য টেবিলে।
অল্পক্ষণেই জমে উঠল গল্প। নিজেদের জীবনের নানান টুকিটাকি কথা। রানার কি একটা কথায় হেসে উঠেই হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল মায়া। যেন ভূত দেখেছে।
‘কি হলো?’ জিজ্ঞেস করল বিস্মিত রানা।
কয়েক সেকেণ্ড কোনও কথাই বলতে পারল না মায়া। তারপর রানার পিছনে দেয়ালের ও-পাশটা আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘ওই, ওইখানে দাঁড়িয়ে ছিল লোবো! আমি চাইতেই সরে গেল!’
‘কি যা-তা বলছ?’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল রানা। একহাত ধরে টেনে রাখল ওকে মায়া। একা বসে থাকবার কথা ভাবতেও পারে না সে।
‘ভয় লাগছে। আমাকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছ?’
রানা বুঝল দেরি হয়ে গেছে। যদি ঘটনাটা সত্যিও হয়, ওখানে আর কাউকে পাওয়া যাবে না। বসে পড়ল সে আবার। বলল, ‘চোখের ভুল হয়েছে তোমার।’
‘অসম্ভব! কিছু একটা দেখেছি নিশ্চয়ই। লোবোর প্রেতাত্মা নয়তো?’
হেসে ফেলল রানা। ডিনার এসে গেছে। চুপচাপ খেয়ে নিল ওরা। রানা লক্ষ্য করল মন থেকে লোবোর প্রেতাত্মার ভয় তাড়াতে পারছে না মায়া কিছুতেই। ভাল করে খেতেও পারল না সে। বেশির ভাগই পড়ে থাকল ডিশে, প্লেটে। কেমন যেন ঠাণ্ডা, নির্জীব হয়ে গেছে মায়া ভয়ে।
‘খুব ভয় পেয়েছ, মায়া?’ মায়ার কাঁধে হাত রাখল রানা।
কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না মায়া। তারপর বলল, ‘আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো, রানা। এখানে ভাল লাগছে না।’
আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল হলঘর থেকে। অবজারভেশন লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে কফি খেলো ওরা। রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল সাগরের দীর্ঘনিঃশ্বাস। তারপর মায়ার কেবিনে ওকে পৌঁছে দিয়ে রাত দশটার মধ্যেই ফোন করবে কথা দিয়ে নিজের কেবিনে চলে এল রানা।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছে রানা। সত্যিই তো, ঢাকার এক চাইনিজ রেস্তোরার মালিক মায়ার মামা যদি মায়াকে নিতে অস্বীকার করে? তাহলে? মেয়েটাকে ঢাকায় টেনে নিয়ে যাওয়া ভুল হচ্ছে না তো? নাহ। দস্যু চ্যাঙের গুপ্তধন এখন মায়ার। কোটি কোটি টাকা। ভালই কাটবে ওর জীবন।
বেজে উঠল টেলিফোন। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিল রানা! ‘কি ব্যাপার, মায়া?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি ওয়্যারলেস অপারেটার বলছি, স্যার,’ মোটা পুরুষ কণ্ঠ।
‘বলুন, কি ব্যাপার?’ এক সেকেণ্ডে সামলে নিল রানা নিজেকে।
‘আপনার নামে একটা সাইফার সিগন্যাল এসেছে, স্যার। মোস্ট ইমিডিয়েট। পড়ে শোনাব না পাঠিয়ে দেব, স্যার?’
সাইফার সিগন্যাল আবার কোত্থেকে এল? একটু থেমে রানা বলল, ‘পাঠিয়ে দিন। আমি ঘরেই আছি। ধন্যবাদ।’
জ্বালাতন! কিন্তু এই অসময়ে সাইফার সিগন্যাল কেন? কার কাছ থেকে? মনের ভেতর কেন জানি একটা অ্যালার্ম বেল বেজে উঠল রানার। মনে হলো নিশ্চয়ই দুঃসংবাদ।
দরজায় টোকা পড়তেই উঠে গিয়ে কেবলটা নিয়ে এসে বসল রাইটিং টেবিলের সামনে। চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের মেসেজ। ক্যান্টন থেকে এসেছে। ডি-সাইফার করলে দাঁড়ায়:
আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে মিস্টার লোবো এবং ল্যাংফু একই জাহাজে আপনাদের সহযাত্রী। তাদের কাছে আপনাদের দু’জনেরই লাইফ ইনশিওর করিয়ে নেবেন। তিন ঘণ্টার মধ্যে আমরা বাকি ব্যবস্থা করিছ। সি. এস. এস.
কয়েক মুহূর্ত পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইল রানা। তাহলে সত্যি সত্যিই লোবোকে দেখেছিল মায়া। ল্যাংফু-ও আছে সাথে। তিন ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চয়ই চাইনিজ হেলিকপ্টার আসছে। জোর করে ল্যাণ্ড করবে জাহাজের ওপর। দ্রুত রিসিভার তুলে নিল রানা। এক্ষুণি মায়াকে সাবধান করা দরকার।
‘মিস্ মায়া ওয়াং-কে দিন,’ টেলিফোন অপারেটারকে আদেশ দিল রানা। রিংগুলো শুনতে পাচ্ছে সে। একবার বাজল। দু’বার, তিনবার, চারবার। খটাং করে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল রানা কেবিন থেকে বিশটা কামরার পরেই মায়ার কেবিন। কেউ নেই ঘরে। খাঁ-খাঁ করছে শূন্য ঘর। বিছানার চাদরে ভাঁজ পড়েনি একটাও। আলো জ্বলছে। একমাত্র ব্যতিক্রম চোখে পড়ল রানার-একটা চেয়ার উল্টানো। ঘরের মধ্যে কেউ লুকিয়ে ছিল আগে থেকেই। ধস্তাধস্তি হয়েছে। তারপর?
পোর্টহোলের দিকে চোখ গেল রানার। বন্ধ। তারপর বাথরুমটাও ঘুরে এল। না, কেউ নেই।
মাথাটা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল রানা। লোবো বা ল্যাংফু-র অবস্থায় রানা হলে কি করত? খুন করবার আগে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর বের করবার চেষ্টা করত। গুপ্তধনের সন্ধান জানবার জন্যে নির্যাতন করত। ওকে নিয়ে যেত নিজের কেবিনে, উত্তর বের করবার সময় যেন কোনও ব্যাঘাত না হয়।
নিশ্চয়ই মায়াকে ওরা নিজেদের ঘরে নিয়ে গেছে। পথে কেউ দেখে ফেললে চোখ টিপে মাথা নেড়ে বলেছে, ‘মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছে শ্যাম্পেনের। না, না, ধন্যবাদ, আমি একাই পারব।’ কিন্তু কার ঘরে নিয়ে গেছে। ল্যাংফু না লোবো? কতক্ষণ আগে?
দৌড়ে নিজের কামরায় ফিরে এল রানা। দশটা বাজে।
অ্যালার্ম বাজাবে নাকি সে? ক্যাপ্টেনকে জানাবে? তাহলে একগাদা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, দেরি হবে। জাহাজের সার্জেন্ট এই অসম্ভব কথা শুনে প্রথমেই ওকে মাতাল ঠাওরাবে, ঈর্ষাকাতর প্রেমিকও ভাবতে পারে। ওকে ঠাণ্ডা করবার জন্যে বলবে, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আপনি যা বলছেন তা যদিও খুবই অসম্ভব মনে হচ্ছে— আমাদের যতদূর সাধ্য আমরা নিশ্চয়ই করব। আপনি নিজের কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম করুন গিয়ে, আমরা দেখছি।’
কেবিনের দরজা বন্ধ করেই ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে প্যাসেঞ্জারস্ লিস্ট বের করল রানা। এই তো। মিস্টার ল্যাংফু আর মিস্টার ডাব্লিউ. সি. লোবো! ছি ছি, আগে কেন দেখেনি সে লিস্টটা?
বি-৬৩-নিচের ডেকের ফার্স্ট-ক্লাস কেবিন। একই কেবিনে দু’জন। লোবো আর ল্যাংফু! দুই বন্ধু।
যন্ত্রচালিতের মত সুটকেস খুলে চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের দেয়া ল্যুগার পিস্তলটা বের করল রানা। সাইলেন্সার পাইপটা লাগিয়ে নিল পেঁচিয়ে। টিকিটের সঙ্গে পাওয়া জাহাজের নক্সাটা মেলে ধরল টেবিলের ওপর। সেই সাথে তার মাথার মধ্যে একশো মাইল স্পীডে চলল চিন্তা। এই তো বি-৬৩! আশ্চর্য! ঠিক ওর নিচের ঘরটাই।
গুলি করে তালা ভাঙবে? তারপর দু’জনকে গুলি করবে? নাহ্। তার আগেই শেষ হয়ে যাবে সে নিজে। তাছাড়া ওরা তালা তো লাগিয়েছেই বল্টুও নিশ্চয়ই লাগিয়ে দিয়েছে দরজার।
কয়েকজন লোককে ডেকে জড়ো করবে নাকি রানা?
কিন্তু তাতেও লাভ হবে না কিছুই। দরজায় ধাক্কা পড়লেই পোর্টহোল দিয়ে সাগরে ফেলে দেবে ওরা মায়াকে। তারপর বিরক্ত মুখে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করবে, ‘কি ব্যাপার? এত হইচই কিসের?’
কোমরে গুঁজে নিল রানা পিস্তলটা। তারপর খুলে ফেলল পোর্টহোলের ঢাকনা। কাঁধটা ঢুকিয়ে দেখল আরও ইঞ্চি দুয়েক জায়গা খালি থাকে। নিচের দিকে চেয়ে দেখল। ফুট দশেক নিচে একটা আবছা আলোর বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। বি-৬৩-র পোর্টহোল। ধরা পড়ে যাবে নাকি রানা ব্রিজের ‘ডেকা রাডার’-এ?
বিছানার পাশে ফিরে এসে একটানে চাদর তুলে নিল রানা। দুই টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল সেটা। দুই মাথা গিঁট দিয়ে নিল শক্ত করে। পেঁচিয়ে দড়ি পাকিয়ে নিল সেটাকে। যদি ঢুকতে পারে, বি-৬৩ থেকে একটা চাদর নিয়ে ফিরবে। আর যদি হেরে যায় তবে তো কোনও কথাই নেই। জুতো জোড়া খুলে ফেলল রানা পা থেকে।
সর্বশক্তি দিয়ে টেনে দেখল একবার চাদরটা। না, ছিঁড়বে না। পোর্টহোলের আঙটার সাথে চাদরের একমাথা বাঁধতে বাঁধতে ঘড়ির দিকে চাইল রানা।
দশটা পাঁচ। বেশি দেরি হয়ে গেল না তো? দড়িটা ঝুলিয়ে দিল সে পোর্টহোলের বাইরে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল গর্তের মধ্যে। ধীরে ধীরে বাকি দেহটা এবং সবশেষে পা দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল ওর গর্তের বাইরে।
নিচের দিকে চেয়ো না। চিন্তা কোরো না। আদেশ দিল রানা নিজের মনকে। কিন্তু মন কি তাই শোনে? বহু নিচে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের জলকল্লোল। ছলাৎ ছলাৎ হিস্ হিস্। মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে রানার দেহটা, ধাক্কা খাচ্ছে জাহাজের গায়ে। ধীরে ধীরে নামছে সে সাবধানে।
রশিটা ওর ভার সহ্য করতে পারবে তো? সন্দেহ জাগে। ভেবো না, এসব কথা এখন ভাববার কি দরকার? ক্ষুধার্ত সমুদ্র অপেক্ষা করে আছে নিচে। থাক না। চোখা স্ক্রুগুলো দেহটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দেবে হাত ফস্কালে। হাত ফস্কাবে কেন? তুমি একটা কিশোর। পেয়ারা গাছে উঠেছ। পড়ে গেলে আর কি হবে? পাঁচ হাত নিচেই আছে নরম মাটি আর ঘাস। কতবারই তো পড়েছ, কি হয়েছে? কিছুই না।
চিন্তাটা দূর করে দিল রানা। বাইসেপের পেশী দুটো থরথর করে কাঁপছে। আর বেশিক্ষণ এভাবে ঝুলে থাকা সম্ভব নয়।
বাম পা-টা ঠেকল কিসের সঙ্গে। হ্যাঁ। পোর্টহোলের বাইরের রিম। ধীরে ধীরে নেমে এল রানা আরও নিচে। পর্দা ঝুলছে পোর্টহোলের মুখে। রিমের ওপর ভর দিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল রানা। নিচে গর্জন করছে চীন সাগর। প্রকাণ্ড জাহাজের গা পিঁপড়ের মত চিমটি কেটে ধরে ঝুলছে যেন সে। পর্দার ওপাশে মায়ার কি অবস্থা কে জানে।
পুরুষ কণ্ঠে কেউ কিছু বলল ঘরের মধ্যে। বোঝা গেল না।
‘কিছুতেই বলব না!’ তীক্ষ্ণ নারী কণ্ঠ।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপরই চটাস্ করে চপেটাঘাড়ের জোর আওয়াজ। ঠিক পিস্তলের আওয়াজের মত। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল রানা ভেতরে মাথা নিচের দিকে করে। কিসের ওপরে গিয়ে পড়বে কে জানে? বাম হাতে মাথাটা আড়াল করল সে আর ডান হাতে টেনে বের করল পিস্তলটা শূন্যে থাকতেই।
পোর্টহোলের নিচে রাখা একটা সুটকেসের ওপর পড়েই ডিগবাজি খেয়ে ঘরের মাঝ বরাবর উঠে দাঁড়াল রানা। ডান হাতের তর্জনীটা ট্রিগারের ওপর চেপে থাকায় নখটা সাদা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা দুই চোখ দু’জনের দিকে চাইল একবার করে। পিস্তলটা দু’জনের ঠিক মাঝখানটায় তাক করে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। বুঝল অবস্থাটা এখন ওর আয়ত্তাধীন, এবং এটাকে আয়ত্তেই রাখতে হবে।
‘খবরদার!’ সাবধান করল রানা ওদের।
তোমাকে কে ডেকেছে? তুমি তো এই সীনে ছিলে না? বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল ল্যাংফু। কোনও রকম আতঙ্কের আভাস পাওয়া গেল না ওর কণ্ঠে।
মাটিতে পা রেখে বিছানার ধারে বসে আছে লোবো। তার সামনে রানার দিকে পেছন ফিরে একটা টুলের ওপর বসে রয়েছে মায়া। তার এক হাঁটু চেপে ধরে আছে লোবো মোটা দুই উরুর মধ্যে। ঘাড় ফিরিয়ে চাইল মায়া রানার দিকে। দুই চোখে অবিশ্বাস। হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। রানা দেখল পাঁচ আঙুলের দাগ লাল হয়ে আছে মায়ার বাম গালে।
একটা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম করছিল ল্যাংফু। কনুইয়ের ওপর গাল রেখে উঁচু হলো সে, আরেকটা হাত আলগোছে চলে গিয়েছে শার্টের ভেতর শোল্ডার হোলস্টারে ভরা পিস্তলের বাঁটের কাছে। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে রানার দিকে চাইল সে।
রানার পিস্তলটা দু’জনের ঠিক মাঝখানটায় ধরা। শান্ত নিচু গলায় রানা বলল, ‘মায়া। বসে পড়ো মেঝের ওপর। হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মাঝখানটায় সরে এসো। মাথাটা নিচু করে রেখো।’
তার কথামত কাজ করছে কিনা ফিরে দেখল না সে একবারও। লোবো আর ল্যাংফুর ওপর ছুটোছুটি করতে থাকল ওর সতর্ক দৃষ্টি।
সরে গেছে মায়া।
‘এসেছি, রানা!’ বলল সে। ওর কণ্ঠে আশা আর উত্তেজনার আভাস।
‘এবার সোজা চলে যাও বাথরূমের মধ্যে। দরজা বন্ধ করে শাওয়ার খুলে দাও। যাও, জলদি!’
ক্লিক করে বাথরূমের দরজা বন্ধ হতেই নিশ্চিন্ত হলো রানা। বুলেট থেকে নিরাপদ তো থাকলই, দেখতেও হবে না ওকে এই আসন্ন লড়াই।
লোবো আর ল্যাংফু একে অপরের থেকে গজ দুয়েক দূরে আছে। যদি খুব দ্রুত একসাথে পিস্তল বের করতে পারে তাহলে যে-কোনও একজনের গুলিতে ওকে মৃত্যু বরণ করতে হবে। দু’জনকে একসাথে এত দ্রুত শেষ করতে পারবে না রানা। একজনের ওপর গুলি করলেই আরেকজনের গুলি খেতে হবে তাকে। কিন্তু যতক্ষণ তার হাতের পিস্তলটা নীরব থাকছে ততক্ষণ এর ক্ষমতা অসীম।
হঠাৎ চীনা ভাষায় কি যেন বলে উঠল লোবো। অনেক রিহার্সেল দেয়া কোনও সঙ্কেত হবে। কথাটা বলেই মেঝের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। আর সেই সঙ্গে ডান হাতটা চলে গেল ওয়েস্ট-ব্যাণ্ডের কাছে।
বিছানার ওপর দ্রুত এক গড়ান দিয়ে সরে গেল ল্যাংফু যাতে মাথাটা ছাড়া রানা আর কোনও টার্গেট না পায়। এক ঝটকায় বেরিয়ে এল শার্টের তলা থেকে ওর পিস্তল ধরা হাতটা।
‘দুপ!’
রানার পিস্তল মৃত্যু বর্ষণ করল। চাঁদিতে একটা ছোট্ট ফুটো তৈরি হলো ল্যাংফু-র।
‘বুম’ করে উত্তর দিল নিহত ল্যাংফু-র পিস্তল। বালিশের মধ্যে প্রবেশ করল তপ্ত সীসা।
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল লোবো। মৃত্যু ভয়ে বিকৃত হয়ে গেছে ওর গলা। ভীত দুই চোখ মেলে দেখছে ও রানার পিস্তলটা লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। ওর রিভলভারটা এখনও রানার হাঁটুর নিচে ধরা। ওপরে ওঠাবার আর সুযোগ হবে না।
‘ফেলে দাও ওটা।’
পড়ে গেল রিভলভারটা কার্পেটের ওপর।
‘উঠে দাঁড়াও।’
হাঁসফাঁস করে উঠে দাঁড়াল মোটা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে রানার চোখে চোখে চেয়ে রয়েছে সে, ঠিক যেমন যক্ষ্মা রোগী তাকায় তার রক্তাক্ত রুমালের দিকে।
‘এদিকে সরে এসে উবু হয়ে বসো মেঝের ওপর।’
ভীত চোখ দুটোতে কি একটু স্বস্তির আভাস ফুটে উঠল? সতর্ক থাকল রানা। খুব সাবধান থাকতে হবে।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল লোবো। রানা না বললেও মাথার ওপর হাত তুলে রাখল সে। দুই পা পিছিয়ে ফাঁকা জায়গায় এল সে। ঘুরে দাঁড়াল রানার দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই হাত দুটো নামিয়ে আনল। স্বাভাবিক ভাবেই একটু দুলল হাত দুটো। বাম হাতের চাইতে ডান হাতটা একটু বেশি দুলল না? পর মুহূর্তেই ঝিক করে উঠল একটা থ্রোয়িং নাইফ।
‘দুপ্!’
চট্ করে একপাশে সরে গিয়েই গুলি করেছে রানা।
ডান চোখটা অদৃশ্য হয়ে গেল লোবোর। কালো বিকট একটা গর্ত সে জায়গায়। বাম চোখটা কপালে উঠল। প্রকাণ্ড ধড়টা আধপাক ঘুরে দড়াম করে পড়ল ড্রেসিং টেবিলের ওপর, সেটার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে পড়ল মাটিতে।
সেদিকে চেয়ে দেখল রানা একবার। তারপর দাঁড়াল গিয়ে পোর্টহোলের সামনে। পর্দাটা সরিয়ে ঠাণ্ডা মুক্ত বাতাস গ্রহণ করল সে বুক ভরে। ওরা দু’জন আর কোনদিন এই বাতাসে শ্বাস নেবে না। তারা জ্বলা অপরূপ রাত্রিকে দেখল রানা দু’চোখ ভরে। ওরা কোনদিন দেখবে না। কান পেতে শুনল সে সমুদ্রের মিষ্টি কল্লোলধ্বনি। ওরা কোনদিন শুনবে না।
অথচ কত সুন্দর এই পৃথিবী!
ধীরে ধীরে দেহের উত্তেজিত স্নায়ুগুলো শান্ত স্বাভাবিক হয়ে এল রানার। সেফটি ক্যাচ তুলে দিয়ে কোমরে গুঁজল সে পিস্তলটা।
লোবোর বিছানার চাদরটা তুলে নিল একটানে। তারপর এসে দাঁড়াল বাথরূমের সামনে। কয়েকবার ডাকতেও কোনও সাড়া দিল না মায়া। দরজাটা ঠেলা দিয়ে খুলে দেখল রানা শাওয়ার খুলে দিয়ে দুই হাতে কান ঢেকে তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে মায়া ওয়াং চোখ বন্ধ করে।
শাওয়ার বন্ধ করে দিল রানা। কিন্তু তাও চোখ খুলল না মায়া। হয়তো মনে করল ট্যাঙ্কের পানি শেষ হয়ে গেছে। সমস্ত কাপড়চোপড় চুপচুপে ভেজা। কানে হাত দিয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে সে। হেসে ফেলল রানা। কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফেরাল সে মায়াকে। ‘উহ্’ করে এক চিৎকার দিয়ে ভয়ার্ত দুই চোখ মেলে চাইল মায়া। প্রথমে চিনতেই পারল না রানাকে। তারপর চিনতে পারল, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারল না। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল সে একবার। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকের ওপর।
‘মায়া! এখানে দেরি করলে অসুবিধে হবে। এ ঘর ছেড়ে তাড়াতাড়ি পালাতে হবে আমাদের। কিন্তু সর্বাঙ্গ যেভাবে ভিজিয়েছ তাতে তো তোমাকে নিয়ে—আচ্ছা, দাঁড়াও আমি চট করে বাইরেটা দেখে আসছি।’
‘ওদের কি হলো? ওরা কোথায়?’
‘ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। সব চুকে গেছে। আর কোনও ভয় নেই। দরজাটা খুলে মাথা বের করে এপাশ-ওপাশ দেখল রানা। কেউ নেই করিডরে। ঘড়িতে বাজছে সোয়া দশটা। মায়াকে নিয়ে এখন বেরোলে লোকের চোখে পড়বার সম্ভাবনা বিচার করে দেখল সে মনে মনে। স্থির করল রিস্কটা নিতে হবে।
ফিরে এসে দেখল জামা কাপড় নিঙড়ে যতটা সম্ভব পানি ঝরিয়ে ফেলেছে মায়া। টেবিলের ওপর থেকে একটা হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে বাথরূমে ঢুকল রানা। চাদরটা হালকা করে জড়িয়ে দিল মায়ার ভেজা কাপড়ের ওপর।
‘চোখ বন্ধ করে রাখো। বাইরে না বেরোনো পর্যন্ত চেয়ো না কোন দিকে।’
মায়াকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে এল রানা বাইরে। একহাতে খোলা মদের বোতল। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল সে। ক্লিক করে ছেদ পড়ল অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে।
মাতালের অভিনয় করবার কোনও প্রয়োজনই হলো না। জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখা গেল না সারাটা পথে। মায়ার কেবিনের সামনে এসে ছেড়ে দিল ওকে রানা।
‘ভয় করছে!’ কেবিনে ঢুকতে দ্বিধা করছে মায়া।
‘স্বাভাবিক। তবে সত্যিই আর কোন ভয় নেই। এখানে একা তোমাকে থাকতেও হবে না। ভেজা কাপড় বদলে বেরিয়ে এসো, আমি দাঁড়াচ্ছি।’
কাপড় বদলে বেরিয়ে এল মায়া। ইতিমধ্যে হুইস্কির বোতলটা ছুঁড়ে দিয়েছে রানা রেলিঙের ওপারের অন্ধকারে।
‘এবার?’
‘চলো, দু’কাপ কফি খাই আগে। তারপর সুটকেস গুছিয়ে নিতে হবে। দু’ঘণ্টার মধ্যে এ জাহাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা।’
‘কি ভাবে?’
‘কফি খেতে খেতে বলব, চলো।
সমাপ্তি
…