দুঃসাহসিক
তের
এর পরের ঘটনাগুলো রুটিন মাফিক। জীপ থেকে লাফিয়ে নামল চারজন সামরিক পোশাক পরিহিত চীনা অফিসার। রানার সম্পর্কে আলাপ করল মায়ার সাথে অত্যন্ত ভদ্রভাবে। পুলের উপর টর্চ জ্বেলে দেখল ট্রাকটার ভস্মাবশেষ। একজন ডাইভারশনের নোটিশটা ঠিক জায়গা মত বেঁধে দিল আবার। সযত্নে তোলা হলো জীপে রানার জ্ঞানহীন দেহ। মায়া উঠে বসল পাশে। তারপর হাসপাতাল। সর্বাঙ্গে ডেটল, সার্জিক্যাল টেপ, ইনজেকশন। সেখান থেকে সোজা নিয়ে যাওয়া হলো ওদেরকে ম্যাকাও হেলি-পোর্টে। ফু-চুং-কে আগেই নিয়ে আসা হয়েছে সেখানে।
ওয়্যারলেসে হংকং, সাংহাই আর বেইজিং-এর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। বিশেষ নির্দেশ এসেছে অ্যাডমিরাল হো ইনের কাছ থেকে। হংকং এ চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসের একটা গোপন আস্তানায় নিয়ে আসা হয়েছে ওদের লুকিয়ে।
ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল রানার!
ওকে নড়ে চড়ে উঠতে দেখেই বিছানার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মায়া। কয়েকজন অফিসার দাঁড়িয়ে রয়েছে বিছানার পাশে। চোখ খুলে ওদের দিকে চাইল রানা। স্যালিউট করল ওরা রানাকে। ওদের কাঁধের কাছে জামার উপরের সামরিক চিহ্নগুলো দেখল রানা। মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে। দুই দিন দুই রাত অক্লান্ত সেবা করল মায়া দুঃসাহসী স্পাইটিকে সারিয়ে তোলার জন্যে।
বাম হাতটা বুকের কাছে, গলায় ঝোলানো একটা গোল ফিতের ওপর আলগাভাবে রাখা—তাছাড়া হাবে ভাবে আর কোনও পরিবর্তন নেই—আকর্ণ হাসি, দুষ্টামি ভরা দুই চোখ, আর ডান হাতে একটা চামড়ার ভারি ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল শ্রীমান ফু-চুং, কোন রকম সতর্ক হবার সুযোগ না দিয়েই।
আপন মনে রানার চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছিল মায়া ওয়াং—চট করে সরে দাঁড়াল।
‘কিরে, শালা? ব্যাগে কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা সোফার ওপর নড়ে বসে। ‘তোর বিয়ের যৌতুক।’ বলেই টেবিলের ওপর ব্যাগটা সযত্নে নামিয়ে রেখে একটা সোফা অধিকার করল সে। ‘এক কাপ কফি খাওয়াবে, মায়া দি?’
সুন্দর বিকেল। কাঁচের জানালা দিয়ে দূর সমুদ্রে ছবির মত দেখা যাচ্ছে একটা নোঙর ফেলা জাহাজ। মাথায় ফেনা নিয়ে ভেঙে পড়ছে ঢেউগুলো তীরে এসে। কয়েকটা সী-গাল উড়ছে ঘুরে ঘুরে। মায়া চলে গেল ঘর ছেড়ে। পকেট থেকে একটা খাম বের করে দিল ফু-চুং।
ইংরেজিতে টাইপ করা একটা চিঠি। ওপরে গণ চীনের সরকারী সীলমোহর। রানা পড়ল চিঠিটা :
জনাব মাসুদ রানা,
আপনার দ্বারা গণচীন সবিশেষ উপকৃত হয়েছে।
আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতা আমাদের মুগ্ধ,
বিস্মিত ও চমৎকৃত করেছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের দু’দেশের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হোক।
অ্যাডমিরাল হো ইন।
পুনশ্চ: আপনার জন্য একটি ক্ষুদ্র উপহার পাঠালাম।
জিনিসটির নাম ম্যাজিক ফরটিফোর।
বিস্মিত দৃষ্টি মেলে একবার ব্যাগটার দিকে চাইল রানা। এরই মধ্যে আছে রাহাত খানের এতদিনকার স্বপ্ন, সেই ম্যাজিক ফরটিফোর। এটা নিয়ে গিয়ে যখন বুড়োর হাতে তুলে দেবে, তখন তাঁর চেহারাটা কেমন হবে কল্পনা করবার চেষ্টা করল সে একবার।
ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফু-চুং-এর চোখে দুষ্টামির ঝিলিক।
‘এক ঢিলে দুটো মূল্যবান পাখি মেরে নিয়ে যাচ্ছিস, দোস্ত, এই কিস্তিতে হিংসে হচ্ছে আমার।’
‘একটা তুই রেখে দে না,’ বলল রানা।
‘দিদি ডেকে ফেলেছি যে!’
হাসল রানা। ‘নারে, তুই যা ভাবছিস, সে-সব কিচ্ছু না। ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি আমি ওকে ওর মামার কাছে পৌঁছে দেব বলে। এখানে ওর কেউ নেই।’
‘তাই বুঝি? বেশ তো। এখন মায়া কফি নিয়ে আসবার আগেই কয়েকটা জরুরী কথা সেরে নিতে হবে আমাদের। তোর ইচ্ছেমত আমরা তোদের দু’জনের জন্যে দুটো কেবিন বুক করেছি জাহাজে। ঢাকায় তোদের চীফকেও জানানো হয়েছে যে তুই জাহাজে ফিরছিস দেশে। তাঁরও কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি তোর এই জাহাজে যাওয়াটা মোটেই সমর্থন করতে পারছি না, দোস্ত। জাহাজ একদম নিরাপদ নয়। তোকে এত গোপনে এত সতর্কতার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার মধ্যে রাখা হয়েছে কেন জানিস?’
‘না তো!’
তোদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজছে ওরা। ওদের পাঁচ হাজার মেম্বারের প্রত্যেকের কাছে তোদের দু’জনের ফটো দেয়া হয়েছে। জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারলে এক লক্ষ হংকং ডলার পুরস্কার। সহজে ছেড়ে দেবে না ওরা। প্রচণ্ড ক্ষমতা ওদের। আশ্চর্য কৌশলে ল্যাংফু-কে মুক্ত করে নিয়ে গেছে ওরা হংকং পুলিসের হাত থেকে। অথচ তিনটে খুনের জেল পালানো আসামী সে। ওদের ক্ষমতাটা বুঝতেই পারছিস। আমরা সাধ্যমত গোপনীয়তার সঙ্গে জাহাজে তুলে দেব তোকে ঠিকই, কিন্তু তারপর যদি কোন বিপদ হয়, তখন?’
‘বাদ দে ওসব দুশ্চিন্তা। আমাদের কি অত চিন্তা করলে চলে? তোর-আমার কারবারই তো বিপদ নিয়ে।’
চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবল ফু-চুং। তারপর বলল, ‘ঠিক হ্যায়। তাহলে আজই সন্ধ্যার পর জাহাজে উঠতে হবে তোদের। তৈরি থাকিস। আর জাহাজে কোনও রকম অসুবিধে দেখলে ওয়্যারলেসে জানাবি আমাদের বিনা দ্বিধায়।
কফির কাপ শেষ করে বিদায় নিল ফু-চুং। আজই সে ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল রানা। হঠাৎ এক হাতে জড়িয়ে ধরল ফু-চুং রানাকে। রানাও ধরল ওকে জড়িয়ে। দুই নির্ভীক বন্ধু একে অপরের প্রাণস্পন্দন অনুভব করল অন্তরঙ্গ ভাবে।
‘আবার দেখা হবে,’ বলে বেরিয়ে গেল ফু-চুং। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িতে উঠে কয়েক সেকেণ্ডেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে যান-বাহনের ভিড়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে এল রানা ওর কামরায়।
সন্ধ্যার পর দু’জনকে যথেষ্ট গোপনীয়তার সঙ্গে গ্যাঙওয়ের সিঁড়ি দিয়ে তুলে দেয়া হলো জাহাজে। মায়াকে ওর কেবিনে পৌঁছে দিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল রানা। ‘এন’ ডেকে ওদের কেবিন।
কিন্তু কেউ লক্ষ করল না, গ্যাঙওয়ের মুখে রানা ও মায়াকে দেখে একজন খালাসী দ্রুত নেমে গিয়ে একটা পাবলিক টেলিফোন বুদে ঢুকল।
ঠিক তিন ঘণ্টা পর দু’জন চীনা ব্যবসায়ীকে নামিয়ে দেয়া হলো ডকইয়ার্ডে একখানা কালো গাড়ি থেকে। কাস্টমস্ এবং ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে ঠিক সময় মত উঠে পড়ল ওরা জাহাজে। আর একটু দেরি হলেই ছেড়ে দিত জাহাজ।
একজন ব্যবসায়ীর চেহারা জুজুৎসু ব্ল্যাক বেল্টের মত। উঁচু হয়ে ফুলে আছে বুকের পেশী। পায়ে হকি কেড্স্। ব্রিফ কেসের ওপর নাম লেখা: মিস্টার ল্যাংফু।
দ্বিতীয়জন অসম্ভব মোটা। প্রকাণ্ড পেট হাতখানেক বেরিয়ে আছে সামনের দিকে। দরদর অবিরল ধারায় ঘামছে সে, আর তোয়ালের মত একটা রুমাল দিয়ে ঘাড়, মুখ মুছছে। তার অ্যাটাচি কেসের ওপর লেখা: মিস্টার ডব্লিউ. সি. লোবো।