» » দুঃসাহসিক

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুঃসাহসিক

দশ

পরদিন ঠিক রাত আটটায় কাপড় পরে নেমে এল রানা সপ্তম তলায়।

সকালে স্যার উইন্‌সটন চার্চিলের চাচা লর্ড জন স্পেন্সার চার্চিলের কবর আর সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল দেখার ছুতোয় বেরিয়ে পুরো শহরটা ভালমত দেখে এসেছে রানা। সাথে অবশ্য ছায়ার মত অনুসরণ করেছে চ্যাঙের লোক, কেয়ার করেনি সে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে ঝাড়া তিনঘণ্টা। বিকেলে ব্যালকনিতে বসে বসে দেখেছে সারি সারি সাম্পানের পেছনে অপূর্ব এক রক্তিম সূর্যাস্ত। সী-গালগুলো চলে গেছে ওদের আস্তানায়। কালো হয়ে এসেছে বিকেলের প্রসন্ন মুখ। কেন জানি অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে রানার। বিরাট বিশ্বজগতের তুলনায় সে যে কত ক্ষুদ্র, উপলব্ধি করেছে সে বিমর্ষ চিত্তে।

নিচে নেমেই ডিনার অর্ডার দিল রানা। গ্রিলড্ ম্যাকাও পিজিয়ন আর নারকেল তেলে ভাজা অফ্রিকান চিকেনের ঝাল পর্তুগীজ ডিশ। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখল বারের পাশে ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলটা খালি। সারাটা ফ্লোরেই একটা খালি খালি ভাব। জমে উঠবে সাড়ে আটটার পর। প্রকাণ্ড হোটেল সিসিল সরগরম হয়ে উঠবে তখন নানান জাতের মানুষের নানান রকম উন্মত্ততায়।

রানা লক্ষ্য করেছে হোটেলে ঢুকবার বা বেরোবার একমাত্র পথ হচ্ছে জুয়া খেলার হলঘরের মধ্যে দিয়ে। এই একমাত্র পথে ওপর নিচে ওঠানামা করতে হলে অতিবড় সংযমী পুরুষের পক্ষেও জুয়া খেলার লোভ থেকে আত্মসংবরণ করা শক্ত হয়ে পড়বে। খেলা মানেই হারা।

আর আছে সশস্ত্র রক্ষী। শক্ত সমর্থ চেহারার চৌকস লোক—কোমরে রিভলভার আর গুলিভর্তি বেল্ট। নির্বিকার ভঙ্গিতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর। ক্লান্তি আর একঘেয়েমির ছাপ প্রত্যেকটি জুয়াড়ীর চোখে মুখে, বসবার ভঙ্গিতে। বেশির ভাগই স্ত্রীলোক।

চমৎকার ডিনার শেষে চমৎকার পুডিং, তারপর এল কফি। ডিনারের ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন করে জেনে নিল রানা চ্যাঙ নেই হোটেলে। ডিনার শেষ করে ঘড়ির দিকে চাইল সে—আটটা বেজে বিশ। একটা কোক হাতে নিয়ে আরাম করে বসল সে গা ছড়িয়ে।

রানা ভাবছে, এখন পর্যন্ত আক্রমণের কোনও লক্ষণ যখন নেই, তখন বোধহয় টের পায়নি ওরা কিছু। কিন্তু ব্ল্যাকজ্যাক খেলার শেষে কি হবে? কিভাবে শুরু হবে আসল ঘটনাটা? ফু-চুং-কে কিছু জানিয়ে আসতে পারেনি সে—ও কি ধরা পড়ল? ওকে যে ম্যাকাও পাঠানো হয়েছে সে খবর কি পেল চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিস? ঠিক সময় মত যদি সাহায্য না আসে তাহলে?

দেখা যাক, যা হবার হবে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল রানা। দেখল, ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলে এসে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল রানা সেই টেবিলের দিকে। সামনাসামনি হতেই মুচকি হাসল মেয়েটি।

সারাদিন আজ রানা অপেক্ষা করেছে এই মুহূর্তটির জন্যে। এ পর্যন্ত ওর জানা আছে কি কি ঘটবে, এরপর থেকেই সব কিছু আবছা। কোনও ধারণাই নেই তার কি ঘটতে চলেছে এই খেলার পর। তাই ভেতর ভেতর একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।

কিন্তু আশ্চর্য সাদামাঠা ভাবে শেষ হয়ে গেল খেলা। তিন মিনিটের মধ্যেই আটহাজার ম্যাকাও পতাকা জিতে ফেলল রানা। যুবতীর তাস শাফল করবার অস্বাভাবিক নৈপুণ্য রানাকে বিস্মিত করতে পারল না, কারণ রানা আরও কিছু বিস্ময়ের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কিছুই ঘটল না। সাদামাঠা ভাবে খেলা শেষ হয়ে যেতেই যন্ত্রচালিতের মত উঠে চলে গেল মেয়েটা টেবিল থেকে। বোকার মত বসে রইল রানা।

এখন? এখন কি করবে সে?

লাল প্লেক ক’টা ভাঙিয়ে নিল রানা কাউন্টার থেকে, তারপর নেমে এল নিচতলায়। ভাবল, রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে দেহের আলস্যটা কাটিয়ে নেবে।

ফুটপাথ ধরে গজ বিশেক যেতেই পাশে এসে থামল একটা ট্যাক্সি। হাত নেড়ে নিষেধ করল রানা, লাগবে না। কিন্তু নাছোড়বান্দা ড্রাইভার স্লো স্পীডে চলতে থাকল পাশাপাশি। বিরক্ত হয়ে চাইল রানা একবার গাড়িটার দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ির ভেতরের কার্টিসি লাইটটা একবার জ্বলেই নিভে গেল। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে লিউ ফু-চুং।

বিনা বাক্যব্যয়ে দরজা খুলে পাশের সীটে উঠে বসল রানা। দ্রুত এগিয়ে চলল গাড়ি বড় রাস্তা ধরে।

‘তুই খবর পেলি কি করে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘তোর ওপর নজর রাখবার জন্যে লোক ছিল। আমাকে একটা ফোন করে দিয়েই ও তোর সাথে একই স্টীমারে ম্যাকাও চলে এসেছে। এখান থেকেও আবার কন্ট্যাক্ট করেছে আমাদের সঙ্গে ওয়্যারলেসে। আমি আগে ভাগেই চলে এসেছি— রাত সাড়ে এগারোটায় এসে পৌঁছবে আমাদের সাবমেরিন। কাজ সেরে আজই ফিরে যাব আমরা।’

‘তুই আর হোটেল বিল্টমোরে যাসনি?’

‘নাহ্। পাগল নাকি? টিয়েন হং-এর অবস্থা দেখেই সাবধান হয়ে গেছি আমি।’

‘টিয়েন হং মানে সেই হোয়াইট অ্যাঞ্জেলের জকি তো? ওর আবার কি হলো?’

‘কাল সন্ধের সময় খুন হয়েছে ও নিজের ঘরে। সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। বুকের ওপর ছুরি দিয়ে গেঁথে রেখে গেছে নোটগুলো। লিউঙের কাজ।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দু’জন। তারপর রানা জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে সাবমেরিন আসছে কি করতে?’

‘স্মাগলিং চ্যানেলটা ক্লোজ করে দেব চিরতরে। বেইজিং থেকে হুকুম এসেছে—ধ্বংস করে দাও।’

‘পর্তুগীজ এলাকায় এ-ধরনের কাজ করলে তুমুল আন্দোলন হবে না?’

‘হতে পারে। হয়তো দুনিয়া ফাটিয়ে চিৎকার করবে। কিন্তু আমাদের কাজ আমাদেরকে করতেই হবে। আমি তো বুঝি না, তামাম দুনিয়া দখল করে সীমান্ত থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরের এই ছোট্ট জায়গাটা কেন বাদ রাখল গণচীন সরকার। যত রাজ্যের অ-কাজ কু-কাজ সব এখানে। আফিম আর স্বর্ণের ঘাঁটি। এখানে না আছে ইনকাম ট্যাক্স, না আছে একচেঞ্জ কন্ট্রোল। ফরেন কারেন্সি আর সোনা আমদানী-রপ্তানীর ওপর কোনই বাধা-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ নেই। দিনের পর দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। এদের সঙ্গে আবার হাত মিলিয়েছে হংকং-এর যত গুণ্ডা-পাণ্ডা।’

‘কিভাবে ধ্বংস করবি, কোনও প্ল্যান নিয়েছিস?’

‘সাবমেরিনে আসছে তিরিশজন এক্সপার্ট। টিএনটি আর বাজুকা থাকবে, দরকার হলে ট্যাঙ্ক নামিয়ে দেব। কিন্তু তোর প্ল্যানটা আগে বল। তুই তো, শালা, মেয়েটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিস। ওকে বের করে আনবি কি করে? কি ঠিক করেছিস? আমার ওপর তো অর্ডার দেয়া হয়েছে এইসব হাঙ্গামার আগেই তোকে নিরাপদ দূরত্বে যেন সরিয়ে ফেলি। তোর প্ল্যানটা কি শুনি?’

‘টাইম-বম্ব ঠিক ক’টার সময় ফাটাবি?’

‘জিরো আওয়ারে। ঠিক রাত বারোটায়।’

‘আমি একটা প্ল্যান ঠিক করেছি। মন দিয়ে শোন।’

মন দিয়ে শুনবার আর সুযোগ হলো না। হঠাৎ গলার স্বর বদলে ফু-চুং বলল, ‘খুব সম্ভব আমাদের পেছনে লেজ লেগেছে, রানা। সামনেও আছে, পেছনেও। দুটো গাড়ি। পেছনে তাকাস না। ওই যে সামনের ওপেলটা দেখা যাচ্ছে, দু’জন লোক বসা। দুটো রিয়ার-ভিউ মিরর লাগানো আছে ওতে। আমাদের লক্ষ্য করছে অনেকক্ষণ ধরে। পেছনের সাদা একটা স্পোর্টস্ মডেল জাগুয়ারে আছে আরও দু’জন। এতক্ষণ ছিল না, এই মিনিট পাঁচেক হলো দেখছি। কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। তুই রেডি থাকিস আর লক্ষ রাখিস, আমি পরীক্ষা করে দেখি সত্যিই ওরা চ্যাঙের লোক কিনা।

জোরে অ্যাক্সিলারেটর চেপে ইগনিশন্ সুইচ অফ করে দিল ফু-চুং। ‘ঠাস’ করে পিস্তলের মত একটা শব্দ বেরোল এক্‌জস্ট পাইপ দিয়ে এঞ্জিন ব্যাক ফায়ার করতেই। সাথে সাথেই পেছনের দুজন লোকের হাত পকেটে ঢুকল।

‘ঠিক ধরেছিস্। আওয়াজ হতেই পকেটে হাত ঢুকেছে ওদের অভ্যাসবশে। তুই এক কাজ কর ফু-চুং, আমাকে নামিয়ে দে এখানে। তোকে কিছুই বলবে না ওরা। আমার সাথে সাথে তুই ধরা পড়লে ক্ষতি হয়ে যাবে অনেক।

‘শাট আপ!’ একবার কড়া করে চাইল ফু-চুং রানার দিকে। ‘মায়ার কাছে গিয়ে বীরত্ব দেখাস, এখানে নয়। তোকে এখন নামিয়ে দিলে আমার চাকরি থাকবে মনে করেছিস? তাছাড়া আমাকে ভীতুই বা মনে করলি কেন? তুই তোর ওই খেলনাটা বের করে তৈরি থাক। হাতের টিপটা আগের মতই আছে তো? তাহলে আর চিন্তা নেই, বসে বসে দেখ কেমন ঘোল খাইয়ে দিই শালাদের। মনে আছে, সেবার সাইগনে দু’জন কি বিপদে পড়েছিলাম? সেই রকম পিস্তলের খেল একটু দেখাতে হবে, দোস্ত।’

আলগোছে পিস্তলটা শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে হাতের মুঠোয় নিল রানা। ওর মনের মত কাজ পেয়েছে এইবার।

লম্বা সোজা রাস্তাটায় লোকজন বিশেষ নেই। চল্লিশ মাইল স্পীডে চলছে ওরা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে জাগুয়ার, আর হাত পাঁচেক আছে, ঠিক এমনি সময় ঘ্যাঁচ করে হঠাৎ ফুল ব্রেক করল ফু-চুং। সাবধান না থাকলে রানার নাক ছেঁচে যেত ড্যাশবোর্ডে। বিশ্রী শব্দ তুলে অল্প খানিকটা স্কিড করে থেমে পড়ল গাড়িটা। সাথে সাথেই পেছন থেকে জোরে এক ধাক্কা মারল এসে জাগুয়ারটা। প্রচণ্ড একটা ধাতব শব্দ হলো। জাগুয়ারের সামনের উইগুস্ক্রীন ভেঙে পড়ে গেল চুর হয়ে। ধাক্কার চোটে কয়েক ফুট এগিয়ে গেল রানাদের ট্যাক্সিটা। এবার ফার্স্ট গিয়ারে দিয়ে পেছনের বাম্পারটা জাগুয়ারের সাথেই ভেঙে রেখে এগিয়ে চলল ফু- চুং।

‘কি দেখলি?’ জিজ্ঞেস করল ফু-চুং গর্বের হাসি হেসে।

‘র‍্যাডিয়েটার গ্রিল বার্স্ট করেছে, ব্যাটাদের নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, উইণ্ডস্ক্রীন গায়েব,’ পেছনে ফিরে বসল রানা। ততক্ষণে অনেকদূর চলে এসেছে ওদের ট্যাক্সি। থেঁতলে চাকার সঙ্গে আটকে যাওয়া উইং দুটো তুলবার চেষ্টা করছে লোক দু’জন গাড়ি থেকে নেমে। অল্পক্ষণেই আবার চালু করতে পারবে, সন্দেহ নেই।

‘এতেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ওই দ্যাখ, ওপেলটা রাস্তার এক পাশে থেমে দাঁড়াচ্ছে। মাথা নিচু করে ফ্যাল্। গুলি চালাতে পারে ওরা। সাবধান! ছুটলাম।

পিঠের কাছে অনুভব করতে পারল রানা, থার্ডগিয়ারে ফুল অ্যাক্সিলারেটার দিয়েছে ফু-চুং। রানা বসে পড়েছে নিচে সীট ছেড়ে। সীটের ওপর আধ-শোয়া অবস্থায় চোখ দুটো ড্যাশবোর্ডের চেয়ে একটু উঁচু রেখে এক হাতে চালাচ্ছে ফু-চুং।

সাঁ করে ওপেলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। সাথে সাথেই রিভলভারের তীক্ষ্ণ আওয়াজ এল কানে। একটা গুলি বড়িতে এসে লাগল ঠং করে—বোধ হয় চাকা সই করেছিল। আর দ্বিতীয় গুলিটা উইণ্ডস্ক্রীন ফুটো করে একরাশ কাঁচের টুকরো ছড়াল গাড়িময়। তৃতীয় গুলিটা কি হলো বোঝা গেল না। একটা অশ্লীল চীনা গালি বেরিয়ে এল ফু-চুং-এর মুখ থেকে।

পেছনের সীটে চলে গেল রানা। পিস্তলের বাঁট দিয়ে ঠুকে পেছনের কাঁচটা ভেঙে ফেলল। ওপেলটা এবার তেড়ে আসছে ওদের দিকে। যেন রাগে অগ্নিশর্মা, জ্বলছে ওর দুই চোখ। হেড লাইট সই করতে যাচ্ছিল রানা। ফু-চুং বলল, ‘এখন গুলি করিস না। সামনেই একটা শার্প টার্ন নিচ্ছি। ঘুরেই দাঁড়িয়ে পড়ব। তখন গুলি করিস।’

ফু-চুং-এর কণ্ঠস্বর কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল।

চট্ করে একটা হাতল ধরে ফেলল রানা গাড়িটা ডানদিকে মোড় নিতেই! তিন সেকেণ্ড দুই চাকার ওপর চলে আবার সোজা হয়ে থেমে গেল ট্যাক্সি প্রথম বাড়িটার আড়ালে। ঝট্ করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রানা গাড়ি থেকে। ওপেলটা তখন মোড় নিচ্ছে ভীষণ বেগে। টায়ারের ঘষায় বিশ্রী একটা শব্দ উঠছে রাস্তা থেকে। হেড লাইটটা ক্রমেই সরে আসছে ডানদিকে। হেলে গিয়েছে গাড়িটা ডানধারে। রানা বুঝল, এখনই সময়, সোজা হবার আগেই শেষ করতে হবে।

তিনটে অব্যর্থ গুলি লক্ষ্যভেদ করল।

আর সোজা হলো না ওপেলটা। রাস্তার মাঝের আইল্যাণ্ডে উঠে কোণাকুণি ধাক্কা খেলো একটা গাছের সঙ্গে। আবার রাস্তায় নেমে সোজাসুজি গুঁতো মারল একটা ল্যাম্প পোস্টকে। তারপর কয়েক হাত পিছিয়ে এসে কাত হয়ে উল্টে পড়ে গেল। প্রচণ্ড ধাতব শব্দ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলল বাড়িগুলোর গায়ে।

হঠাৎ লক্ষ্য করল রানা আগুন দেখা যাচ্ছে গাড়ির মুখ থেকে। গাড়ি থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে একজন লোক। রানা বুঝল, এখন যে-কোনও মুহূর্তে ভ্যাকিউম পাম্প বেয়ে এগিয়ে আগুনটা ফুয়েল ট্যাঙ্কে পৌঁছে যাবে। তাহলে আর বেরোতে হবে না ভেতরের কাউকে।

দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল রানা সেদিকে, এমন সময় একটা গোঙানির শব্দে চমকে ঘুরে দাঁড়াল সে। দেখল, মাথাটা ঝুলে পড়েছে ফু-চুং-এর—গড়িয়ে পড়ল সে সীট থেকে গাড়ির মেঝেতে। জ্বলন্ত ওপেলের কথা ভুলে ছুটে এসে দাঁড়াল রানা ট্যাক্সির পাশে। এক ঝটকায় দরজা খুলেই দেখল চারদিকে রক্ত লেগে আছে। ফু-চুং-এর বাম হাতের আস্তিন পর্যন্ত চুপচুপে ভেজা তাজা রক্তে। আবার সীটের ওপর টেনে তুলল রানা ফু-চুংকে। চোখ মেলে চাইল ফু-চুং।

‘রানা! জলদি পালা। এক্ষুণি ওই জাগুয়ারটা এসে পড়বে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল আমাকে।’

‘ঠিক আছে। তুই একটু সরে বস্! কিচ্ছু ভাবিস না।’ সাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা জ্বলন্ত ওপেলকে পেছনে ফেলে। রাস্তায় ইতিমধ্যেই কিছু লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখতে লেগেছে।

‘সোজা চল। খানিকদূর গিয়েই ডানদিকের রাস্তায় উঠে পড়বি। কিছু দেখা যাচ্ছে আয়নায়?’ জানতে চাইল ফু-চুং।

একটা হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। ওটা পুলিসের মোটর সাইকেল না জাগুয়ারের অবশিষ্ট এক চোখ বোঝা যাচ্ছে না। একশো গজ দূরে আছে। দ্রুত এগিয়ে আসছে এই দিকে।

‘ছুটে চল। লুকাতে হবে আমাদের কোথাও। সিনেমা হল আছে একটা সামনে। ডানদিকে ঘোরা। ওই যে বাঁয়ে দেখা যাচ্ছে আলোগুলো, ওটাই সিনেমা হল। এসে গেছি। স্পীড় কমা। জলদি বাঁয়ে কাট। হ্যাঁ। সোজা ঢুকে পড় ওই গাড়িগুলোর পাশে। লাইট অফ। ব্যস।’

বিশ পঁচিশটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে। দুটো গাড়ির মাঝখানে ফাঁক পেয়ে সেখানে ঢুকে পড়ল রানা। চুপচাপ কেটে গেল তিন মিনিট। পাশ ফিরে পেছন দিকে চাইল। নাহ্, একটা মরিস মাইনর আর অস্টিন এ-ফরটি এসে ঢুকল গেট দিয়ে, ভদ্রলোকের মত নেমে চলে গেল যাত্রীরা টিকেট কাউন্টারের দিকে। একটা ছোকরা পান-বিড়ি-সিগারেট হেঁকে চলে গেল।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে ফু-চুং। দুর্বল কণ্ঠে বলল, ‘আর তিন মিনিট দেখব, তারপর আমাকে কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

‘একটু সহ্য করে থাক, ভাই। বেশিক্ষণ লাগবে না। তোর বুদ্ধিটা বোধহয় কাজে লেগে গেল। এ-যাত্রা বেঁচেই গেলাম বোধহয়।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলাল রানা পেছনের অন্ধকারে। কারও দেখা নেই। আশপাশের গাড়িতেও কোন রকম সন্দেহজনক কিছু পেল না সে। ভাবছে এক্ষুণি ডাক্তারের উদ্দেশে রওনা হবে, না আরও দু’এক মিনিট অপেক্ষা করবে—এমন সময় নাকে এল আফটার শেভ লোশনের গন্ধ। পরমুহূর্তেই একটা কালো মূর্তি উঠে এল মাটি ফুঁড়ে ঠিক জানালার পাশে। হাতের সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল সোজা রানার কপালের দিকে ধরা। ফু-চুং-এর ধারের জানালা দিয়ে একটা মৃদু গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘চিৎকার করবার চেষ্টা কোরো না। ধীরস্থির ভাবে পরাজয় মেনে নাও। নইলে অসুবিধায় পড়বে।’

রানা ওর পাশের লোকটার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে চাইল ভাল করে। চোখ দুটো হাসছে ওর টিটকারির হাসি। ফিসফিস করে বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলের মত বেরিয়ে এসো বাইরে। আমাদের শুধু তোমাকে দরকার। নইলে দু’জনেরই লাশ নিয়ে যেতে হবে আমাদের।’

রানা ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ফু-চুং-এর দিকে। ব্যথায় কুঁচকে গেছে ওর গাল দুটো। যে-কোনও মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে। এক্ষুণি চিকিৎসা দরকার। প্রচুর রক্তক্ষরণে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল ধরা আছে ওর গলার ওপর ঠেসে। আশপাশের কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। সিনেমা হলের পার্কিং কর্ণারটা অন্ধকার মত। কাছেই কয়েকটা স্টেশনারী দোকান আছে, তাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না? দেখা যাক।

‘আমি নেমেই যাই, ড্রাইভার। দু’জন একসাথে মারা পড়ার চাইতে আমার নেমে যাওয়াই ভাল। সম্ভব হলে ফিরে এসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। নিজের দিকে লক্ষ্য রেখ।’

রানার কথাটা শেষ হতেই ওর পাশের দরজাটা খুলে গেল। তখনও পিস্তলটা ধরা আছে রানার দিকে স্থির ভাবে। ওপাশের লোকটা বলল, ‘তোমাকেও ছাড়া হবে না, বাবাজী। তোমার অপরাধের শাস্তিও সময় মত পাবে। এখন আপাতত তুমি আহত, হাঁটিয়ে নিতে পারব না, তাই রেখে যাচ্ছি। কিন্তু ম্যাকাও ছেড়ে যাবে কোথায়? ড্রাইভারগিরি ভুলিয়ে দেয়া হবে তোমাকে।’

‘আমি দুঃখিত, বন্ধু,’ করুণ ক্লান্ত শোনাল ফু-চুং-এর কণ্ঠস্বর। ‘তোমাকে বদমাইশগুলোর হাত থেকে রক্ষা করতে পারলাম না। আমি…’ এটুকু বলার পরই ঠক করে বেশ জোরে একটা শব্দ হলো ওপাশের লোকটার পিস্তলের বাঁটটা ফু-চুং- এর কানের পেছনে আঘাত করতেই। নীরবে কাত হয়ে ঢলে পড়ল ফু-চুং-এর ক্লান্ত দেহ।

দাঁতে দাঁত ঘষল রানা, পেশীগুলো দৃঢ় হয়ে উঠল ওর দেহের। দুটো পিস্তলের দিকে চাইল সে একবার নিষ্ফল আক্রোশে। ওর ওয়ালথারটা হোলস্টার থেকে বের করবার সময় পাওয়া যাবে না। চারটে চোখ লোভাতুর দৃষ্টি মেলে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। ছুতো খুঁজছে যেন খুন করবার। ও কিছু একটা করবার চেষ্টা করুক, তাই চাইছে ওরা আন্তরিক ভাবে। নিজেকে সামলে নিল রানা। নেমে এল সে গাড়ি থেকে। হত্যার চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তাই করতে পারল না সে এই মুহূর্তে।

‘সোজা গেট দিয়ে বেরিয়ে যাও। স্বাভাবিক থাকো। আমাদের পিস্তল তৈরি থাকল, কোনও চালাকির চেষ্টা করলে…’ কথাটা আর শেষ করল না আফটার-শেভ লোশন মাখা লোকটা। ওর ডান হাতটা এখন কোটের পকেটে চলে গেছে। রানা ফিরে দেখল দ্বিতীয়জনেরও একই অবস্থা—হাত চলে গেছে কোটের পকেটে, অদৃশ্য হয়েছে পিস্তলটা।

স্টেশনারী দোকানগুলোর পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল তিনজন রাস্তার ওপর দ্রুতপায়ে। আকাশে চাঁদ উঠেছে আধখানা।