» » দুঃসাহসিক

বর্ণাকার

কাজী আনোয়ার হোসেন

দুঃসাহসিক

নয়

ফটো ইলেকট্রিক সেল পরিচালিত কাঁচের দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল রানা এগোতেই! ধীর পায়ে ঢুকল রানা হোটেল সিসিলে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা পেছনে। ওর মনে হলো সিংহের খাঁচায় ঢুকে পড়েছে যেন ও।

হংকং-কে দুর্বৃত্তের স্বর্গ বলা হলেও তাও খানিকটা খোলামেলা। ম্যাকাও পৌঁছে রানা অনুভব করল চারদিকটা যেন বন্ধ। পঙ্কিল পাপের দুর্গন্ধ উঠে দূষিত হয়ে গেছে যেন এখানকার আকাশ বাতাস। বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায় না। কেমন যেন অসহায় বোধ করল ও। বুঝল, এখানকার একমাত্র আইন হচ্ছে ওয়েবলি অ্যাণ্ড স্কট্। পারবে সে টিকে থাকতে?

থ্রী ডেকার এস. এস. টাকশিং স্টীমারে উঠেই রানা একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেয়েছিল এক সেকেণ্ডের জন্যে। লোবো। সে-ও চলেছে ম্যাকাও রানার সাথে সাথে। পুরো তিনঘণ্টা লাগল এই চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করতে—এর মধ্যে লোবোর ছায়াও দেখতে পাওয়া যায়নি আর।

প্রকাণ্ড নয়তলা ভবন সিসিলের হোটেল হচ্ছে কেবল অষ্টম ও নবম তলাটা। বাকি সমস্ত তলায় বিভিন্ন রকমের দেশী-বিদেশী জুয়ার ব্যবস্থা।

প্রত্যেকটা তলা ঘুরে দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে থাকল রানা সিঁড়ি বেয়ে। লিফট অবশ্য আছে একটা। কিন্তু প্রায়ই অকেজো হয়ে থাকে। সপ্তম তলায় খেলা হয় সব চাইতে উঁচু স্টেকে। ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে স্টেক একতলা, দোতলা, তেতলা করে।

হঠাৎ চমকে উঠল রানা। মায়া না? কোণের একটা টেবিলে একজন বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে বসে আছে মায়া ওয়াং। রানার দিকে একবার চেয়ে যেন চিনতেই পারেনি এমনি ভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিল মায়া। কিন্তু বৃদ্ধ চীনা স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ করছে তাকে। নিশ্চয়ই চ্যাঙ। এ লোক চ্যাঙ ছাড়া আর কেউ নয়। লাফিয়ে উঠল রানার বুকের ভেতর এক ঝলক রক্ত।

যেন সম্মোহন করছে এমনি তীক্ষ্ণ চ্যাঙের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে রানার চোখে। রানাও পাল্টা লক্ষ করল ওকে আপাদমস্তক। মাথা ভর্তি টাক, শক্ত সমর্থ চেহারা, চিবুকে অল্প খানিকটা কাঁচা পাকা দাড়ি, শানটুং সিল্কের শার্ট আর গ্যাবারডিনের ঢোলা স্যুট পরনে, কান দুটো অস্বাভাবিক বড়। মনের মধ্যে গেঁথে নিল রানা ছবিটা, তারপর ঘুরে হাঁটতে থাকল সিঁড়ির দিকে। পুরো ঘরটা পেরিয়ে তারপর অষ্টম তলার সিঁড়ি। কারণটা সহজেই বুঝতে পারল রানা। হোটেলের গেস্টকে ঢুকতে বা বেরোতে হলে প্রত্যেকটা জুয়ার টেবিলের পাশ দিয়ে আসতে-যেতে হবে। ফলে তার পক্ষে লোভ সংবরণ করা শক্ত হবে।

সিঁড়ির কাছে গিয়ে একবার ফিরে চাইল রানা। দেখল, এখনও তেমনি ভাবে তার দিকে চেয়ে আছে দস্যু চ্যাঙ।

অষ্টম তলায় দুই কামরার একখানা চমৎকার স্যুইট রিজার্ভ করা আছে রানার জন্যে। সব ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর। একটা বেডরূম, একটা লিভিংরূম-পুরু কার্পেটে মোড়া। বেডরূমের সঙ্গে সমুদ্রের দিকে মুখ করা ব্যালকনি আছে একটা। রানা ভাবল, একটু অতিরিক্ত খাতির হয়ে যাচ্ছে না? তবে কি ওরা কিছুই সন্দেহ করেনি? নাকি খাঁচায় ঢুকিয়ে নিয়ে খেলা দেখতে চাইছে?

স্টীমারেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিল রানা। ঘড়িতে বাজছে রাত বারোটা। শহরটা ঘুরে ফিরে সব গলি ঘুঁচি চিনে নেয়ার প্রবল ইচ্ছেটাকে চাঁটি মেরে দাবিয়ে দিল সে। আর কোনও কাজ নয়, বিশ্রাম নিতে হবে আজ।

ঠিক রাত দুটোর সময় কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রানার। মনে হলো কেউ যেন টোকা দিল দরজায়। স্লীপিং গাউন পরা ছিল। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে খালি পায়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। কান পাতল দরজার গায়ে। একটা মৃদু পদশব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। নিঃশব্দে হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল রানা—মাথাটা বের করল বাইরে। দেখল করিডর ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে, খালি পায়ে। চিনতে পারল সে-মায়া ওয়াং। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলছে একটা ঢোলা নাইট গাউন।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল রানা ঘর থেকে। দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে দিল। তারপর চলল মায়ার পিছুপিছু। একবার পিছু ফিরে ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল মায়া। তারপর ডানধারে মোড় নিল। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল রানা জনশূন্য করিডর ধরে। এবার নবম তলার সিঁড়ি ধরে উঠছে মায়া। রানাও উঠে এল পেছন পেছন। নবম তলার একটা বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মায়া ওয়াং, ওর পিঠের কাছে রানা।

আর একবার পেছন ফিরে ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল মায়া। রানা মাথা ঝাঁকাল। ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজায় তালা দিয়ে দিল মায়া। হাত ধরে টেনে নিয়ে এল রানাকে ঘরের মাঝখানে।

রানা বলল, ‘কি ব্যাপার, মায়া? হঠাৎ এত রাতে?’

‘চুপ! আস্তে কথা বলো!’ চাপা গলায় বলল মায়া। ‘পাশের ঘরেই চ্যাঙ। তোমার পাশের ঘরে লোবো। তুমি তো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছ, এদিকে আমি ছটফট করে মরছি। না জানি কি বিপদ ঝুলছে তোমার মাথার ওপর। ওরা তোমাকে সন্দেহ করেছে, রানা।’

‘তুমি কি করে জানলে?’

‘আগে বসো, তারপর বলছি।’

রানাকে ইতস্তত করতে দেখে বলল, ‘নিশ্চিন্তে বসো। এই ঘরে মাইক্রোফোন নেই, আস্তে কথা বললে টের পাবে না কেউ।’

একটা সোফায় বসে পড়ল রানা, তার পাশে বসল মায়া ওয়াং। গায়ে সুগন্ধি সাবানের সুবাস। পাশের শোবার ঘর থেকে হালকা আলো এসে পড়েছে এ ঘরে। সুন্দর লাগছে রানার মায়াকে।

‘তুমি জানলে কি করে?’ আবার জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আজ সন্ধের পর থেকেই খুব বিচলিত দেখছিলাম চ্যাঙকে। তুমি যখন এলে তখন ভালমত তোমাকে লক্ষ করে আমাকে বলল—এ লোক কিছুতেই চোর হতে পারে না। হাজার হাজার চোর-ডাকাত-খুনী দেখেছি আমি, এ নিশ্চয়ই পুলিসের লোক। আইনের বিরুদ্ধে গেলে চেহারায় যে ছাপ পড়ে-এর চেহারায় সে ছাপ নেই। তুমি খাল কেটে কুমির এনেছ, মায়া। আমি বললাম— খতম করে দিন না, তাহলেই তো চুকে যায়। চ্যাঙ বলল— দাঁড়াও, দেখা যাক ঝুড়িতে করে কি সাপ এনেছে এই নতুন সাপুড়ে। আমার মুঠি থেকে আর বেরোতে হবে না। লিউঙ ওর আসল পরিচয় বের করে ফেলবে তিনদিনের মধ্যেই। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ব্যাটা বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। জাল করেছে বলে লিউঙকে যে নোট দিয়েছিল, আমাদের এক্সপার্ট পরীক্ষা করে রায় দিয়েছে ওগুলো সেন্ট পারসেন্ট খাঁটি। আমি জিজ্ঞেস করলাম—কিন্তু ওর আসল মতলব কি? চ্যাঙ বলল—সেটা বের করতে অসুবিধে হবে না। আমাদের সাবধান থাকতে হবে।’

এই পর্যন্ত বলে থামল মায়া। রানার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চাইল। তারপর বলল, ‘এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও তুমি, রানা। আজ কেবল তোমার জন্যেই বাড়ি যায়নি চ্যাঙ—আমাকেও রেখে দিয়েছে এই হোটেলে। তোমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে ও। এক বছর পর এই প্রথম হোটেলে রাত কাটাচ্ছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতখানি বিচলিত হয়ে পড়েছে ও।’

‘অথচ বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই। আমার বিরুদ্ধে কিছুই খুঁজে পাবে না লিউঙ। কোনও ভাবে—’

খিলখিল করে হেসে উঠল মায়া। ‘মনে হচ্ছে চ্যাঙের সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছ। তোমাকে কে জিজ্ঞেস করেছে তোমার আসল পরিচয়? আমি তোমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানতে চাই না। তুমি চোর হলেই বা আমার কি, আর পুলিস হলেই বা কি? কিছুই যায় আসে না। কথা ছিল আমাকে উদ্ধার করবে এদের কবল থেকে—তার আগেই যাতে খতম না হয়ে যাও তাই সাবধান করে দিলাম। আমি ও তোমার সাথে জড়িয়ে আছি কি না।’

‘পালিয়ে যেতে বলছ, তাই যেতাম। ওদের ভাবগতিক আমারও ভাল লাগছে না। তোমাকে কথা না দিলে, আর তোমার ব্ল্যাকমেইলিং-এর ভয়ে আধমরা হয়ে না থাকলে আমি অনেক আগেই কেটে পড়তাম। আসতেই হলো, পাছে তুমি আবার চ্যাঙকে বলে দাও যে গুপ্তধনের সন্ধান আমি জানি, তাই।’

এবার আবার হেসে উঠল মায়া। পাগলের মত খিলখিল করে হাসল কিছুক্ষণ, তারপর দম নিয়ে বলল, ‘তুমি একটা বুদ্ধ!’

‘কেন?’ অবাক হয়ে চাইল রানা মায়ার মুখের দিকে।

‘চলো, পাশের ঘরে চলো। বলছি।’

উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত ধরে টেনে তুলল সে রানাকে সোফা থেকে, তারপর যেন বল-ডান্স করছে এমনি ভাবে তালে তালে স্টেপিং করে নিয়ে গেল ওকে শোবার ঘরে। মুখে দুষ্টামির চাপা হাসি।

‘আমি তোমার সব কথা জানি, রানা,’ বলল মায়া খাটের কিনারায় বসে।

‘কি জানো?’

‘তুমি দুঃসাহসী এক বাঙালী স্পাই-মাসুদ রানা। এসেছ চ্যাঙকে ধ্বংস করতে।’

চমকে উঠল রানা। মায়া জানল কি করে? ব্যাপার কি? তবে কি সব প্রকাশ পেয়ে গেছে এদের কাছে?

‘বলব, কি করে জানলাম?’

‘জলদি বলো,’ তাগিদ দিল রানা।

‘গতকাল স্টীমারে তোমার পরিচিত একজন লোক বলল সব কথা। কোনও বিপদ দেখলে যেন আগে থেকে সাবধান করি তোমাকে, সে-ব্যাপারে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করল। তুমি নাকি তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি।’

কে হতে পারে? অবাক হয়ে যায় রানা। সে জানল কি করে যে মায়ার সাহায্য পাওয়া যাবেই?

‘কি নাম তার?’ জিজ্ঞেস করল রানা। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে। কে বলল মায়াকে এসব কথা? নামটা জানবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল ওর মন।

চুপচাপ কিছুক্ষণ রানার অস্থিরতা উপভোগ করে মৃদু হাসল মায়া। বলল, ‘নিউ ফু-চুং। তোমার সেই বন্ধু। ও নাকি সেদিন রিপালস বে হোটেলে আমাদের সমস্ত কথাবার্তা টেপ করে নিয়েছিল তোমার অজান্তে।’

‘আচ্ছা! আশ্চর্য তো? আমাকে বলেনি কিছু।’

‘তুমিও তো বলোনি ওকে কিছু। তুমিও তো সব ব্যাপার চেপে গেছ ওর কাছে।’

‘বলিনি সে কেবল তোমার জন্যে, মায়া। বললেই আমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিত, সেই ভয়ে বলিনি। তাহলে তোমাকে রক্ষার আর কোনও পথ থাকত না…’

‘আমি তা জানি। ফু-চুং-ও জানে। মনে মনে সবজান্তার হাসি হাসছে সে, আর এই একটা ব্যাপারে তোমাকে ঠকাতে পেরে খুব পুলকিত হচ্ছে। কিন্তু আমার জন্যে এই ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে জেনে শুনে কেন ঝাঁপ দিলে তুমি, রানা? কি হতো একটা মেয়েকে উদ্ধার করতে এগিয়ে না এলে? একটা দস্যুকন্যার জীবনের কি দাম আছে? তোমার কাজ তো হাসিল হয়েই গিয়েছিল। এতবড় একটা বিপদের মুখে তুমি এগিয়ে এসেছ কেবল আমারই জন্যে ভাবতে আশ্চর্য লাগছে আমার। অদ্ভুত লাগছে। ধন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। সেই সাথে আবার ভয় হচ্ছে। স্বার্থপরের মত তোমাকে এসব ব্যাপারে না জাড়ালেই বোধহয় ভাল করতাম। ভয় হচ্ছে…’

পাশের ঘরে টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে একসাথে চমকে উঠল ওরা দু’জন। কি মনে করে ছাতের দিকে চেয়েই এক লাফে ঘরের এক কোণে সরে গেল রানা।

‘মায়া!’ রানার কণ্ঠে উত্তেজিত জরুরী ভাব। ‘এই ঘরের ছাতে লেন্স কিসের? নিশ্চয়ই ক্লোজ-সার্কিট টেলিভিশনের ক্যামেরা! আমরা ধরা পড়ে গেছি, মায়া। কেউ আমাদের দেখে ফেলেছে। এখন সংবাদ দিচ্ছে চ্যাঙকে।

ভয়ে পাংশু হয়ে গেল মায়ার মুখ। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘এখন উপায়?’

‘উপায় আছে। অত ভয় পেয়ো না। তুমি কিছু না জানার ভান করবে। একেবারে ন্যাকা বনে যাবে। আমি ব্যালকনি দিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে যাচ্ছি। কার্নিশ ধরে চলে যাব আমার ঘরে।’

‘এত উঁচু থেকে যদি পড়ে যাও?’ রানার একটা হাত ধরল মায়া।

‘ওসব ভাববার সময় নেই এখন। কোনও ভয় নেই, বুঝতে পেরেছ?’ হাসল রানা অভয় দিয়ে। দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে ব্যালকনির অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওয়ালথারটা দাঁতে চেপে সড়সড় করে নেমে গেল সে পাইপ বেয়ে।

ওর ঘরের ঠিক আগের ঘরটায় দেখা গেল বাতি জ্বলছে। উঁকি দিয়ে দেখল রানা দরজা দুপাট খোলা।

দশমিনিট পর ঘুমিয়ে পড়ল রানা নিজের বিছানায়। বিশ্রাম দরকার।