» » » কাকাতুয়া : শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী প্রণীত

মাস পাঁচ ছয় হইল, একদিন প্রাতে স্নানাদিক্রিয়াসম্পন্ন করিয়া কিঞ্চিৎ গুড় ছোলা খাইয়া বসিয়া তামাকু টানিতেছি, এমন সময় প্রসন্ন গোয়ালিনী আসিয়া উপস্থিত। সু—বামহস্ত কোমরস্থিত সাধুভাণ্ড জড়াইয়া রহিয়াছে, পোড়া ডান হাতে একটা পাখীর খাঁচা। খাঁচাটা অতি সাবধানে মাটিতে রাখিয়া প্রসন্ন বসিল। রকম দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কত রঙ্গই জান?

প্রসন্ন উত্তর করিল—কেন, রঙ্গ আবার কি দেখিলে?

আ। তোমার সব দুধ দই আমাকে না দিয়া পাঁচজনকে বেচিয়া বেড়াও, এই ত এক রঙ্গ। আবার এতদিনের পর নূতন পাখী কেন?

প্র। নূতন পুরাতন আবার কি? আমি ত আর কখন পাখী পুষি নাই।

আ। সে কি প্রসন্ন? আর কখন পাখী পোষ নাই কি? আমিই যে তোমার খাঁচার পাখী—তোমার ঐ পরম ভাণ্ডের মধ্যে আমি শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ক্ষীরোদশয্যাশায়ী অনন্ত পুরুষের ন্যায় সদাই যোগমুগ্ধ। ঐ ক্ষীরাধার ভাণ্ড আমার অনন্তশয্যারূপী খাঁচা। আমি ঐ খাঁচার ক্ষীরপায়ী পক্ষী। তাই বলি, আবার একটা পাখী কেন?

প্র। দেখিলাম পাখীটা আর একটা পাখীর বাসায় ঢুকিতে গিয়া ঠোকর খাইয়া মাটিতে পড়িয়া ধড়ফড় করিতেছে। দেখিয়া বড় দুঃখ হইল; তাই পাখীটাকে খাঁচায় পুরিয়া আনিলাম।

আ। যে পরের বস্তু লইবার জন্য অনধিকার—প্রবেশের চেষ্টা করে, তাহার জন্য আবার দুঃখ কি? সে ত ঘোর অত্যাচারী! পিনালকোডের ৫১১ ধারানুসারে সে ষোল আনা চুরি এবং অনধিকার—প্রবেশের দায়ে দায়ী, তা জানিস্!

প্র। অমন কথা বল না! ওর কিছু নাই বলিয়াই অমন অসাহসের কাজ করিতে গিয়াছিল। আহা! যার নাই, তাকে যদি লোকে না দেবে ত সে কোথায় যাবে—আমরা মেয়েমানুষ এই ত বুঝি।

প্রসন্নের মুখে দান দাতব্যের কথা বড়ই ভয়াবহ। আমার এককালে ভয় এবং রাগের সঞ্চার হইল। গরম হইয়া বলিলাম—

তবে বুঝি ওই পাখীটাকে তোর যথাসর্ব্বস্ব দিবি? আমি বুঝি আমার এই দুগ্ধপুষ্ট তনুখানি গঙ্গাজলে ভাসাইয়া দিব?

প্র। ও কি রকম কথা? আমি কি তোমাকে তাই করতে বলছি?

আ। নয়ই বা কেন? ঐ পাখীটাই যদি তোর সব দুধ দই খেলে, তবে আমি বাতাস খেয়ে থাকব না Huxley সাহেবের protoplasm খেয়ে থাকব?

প্র। কেন, তুমিও খাবে, ও—ও খাবে।

আ। না, প্রসন্ন, কমলাকান্ত সরিকিতে নাই।

প্র। সে আবার কি?

আ। ভাগাভাগিতে আমি নাই। দায়ভাগের ভাগাভাগির ভয়ে আমি সংসারধর্ম্মেই করিলাম না। আবার তোর ভাঁড়েও ভাগাভাগি?

প্র। কেন, তুমিই ত সে দিন কত দান ধর্ম্মের কথা, কত হোমান্‌টি মটরসুঁটির কথা বলছিলে?

আ। সে পরকে শেখাবার জন্য।

প্র। ও মা, সে কি গো! আপনার বেলা লীলাখেলা পাপপুণ্য পরের বেলা!

আ। প্রসন্ন, কমলাকান্তের জাতিকে তুই এখনও চিনিস্ নাই। তা সে সব কথা যাক্। পাখীটাকে ছেড়ে দে।

প্র। তা হবে না। যাকে একবার ঠাঁই দিয়েছি তাকে তাড়াতে পার্‌ব না।

আ। সেটা ত তোদের জাতিরই ধর্ম্ম নয়?

এবার প্রসন্ন রাগিল। বলিল—

কি, বামণ, তুমি ধর্ম্ম ধর্ম্ম কর? তোমার মতন দুর্ম্মুখ ত ভূ—ভারতে নাই। তোমার কাছে আবার মানুষ আসে?

এই বলিয়া প্রসন্ন উঠিল। প্রত্যহ প্রাতে আমাকে যে দুধটুকু দেয় তাহা না দিয়াই চলিল। দুধ চলিয়া যায় দেখিয়া আমি রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলাম –আচ্ছা, আমিও একটা পাখী পুষিব, আমার যা কিছু আছে সব তাকে দিব। প্রসন্ন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া খাঁচাটা মাটীতে রাখিয়া দক্ষিণ হস্ত নাড়িয়া আমাকে বলিল –আচ্ছা, আমিও এই বলে যাচ্চি, যে দিন তুমি পাখীকে পোষমানাতে পার্‌বে, সেই দিন আমি আমার এই দুধের কেঁড়ে ভেঙ্গে ফেল্‌ব।

এই বলিয়া প্রসন্ন খাঁচাটা তুলিয়া লইয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেল। কেঁড়ের দুধ চল্‌কে কাপড় বাহিয়া পড়িতে লাগিল। O what a fall was there!

আমি ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া পাখীর সন্ধানে বাহির হইলাম। অনেক ঘুরিলাম, অনেক পাখীর দোকানে গেলাম। কোথাও মনের মতন পাখী পাইলাম না। শেষে এক দোকানে একটি পাখী মনোনীত হইল, কিন্তু তখনই দামের কথা মনে পড়িল। আমি শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী, আমার ত একটি পয়সাও নাই; তবে কি বলিয়া পাখী কিনিতে আসিলাম? কিছু অবসন্ন হইলাম; কিন্তু তখনই মনে হইল যে কমলাকান্তের দেশে কয়জন সম্বলবিশিষ্ট লোক আছে? আর সম্বলহীন হইয়াও কে না বড় বড় সওদার চেষ্টায় ফিরিতেছে? কে না বড় বড় পদ, লম্বা লম্বা, খেতাবের জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? কিন্তু তাহারা কেহই ত লজ্জা, অপমান, ঘৃণা, কিছুই অনুভব করে না! তবে আমিই কেন লজ্জিত হই? এইরপ ভাবিতে ভাবিতে আসিতেছি, এমন সময় কর্কশ শব্দ শুনিতে পাইলাম। শব্দটা এইরূপ— Plateetud, Plateetud, Plateetud, বারম্বার এই অশ্রুতপূর্ব্ব শব্দ শুনিয়া শব্দের কারণ জানিবার ইচ্ছা হইল। খুঁজিতে খুঁজিতে এক দরিদ্র মুসলমানের বাড়ীতে আসিলাম। উঁকি মারিয়া দেখিলাম উঠানে এক কচ্ছহীন বীরপুরুষ কতকগুলো মুর্গী জবাই করিতেছে –রক্তের স্রোত বহিয়া যাইতেছে। একখানা ঘরের দাবায় একটা স্ত্রীলোক পড়িয়া ছট্‌ফট্ করিতেছে, এবং বিষম যন্ত্রণাসূচক চীৎকার করিতেছে। ঘরের চালে ডাঁড়ে বসিয়া একটা পাখী একবার সেই রক্তের স্রোত দেখিতেছে, একবার সেই স্ত্রীলোকটাকে দেখিতেছে এবং আহ্লাদে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছে। এক একবার স্ত্রীলোকটাকে ঠোক্‌রাইবার চেষ্টা করিতেছে, এবং ঘুরিয়া ফিরিয়া Plateetud, Plateetud করিতেছে। আমি গৃহস্বামীকে ডাকিলাম। গৃহস্বামী বাহিরে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম –তোমার বাড়ীতে কাহার কোন পীড়া হইয়াছে?

গৃ—স্বা। হাঁ, আমার স্ত্রীর হাঁটুতে বড় একটা বেদনা হইয়াছে। আমি সেইজন্য বড় বিপাকে পড়িয়াছি। আমার বাড়ীতে আজ দশজন লোক খাবে, আর এই বিপদ্।

আ। আমি একটা ঔষধ দিতেছি; জলে গুলিয়া হাঁটুতে মালিশ করিয়া দাও, শীঘ্র আরাম হইবে। কিন্তু আমাকে কি দিবে?

গৃ—স্বা। আপনি কি চান?

আ। ঐ পাখীটা।

গৃ—স্বা। এখনি লইয়া যান। ওটাকে আমি খুব যত্ন করিয়া আনিয়াছিলাম, কিন্তু মহাশয়, এখন ওটা আমার ছেলেপিলেকে ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে মারিয়া ফেলিতেছে। আপনি এখনই লইয়া যান।

তখন আমি বিষম গোলে পড়িলাম। আফিঙ্গ দিই কেমন করিয়া? যা আফিঙ্গ দেবাসুরে সমুদ্র মন্থন করিয়া, সৃষ্টির সারভূত পদার্থস্বরূপ লাভ করিয়া আমি লোভ—পরিশূন্যসংসার—বিরাগী বলিয়া আমার জিম্মায় রাখিয়াছেন, সে আফিঙ্গ দিই কেমন করিয়া? কিন্তু না দিলেও নয়। প্রসন্নের কাছে মুখ রাখা চাই, সেই দুধ দেয়। দেবাসুরে আমাকে এক ছিলিম তামাকুও দেয় না। সুতরাং ক্ষণেক ইতস্ততঃ করিয়া অবশেষে চক্ষু বুজিয়া ছোট্ট একটি গুলি গৃহস্বামীর হাতে দিয়া পাখীটা লইয়া চলিয়া আসিলাম। কাজটা মন্দ করিলাম কি? উপকার করিয়া তাহার মূল্যস্বরূপ পাখীটা লইলাম। কে না লয়? ডাক্তার মহাশয়েরা দরিদ্র রোগীর নিকট হইতে কি Fee লয়েন না উকীল মহাশয়েরা নিঃস্ব মোয়াক্কেলের নিকট হইতে ফি লয়েন না? রাজপুরুষেরা দরিদ্র গৃহস্থের নিকট হইতে টেক্স লয়েন না? কুলকামিনীরা দরিদ্র স্বামীর নিকট হইতে খোরপোষ লয়েন না? তবে আমিই কি এমন ভয়ানক কাজ করিলাম?

সেই দিন সন্ধ্যার পর আফিঙ্গ খাইয়া পাখীর ডাঁড়টা সামনে ঝুলাইয়া তামাকু খাইতে বসিলাম। ক্রমে আফিঙ্গ চড়িয়া উঠিল। তখন শুনিলাম পাখীটা বলিতেছে –আমাকে কেন তেমন জায়গা হইতে এখানে আনিলে? Plateetud, Plateetud।

আ। তুমি এই যে বেশ কথা কহিতে পার! তোমার নাম কি, বাড়ী কোথা?

পা। আমার নাম কাকাতুয়া, অর্থাৎ, তুয়া কাকা। তোমাদিগকে uncleship শিখাইবার নিমিত্ত আমার এ প্রদেশে আগমন। Plateetud, Plateetud।

আ। তুমি তবে এ দেশীয় নও? তোমার বাড়ী কোথা?

পা। আপাততঃ এখান হইতে অনেক পশ্চিমে।

আ। আগে কোথায় থাক্‌তে?

পা। সে অনেক কথা। শুনিবে কি?

আ। শুনিব। আজ কাল অনেকে পুরাতত্ত্ব চর্চ্চা করিয়া খুব সস্তাদরে নাম কিন্‌চে, দেখি যদি আমিও কিছু করিতে পারি।

পা। শুনিয়া আমাকে ছাড়িয়া দিবে বল?

আ। সে পরের কথা। আগে শুনি।

পা। আমি পাখী নই। আমি পশু। বহুকাল পূর্ব্বে কৃষ্ণসাগরের নিকট আমার বাস ছিল। তখন আমি শূকর ছিলাম। পাঁক ঘাঁটিতাম, পাঁক মাখিতাম, পাঁক খাইতাম। ক্রমে সেখানে মনুষ্যনামা এক প্রকার দ্বিপদবিশিষ্ট হিংস্রক জন্তু দেখা দিল। এবং পাঁকাল মাছ মনে করিয়া আমাদিগকে ধরিয়া খাইতে লাগিল।

আ। শূকরকে পাঁকাল মাছ মনে করিল কেমন করে?

পা। শূকরও পাঁক ঘাঁটে, পাঁকাল মাছও পাঁক ঘাঁটে। অতএব শূকর এবং পাঁকাল মাছ এক।

আমার Whately’s Logic জানা ছিল, ফস্ করে বলিলাম –ওটা যে fallacy of undistributed middle হল।

পা। Tut, fal—la—cy of un—dis—tri—bu—ted mid—dle! ও ত logic—এর কথা। Antiquities—এর সহিত logic—এর সম্পর্ক কি? দিন কতক Antiquities চর্চ্চা কর, Webber সাহেবের গ্রন্থ পড়, তাহা হইলে আর কিছু আটকাবে না, ও রকম খট্‌কা হবে না। দ্বিপদগণের তাড়নায় আমরা পলাইতে লাগিলাম। যত পলাই ততই শীত, আর ততই আমাদের গায়ে বড় বড় লোম দেখা দিতে লাগিল। Plateetud; Plateetud।

আ। সেটা কি রকম করিয়া হইল?

পা। দেখ, কথায় কথায় ছল ধরিলে পুরাতত্ত্ব শেখা যায় না। শিবের কপালে চোক হইল কেমন করিয়া? গণেশের ঘাড়ে হাতীর মুণ্ডু হইল কেমন করিয়া? হিমালয় পর্ব্বতটা দুর্গার বাপ হইল কেমন করিয়া? কুমারী মেরীর গর্ভে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম হইল কেমন করিয়া? এসব পুরাণের কথা, কে না বিশ্বাস করে? তবে পুরাতত্ত্বের বেলা এত খট্‌কা কেন? পুরাণ আর পুরাতত্ত্ব একই জিনিষ। উভয়েই পুরা কবিত্বময়। একত্বের কি চমৎকার প্রমাণ দেখ দেখি! তবে দুইটি শব্দের শেষ ভাগে যে একটা প্রভেদ দেখিতে পাও, সে কেবল প্রত্যয় ভেদে ঘটিয়াছে।

আ। তুমি সে সংস্কৃত ব্যাকরণও জান দেখিতেছি।

পা। আমি জানিব না ত কি তুমি জানিবে? সংস্কৃত ব্যাকরণ আমাদের পশ্চিমাঞ্চল হইতে ভারতবর্ষে আসিয়াছে, তা জান? আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারিতেছি না, বই কাছে নাই, কিন্তু আমার বোধ হয় Webber সাহেবের গ্রন্থে একথারও প্রমাণ পাওয়া যাইতে পারে।

আ। কোবিদবর! বলিয়া যান্!

পা। পলাইতে পলাইতে শেষে আমরা সমুদ্রমধ্যস্থিত একটি গিরিগুহায় ঢুকিয়া রক্ষা পাইলাম। সেখানে খুব শীত। সেই শীতে আমাদের ভূঁড়ো পেট কুঁক্‌ড়ে গেল –আমরা সিংহ হইয়া গেলাম। এই দেখ সেই সিংহের কেশর আমার ঘাড়ে উচ্চ ঝোটন আকারে বিরাজমান।

আ। আবার সেই রকম fallacy হল না?

পা। দেখ, এই মাত্র তোমাকে বুঝাইয়া দিলাম, এ সকল পুরাতত্ত্ব, ইহাতে fallacy কোন ক্রমেই হইতে পারে না, তুমি সে সব কথা ইহারই মধ্যে ভুলিয়া গিয়াছ? তোমাকে আর শুনাইয়া কি করিব, আমি ক্ষান্ত হইলাম।

আ। দেখ, তুমি রাগ করিও না, আমি একটু একটু আফিঙ্গ খাই বলিয়া সকল সময় আমার সব কথা মনে থাকে না।

পা। ওঃ! তুমি আফিঙ্গ খাও। তবে ত আমি তোমার একজন পরম সুহৃৎ, প্রধান শুভানুধ্যায়ী। আমি নিজে আফিঙ্গ খাই না বটে, আফিঙ্গ খেলে আমার পেট ফাঁপে, কিন্তু আফিঙ্গখোর মাত্রই আমার স্নেহের বস্তু, আমার পোষ্যপুত্র বলিলেও হয়। তবে শুন।

যখন সিংহ ছিলাম তখন মধ্যে মধ্যে গুহা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া নিকটস্থ একটা দেশে আহার সংগ্রহ করিতে যাইতাম। কিন্তু শীঘ্রই সে দিকে কাঁটা পড়িল। একটা ভূতের মেয়ে এক দিন এমনি আমাদের লেজ মুচড়াইয়া দিয়াছিল যে, লেজগুলা একেবারে চেপটা হইয়া গেল, আর সে দিকে যাইতে সাহস হইল না। কাজেই পেটের জ্বালায় আপনাপনি খাইতে আরম্ভ করিলাম। বোধ হয় এই রকম করিয়া সমস্ত সিংহকুল নিঃশেষিত হইয়া যাইত। কিন্তু “ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান্ বয়।” ভাগ্যবলে আমাদের গায় পালক দেখা দিল। আমরা সাদা সাদা ডানা বিস্তার করিয়া সমুদ্র পার হইয়া এ দেশে ওদেশে যাইতে আরম্ভ করিলাম। যেখানে উত্তম আহারের সম্ভাবনা দেখিলাম, সেইখানে বাসা নির্ম্মাণ করিতে আরম্ভ করিলাম। যে প্রতিবাদী হইল, তাহাকে মারিয়া ফেলিলাম, অথবা তাড়াইয়া দিলাম। Plateetud; Plateetud।

আ। এদেশেও কি বাসা নির্ম্মাণ করিয়াছ?

পা। করিয়াছি, কিন্তু পাকা পোক্ত রকম নয়।

আ। নয় কেন?

পা। এখানে এত বেশী খাই যে, শীঘ্র উদরাময় জন্মিয়া যায়, বাড়ীতে না গেলে সারে না। আর গুহার ভিতর সঞ্চিত আহার লুকাইবার সুবিধাও খুব।

আ। আচ্ছা, তোমার দুইটি বই পা দেখিতেছি না। আর দুইটি পা কি হইল?

পা। সে বড় দুঃখের কথা, কাহাকেও বলিও না। সংক্ষেপে বলি – ইচ্ছানন্দপুর নামক স্থানে একটা দ্বিপদবিশিষ্ট জন্তুর বাসায় আহারের লোভে প্রবেশ করিয়াছিলাম। জন্তুটা আমাকে ধরিয়া আমার একটা পা কাটিয়া দিল। এবং মহানন্দপুর নামক আর এক স্থানে ঐরূপ কারণে আর একটা পা কাটা গিয়াছে! অতএব আমি পক্ষিরূপে একটি পশু। Plateetud, Plateetud।

এই সময় প্রসন্ন গোয়ালিনী সেখানে না থাকায় আমার বড়ই আপ্‌শোস্ হইল। থাকিলে শুনাইয়া দিতাম, পরের ঘরে লুকোচুরি খেলা কি রকম লাভের কাজ। পরে পাখীটাকে জিজ্ঞাসা করিলাম –তুমি কি ও Plateetud, Plateetud কর?

পা। এদেশে আসা অবধি আমি Plateetud বলিতে বড় ভালবাসি।

আ। কথাটার কোন অর্থ আছে কি?

পা। আছে বৈ কি। কথাটা plaintain শব্দ হইতে উৎপন্ন।

আ। বুঝিয়াছি, তুমি plantain খাইতে ভালবাস বলিয়া সর্ব্বদা Plateetud, Plateetud কর।

পা। তা নয়; আমি এদেশের যথাসর্ব্বস্ব লুঠিয়া খাইতেছি। কাজেই আপ্‌শোস্ দেশের দ্বিপদবিশিষ্ট জন্তুগুলার ভাগ্যে plantain বই আর কিছুই থাকে না। তাহাদিগের edification—এর জন্য Plateetud বলি। বুঝ্‌লে?

আ। আহা তুমি কি পরোপকারী!

পা। তার প্রমাণ ঐ নীচে দেখ।

দেখিলাম ডাঁড়ের নীচে, মেজের উপর পিপীলিকার ন্যায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জন্তু কিল্ কিল্ করিয়া বেড়াইতেছে। পাখীকে জিজ্ঞাসা করিলাম–ও সব ত পিপীলিকা দেখিতেছি। ওখানে তোমার পরোপকারিত্বের প্রমাণ কই?

পা। উহারা পিপীলিকার ন্যায় ক্ষুদ্র বটে, দেখিতেও প্রায় পিপীলিকা, কিন্তু উহারা পিপীলিকা নয়। উহাদিগকে বঙ্গজ বলে। ঐ দেখ আমার ডাঁড় থেকে এক ফোঁটা দুধ পড়িল আর বঙ্গজগুলা কিল্ কিল্ করিয়া মারামারি ঠেলাঠেলি করিয়া ঐ দুধটুকু খাইতে আসিল। আমার ডাঁড় হইতে যে দুই এক ফোঁটা দুধ পড়ে তাই খাইয়া উহারা জীবনধারণ করে। আমি উহাদের উপকারক নই?

আ। শুধু উপকারক? যখন তুমি উহাদের উদর চালাইতেছ, তখন তুমি উহাদের প্রাণপুরুষ, জীবাত্মা, পরমাত্মা, প্রেতাত্মা, হর্ত্তা, কর্ত্তা, বিধাতা, সবই, কেন না উহারা উদরময় উদরসর্ব্বস্ব। আচ্ছা, উহাদের মধ্যে ঐ যে কতকগুলার বড় বড় মাথা দেখিতেছি উহারা কে? উহাদের মাথা অত বড় কেন?

পা। মাথা বড় নয়। আমার কাছে মাথা খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া উহারা মাথা ফুলাইয়া ফেলিয়াছে। উহারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান্। দেখিতেছ না উহারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শান্ত শিষ্ট স্বজাতীয়দিগকে মারিয়া ধরিয়া, তাড়াইয়া দিয়া আমার ডাঁড়ের নীচে দাঁড়াইয়া মাথা নাড়িয়া আমাকে কত সেলাম করিতেছে এবং আমার প্রসাদের সারাংশ সংগ্রহ করিয়া দূরস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বঙ্গজের দলে প্রবেশ করিয়া মাথা উন্নত করিয়া বেড়াইতেছে?

আ। এ তোমার বড় অন্যায়। তুমি ছোট ছোট কৃশাঙ্গগুলিকে যত্ন না করিয়া মোটা মোটাগুলাকে অনুগ্রহ কর?

পা। দেখ, আমি প্রকৃতপক্ষে কাহাকেও যত্ন কি অনুগ্রহ করি না। আমার সমস্ত যত্ন এবং অনুগ্রহ আমাতেই অর্পিত। তবে, মোটা মাথাগুলো খুব সেলাম করে, এবং বিভীষণের ন্যায় আপনাদের ঘরের সমস্ত কথা আমাকে বলিয়া দেয়, তাই উহাদিগকে দুধের উপর দুই একটা ছোলার খোসা দিয়া থাকি। Plateetud।

আ। ওরা কি দানা খেতে কিছু ভালবাসে?

পা। দানা নয়, খোসা, খোসা, খোসা তার বেশী হজম করিবার ক্ষমতা উহাদের নাই। তবে এখন আমাকে ছাড়িয়া দাও। আমার ইতিহাস শুনিলে ত?

আ। কেন, তুমি কোথায় যাবে?

পা। আমি সেই মুসলমানের বাড়ীতে গিয়া থাকিব।

আ। কেন, এখানে তোমার কিসের কষ্ট?

পা। এখানে ত মুর্গী জবাই দেখিতে পাইব না, ছোট ছেলের নেড়া মাথা ঠোকরাইতে পাইব না। এখানে কি সুখে থাকিবে? আমাকে ছাড়িয়া দেও– আমি তোমাকে সর্ব্বদা আফিঙ্গ সরবরাহ করিব–Plateetud।

আ। সে ভাল কথা, কিন্তু দুই চারি দিন আমি তোমাকে ছাড়িব না–আমার একটু জিদ আছে।

প্রসন্ন বলিয়া উঠিল–কি ঠাকুর, ছাড়িবে না, পোষ মানাবে? ঐ দেখ তোমার পাখী কট্ করে শিক্‌লি কেটে উড়ে গেল।

আমি চমকিয়া উঠিলাম। কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া উঠিলাম–কে ও, প্রসন্নময়ি, কি মনে করে?

প্র। আর আদরে কাজ নাই। চল দুধ নেবে চল।

আ। এস। কিন্তু আগে একটা কাজ কর ত। ঐ ঝাঁটা গাছটা দিয়া বঙ্গজগুলাকে ঝাঁটাইয়া ফেলিয়া দেও ত।

গোয়ালিনী মাগী তাহাই করিল।

Leave a Reply