সেই আফিঙ্গখোর কমলাকান্তের অনেক দিন কোন সম্বাদ পাই নাই। অনেক সন্ধান করিয়াছিলাম, অকস্মাৎ সম্প্রতি একদিন তাহাকে ফৌজদারী আদালতে দেখিলাম। দেখি যে, ব্রাহ্মণ এক গাছতলায় বসিয়া, গাছের গুঁড়ি ঠেসান দিয়া, চক্ষু বুজিয়া ডাবায় তামাকু টানিতেছে। মনে করিলাম, আর কিছু না, ব্রাহ্মণ লোভে পড়িয়া কাহার ডিবিয়া হইতে আফিঙ্গ চুরি করিয়াছে—অন্য সামগ্রী কমলাকান্ত চুরি করিবেনা—ইহা নিশ্চিত জানি। নিকটে একজন কালোকোর্ত্তা কনষ্টেবলও দেখিলাম। আমি বড় দাঁড়াইলাম না—কি জানি যদি কমলাকান্ত জামিন হইতে বলে। তফাতে থাকিয়া দেখিতে লাগিলাম যে, কাণ্ডটা কি হয়।
কিছুকাল পরে কমলাকান্তের ডাক হইল। তখন একজন কনষ্টেবল রুল ঘুরাইয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া এজ্লাসে লইয়া গেল। আমি পিছু পিছু গেলাম। দাঁড়াইয়া, দুই একটি কথা শুনিয়া ব্যাপারখানা বুঝিতে পারিলাম।
এজ্লাসে, প্রথমত মাচানের উপর হাকিম বিরাজ করিতেছেন। হাকিমটি একজন দেশী ধর্ম্মাবতার—পদে ও গৌরবে ডিপুটি। কমলাকান্ত আসামী নহে—সাক্ষী। মোকদ্দমা গরুচুরি। ফরিয়াদি সেই প্রসন্ন গোয়ালিনী।
কমলাকান্তকে সাক্ষীর কাটরায় পূরিয়া দিল। তখন কমলাকান্ত মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। চাপরাশী ধমকাইল— “হাস কেন?”
কমলাকান্ত যোড়হাত করিয়া বলিল. “বাবা, কার ক্ষেতে ধান খেয়েছি যে, আমাকে এর ভিতর পূরিলে?”
চাপরাশী মহাশয় কথাটা বুঝিলেন না। দাড়ি ঘুরাইয়া বলিলেন, “তামাসার জায়গা এ নয় –হলফ পড়।”
কমলাকান্ত বলিল, “পড়াও না বাপু।”
একজন মুহুরি তখন হলফ পড়াইতে আরম্ভ করিল। বলিল, “বল আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া…”
কমলাকান্ত। (সবিস্ময়ে) কি বলিব?
মুহুরি। শুন্তে পাও না—“পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে__”
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে! কি সর্বনাশ!
হাকিম দেখিলেন, সাক্ষীটা কি একটা গণ্ডগোল বাধাইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সর্বনাশ কি?”
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনেছি—এ কথাটা বল্তে হবে?
হাকিম। ক্ষতি কি? হলফের ফারমই এই।
কমলা। হুজুর সুবিচারক বটে। কিন্তু একটা কথা বলি কি, সাক্ষ্য দিতে দিতে দুই একটা ছোট রকম মিথ্যা বলি, না হয় বলিলাম—কিন্তু গোড়াতেই একটা বড় মিথ্যা বলিয়া আরম্ভ করিব, সেটা কি ভাল?
হাকিম। এর আর মিথ্যা কথা কি?
কমলাকান্ত মনে মনে বলিল, “তত বুদ্ধি থাকিলে তোমার কি এ পদবৃদ্ধি হইত?” প্রকাশ্যে বলিল, “ধর্ম্মাবতার, আমার একটু একটু বোধ হইতেছে কি যে, পরমেশ্বর ঠিক প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। আমার চোখের দোষই হউক, আর যাই হউক; কখনও ত এ পর্য্যন্ত পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম না। আপনারা বোধ হয় আইনের চসমা নাকে দিয়া তাঁহাকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পারেন—কিন্তু আমি যখন তাঁহাকে এ ঘরের ভিতর প্রত্যক্ষ পাইতেছি না—তখন কেমন করিয়া বলি—আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে__”
ফরিয়াদীর উকিল চটিলেন—তাঁহার মূল্যবান সময়, যাহা মিনিটে মিনিটে টাকা প্রসব করে, তাহা এই দরিদ্র সাক্ষী নষ্ট করিতেছে। উকীল তখন গরম হইয়া বলিলেন, “সাক্ষী মহাশয়!” Theological Lecture টা ব্রাহ্মসমাজের জন্য রাখিলে ভাল হয় না? এখানে আইনের মতে চলিতে মন স্থির করুন।”
কমলাকান্ত তাঁহার দিকে ফিরিল। মৃদু হাসিয়া বলিল, “আপনি বোধ হইতেছে উকীল।”
উকীল। (হাসিয়া) কিসে চিনিলে?
কমলা। বড় সহজে। মোটা চেন আর ময়লা শামলা দেখিয়া। তা মহাশয়! আপনাদের জন্য এ Theological Lecture নয়। আপনারা পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখেন স্বীকার করি—যখন মোয়াক্কেল আসে।
উকীল সরোষে উঠিয়া হাকিমকে বলিলেন, “I ask the protection of the Court against the insults of this witness.”
কোর্ট বলিলেন, “O Baboo! the witness is your own witness, and you are at liberty to send him away if you like.”
এখন কমলাকান্তকে বিদায় দিলে উকীল বাবুর মোকদ্দমা প্রমাণ হয় না—সুতরাং উকীল বাবু চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। কমলাকান্ত ভাবিলেন, এ হাকিমটা জাতিভ্রষ্ট—পালের মত নয়।
হাকিম গতিক দেখিয়া, মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, “ওথের প্রতি সাক্ষীর objection আছে—উহাকে simple affirmation দাও।” তখন মুহুরি কমলাকান্তকে বলিল, “আচ্ছা, ও ছেড়ে দাও—বল, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি—বল।”
কমলা। কি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেটা জানিয়া প্রতিজ্ঞাটা করিলে ভাল হয় না?
মুহুরি হাকিমের দিকে চাহিয়া বলিল, “ধর্ম্মাবতার! সাক্ষী বড় সেরকশ্।”
উকীল বাবু হাঁকিলেন, “Very obstructive.”
কমলা। (উকীলের প্রতি) শাদা কাগজে দস্তখত করিয়া লওয়ার প্রথাটা আদালতের বাহিরে চলে জানি—ভিতরেও চলিবে কি?
উকীল। শাদা কাগজে কে তোমার দস্তখত লইতেছে?
কমলা। কি প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে, তাহা না জানিয়া, প্রতিজ্ঞা করা, আর কাগজে কি লেখা হয় তাহা না দেখিয়া, দস্তখত করা, একই কথা।
হাকিম তখন মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, “প্রতিজ্ঞা আগে ইহাকে শুনাইয়া দাও—গোলমালে কাজ নাই।” মুহুরি তখন বলিল, “শোন, তোমাকে বলিতে হইবে যে, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি যে সাক্ষ্য দিব, তাহা সত্য হইবে, আমি কোন কথা গোপন করিব না—সত্য ভিন্ন আর কিছু হইবে না।”
কমলা। ওঁ মধু মধু মধু।
মুহুরি। সে আবার কি?
কমলা। পড়ান, আমি পড়িতেছি।
কমলাকান্ত তখন আর গোলযোগ না করিয়া প্রতিজ্ঞা পাঠ করিল। তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য উকীল বাবু গাত্রোত্থান করিলেন, কমলাকান্তকে চোখ রাঙ্গাইয়া বলিলেন, “এখন আর বদ্মায়েশি করিও না—আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তার যথার্থ উত্তর দাও। বাজে কথা ছাড়িয়া দাও।”
কমলা। আপনি যা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাই আমাকে বলিতে হইবে? আর কিছু বলিতে পাইব না?
উকীল। না।
কমলাকান্ত তখন হাকিমের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “অথচ আমাকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন যে, ‘কোন কথা গোপন করিব না।’ ধর্ম্মাবতার, বে—আদবি মাফ হয়! পাড়ায় আজ একটা যাত্রা হইবে, শুনিতে যাইব ইচ্ছা ছিল; সে সাধ এইখানেই মিটিল। উকীল বাবু অধিকারী—আমি যাত্রার ছেলে, যা বলাইবেন, কেবল তাই বলিব; যা না বলাইবেন, তা বলিব না। যা না বলাইবেন, তা কাজেই গোপন থাকিবে। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের অপরাধ লইবেন না।”
হাকিম। যাহা আবশ্যক বিবেচনা করিবে, তাহা না জিজ্ঞাসা হইলেও বলিতে পার।
কমলাকান্ত তখন সেলাম করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব।” উকীল তখন জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন, “তোমার নাম কি?”
কমলা। শ্রী কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী।
উকীল। তোমার বাপের নাম কি?
কমলা। জোবানবন্দীর আভ্যুদয়িক আছে না কি?
উকীল গরম হইলেন, বলিলেন, “হুজুর! এ সব Contempt of Court.” হুজুর, উকীলের দুর্দ্দশা দেখিয়া নিতান্ত অসন্তুষ্ট নন—বলিলেন, “আপনারই সাক্ষী।” সুতরাং উকীল আবার কমলাকান্তের দিকে ফিরিলেন, বলিলেন, “বল। বলিতে হইবে।”
কমলাকান্ত পিতার নাম বলিল। উকীল তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি জাতি?”
কমলা। আমি কি একটা জাতি?
উকীল। তুমি কোন্ জাতীয়।
কমলা। হিন্দু জাতীয়।
উকীল। আঃ! কোন্ বর্ণ?
কমলা। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
উকীল। দূর হোক ছাই! এমন সাক্ষীও আনে! বলি তোমার জাত আছে?
কমলা। মারে কে?
হাকিম দেখিলেন, উকীলের কথায় হইবে না। বলিলেন, “ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈয়বর্ত্ত, হিন্দুর নানা প্রকার জাতি আছে জান ত—তুমি তার কোন জাতির ভিতর?”
কমলা। ধর্ম্মাবতার! এ উকীলের ধৃষ্টতা! দেখিতেছেন আমার গলায় যজ্ঞোপবীত, নাম বলিয়াছি চক্রবর্ত্তী—ইহাতেও যে উকীল বুঝেন নাই যে, আমি ব্রাহ্মণ, ইহা আমি কি প্রকারে জানিব?
হাকিম লিখিলেন, “জাতি ব্রাহ্মণ।” তখন উকীল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বয়স কত?”
এজ্লাসে একটা ক্লক ছিল—তাহার পানে চাহিয়া হিসাব করিয়া কমলাকান্ত বলিল, “আমার বয়স একান্ন বৎসর, দুই মাস, তের দিন, চারি ঘণ্টা, পাঁচ মিনিট—”
উকীল। কি জ্বালা! তোমার ঘণ্টা মিনিট কে চায়?
কমলা। কেন, এইমাত্র প্রতিজ্ঞা করাইয়াছেন যে, কোন কথা গোপন করিব না।
উকীল। তোমার যা ইচ্ছা কর! আমি তোমায় পারি না। তোমার নিবাস কোথা?
কমলা। আমার নিবাস নাই।
উকীল। বলি, বাড়ী কোথা?
কমলা। বাড়ী দূরে থাক, আমার একটা কুঠারীও নাই।
উকীল। তবে থাক কোথা?
কমলা। যেখানে সেখানে।
উকীল। একটা আড্ডা ত আছে?
কমলা। ছিল, যখন নসী বাবু ছিলেন। এখন আর নাই।
উকীল। এখন আছ কোথা?
কমলা। কেন, এই আদালতে।
উকীল। কাল ছিলে কোথা?
কমলা। একখানা দোকানে।
হাকিম বলিলেন, “আর বকাবকিতে কাজ নাই—আমি লিখিয়া লইতেছি, নিবাস নাই। তারপর?
উকীল। তোমার পেশা কি?
কমলা। আমার আবার পেশা কি? আমি কি উকীল না বেশ্যা যে, আমার পেশা আছে?
উকীল। বলি, খাও কি করিয়া?
কমলা। ভাতের সঙ্গে ডাল মাখিয়া, দক্ষিণ হস্তে গ্রাস তুলিয়া, মুখে পুরিয়া গলাধঃকরণ করি।
উকীল। সে ডাল ভাত জোটে কোথা থেকে?
কমলা। ভগবান্ জোটালেই জোটে, নইলে জোটে না।
উকীল। কিছু উপার্জ্জন কর?
কমলা। এক পয়সাও না।
উকীল। তবে কি চুরি কর?
কমলা। তাহা হইলে ইতিপূর্ব্বেই আপনার শরণাগত হইতে হইত। আপনি কিছু ভাগও পাইতেন।
উকীল তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া, আদালতকে বলিলেন, “আমি এ সাক্ষী চাহি না। আমি ইহার জোবানবন্দী করাইতে পারিব না।”
প্রসন্ন বাদিনী, উকীলের কোমর ধরিল; বলিল, “এ সাক্ষী ছাড়া হইবে না। এ বামন সত্য কথা বলিবে, তাহা আমি জানি—কখনও মিছা বলে না। উহাকে তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে জান না—তাই ও অমন করিতেছে। ও বামনের আবার পেশা কি? ও এর বাড়ী ওর বাড়ী খেয়ে বেড়ায়, ওকে জিজ্ঞাসা করিতেছ, উপার্জ্জন কর! ও কি বলবে?”
উকীল তখন হাকিমকে বলিল, “লিখুন, পেশা ভিক্ষা।”
এবার কমলাকান্ত রাগিল, “কি? কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ভিক্ষোপজীবী? আমি মুক্তকণ্ঠে হলফের উপর বলিতেছি, আমি কখনও কাহারও কাছে এক পয়সা ভিক্ষা চাই না।”
প্রসন্ন আর থাকিতে পারিল না—সে বলিল, “সে কি ঠাকুর! কখন আফিঙ্গ চেয়ে খাও নাই?”
কমল। দূর মাগি ধেমো গোয়ালার মেয়ে! আফিঙ্গ কি পয়সা! আমি কখন একটি পয়সাও কাহারও কাছে ভিক্ষা লই নাই।
হাকিম হাসিয়া বলিলেন, “কি লিখিব কমলাকান্ত?”
কমলাকান্ত নরম হইয়া বলিল, “লিখুন, পেশা ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ—গ্রহণ” সকলে হাসিল—হাকিম তাই লিখিয়া লইলেন।
তখন উকীল মহাশয় মোকদ্দমায় প্রবৃত্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি ফরিয়াদীকে চেন?”
কমল। না।
প্রসন্ন হাঁকিল, “সে কি ঠাকুর! চিরটা কাল আমার দুধ দই খেলে, আজ বল চিনি না?”
কমলাকান্ত বলিল, “তোমার দুধ দই চিনি না, এমন কথা ত বল্তেছি না—তোমার দুধ দই বিলক্ষণ চিনি। যখনই দেখি এক পোয়া দুধে তিন পোয়া জল, তখনই চিনিতে পারি যে, এ প্রসন্ন গোয়ালিনীর দুধ; যখনই দেখ্তে পাই যে, ঘোলের চেয়ে দই ফিকে, তখনই চিনতে পারি যে, এ প্রসন্নময়ীর দুধ। দুধ দই চিনি নে?”
প্রসন্ন নথ ঘুরাইয়া বলিল, “আমার দুধ দই চেন, আর আমায় চিনিতে পার না?”
কমলাকান্ত বলিল, “মেয়েমানুষকে কে কবে চিনিতে পেরেছে, দিদি? বিশেষ, গোয়ালার মেয়ের কাঁকালে যদি দুধের কেঁড়ে থাকিল, তবে কার বাপের সাধ্য তাকে চিনে উঠে?”
উকীল তখন আবার সওয়াল করিতে লাগিলেন, “বুঝা গেল; তুমি বাদিনীকে চেন—উহার সঙ্গে তোমার কোন সম্বন্ধ আছে?”
কমল। মন্দ নয়—এত গুণ না থাকিলে কি উকীল হয়!
উকীল। তুমি আমার কি গুণ দেখিলে?
কমল। বামনের ছেলে গোয়ালার মেয়েতেও আপনি একটা সম্বন্ধ খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।
উকীল। এমন সম্বন্ধ কি হয় না? কে জানে তুমি ওর পোষ্যপুত্র কি না?
কমল। ওর নয়, কিন্তু ওর গাইয়ের বটে।
উকীল। বুঝা গেল, তোমার সঙ্গে বাদিনীর একটা সম্বন্ধ আছে, একেবারে সাফ বলিলেই হইত—এত দুঃখ দাও কেন? এখন জিজ্ঞাসা করি, তুমি এ মোকদ্দমার কি জান?
কমল। জানি যে, এ মোকদ্দমায় আপনি উকীল, প্রসন্ন ফরিয়াদী, আমি সাক্ষী আর এই নেড়ে আসামী।
উকীল। তা নয়, গোরুচুরির কি জান?
কমল। গোরুচুরির আমার বাপ—দাদাও জানে না। বিদ্যাটা আমায় শিখাইবেন?—আমার দুধ দধির বড় দরকার।
উকীল। আঃ—বলি গোরুচুরি দেখিয়াছ?
কমল। একদিন দেখিয়াছিলাম। নসী বাবুর একটা বক্না—এক বেটা মুচি—
উকীল। কি যন্ত্রণা! বলি, প্রসন্ন গোয়ালিনীর গোরু যখন চুরি যায়, তখন তুমি দেখিয়াছ?
কমল। না—চোর বেটার এত বুদ্ধি হয় নাই যে, আমাকে ডাকিয়া সাক্ষী রাখিয়া গোরুটা চুরি করে। তাহা হইলে আপনারও কাজে সুবিধা হইত, আমারও কাজের সুবিধা হইত।
প্রসন্ন দেখিল, উকীলকে টাকা দেওয়া সার্থক হয় নাই –তখন আপনার হাতে হাল লইবার ইচ্ছায়, উকীলের কাণে কাণে বলিয়া দিল, “ও বামুন সে সব কিছুর সাক্ষী নয়—ও কেবল গোরু চেনে।”
উকীল মহাশয় তখন কূল পাইলেন। গর্জ্জিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি গোরু চেন?”
কমলাকান্ত মধুর হাসিয়া বলিল, “আহা চিনি বই কি—নহিলে কি আপনার সঙ্গে এত মিষ্টালাপ করি?”
হাকিম দেখিলেন, সাক্ষী বড় বাড়াবাড়ি করিতেছে—বলিলেন, “ও সব রাখ।” প্রসন্ন গোয়ালীর শামলা গাই আদালতের সম্মুখে মাঠে বাঁধা ছিল—দেখা যাইতেছিল। ডিপুটি বাবু সেই দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এই গোরুটিকে চেন?”
কমলাকান্ত যোড়হাত করিয়া বলিল, “কোন্ গোরুটি, ধর্ম্মাবতার?”
হাকিম বলিলেন, “কোন্ গোরুটি কি? একটি বই ত সাম্নে নাই?”
কমল। আপনি দেখিতেছেন, একটি—আমি দেখিতেছি অনেকগুলি।
হাকিম বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “দেখিতে পাইতেছ না—ঐ শামলা?”
কমলাকান্ত শামলা গাইয়ের দিকে না চাহিয়া উকীলের শামলার প্রতি চাহিল। বলিল, “এ শামলাও চুরির না কি?”
কমলাকান্তের নষ্টামি হাকিম আর সহ্য করিতে পারিলেন না—বলিলেন, “তুমি আদালতের কাজের বড় বিঘ্ন করিতেছ—Contempt of Court জন্য তোমার পাঁচ টাকা জরিমানা।”
কমলাকান্ত আভূমিপ্রণত সেলাম করিয়া যোড়হাত করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব হুজুর! জরিমানা আদায়ের ভার কার প্রতি?”
হাকিম। কেন?
কমল। কিরূপে আদায় করিবেন, সে বিষয়ে তাঁহাকে কিছু উপদেশ দিব।
হাকিম। উপদেশের প্রয়োজন কি?
কমল। ইহলোকে ত আমার নিকট জরিমানা আদায়ের কোন সম্ভাবনা নাই— তিনি পরলোকে যাইতে প্রস্তুত কি না জিজ্ঞাসা করিব।
হাকিম। জরিমানা না দিতে পার, কয়েদ যাইবে।
কমল। কত দিনের জন্য, ধর্ম্মাবতার?
হাকিম। জরিমানা অনাদায়ে এক মাস কয়েদ।
কমল। দুই মাস হয় না?
হাকিম। বেশী মিয়াদের ইচ্ছা কর কেন?
কমল। সময়টা কিছু মন্দ পড়িয়াছে—ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ আর তেমন সুলভ নয়—জেলখানায় যাহাতে মাস দুই ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ হয়, সে ব্যবস্থা যদি আপনি করেন, তবে গরীব ব্রাহ্মণ উদ্ধার পায়।
এরূপ লোককে জরিমানা বা কয়েদ করিয়া কি হইবে? হাকিম হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি যদি গোল না করিয়া সোজা জোবানবন্দী দাও, তবে তোমার জরিমানা মাপ করা যাইতে পারে। বল—ঐ গোরু তুমি চেন কি না?”
হাকিম তখন একজন কনষ্টেবলকে আদেশ করিলেন যে গোরুর নিকট গিয়া প্রসন্নের গাই দেখাইয়া দেয়। কনষ্টেবল তাহাই করিল। বিষণ্ণ উকীল বাবু তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ গোরু তুমি চেন?”
কমল। সিংওয়ালা গোরু—তাই বলুন।
উকীল। তুমি বল কি?
কমল। আমি বলি শামলাওয়ালা—তা যাক্—আমি ও সিংওয়ালা গোরুটা চিনি। বিলক্ষণ আলাপ আছে।
উকীল। ও কার গোরু?
কমল। আমার।
উকীল। তোমার!
কমল। আমারই।
হরি হরি! প্রসন্নের মুখ শুকাইল! উকীল দেখিল, মোকদ্দমা ফাঁসিয়া যায়। প্রসন্ন তখন তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া বলিল, “তবে রে বিটলে! গোরু তোমার!”
কমলাকান্ত বলিল, “আমার না ত কার! আমি ওর দুধ খেয়েছি, ওর দই খেয়েছি—ওর ঘোল খেয়েছি, ওর ছানা খেয়েছি—ওর মাখন খেয়েছি, ওর ননী খেয়েছি—ও গোরু আমার হলো না, তুই বেটী পালিস্ ব’লে কি তোর বাবার গোরু হলো!”
উকীল অতটা বুঝিলেন না। বলিলেন, “ধর্ম্মাবতার, witness hostile! permission দিন আমি ওকে cross করি।”
কমল। কি? আমায় cross করিবে?
উকিল। হাঁ করিব।
কমল। নৌকায়, না সাঁকো বেঁধে?
উকিল। সে আবার কি?
কমল। বাবা! কমলাকান্ত—সাগর পার হও, এত বড় হনূমান্ তুমি আজও হও নাই।
এই বলিয়া কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী রাগে গর্ গর্ করিয়া কাটরা হইতে নামিয়া যায়—চাপরাশী ধরিয়া আবার কাটরায় পূরিল। তখন কমলাকান্ত আলু থালু হইয়া নিশ্চেষ্ট হইল—বলিল, “কর বাবা ক্রস্ কর!—আমি অগাধ সমুদ্রে পড়িয়া আছি—যে ইচ্ছা লম্ফ দাও—‘অপামিবাধারমনুত্তরঙ্গং! —উকিল মহাশয়! এ প্রশান্ত মহাসমুদ্র তরঙ্গ বিক্ষেপ করে না আপনি স্বচ্ছন্দে উল্লম্ফন করুন।”
উকীল তখন কোর্টকে বলিলেন, “ধর্ম্মাবতার, দেখা যাইতেছে যে, এ ব্যক্তি বাতুল; ইহাকে আর ক্রস্ করিবার প্রয়োজন নাই। বাতুল বলিয়া ইহার জবানবন্দী পরিত্যক্ত হইবে। ইহাকে বিদায় দেওয়া হউক।”
হাকিম কমলাকান্তের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলে বাঁচেন, বিদায় দিতে প্রস্তুত, এমত সময়ে প্রসন্ন হাত যোড় করিয়া আদালতে নিবেদন করিল, “যদি হুকুম হয়, তবে আমি স্বয়ং উহাকে গোটা কত কথা জিজ্ঞাসা করি, তার পর বিদায় দিতে হয়, দিবেন।”
হাকিম কৌতূহলী হইয়া অনুমতি দিলেন। প্রসন্ন তখন কমলাকান্তের প্রতি চাহিয়া বলিল, “ঠাকুর! মৌতাতের সময় হয়েছে না?”
কমল। মৌতাতের আবার সময় কি রে বেটী –“অজরামরবৎ প্রাজ্ঞঃ বিদ্যাং নেশ্চাঞ্চ চিন্তয়েৎ।”
প্রসন্ন। অং বং এখন রাখ –এখন মৌতাত করিবে?
কমল। দে!
প্রসন্ন। আচ্ছা, আগে আমার কথার উত্তর দাও –তার পর সে হবে।
কমল। তবে জল্দি জল্দি বল – জল্দি জল্দি জবাব দিই।
প্রসন্ন। বলি, গোরু কার?
কমল। গোরু তিন জনের; গোরু প্রথমে বয়সে গুরুমহাশয়ের; মধ্যবয়সের স্ত্রীজাতির; শেষ বয়সে উত্তরাধিকারীর; দড়ি ছিঁড়িবার সময়ে কারও নয়।
প্রসন্ন। বলি, ঐ শামলা গাই কার?
কমল। যে ওর দুধ খায় তার।
প্রসন্ন। ও গোরু আমার কি না?
কমল। তুই বেটী কখন ওর এক বিন্দু দুধ খেলি নে, কেবল বেচে মর্লি, গোরু তোর হলো? ও গোরু যদি তোর হয়, তবে বাঙ্গাল বেঙ্কের টাকাও আমার। দে বেটী, গোরুচোরকে ছেড়ে দে—গরীবের ছেলে দুধ খেয়ে বাঁচুক।
হাকিম দেখিলেন, দুই জনে বড় বাড়াবাড়ি করিতেছে—আদালত মেছো—হাটা হইয়া উঠিল। তখন উভয়কে ধমক দিয়া জিজ্ঞাসাবাদ নিজহস্তে লইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রসন্ন এই গোরুর দুধ বেচে?”
কমল। আজ্ঞে, হাঁ।
“উহার গোহালে এই গোরু থাকে?”
কমল। ও গোরুও থাকে, আমিও কখন কখন থাকি।
“ওই খাওয়ায়?”
কমল। উভয়কে।
বাদিনীর উকীল তখন বলিলেন, “আমার কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে—আমি উহাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই না”। এই বলিয়া তিনি উপবেশন করিলেন। তখন আসামীর উকীল গাত্রোত্থান করিলেন। দেখিয়া কমলাকান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার তুমি কে?”
আসামীর উকীল বলিলেন, “আমি আসামীর পক্ষে তোমাকে ক্রস্ করিব”।
কমল। একজন ত ক্রস্ করিয়া গেল, আবার তুমি কুমার বাহাদুর এলে না কি?
উকীল। কুমার বাহাদুর কে?
কমল। রাজপুত্রকে চেন না? ত্রেতা যুগে আগে ক্রস্ করিলেন, পবনাঙ্গজ মহাশয়। তার পর ক্রস্ করিলেন, কুমার বাহাদুর।১
উকীল। ও সব রাখ—তুমি গোরু চেন বলেছ—কিসে চেন?
কমল। কখন শিঙ্গে—কখন শামলায়!
উকীল রাগিয়া উঠিয়া, গর্জ্জন করিয়া টেবিল চাপড়াইয়া বলিলেন, “তোমার পাগলামি রাখ—তুমি এই গোরু চিনিতে পারিতেছ কিসে?”
কমল। ঐ হাম্বা—রবে।
উকীল হতাশ হইয়া বলেন, “Hopeless” উকীল মহাশয় বসিয়া পড়িলেন—আর জেরা করিবেন না। কমলাকান্ত বিনীতভাবে বলিল, “দড়ি ছেঁড় কেন বাবা?”
উকীল আর জেরা করিবেন না দেখিয়া হাকিম কমলাকান্তকে বিদায় দিলেন। কমলাকান্ত উর্দ্ধ্বশ্বাসে পলাইল। আমি কিছু কাজ সারিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, কমলাকান্ত থেলো হুঁকা হাতে করিয়া বসিয়া আছে—চারি দিকে লোক জমিয়াছে—প্রসন্নও সেখানে আসিয়াছে। কমলাকান্ত তাহাকে তিরস্কার করিতেছে আর বলিতেছে, “তোর মঙ্গলার বাঁটের দিব্য, তোর দুধের কেঁড়ের দিব্য, তোর ঘোলমউনির দিব্য, তোর ফাঁদি—নথের দিব্য, তুই যদি চোরকে গোরু ছেড়ে না দিস্!”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়! চোরকে গোরু ছাড়িয়া দিবে কেন?”
কমলাকান্ত বলিল, “পূর্ব্বকালে মহারাজ শ্যেনজিৎকে এক ব্রাহ্মণ বলিয়াছিল যে, ‘বৎস, গোপস্বামী ও তস্কর, ইহাদের মধ্যে যে ধেনুর দুগ্ধ পান করে, সেই তাহার যথার্থ অধিকারী। অন্যের তাহার উপর মমতা প্রকাশ করা বিড়ম্বনা মাত্র।২ এই হলো ভীষ্মদেব ঠাকুরের Hindu Law, আর ইহাই ইউরোপের International Law. যদি সভ্য এবং উন্নত হইতে চাও, তবে কাড়িয়া খাইবে। গো শব্দে ধেনুই বুঝ, আর পৃথিবীই বুঝ, ইনি তস্করভোগ্যা। সেকন্দর হইতে রণজিৎ সিংহ পর্য্যন্ত সকল তস্করই ইহার প্রমাণ। Right of Conquest যদি একটা right হয়, তবে Right of theft, কি একটা right নয়? অতএব, হে প্রসন্ন নামে গোপকন্যে! তুমি আইনমতে কার্য্য কর। ঐতিহাসিক রাজনীতির অনুবর্ত্তী হও। চোরকে গোরু ছাড়িয়া দাও।”
এই বলিয়া কমলাকান্ত সেখান হইতে চলিয়া গেল। দেখিলাম, মানুষটা নিতান্ত ক্ষেপিয়া গিয়াছে।
খোশনবীস্ জুনিয়র।