তৃতীয় দৃশ্য
লাইব্রেরি
[বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, পরেশের মা প্রবেশ করিল]
পরেশের মা। রাত্তিরে কিচ্ছু খাওনি, আজ একটু সকাল সকাল খেয়ে নাও না দিদিমণি।
[বিজয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া পুনরায় লেখায় মনঃসংযোগ করিল]
পরেশের মা। খেয়ে নিয়ে তারপরে লিখো। ওঠো—ও-মা, ডাক্তারবাবু আসচেন যে!
[বলিয়াই সরিয়া গেল। পরেশ নরেনকে পৌঁছাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। নরেন ঘরে ঢুকিয়া অদূরে একখানা চৌকি টানিয়া বসিল। তাহার মুখ শুষ্ক, চুল এলোমেলো। উদ্বেগ ও অশান্তির চিহ্ন তাহার চোখে-মুখে বিদ্যমান]
নরেন। কাল আমাকে চিনতে চাননি কেন বলুন ত! এখন থেকে চিরদিনের মত অপরিচিত হয়ে গেলুম এই বুঝি ইঙ্গিত?
বিজয়া। আপনার চোখ-মুখ এমন ধারা দেখাচ্চে কেন, অসুখ-বিসুখ করেনি ত? এত সকালে এলেন কি করে? কিছু খাওয়াও হয়নি বোধ করি?
নরেন। স্টেশনে চা খেয়েছি। ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। কাল খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি, সারা রাত কেবল এক কথাই মনে হয়েছে দোর বোধ হয় বন্ধ হলো,— দেখা আর হবে না।
বিজয়া। ও-বাড়ি থেকে কাল না খেয়ে পালিয়ে গেলেন, বাসায় ফিরে গিয়ে খেলেন না শুলেন না, আবার সকালে উঠে স্নান নেই খাওয়া নেই, এতটা পথ হাঁটা,—শরীরটা যাতে ভেঙ্গে পড়ে সেই চেষ্টাই হচ্চে বুঝি? আমাকে কি আপনি এতটুকু শান্তি দেবেন না?
নরেন। আপনি অদ্ভুত মানুষ। পরের বাড়িতে চিনতে চান না, আবার নিজের বাড়িতে এত বেশী চেনেন যে সেও আশ্চর্য ব্যাপার। কালকের কাণ্ড দেখে ভাবলুম খবর দিলে দেখা করবেন না, তাই বিনা সংবাদে পরেশের সঙ্গে এসে আপনাকে ধরেচি। একটু ক্লান্ত হয়েছি মানি, কিন্তু এসে ঠকিনি। (বিজয়া নীরবে চাহিয়া রহিল) কাল ফিরে গিয়ে দেখি সাউথ অ্যাফ্রিকা থেকে কেব্ল এসেছে, আমি চাকরি পেয়েছি। চারদিন পরে করাচী থেকে জাহাজ ছাড়বে—আজ আসতে না পারলে হয়ত আর কখনো দেখাই হতো না। আপনার বিবাহের নিমন্ত্রণপত্রও পেলুম। দেখে যাবার সৌভাগ্য হবে না, কিন্তু আমার আশীর্বাদ, আমার অকৃত্রিম শুভকামনা আপনাদের পূর্বাহ্নেই জানিয়ে যাই। আমার কথা অবিশ্বাস করবেন না এই প্রার্থনা।
বিজয়া। এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে সাউথ অ্যাফ্রিকায় চলে যাবেন? কিন্তু কেন?
নরেন। (হাসিয়া) বেশী মাইনে বলে। আমার কলকাতাও যা, সাউথ অ্যাফ্রিকাও ত তাই।
বিজয়া। তাই বৈ কি! কিন্তু নলিনী কি রাজী হয়েছেন? হলেও বা এত শীঘ্র কি করে যাবেন আমি ত ভেবে পাইনে। তাঁকে সমস্ত খুলে বলেছেন কি? আর এত দূরে যেতেই বা তিনি মত দিলেন কি করে?
নরেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখনো কাউকে সমস্ত কথা খুলে বলা হয়নি বটে, কিন্তু—
বিজয়া। কিন্তু কি? না সে কোনমতেই হতে পারবে না। আপনারা কি আমাদের বাক্স-বিছানার সমান মনে করেন যে, ইচ্ছে থাক না থাক দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে দিলেই সঙ্গে যেতে হবে? সে কিছুতেই হবে না। তাঁর অমতে কোনমতেই অত দূরে যেতে পারবেন না।
নরেন। (কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ব্যাপারটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলুন ত? পরশু না কবে এই নূতন চাকরির কথাটা দয়ালবাবুকে বলতে তিনিও চমকে উঠে এই ধরনের কি একটা আপত্তি তুললেন আমি বুঝতেই পারলুম না। এত লোকের মধ্যে নলিনীর মতামতের ওপরেই বা আমার যাওয়া-না-যাওয়া কেন নির্ভর করে, আর তিনিই বা কিসের জন্যে বাধা দেবেন,—এ-সব যে ক্রমেই হেঁয়ালি হয়ে উঠচে।কথাটা কি আমাকে খুলে বলুন ত!
বিজয়া। (ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে) তাঁর সঙ্গে একটা বিবাহের প্রস্তাব কি আপনি করেন নি?
নরেন। আমি? না কোনদিন নয়।
বিজয়া। না করে থাকলেও কি করা উচিত ছিল না? আপনার মনোভাব ত কারও কাছে গোপন নেই।
নরেন। (কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া) এ অনিষ্ট কার দ্বারা ঘটেছে আমি তাই শুধু ভাবচি। তাঁর নিজের দ্বারা কদাচ ঘটেনি। দু’জনেই জানি এ অসম্ভব।
বিজয়া। অসম্ভব কেন?
নরেন। সে থাক। একটা কারণ এই যে আমি হিন্দু এবং আমাদের জাতও এক নয়।
বিজয়া। জাত আপনি মানেন?
নরেন। মানি।
বিজয়া। আপনি শিক্ষিত হয়ে একে ভালো বলে মানেন কি করে?
নরেন। ভালো-মন্দর কথা বলিনি, জাত মানি তাই বলেচি।
বিজয়া। আচ্ছা অন্য জাতের কথা থাক, কিন্তু জাত যেখানে এক, সেখানেও কি শুধু আলাদা ধর্মমতের জন্যই বিবাহ অসম্ভব বলতে চান? আপনি কিসের হিন্দু? আপনি ত একঘরে। আপনার কাছেও কি কোন অন্য সমাজের কুমারী বিবাহযোগ্যা নয় মনে করেন? এত অহঙ্কার আপনার কিসের জন্য? আর এই যদি সত্যিকার মত, তবে সে কথা গোড়াতেই বলে দেননি কেন?
[বলিতে বলিতে তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং ইহাই গোপন করিতে সে মুখ ফিরাইয়া লইল]
নরেন। (ক্ষণকাল একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া) আপনি রাগ করে যা বলচেন এ ত আমার মত নয়।
বিজয়া। নিশ্চয় এই আপনার সত্যিকার মত।
নরেন। আমাকে পরীক্ষা করলে টের পেতেন এ আমার সত্যিকার মিথ্যেকার কোন মতই নয়। এ ছাড়া নলিনীর কথা নিয়ে কেন আপনি বৃথা কষ্ট পাচ্ছেন? আমি জানি তাঁর মন কোথায় বাঁধা এবং তিনিও নিশ্চয় বুঝবেন কেন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পালাচ্চি। আমার যাওয়া নিয়ে আপনি নিরর্থক উদ্বিগ্ন হবেন না।
বিজয়া। নিরর্থক? তাঁর অমত না হলেই আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন মনে করেন?
নরেন। না তা পারিনে। আপনার অমতেও আমার কোথাও যাওয়া চলে না। কিন্তু আপনি ত আমার সব কথাই জানেন। আমার জীবনের সাধও আপনার অজানা নয়, বিদেশে কোনদিন হয়ত সে সাধ পূর্ণ হতেও পারে, কিন্তু এ-দেশে এত বড় নিষ্কর্মা দীন-দরিদ্রের থাকা-না-থাকা সমান। আমাকে যেতে বাধা দেবেন না।
বিজয়া। আপনি দীন-দরিদ্র ত নন। আপনার সবই আছে, ইচ্ছে করলেই ফিরে নিতে পারেন।
নরেন। ইচ্ছে করলেই পারিনে বটে, কিন্তু আপনি যে দিতে চেয়েছেন সে আমার মনে আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিন্তু দেখুন, নেবারও একটা অধিকার থাকা চাই—সে অধিকার আমার নেই।
বিজয়া। (উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে করিতে উত্তেজিত-স্বরে) আছে বৈ কি। বিষয় আমার নয়, বাবার। সে আপনি জানেন। নইলে পরিহাসচ্ছলেও তাঁর যথাসর্বস্ব দাবী করার কথা মুখে আনতে পারতেন না। আমি হলে কিন্তু ঐখানেই থামতুম না। তিনি যা দিয়ে গেছেন সমস্ত জোর করে দখল করতুম, তার একতিলও ছেড়ে দিতুম না। (টেবিলে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল)
নরেন। নলিনী ঠিকই বুঝেছিল বিজয়া, আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভাবতেই পারিনি আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোককে কারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সত্যিই যদি এই অসঙ্গত খেয়াল তোমার মাথায় ঢুকেছিল শুধু একবার হুকুম করোনি কেন? আমার পক্ষে এর স্বপ্ন দেখাও যে পাগলামি বিজয়া!
[বিজয়া মুখের উপর আঁচল চাপিয়া উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে লাগিল। নরেন পিছনে পদশব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল দয়াল দাঁড়াইয়া দ্বারের কাছে। তিনি ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া বিজয়ার আসনের একান্তে বসিয়া তাহার মাথায় হাত দিলেন, বলিলেন—]
দয়াল। মা!
[বিজয়া একবার মুখ তুলিয়া দেখিল পুনরায় উপুড় হইয়া পড়িয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। দয়ালের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল, সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন—]
দয়াল। শুধু আমার দোষেই এই ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেল মা, শুধু আমি এই দুর্ঘটনা ঘটালুম। কাল তোমরা চলে গেলে নলিনীর সঙ্গে আমার এই কথাই হচ্ছিল,—সে সমস্তই জানত। কিন্তু কে ভেবেছে নরেন মনে মনে কেবল তোমাকেই,—কিন্তু নির্বোধ আমি সমস্ত ভুল বুঝে তোমাকে উলটো খবর দিয়ে এই দুঃখ ঘরে ডেকে আনলুম। এখন বুঝি আর কোন প্রতিকার নেই?(তেমনি মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে) এর কি আর কোন উপায় হতে পারে না বিজয়া?
বিজয়া।(তেমনি মুখ লুকাইয়া ভগ্নকণ্ঠে) না দয়ালবাবু, মরণ ছাড়া আর আমার নিষ্কৃতির পথ নেই।
দয়াল। ছি মা, এমন কথা বলতে নেই।
বিজয়া। আমি কথা দিয়েছি দয়ালবাবু। তাঁরা সেই কথার নির্ভর করে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে এনেছেন। এ যদি ভাঙ্গি, সংসারে আমি মুখ দেখাব কেমন করে? শুধু বাকী আছে মরণ—
[বলিতে বলিতে পুনরায় তাহার কণ্ঠরোধ হইল। দয়ালের চোখ দিয়াও আবার জল গড়াইয়া পড়িল। হাত দিয়া মুছিয়া বলিলেন—]
দয়াল। নলিনী বললে, বিজয়া কথা দিয়েছে, সই করে দিয়েছে—এ ঠিক। কিন্তু কোনটায় তার অন্তর সায় দেয়নি। তার সেই মুখের কথাটাই বড় হবে মামাবাবু, আর হৃদয় যাবে মিথ্যে হয়ে? তার মামী বললে, ওর মা নেই, বাপ নেই,—একলা মেয়ে,—আচার্য হয়ে তুমি এতবড় পাপ করো না। যে দেবতা হৃদয়ে বাদ করেন এ অধর্ম তিনি সইবেন না। সারা রাত চোখে ঘুম এল না, কেবলই মনে হয় নলিনীর কথা—মুখের বাক্যটাই বড় হবে, হৃদয় যাবে ভেসে? ভোর হতেই ছুটলুম কলকাতায়—নরেনের কাছে—
নরেন। আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন?
দয়াল। গিয়ে দেখি তুমি বাসায় নেই, খোঁজ নিয়ে গেলুম তোমার আফিসে, তারাও বললে, তুমি আসনি। ফিরে এলুম বিফল হয়ে, কিন্তু আশা ছাড়লুম না। মনে মনে বললুম, যাব বিজয়ার কাছে, বলব তাকে গিয়ে সব কথা—
[পরেশ গলা বাড়াইয়া দেখা দিল]
পরেশ। মা ঠান, একটা-দুটো বেজে গেল—তুমি না খেলে যে আমরা কেউ খেতে পাচ্চিনে।
[শুনিয়া বিজয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিল]
বিজয়া।(ব্যস্তভাবে) দয়ালবাবু, এখানেই আপনাকে স্নানাহার করতে হবে।
দয়াল। না মা, আজ তোমার আদেশ পালন করতে পারব না। তারা সব পথ চেয়ে আছে। নরেন, তোমাকেও যেতে হবে। কাল না খেয়ে চলে এসেছ, সে দুঃখ ওদের যায়নি, এস আমার সঙ্গে।
[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজয়া ইঙ্গিতে তাহাকে একপাশে ডাকিয়া লইয়া দয়ালের অগোচরে মৃদুকণ্ঠে বলিল]
বিজয়া। আমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে যাবেন না ত?
নরেন। না। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব।
বিজয়া। ভুলে যাবে না?
নরেন। (হাসিয়া) ভুলে যাব? চলুন দয়ালবাবু, আমরা যাই।
দয়াল। চল। আসি মা এখন।
[একদিক দিয়া দয়াল ও নরেন, অন্যদিক দিয়া বিজয়া প্রস্থান করিল