» » বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী

বর্ণাকার

[ গ ]

‘প্রথম প্রথম শহরে এসে আমার মত পাড়াগেঁয়ে গোঁয়ারকে বিষম বিব্রত হয়ে উঠতে হয়েছিল, বিশেষ করে শহুরে ছোকরাদের দৌরাত্মিতে। সে ব্যাটারা পাড়াগেঁয়ে ছেলেগুলোকে যেন ইঁদুর-প্যাঁচার মত পেয়ে বসে। যা হোক, অল্পদিনেই আমি শহুরে কায়দায় কেতা-দুরস্ত হয়ে উঠলুম। ক্রমে ‘অহম’ পাড়া-গেঁয়ে ভূতই আবার তাদের দলের একজন হুমরো-চুমরো ওস্তাদ ছোকরা হয়ে পড়ল। সেই–আগেকার পগেয়া–খচ্চর ছেলেগুলোই এখন আমায় বেশ একটু সমীহ করে চলতে লাগল।–বাবা, এ শর্মার কাছে বেঁড়ে-ওস্তাদি, এ ছেলে হচ্ছে অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি। দেখতে দেখতে পড়ালেখায় যত না উন্নতি করলুম, তার চেয়ে বহুল পরিমাণে উন্নতি করলুম রাজ্যের যত দুষ্টোমির গবেষণায়। তখন আমায় দেখলে বর্ধমানের মত পবিত্র স্থানও তটস্থ হয়ে উঠত। ক্রমে আমাদের মস্ত একটা দল পেকে উঠল। পুলিশের ঘাড়ে দিনকতক এগারো-ইঞ্চি ঝাড়তেই তারা আমাদের সঙ্গে গুপ্ত সন্ধি করে ফেললে। এইরূপে ক্রমেই আমি নিচু দিকে গড়িয়ে যেতে লাগলুম–তাই বলে যে আমাদের দিয়ে কোনো ভাল কাজ হয়নি, তা বলতে পারব না। মিশন, কুষ্ঠরোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতিতে আমাদের এই বওয়াটে ছেলের দল যা করেছে তার শতাংশের একাংশও করে উঠতে পারেনি ওই গোবেচারা নিরীহ ছাত্রের দল। তারা আমাদের মত অমন অদম্য উৎসাহ-ক্ষমতা পাবে কোথায়? তারা তো শুধু বই-এর পোকা। বর্ধমান যখন ডুবে যায়, তখন আমরাই শহরের সিকি লোককে বাঁচিয়েছিলুম, সে সময়ে আমাদের দলের অনেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করে, আর্তের জীবন রক্ষা করেছিল। কনফারেন্সের, সভাসমিতির চাঁদা আদায়ের প্রধান উদ্যোগ আয়োজনের প্রধান পাণ্ডা ছিলুম আমরা। আমাদেরই চেষ্টায় ‘স্পোর্টস’, ‘জিমনাস্টিক’, ‘সার্কাস’, থিয়েটার, ক্লাব প্রভৃতির আড্ডাগুলোর অস্তিত্ব অনেকদিন ধরে লোপ পায়নি।

পিতার অবস্থা খুব সচ্ছল না হলেও মাসোহারাটা ঠিক রকমেই পাঠাতেন। তিনি তো আর আমার এতদূর উন্নতির আশা করেননি, আর এত খবরও রাখতেন না। কারণ কোনো ক্লাশে আমার ‘প্রমোশন’ স্টপ হয়নি। বহু গবেষণার ফলেও হেড মাস্টার মহাশয় আবিষ্কার করতে পারেনি–আমার মত বওয়াটে ছোকরা কী করে পাসের নম্বর রাখে। ভায়া ঐখানেই তো genius-এর (প্রতিভার) পরিচয়!–‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।’ পরীক্ষার সময় চার-পাঁচজোড়া অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি আমার পেছনে লেগে থাকতই, কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর যার কূল-কিনারা পান না, তাকে ধরবেন ‘পদীর ভাই গৌরীশঙ্কর’। তাছাড়া খালি চুরি বিদ্যায় কি চলে? এতে অনেক মাথা ঘামাতে হয়। পরীক্ষকের ঘর হতে তাঁর ছেলে বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র আত্মীয়ের থ্রু দিয়ে রজত চক্রের বিনিময়ে খাতাটি বেমালুম বদলে ফেলা, প্রেস হতে প্রশ্ন চুরি, প্রভৃতি অনেক বুদ্ধিই এ শর্মার আয়ত্ত ছিল। সে-সব শুনলে তোমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠবে।–যা হোক, এই রকমেই ‘যেন তেন প্রকারেণ’ থার্ড ক্লাসের চৌকাঠে পা দিলুম গিয়ে।

বাড়ি খুব কম যেতুম, কারণ পাড়াগাঁ তখন আর ভাল লাগত না। পিতাও বাড়ি না গেলে দুঃখিত হতেন না, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমি এইবার একটা কিছু না হয়ে যাই না। আমাদের গ্রামের কুল্লে আমিই পড়তে এসেছিলুম ইংরেজি স্কুলে, তার উপর আমি নাকি পাসগুলো পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত তড়াত্তর ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছিলুম! কেবল একজনের আঁখি দুটি সর্বদাই আমার পথ পানে চেয়ে থাকত, তিনি আমার স্নেহময়ী জননী। মায়ের মন তো এত শত বোঝে না, তাই দু-মাস বাড়ি না গেলেই মা কেঁদে আকুল হতেন। সংসারে মার কাছ ভিন্ন আর কারুর কাছে একটু স্নেহ-আদর পাইনি! দুষ্ট বদমায়েস ছেলে বলে, আমায় যখন সকলেই মারত, ধমকাত, তখন মা-ই কেবল আমায় বুকে করে সান্ত্বনা দিতেন। আমার এই দুষ্টোমিটাই যেন তাঁর সবচেয়ে ভাল লাগত। আমার পিঠে প্রহারের দাগগুলোয় তেল মালিশ করে দিতে দিতে কতদিন তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রুর নদী বয়ে গেছে।

যখন থার্ড ক্লাসে উঠলুম, তখন বোধ হয় মায়ের জিদেই বাবা আমায় চতুষ্পদ করে ফেললেন, অর্থাৎ বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমি ‘কটিদেশ বন্ধনপূর্বক’ নানা ওজর আপত্তি দেখাতে লাগলুম, কিন্তু মায়ের আদালতে ও তাঁর অশ্রুজলের ওকালতিতে আমার সমস্ত ওজর বাতিল ও নামঞ্জুর হয়ে গেল। কী করি, যখন শুভদৃষ্টি হয়ে গেল, তখন তো আর কথাই নাই। তাছাড়া, কনেটি মন্দ ছিল না, আজকালকার বাজারে পাড়াগাঁয়ে এরকম কনে শয়ে একটি মেলে না। বয়সও বারো-তেরো হয়েছিল। ঐ বারো-তেরো বছরের কিশোরীটিকেই মা নাকি সোমত্থ মেয়ে দেখে বউ করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। আমারও বয়স তখন উনিশের কাছাকাছি। এতেই নাকি মেয়েমহলে মাকে কত কথা শুনতে হত। প্রথম কনে বউ একটি পুটুঁলির মত জড়সড় হয়ে তার নির্দিষ্ট একটি কোণে চুপ করে বসে থাকত। নববধূদের নাকি চোখ তেড়ে চাইতে নেই, তাই সে প্রায়ই চোখ বুঁজে থাকত। কিন্তু অনবরত চোখ বুঁজে থাকা, সেও যে এক বীভৎস ব্যাপার, তাই সে দু-একবার অন্যের অলক্ষ্যে ভয়-চকিত দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে নিত, যদি তার এই বেহায়াপনা কেউ দেখে ফেলে, তা হলেই মহাভারত অশুদ্ধ আর কি! আমাকে দেখলে তো আর কথাই নেই, নিজেকে কাছিমের মতো তৎক্ষণাৎ শাড়ি ওড়না প্রভৃতির ভিতর ছাপিয়ে ফেলত। তখন একজন প্রকাণ্ড অনুসন্ধিৎসু লোকের পক্ষেও বলা দুঃসাধ্য হয়ে উঠত, ওটা মানুষ, না কাপড়ের একটা বোঁচকা। তবে এটা আমার দৃষ্টি এড়াত না যে, আমি অন্যদিকে চাইলেই সে তার বেনারসি শাড়ির ভিতর থেকে চুরি করে আমার দিকে চেয়ে দেখত, কিন্তু আমি তার দিকে চাইতে না চাইতেই সে সটান চোখ দুটোকে বুঁজে ফেলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকত, যেন আমায় দেখবার তার আদৌ গরজ নাই। আমি মুখ টিপে হাসতে হাসতে পালিয়ে এসে উচ্চৈঃস্বরে বউয়ের লজ্জাহীনতার কথা প্রকাশ করে ফেলতুম। মা তো হেসেই অস্থির। বলতেন, হ্যাঁরে, তুই কি জনমভর এই রকম খ্যাপাই থাকবি? আমার ভগ্নিগুলি কিন্তু কিছুতেই ছাড়বার পাত্রী নন, তাঁরা বউ-এর রীতিমত কৈফিয়ত তলব করতেন। সে বেচারির তখনকার বিপদটা ভেবে আমার খুব আমোদ হত, আমি হেসে লুটোপুটি যেতুম। যাহোক, এ একটা খেলা মন্দ লাগছিল না। ক্রমে আমি বুঝতে পারলুম, কিশোরী কনে আমায় ভালবাসতে আরম্ভ করেছে। আমি কিন্তু পারতপক্ষে তাকে জ্বালাতন করতে ছাড়তুম না। আমার পাগলামির ভয়ে সে বেচারি আমার সঙ্গে চোখাচোখি চাইতে পারত না, কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে সে যে আমার পানে তার পটলচেরা চোখ দুটির ভাসা-ভাসা করুণ দৃষ্টি দিয়ে হাজারবার চেয়ে দেখত, তা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারতুম, আর গুন গুন স্বরে গান ধরে দিতুম –

‘সে যে করুণা জাগায় সকরুণ নয়ানে,

কেন, কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।’

ক্রমে আমারও ভালবাসা এই ছেলেমির মধ্যে দিয়ে এক-আধটু করে বেরিয়ে পড়তে লাগল। তারপর পরীক্ষা নিকট দেখে শুভাকাঙ্ক্ষী পিতা আমার আর বাড়িতে থাকা নিরাপদ বিবেচনা করলেন না। আমি চলে আসার দিনে আর জ্যাঠামি দিয়ে হৃদয় লুকিয়ে রাখতে পারিনি। হাসতে গিয়ে অশ্রুজলে গণ্ডস্থল প্লাবিত করেছিলুম। সজল নয়নে তার হাত দুটি ধরে বলেছিলুম, ‘আমার সকল দুষ্টোমি ক্ষমা করো লক্ষ্মীটি, আমায় মনে রেখো।’ সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলে না, কিন্তু তার ঐ চোখের জলই যে বলে দিলে সে আমায় কত ভালবেসে ফেলেছে। আমি ছেড়ে দেওয়ার পর সে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে অব্যক্ত স্বরে কাঁদতে লাগল। আমি চোখে রুমাল চেপে কোনো রকমে নিজের দুর্বলতাকে সংবরণ করে ফেললুম। কে জানত, আমার সেই প্রথম সম্ভাষণই শেষ বিদায়-সম্ভাষণ–আমার সেই প্রথম চুম্বনই শেষ চুম্বন! কারণ, আর তাকে দেখতে পাইনি। আমি চলে আসবার মাস দুই পরেই পিত্রালয়ে সে আমায় চিরজনমের মত কাঁদিয়ে চলে যায়। প্রথম যখন সংবাদটা পেলুম, তখন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হল না। এত বড় দুঃখ দিয়ে সে আমায় চলে যাবে? আমার এই আহত প্রাণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, ‘না গো না, সে মরতেই পারে না! স্বামীকে না জানিয়ে সে এমন করে চলে যেতেই পারে না। সব শত্রু হয়ে তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা জানিয়েছে’। আমি পাগলের মত রাবেয়াদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলুম। আমায় দেখে তাদের পুরোনো শোক আবার নতুন করে জেগে উঠল। বাড়িময় এক উচ্চ ক্রন্দনের হাহাকার রোল আমার হৃদয়ে বজ্রের মত এসে বাজল। আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম।–ওগো, আর তার মৌন অশ্রুজল আমার পাষাণ বক্ষ সিক্ত করবে না? একটি কথাও যে বলতে পারেনি সে। সে যাবে না, কক্ষণো যাবে না। ‘হায় অভিমানিনী! ফিরে এস! ফিরে এস।’

সে এল না, যখন নিঝুম রাত্তির, কেউ জেগে নেই, কেবল একটা ‘ফেরু’ ফেউ ফেউ চিৎকার করে আমার বক্ষের স্পন্দন দ্রুততর করে তুলছিল, তখন একবার তার গোরের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লুম–‘রাবেয়া! প্রিয়তমে! একবার ওঠ, আমি এসেছি, সকল দুষ্টোমি ছেড়ে এসেছি। আমার সারা বক্ষ জুড়ে যে তোমারই আলেখ্য আঁকা, তাই দেখাতে এই নিভৃত গোরস্থানে নীরব যামিনীতে একা এসেছি। ওঠ, অভিমানিনী রাবেয়া আমার, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না।’ কবর ধরে সমস্ত রাত্তির কাঁদলুম, রাবেয়া এল না। আমার চারিদিকে একটা ঘূর্ণিবায়ু হুহু করে কেঁদে ফিরতে লাগল, ছোট্ট শিউলি গাছ থেকে শিশিরসিক্ত ফুলগুলো আমার মাথার ঝরে পড়তে লাগল। ও আমার রাবেয়ার অশ্রুবিন্দু, না কারুর সান্ত্বনা? দু-একটা ধসে যাওয়া কবরে দপ দপ করে আলেয়ার আলো জ্বলে উঠতে লাগল। আমি শিউরে উঠলুম। তখন ভোর হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সর্বাঙ্গে তার কবরের মাটি মেখে আবার ছুটে এলুম বর্ধমানে। হায়, সে তো চলে গেল, কিন্তু আমার প্রাণে স্মৃতির যে আগুন জ্বেলে গেল সে তো আর নিবল না। সে আগুন যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আমার বুক যে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। এই প্রাণ-পোড়ানো স্মৃতির আগুন ছাড়া একটা কোনো নিদর্শন যে সে রেখে যায়নি, যাতে করে আমার প্রাণে এতটুকু সান্ত্বনা পেতুম।

সেই যে আঘাত পেলুম, তাতেই আমার বুকের পাঁজর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। আমি আর উঠতে পারলুম না।