» » বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী

বর্ণাকার

[ ঘ ]

‘দিন যায়, থেমে থাকে না। আমারও নীরস দিনগুলো কেটে যেতে লাগল কোনো রকমে। ক্রমে ফার্স্ট ক্লাসে উঠলুম। তখন অনেকটা শুধরেছি। ইতিমধ্যে বর্ধমান ‘নিউ স্কুল’ উঠে যাওয়ায়, তাছাড়া অন্য জায়গায় গেলে কতকটা প্রকৃতিস্থ হতে পারব আশায়, আমি রানিগঞ্জে এসে পড়তে লাগলুম। আমাদের ভূতপূর্ব হেডমাস্টার রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ-স্কুলের হেডমাস্টারি পদ পেয়েছিলেন। তাঁর পুরোনো ছাত্র বলে তিনি আমায় স্নেহের চক্ষে দেখতে লাগলেন, আমিও পড়া-লেখায় একটু মন দিলুম। কিন্তু ইতিমধ্যে আর একটা বিভ্রাট বেধে গেল, আমার আবার বিয়ে হয়ে গেল। তুমি শুনে আশ্চর্য হবে, আমি এ বিয়েতে কোনো ওজর আপত্তি করিনি। তখন আমার মধ্যে সে উৎসাহ সে একগুঁয়েমি আর ছিল না। রাবেয়ার মৃত্যুর সঙ্গে আমি যেন একেবারেই পরনির্ভরশীল বালকের মত হয়ে পড়লুম। যে যা বলত তাতে উদাসীনের মতো ‘হ্যাঁ’ বলে দিতুম। কোনো জিনিস তলিয়ে বুঝবার বা নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করবার ক্ষমতা যেন তখন আমার আদৌ ছিল না। আমার পাগলামি, হাসি সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এইসব দেখেই বোধ হয় মা আমার আবার বে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আমি আরও ভেবেছিলুম হয়ত এই নবোঢ়ার মধ্যেই আমার রাবেয়াকে ফিরে পাব, আর তার স্নেহকোমল স্পর্শ হয়ত আমার বুকের দারুণ শোক-যন্ত্রণার মধ্যে শান্তি আনতে পারবে। কিন্তু হায়! যার জীবন চিরকালই এই রকম বিষাদময় হবে বলে বিধাতার মন্তব্য-বহিতে লিখিত হয়ে গেছে, তার ‘সবর’ ও ‘শোকর’ ভিন্ন নান্যগতি। তার কপাল চিরদিনই পুড়বে। নববধূ সখিনা দেখতে শুনতে মন্দ নয়, তাই বলে ডানাকাটা পরীও নয়; আর আমার নিজের চেহারার গুণ বিচার না করে ওরকম একটি পরীর কামনা করাও অন্যায় ও ধৃষ্টতা। গুণও আমার তুলনায় অনেক বেশি, সেসব বিষয়ে কোথাও খুঁত ছিল না। আজকালকার ছোকরারা নিতান্ত বেহায়ার মত নিজে বউ পছন্দ করে আনে। নিজের শরীর যে আবলুস কাঠের চেয়েও কালো বা কেঁদ কাঠের চেয়েও এবড়োখেবড়ো সেদিকে দৃষ্টি নেই, কিন্তু বউটির হওয়া চাই দস্তুরমত দুধে-আলতার রং, হরিণের মত নয়ন, অন্তত পটলচেরা তো চাই-ই, সিংহের মত কটিদেশ, চাঁদের মত মুখ, কোকিলের মত কণ্ঠস্বর, রাজহংসীর মত গমন; রাতুল চরণকমল, কারণ মানভঞ্জনের সময় যদি ‘দেহি পদপল্লবম্ উদারম্’ বলে তাঁর চরণ ধরে ধন্না দিতে হয়, আর সেই যে চরণ যদি God forbid (খোদা বা করেন) গদাধরের পিসির ঠ্যাং-এর মতই শক্ত কাঠপারা হয়, তাহলে বেচারা একটা আরাম পাওয়া হতে যে বঞ্চিত হয়, আর বেজায় রসভঙ্গও হয়। তৎসঙ্গে আরও কত কী কবিপ্রসিদ্ধির চিজবস্তু, সেসব আমার আর এখন ইয়াদ নেই। এইসব বোকারা ভুলেও ভাবে না যে, মেয়েগুলো নিতান্ত সতীলক্ষ্মী গোবেচারার জাত হলেও তাদেরও একটা পছন্দ আছে। তারাও ভাল বর পেতে চায়। আমরা যত সব পুরুষ মানুষ বেজায় স্বার্থপর বলে তাদের কোনো কষ্ট দেখেও দেখি নে। মেয়েদের ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ ভাব আমি বিলকুল না-পছন্দ করি। অন্তত যার সঙ্গে সারা জীবনটা কাটাতে হবে, পরোক্ষেও যদি তার সম্বন্ধে বেচারিরা কিছু বলতে কইতে না পায়, তবে তাদের পোড়াকপালি নাম সার্থক হয়েছে বলতে হবে। থাক, আমার মত চুনোপুঁটির এ-সব ছেঁদো কথায় বিজ্ঞ সমাজ কেয়ার তো করবেনই না, অধিকন্তু হয়ত আমার মস্তক লোমশূন্য করে তাতে কোনো বিশেষ পদার্থ ঢেলে দিয়ে তাঁদের সীমানার বাইরে তাড়িয়ে দেবেন। অতএব আমি নিজের কথাই বলে যাই।

নব পরিণীতা সখিনার এসব গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে ভালবাসতে পারলুম না। অনেক ‘রিহার্স্যাল’ দিলুম, কিছুতেই কিছু হল না। হৃদয় নিয়ে এ ছিনিমিনি খেলার অভিনয় যেন আর ভাল লাগছিল না। তাছাড়া তুমি বললে হয়ত বিশ্বাস করবে না, রাবেয়া যেন আমার হৃদয় জুড়ে রাণীর মত সিংহাসন পেতে বসেছিল, সেখানে অন্য কারুর প্রবেশাধিকার ছিল না। একনিষ্ঠ প্রেমে মানুষকে এতটা আত্মহারা যদি না করে ফেলত তবে ‘কায়েস’ ‘মজনু’ হয়ে লায়লীর জন্য এমন করে বনে-পাহাড়ে ছুটে বেড়াত না, ফরহাদের ও-রকম পরিণাম হত না। সখিনা কত ব্যথা পাচ্ছে বুঝতে পারতুম, কিন্তু হায়, বুঝেও কিছু করতে পারতুম না। বিবাহিতা পত্নীর প্রতি কর্তব্যের অবহেলা আমার বুকে কাঁটার মত বিঁধছিল। মা ক্ষুণ্ন হলেন, বোনেরা বউকেই দোষী সাব্যস্ত করে তালিম করতে লাগল। কিন্তু কোথায় কী ফাঁক রয়ে গেল জানি না, কিছুতেই তার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের মিশ খেল না। সে কেঁদে মাটি ভিজিয়ে দিলে, তবু মন ভিজল না। অনুশোচনার ও বাক্যজ্বালার যন্ত্রণায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলুম। রাবেয়া আমার বুকে যে আঘাত করে গিয়েছিল তাই সইতে পারছিলুম না, তার উপর–হা খোদা, এ কী করলুম নিতান্ত অর্বাচীনের মত? এ হতভাগিনীর জীবন কেন আমার সঙ্গে এমন করে জড়িয়ে ফেললুম? অসহ্য এই বৃশ্চিক যন্ত্রণা কাঁটার মত আমার আগেকার আঘাতটায় খোঁচা মারতে লাগল। আমি পাগল হয়ে যাওয়ার মত হলুম। এরই মধ্যে রাণীগঞ্জে এসে ‘টেস্ট একজামিনেশন’ দিলুম। সমস্ত বছর হট্টগোলে কাটিয়েছি। পাশ করব কোত্থেকে? আগেকার সে চুরি বিদ্যায়ও প্রবৃত্তি ছিল না–অর্থাৎ এখন সাফ বুঝতে পাচ্ছ যে, টেস্টে এলাউ হইনি; সুতরাং ওটা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এই শুভ সংবাদ বাবার কর্ণগোচর হবা মাত্র তিনি কিঞ্চিদধিক এক দিস্তা কাগজ খরচ করে আমায় বিচিত্র সম্ভাষণের উপসংহারে জানিয়ে দিলেন যে, আমার মত কুপুত্তুরের লেখাপড়া ঐখানেই খতম হবে তা তিনি বহু পূর্বেই আন্দাজ করে রেখেছিলেন,–অনর্থক এক রাশ টাকা জলে ফেলে দিলেন ইত্যাদি। আমার জানটা তেতবেরক্ত হয়ে উঠল। ‘দুত্তোর’ বলে দফতর গুটালুম। পরে, যা মনে আসতে লাগল তাই করতে লাগলুম। লোকে আমায় বহরমপুর যাওয়ার জন্য বিনা ফি-তে যেচে উপদেশ দিতে লাগল। আমি তাদের কথায় ‘ড্যামকেয়ার’ করে দিনরাত বোঁ হয়ে রইলুম। দু-চারদিন সইতে সইতে শেষে একদিন বোর্ডিং সুপারিনটেণ্ডেণ্ট মশাই শুভক্ষণে আমায় অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় দিলেন। আমি ফের বর্ধমানে চলে এলুম। আমাদের ছত্রভঙ্গদলের ভূতপূর্ব গুণ্ডাগণ আমায় সাদরে বরণ করে নিল। পিতা সব শুনে আমায় ত্যাজ্যপুত্র করলেন। এক বৎসর পরে খবর এল সখিনা আমায় নিষ্ঠুর উপহাস করে অজানার রাজ্যে চলে গেছে। মরবার সময়ও নাকি হতভাগিণী আমার মত পাপিষ্ঠের চরণ-ধুলোর জন্য কেঁদেছে, আমার ছেঁড়া পুরোনো একটা ফটো বুকে ধরে মরেছে। ক্রমেই আমার রাস্তা ফরসা হতে লাগল। আরও ছয় মাস পর মা-ও চলে গেলেন। আমি তখন অট্টহাসি হেসে বোতলের পর বোতল উড়াতে লাগলুম। তারপর শুভক্ষণে পল্টনে এসে সেঁদিয়ে পড়লুম বোম কেদারনাথ বলে। আর এক গ্লাস জল দিতে পার ভাই?