☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
৯
শুনিয়াছি, মোহনলালের পিতা খুব বন্ধুবৎসল ছিলেন। সেই গুণ অনেকখানি মোহনলালের মধ্যে বর্তাইয়াছে। তার মত বন্ধু খুব কমই মেলে। যে কোন ব্যাপারে অসুবিধায় পড়িলে মোহনলাল তাহার সুরাহা করিয়া দিবে। “মোহনলাল; আজ টাকা নাই, এখনই আমার এক-শ টাকার প্রয়োজন।” মোহনলাল হাস্যমুখে বলে, “কোন চিন্তা নেই। এখনই এনে দিচ্ছি।” “মোহনলাল, আমার রিসার্চ-স্কলারশিপের রিপোর্ট কালই দাখিল করতে হবে। এতগুলো পৃষ্ঠা কি করে নকল করব একদিনের মধ্যে?” মোহনলাল বলে, “কোন চিন্তা নাই। আমি নকল করিয়ে দিচ্ছি।” মোহনলাল আমার কাছ হইতে কাগজ লইয়া তার মামাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিলি করিয়া দিল। এক রাতের মধ্যে সমস্ত কাজ হইয়া গেল।
“মোহনলাল, টাকা নেই, রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার দেখব।” মোহনলাল পিছনের দরজা দিয়া আমাকে ভিতরে ঢুকাইয়া দিয়া আসিল।
বই-এর পাণ্ডুলিপি তৈরী করা, প্রচ্ছদপটে ছবি আঁকান প্রভৃতি কত কাজই সে আমাকে হাসিমুখে করিয়া দিয়াছে! তার সঙ্গে মতের কোন অমিল হইত না কোনদিন। আমি যদি বলিতাম “হু” সে বলিত “হ্যঁ।”। কোনখানে বেড়াইতে যাইতে, কাউকে অসময়ে গিয়া বিরক্ত করিতে—যখন যে-কোন অসম্ভব কাজে তাহাকে ডাকিয়াছি, সে বাতাসের আগে আসিয়া সাড়া দিয়াছে।
একদিন জ্যোৎস্নারাত। আমরা দুইজনে বসিয়া গল্প করিতেছি। রাত প্রায় একটা। আমাদের খেয়াল হইল, চল, আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে ঘুম হইতে জাগাইয়া দিয়া আসি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি হইতে রিকসায় চাপিয়া চলিলাম পার্ক সার্কাস। বৌবাজার হইতে দুইজনে দুইগাছি ভাল বেলফুলের গোড়ের মালা কিনিয়া লইলাম।
আব্বাসউদ্দীন থাকিত কড়েয়া রোডের এক মেসে। বড়ই ঘুমকাতুরে। ঘুম হইতে জাগাইতে সেত রাগিয়া অস্থির। আমরা অভিনয়ের ভঙ্গীতে বলিলাম, “হে গায়ক প্রবর, আজ আমরা দুই বন্ধুতে স্থির করিলাম, অখ্যাতবিখ্যাত আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে রজনী যোগে গিয়া ফুলের মালা পরাইয়া আসিব। অতএব আপনি ক্রোধ সংবরণ করিয়া এই মাল্য গ্রহণ করুন।”
দুই জনে তাহার গলায় দুইটি মালা পরাইয়া দিলাম। বন্ধুবর হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। তারপর বহু ক্ষণ গল্প গুজব করিয়া জোড়াসাঁকো ফিরিয়া আসিলাম। পথের দুই ধারে ফুটপাথের উপর সারি সারি গৃহহীন সর্বহারারা শুইয়া আছে। মাঝে মাঝে রিক্সা থামাইয়া বহুক্ষণ তাহাদের দেখিলাম। মোহনলাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, “এদের কবিতা কোন কবি লিখবে?”
মোহনলালকে লইয়া আরও কত আমোদ করিয়াছি! কোন কোন দিন আমাদের নাচে পাইত। নাচের উপযুক্ত গান তৈরী করিয়া তখন তাহাতে সুর সংযোগ করিয়া মোহনলালের ভাইদের শিখাইয়া দিতাম। কেহ একটা ঢোলক আনিয়া বাজাইতে বসিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের নাচ চলিত। এই আসরে নরেন্দ্রনাথ, ব্রতীন্দ্রনাথও মাঝে মাঝে আসিয়া যোগ দিতেন।
দোলের দিনে ওদের বাড়ি খুব আমোদ হইত। একবার দোলের সময় আমি ঠাকুরবাড়ির সবাইকে তামাসা করিয়া একটি কবিগান রচনা করিয়া ছিলাম। বাড়ির ছেলেরা সেই কবিগানের ধুয়া ধরিয়াছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম—
ব্রতীনবাবু সর্বসময়
ব্যস্ত আছেন ভারি,
সবই কিন্তু পরের তরে
কোন কাজ নেই তারি
কনকবাবু অধিক সময় জমিদারির কাজ দেখিতে মফস্বলে ঘোরেন, মাঝে মাঝে জোড়াসাঁকো আসিয়া উদয় হন; কে খুব খাইতে পছন্দ করে কে গান গাহিতে ঘাড় নাচায়; কে সারা দিন বসিয়া শুধু নভেল পড়ে—ইত্যাদির বর্ণনায় গানটি ভরা ছিল। আমরা নাচিয়া নাচিয়া সেই গান গাহিয়া খুব আনন্দ উপভোগ করিয়াছিলাম।
নীচের তলার ঘরে মাঝে মাঝে বসিয়া আমরা যত সব আজগুবি গবেষণা করিতাম। এই কাজে ব্রতীন্দ্রনাথের বুদ্ধি ছিল খুব প্রখর। একদিন আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হইল—রবীন্দ্রনাথ কবি নন, একেবারেই নকল—তাহাই প্রমাণ করা। এক একটি করিয়া, পয়েন্ট টোকা হইল–
১। রবীন্দ্রনাথ খুব ভাল খাইতে পছন্দ করেন। কোন কবিই বেশি খান না।
২। কবিদের দেখা যায়, সন্ধ্যা-সকাল আকাশের দিকে বিভোর ভাবে চাহিয়া থাকিতে। রবীন্দ্রনাথ শেষরাত্রে উঠিয় স্নান করিয়া অনেক গুলি সন্দেশ খাইয়া লিখিতে বসেন। সুতরাং তিনি যাহা লেখেন, তাহা সেই সন্দেশ খাওয়ারই প্রভাব। সত্য সত্য তাহার ভিতরে কোন কাব্য নাই।
৩। বহু বৈষ্ণব কবিতা তিনি নকল করিয়া মারিয়া দিয়াছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তার ‘পশারিণী’ কবিতার উল্লেখ করা যাইতে পারে। তিনি মাঝে মাঝে কাসিয়া উঠেন। তাহাও নিতান্ত অকবি-জনোচিত।
৪। যেহেতু তিনি জমিদারি কার্যে অত্যন্ত সুদক্ষ, সুতরাং কবি হইতে পারেন না।
৫। তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমেই কর্কশ হইয়া যাইতেছে। কেমন ভাবলেশহীন। ইহা সত্যকার কবির লক্ষণ নয়।
এইভাবে যে যত পয়েন্ট বাহির করিতে পারি, তাহার তত জিত হইত। এই সব আলোচনার পরে রবীন্দ্রনাথের গান বিকৃত করিয়া গাওয়া হইত। এই কাজে আমি ছিলাম বোধহয় সব চেয়ে অগ্রণী। আমার না ছিল তাল-জ্ঞান, না ছিল সুর-জ্ঞান। রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে ভাটিয়ালি সুরে গাহিয়া সকলের হাস্যের উদ্রেক করিতাম। এই জন্য দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অতর্কিতে একদিন আমাদের সভায় ঢুকিয়া আমাকে তাড়া করিয়াছিলেন। তার সব চাইতে ক্রোধের কারণ, আমার বেতালা সুরে গান গাওয়া। অন্য কোন কারণে কেহ কোনদিন তাঁকে রাগিতে দেখেন নাই, কিন্তু তার সামনে বেতালা বেসুরো করিয়া কেহ গান গাহিলে তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করিয়াই আমরা বেতালা সুরে গান গাহিয়া তাকে রাগাইয়া দিতাম। আমার রচিত গ্রাম-গান তিনি খুব ভালবাসিতেন। তিনি আমাকে কথা দিয়াছিলেন, “তোমার গ্রাম্য-গানগুলির স্বরলিপি করিয়া আমি একটি বই তৈরী করিয়া দিব।” কিন্তু অকালে তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় ইহা ঘটিয়া উঠে নাই।
একবার নিখিলবঙ্গ সঙ্গীত-সম্মেলন হয়। খুব সম্ভব ১৯৩০ সনে। দিনু দা সেই সম্মেলনে পল্লীসঙ্গীত বিভাগে আমাকে বিচারক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির সময় এই সম্মেলন বসে। তখন আমি বাড়ি চলিয়া আসি। সেইজন্য উহাতে যোগদান করিতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথের মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর দল লইয়া কলিকাতায় অভিনয় করিতে আসিতেন। এই উপলক্ষে সাত-আট দিন ঠাকুরবাড়িতে অনলরত রিহার্সাল। বাহিরের কাহারো প্রবেশ করিবার উপায় ছিল না। দিনু-দাকে অনুরোধ করিতেই তিনি আমাকে রিহার্সাল শুনিবার অনুমতি দিলেন।
দিনু-দার পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের গানের মহড়া যাঁহারা না শুনিয়াছেন, তাঁহারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের একটা খুব বড় জিনিস। উপভোগ করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন গান দিনু-দা শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের শিখাইতেন। তাঁহার কণ্ঠ হইতে গানের পাখি বাহির হইয়া নানা কণ্ঠে সুরের ডানা মেলিয়া ঘুরিত। এ যেন পক্ষি-মাতা তার শাবকগুলিকে ওড়া শিখাইত। তাদের ভীরু অপটু সুরের সঙ্গে তাঁর সুদক্ষ সুর মিলিয়া রিহার্সেলের আসরে যে অপূর্ব ভাব-রসের উদ্রেক হইত, তাহার তুলনা মেলে না। সেই ভাব-সমাবেশ প্রতিদিন গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইত। এক একটি রিহার্সেলে গান এমনই জমিত যে, স্টেজে প্রকৃত গানের আসরে তাহার শতাংশের এক অংশও জমিত না। প্রতিদিন আমি দিনুদার গানের রিহার্সেলের সময় বসিয়া অপূর্ব সঙ্গীত-সুধা উপভোগ করিতাম।