» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

খিড়কির দরজায় মোহনলাল দাঁড়াইয়াছিল। তাহাকে ঝুলিটি দিয়া ঢুলিতে ঢুলিতে আমি সদর-দরজা দিয়া ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করিলাম। পূর্বনির্দেশমত মোহনলালের মামাতোভাইরা সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পুষ্পচন্দন লইয়া ঘেটু তারই একপাশে। আমাকে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা’ হলঘরে একটা জলচৌকির উপর বসিতে দেওয়া হইল। মনোজ অতি ভক্তিভরে চাদর দিয়া বসিবার জায়গাটি মুছিয়া দিল। আমি বসিতেই মোহনলালের ভাইরা পূর্ব নির্দেশমত একে একে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিল। একটি থালাভরা সন্দেশ আমার সামনে রাখিয়া ঘেটু আসিয়া আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া কহিল, “দেবতা, আপনি গ্রহণ করুন।”

আমি স্বর্গীয় হাসি হাসিয়া বলিলাম, “এসব কেন এনেছ? আমি ত মা কালীকে না দিয়ে কিছু গ্রহণ করিনে। মা-কালী আসবেন সন্ধ্যার পরে।” ঘেটুর মুখ শুকনা হইয়া গেল। জোড়হাতে বলিল, “আপনি শুধু একটু স্পর্শ করে দেন। ভক্তের মনে কষ্ট দেবেন না।”

অগত্যা আমি সেই সন্দেশ স্পর্শ করিয়া দিলাম। তারপর সমবেত ভক্তজনেরা তাহা কাড়াকাড়ি করিয়া ভাগ করিয়া খাইল। গম্ভীর হইয়া বসিয়া থাকিলেও মাঝে মাঝে হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিতেছিলাম না। মনোজ তাহার ব্যাখ্যা করিল, “উনি দিব্য ধামে আছেন কিনা, তাই মাঝে মাঝে দেবতাদের নানা ঘটনা দেখিয়া হাসিয়া উঠেন।”

এমন সময় ঘেটুর বড় ভাই বিপুল সাহা আসিয়া আমাকে প্রণাম করিলেন। আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলাম, “তোমার নাম বিপুল সাহা। একটা খুব বড় মামলার উকিল হয়েছ।”

বিপুলবাবু জোড়হাতে বলিলেন, “গুরুদেব আপনি দয়া করে আমাকেও যদি কালী দেখান, যারপর নাই খুসি হব।”

আমি বলিলাম, “কালী দেখতে হলে সাত দিন নিরামিষ খেতে হয়। তুমি তা করনি?”

বিপুলবাবু উকিল মানুষ। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই যে সব ছেলের দল, ওরাও কি মাছ-মাংস খায়নি?”

তাহারা একবাক্যে সাক্ষ্য দিল, গত সাতদিন তাহারা মাছ-মাংস স্পর্শ করে নাই।

এমন সময় মনোজ গল্প ফাঁদিল” “গুরুদেব যাকে তাকে কালী দেখান না। ইন্দোরের মহারাজা সেবার গুরুদেবের পা ধরে কত কাঁদলেন, কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন না। আজ ঘেটুবাবুর বড়ই পুণ্যফল যে, তিনি কালী দেখতে পাবেন। গুরুদেব, কাল ধ্যানে বসে বুদ্ধদেবের সঙ্গে আপনার কি আলাপ হয়েছিল—একবার বলুন না?”

আমি লজ্জিত ভাবে বলিলাম, “ওসব কেন তুলছ? বুদ্ধদেব বড়  কথা নয়। সেদিন চৌঠা আসমানের পরে যিশুখৃস্টের সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে বললেন, কালী-সাধনাটা আমাকে শিখিয়ে যাও।”

এই বলিয়া আমি ধ্যানমগ্ন হইলাম। মনোজ চাদর দিয়া আমাকে বাতাস করিতে লাগিল।

বিপুলবাবু মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া গেলেন। মোহনলাল আসিয়া আমার কানে কানে বলিল, “সর্বনাশ, গবামামা বের হয়ে গেছে। কালী সাজানো হবে না। সুজনকে সাহেব সাজিয়ে আনতে পারি। ভাতে তাকে কেউ চিনতে পারবে না।”

আমি বলিলাম, “বেশ তাই কর।”

ধীরে ধীরে রাত্রির অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল। আমি ঘেটুকে ডাকিয়া বলিলাম, “ঘেটু, তুমি মা-কালীকে কেন দেখতে চাও?”

ঘেটু বলিল, “মা-কালীর কাছে আমি একটি চাকরির বর চাই। অনেক দিন আমি বেকার।”

আমি খুব স্নেহের সঙ্গে বলিলাম, “চাকরি ত মা-কালীকে দিয়ে হবে না। আমি একজন সাহেব ভুত আনি। তার কাছে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।”

ঘেটু গদগদ ভাবে বলিল, “দাদা, আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই করুন।”

রবীন্দ্রনাথের অন্দরবাড়িতে যেখানে অভিনয় হয়, তার উত্তর দিকের ঘরে একটি বেদী আছে। সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সাধনা করিতেন। মোহনলালের ব্যবস্থা মত সেই বেদীর উপর আমার কালী-সাধনার আসন তৈরী হইল। দক্ষিণ দিকে সৌম্যেন ঠাকুরদের বারান্দায় এমনভাবে আলো জ্বালান হইল যেন এ পাশের অন্ধকার আরও গাঢ় দেখায়। চারিদিকে অন্ধকার। সেই বেদীর উপর আসিয়া আমি বসিলাম। ভক্তমণ্ডলী আমার দুইদিকে সামনে বসিল, ঘেটু আমার পাশে। সে কেবল বার বার আমার পায়ে লুটাইয়া পড়িতেছে আর গদগদ কণ্ঠে বলিতেছে, “দাদা, আপনি ভগবান।”

বাড়ির মেয়েরা উপরতলার গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়াইয়া এই দৃশ্য উপভোগ করিতেছেন।

একবার আমি এক তান্ত্রিক সাধুর শিষ্য হইয়া শ্মশানে শ্মশানে ঘুরিয়াছিলাম। তাহা ছাড়া অনেক ভূতান্তরী মন্ত্র ও আমার জানা ছিল। কতক পূর্বস্মৃতি হইতে, কতক উপস্থিত তৈরি করিয়া আমি ডাক ছাড়িয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম। প্রথম শরীর-বন্ধন করিয়া সরিষা-চালান দিলাম। পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তর-মেরুতে, দক্ষিণ মেরুতে যোলশ ডাক-ডাকিনীর সঙ্গে আমার সরিষা উধাও হইয়া ছুটিল–

পিঙ্গলবরণী দেবী পিঙ্গল পিঙ্গল জটা

অমাবস্যার রাতে যেন কালো মেঘের ঘটা

সেইখানে যায়া সরষে ইতিউতি চায়,

কাটা মুণ্ডু হতে দেবীর রক্ত ভেসে যায়।

এইভাবে সরষে ঘুরিতে ঘুরিতে–

তারও পূবেতে আছে একখানা শ্বেত দ্বীপ,

নীল সমুদ্রের উপরে যেন সাদা টিপ।

সেইখান থেকে আয় আয়, দেও-দানা আয়,

নীলা আসমান তোর ভাইঙ্গা পড়ুক গায়।

এই মন্ত্র পড়িতে পড়িতে খট করিয়া একটি শব্দ হইল। পুর্ব নির্দেশমত তিন চারজন ভক্ত অজ্ঞান হইয়া পড়িল। মোহনলাল হাত জোড় করিয়া বলিল, “হায়, হায়, গুরুদেব, এখন কি করি? এরা যে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।”

আমি বলিলাম, “কোন চিন্তা করো না। যতক্ষণ আমি আছি, কোন ভয় নাই।”

পা দিয়া এক এক জনকে ধাক্কা দিতেই তারা উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘেটু তখন ভয়ে কাঁপিতেছে, আর বিড়বিড় করিতেছে। মোহনলাল তার পাশে বসিয়া আছে স্মেলিংসল্টের শিশি লইয়া। যদি অজ্ঞান হইয়া পড়ে, তখন উহা ব্যবহার করা যাইবে।

আমি আরও জোরে জোরে মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম।

“আয় আয়—কালকেচণ্ডী আয়, শ্মশানকালী আয়—”

অদূরে সামনে আসিয়া সাহেবভূত খাড়া হইল। উপস্থিত ভক্তমণ্ডলীর কাছে আমি বলিলাম, “যার যা খাবার ইচ্ছে, সাহেব ভূতের কাছে চেয়ে নাও।”

একজন বলিল, “আমি আম খাব।” কেউ বলিল, “আমি বিস্কুট খাব।” বলিতে না বলিতে সাহেব তার ঝুলির ভিতর হইতে যে যাহা চায়, ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়। বিস্ময়ে ঘেটু কেবল কাঁপিতেছে। তাকে বলিলাম, “ঘেটু, তুমি কিছু চাও।”

মোহনলাল তাহার কানে কানে বলিয়া দিল, “বল, আমি লকেটফল চাই।”

ঘেটু তাহার নির্দেশমত বলিল “আমি লকেটফল চাই।”

আমি, ভুতকে বলিলাম, “শিগগীর লকেটফল নিয়ে এসো।” ভুত ইসারা করিয়া ‘না, না’ বলে। আমি বলি, “তা হবে না। তুমি এখনই সেই শ্বেতদ্বীপে গিয়ে লকেটফল নিয়ে এসো। অনেক দূর–কষ্ট হবে, তাই বলছ? কিন্তু মা-কালী মুণ্ড চিবিয়ে খাবে যদি আমার  কথা না শোন। দোহাই তোর দেব-দেবতার, দোহাই তোর কার্তিকগণেশের। আমার কথা রাখ।”

তখন ভূত অন্ধকারে মিশিয়া গিয়া খানিক বাদে একছড়া লকেটফল ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। ঘেটু তাহা পাইয়া আমার পায়ের উপর পড়িয়া কেবল বলিতে লাগিল, “দাদা আপনি মানুষ নন। সাক্ষাৎ ভগবান।”

তখন আমি ভূতকে বলিলাম, “তুই আরও এগিয়ে আয়। ঘেটুকে আশীর্বাদ করে যা। ঘেটুর যেন চাকরি হয়।”

ভূত আসিয়া ঘেটুর মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিল। ঘেটু তবু সাহেববেশধারী সুজনকে চিনিতে পারিল না।

তখন আমি ঘেটুকে কাছে ডাকিয়া বলিলাম, “ভাই ঘেটু, সবই অভিনয়। তোমাকে নিয়ে আজ আমরা কিছু মজা করলাম। তোমার বন্ধু সুজন সাহেব-ভূত সেজে তোমাকে আশীর্বাদ করে গেল। তুমি কিন্তু চিনতে পারনি।”

কিন্তু ঘেটুর চেহারায় কোনও রূপান্তর হইল না। সে আমার কথা বিশ্বাস করিল না। পরদিন যখন সে সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিল, লোকের ঠাট্টার ভয়ে সাত-আটদিন ঘরে দরজা দিয়া রহিল। এখনো ঘেটুর সঙ্গে দেখা হইলে সেই পূর্ব রহস্যের হাসিতামাসার রঙটুকু আমরা উপভোগ করি।

এই রহস্যনাট্যের অন্যান্য অংশে যাহারা অভিনয় করিয়াছিল, তাদের সঙ্গে দেখা হইলেও এই ঘটনাটির উল্লেখ করিয়া আমরা পরস্পর আনন্দ লাভ করি। দশে মিলিয়া ভগবানকে কেমন করিয়া ভূত বানান যায়, এই ঘটনাটি তার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।