» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

কলিকাতায় আসিয়া এখন ঘন ঘন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার দেখা হইতে লাগিল। একদিন তাহাকে বলিলাম, “দাদা মশাই, শুনেছি আপনাদের বাড়িতে লাল, ইয়াকুৎ, জহরৎ বহু রকমের মণিমাণিক্য আছে। রূপকথায় এগুলোর নাম শুনেছি। কিন্তু চক্ষে দেখিনি।”

তিনি একটু ভাবিয়া বলিলেন “তুমি দেখতে চাও?”

আমি বলিলাম, “যদি দেখান, বড় খুশি হব।”

তিনি বলিলেন, “পরশু সকালবেলা এসো। সকালের আলো না হলে মণিমাণিক্যগুলির রোশনাই খোলে না।”

নির্দিষ্ট সময়ে আমি তার সামনে উপস্থিত হইলাম। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “এসেছ? আমার সঙ্গে এসো।”

তাঁর সঙ্গে চলিলাম। আমার মন রহস্যে ভরপুর। রূপকথার আলাদীনের মত আমি যেন অতীতের কোন রাজা-বাদশার অন্ধকার ধনাগারে প্রবেশ করিতেছি।

ঘরের এক কোণে একটি প্রকাণ্ড বাক্স। আমাকে তাহার ডালাটি তুলিয়া ধরিতে বলিলেন। ডালা তুলিয়া ধরিতে সেই বাক্সের ভিতর হইতে তিন-চারটি বাক্স বাহির করিলেন। প্রত্যেকটি বাক্স ভর্তি নুড়ি-পাথর—নানা আকৃতির, নানা রঙের।

তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দেখ, কত মণিমাণিক্য এখানে জড় হয়ে আছে।”

বাক্স হইতে এক একটি পাথর দেখাইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “এইটে লাল, এইটে ইয়াকুৎ, এইটে জহরৎ, আর দেখ এইটে হল নীলমণি। শ্রীকৃষ্ণের বুকে লটকান থাকত।”

বিস্ময়ে আমি হতবাক। অনেকক্ষণ সেই মণিমাণিক্য দেখিয়া বলিলাম, “আচ্ছা দাদামশাই, এগুলো এখানে এমন অসাবধানে রেখেছেন, বাক্সটায় তালা-চাবি পর্যন্ত লাগাননি। চোরে যদি চুরি করে নিয়ে যায়?”

নির্বিকার ভাবে তিনি বলিলেন, “চোরের এগুলো নুড়ি-পাথর না মণিমাণিক্য তা জানার চোখ থাকা চাই। তাছাড়া সাবধানে কোন জিনিস রাখলেই চোরের উপদ্রব হয় বেশি। দেখ না, সকালবেলা ঘাসের শিশিরফোঁটায় কত মণিমাণিক্য জড় হয়। কেউ চুরি করে না। যদি তালা-চাবি দিয়ে কেউ বাক্সে আটকে রাখত, তবে রাতারাতি চুরি হয়ে যেত।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা দাদামশাই, এই সব মণিমাণিক্য কত কালের?”

তিনি বলিলেন “বহু বহু আগের। হাজার হাজার বছর আগে এরা তৈরি হয়েছিল সমুদ্রের তলে। ভাল  কথা, ওহে জসীমিঞা, তুমি ত দেখে গেলে আমার ধনরত্ন। কাউকে যেন বলে দিও না।”

আমি নীরবে সম্মতি জানাইলাম। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তাঁর সামনে লুটাইয়া পড়িতে ইচ্ছা হইল। তিনি আমাকে কতই না বিশ্বাস করিয়াছেন। এই গুপ্ত ধনরত্নের কথা হয়ত তার ছেলেমেয়েরাও জানে না। তাই কিনা তিনি আমাকে দেখাইলেন। আমি বলিলাম, “দাদা মশাই, অন্ধকারে এগুলো ভাল মত দেখতে পাচ্ছিনা। একটু বারান্দায় নিয়ে দেখব?”

হাসিয়া বলিলেন, “তা দেখ।”

আমি মণিমাণিক্য-ভরা দুই-তিনটি বাক্স বারান্দায় আনিয়া দেখিয়া অবাক হইলাম। ও মা, এ যে সবই নুড়ি-পাথর। মোহনলাল সামনে দিয়া যাইতেছিল, তিনি ডাকিয়া বলিলেন, “জসীমিঞা রোজ আমাকে ধরে মণিমাণিক্য দেখবে। আজ তাকে এগুলো দেখিয়ে দিলাম।”

মোহনলাল মৃদু হাসিয়া চলিয়া গেল। পরে মোহনলালের কাছে শুনিয়াছি, বহুদিন আগে তার স্পর্শমণি পাওয়ার শখ জাগিয়াছিল। সেই উপলক্ষে তিনি নানা দেশ হইতে বহু নুড়ি-পাথর কুড়াইয়া আনিয়া জড় করিয়াছিলেন। গত দুই দিনে তিনি আরও কিছু পাথর সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সঙ্গে যোগ করিয়াছেন। আমার মত একটি সামান্য লোককে বিস্মিত করিবার জন্য এমন প্রচেষ্টা তাঁর কাব্যময় অন্তরের পরিচয় দেয়।

একবার অবনীন্দ্রনাথের খেয়াল চাপিল, যাত্রাগান করিবেন। সত্য-ত্রেতা-দ্বাপরের নহুস-মান্ধাতা-বিশ্বকর্মা প্রভৃতি নানা চরিত্র অবলম্বন করিয়া তিনি এক অদ্ভুত যাত্রার পালা রচনা করিলেন। তারপর এ-বাড়ির ও-বাড়ির ছেলেদের লইয়া সেই যাত্রাগানের মহড়া চলিতে লাগিল। মহড়ার সময় তার কি মাতামাতি। ওখানটার বক্তৃতা থিয়েটারের মত হল; ঠিক যাত্রার দলের রাজার মত বলা হল না। চোরের কথাটা চোরের মতই বলতে হবে; ভদ্রলোকের মত নয় ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিলেন। তিনি খবর পাইয়া বলিলেন, “অবন, কেমন যাত্রা করেছ দেখব।”

অবনীন্দ্রনাথের হলঘরে যাত্রার আয়োজন হইল। রবীন্দ্রনাথ আসিয়া আরামকেদারায় বসিলেন। এ-বাড়ির ও-বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরাও আসিলেন। এর আগেও একবার এই যাত্রার অভিনয় হইয়াছে। সেদিন দেখিয়াছি তার কী লাফালাফি! এখানে ওকে দাড় করাও, ওখান দিয়ে প্রবেশ কর, খাড়া হয়ে দাঁড়াও—এমনি হম্বিতম্বি। কিন্তু আজ তিনি রবীন্দ্রনাথের সামনে ভেজা-বেড়ালটির মত আসরের এককোণে ঢোলক লইয়া বসিয়া আছেন। মুখখানা একেবারে চুন। বহু হাসিতামাশার মধ্যে যাত্রার অভিনয় শেষ হইল। শ্রোতারা খুব উপভোগ করিল। রবীন্দ্রনাথ নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। তিনি কোন কথা বলিলেন না।

পরদিন সকালে রবীন্দ্রনাথকে গিয়া ধরা হইল, যাত্রাগান কেমন হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “নাটক জমেছিল খুব। কিন্তু এলোমেলো সব ঘটনা; একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন; পরিণামে যে কী হল বুঝতে পারলাম না।”

এই কথা অবনীন্দ্রনাথকে জানাইলে তিনি বলিলেন, “এটাই ত নাটকের বৈশিষ্ট্য। নাটক যখন জমেছে তখন কী যে হল, না-ই বা বুঝা গেল।”

একদিন তিনি ছবি আঁকিতেছেন। আমি বলিলাম, একজন সমালোচক আপনার ছবির সমালোচনা করে লিখেছেন, He is an wonderful wanderer, আপনি যখন মোগল আর্ট করেন তখন একেবারে সেই যুগের শিল্পীদের মধ্যে লোপ পেয়ে যান। আবার যখন চীনা আর্টিস্টদের মত আঁকেন তখন আপনি চীনা বনে যান। এ কথাই উদ্ধৃত করে একজন বাঙালি সমালোচক বলেছেন, আপনার নিজস্ব কোন বাণী নেই।”

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “ওটাই আমার বাণী। যে এক জায়গায় বসে থাকে, সে ত মরে যায়। নানা পথে ঘুরে বেড়ানই আমার বৈশিষ্ট্য।”

আর একদিন তিনি বলিতেছিলেন, “প্রত্যেক দেশরই এক এক ভাষা। সেই ভাষায় কেউ না লিখে যদি অন্য ভাষায় লেখে, তবে তার  লেখা হবে কৃত্রিম। এটা যেমন সাহিত্যের ব্যাপারে সত্য তেমনি শিল্পের ব্যাপারে। আমরা আমাদের নিজস্ব আর্টের ভাষায় অঙ্কন করেছি ভাষার ধারা ধরেই আমাদের আর্ট করতে হবে। অপরের অনুসরণ করে আমরা বড় হতে পারব না।

মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতন হইতে নন্দলাল বসু আসিতেন তার সঙ্গে দেখা করতে। গুরুশিষ্যে আলাপ হইত। মুখের কথায় নয়। যেন অন্তরে অন্তরে—যেন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের বিনিময় হইত। গুরুর সামনে একটি চেয়ার লইয়া নন্দলাল বসতেন। গুরু ছবি আঁকিয়া যাইতেন, মাঝে মাঝে দু-একটি কথা। ডাহুক-মাতা যেন গভীর রাত্রিতে তার বাচ্চাদের আদরের কথা শুনাইতেছে।

অবনীন্দ্রনাথের মুখে কতবার নন্দলালের একটি কাহিনী শুনিয়াছি। একবার শিষ্যের একখানা ছবি দেখিয়া তিনি বলিলেন, এর background-এর রঙটি এমন না করিয়া অমন করিবে। শিষ্য নীরবে গুরুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া গেলেন। রাত্রে তার মনে হইল, তিনি ভুল করিয়াছেন। শিষ্য ছবির background-এ যে রঙ দিয়াছেন, তাহাই ভাল। সারারাত্রি তাঁর ঘুম হইল না। কী জানি যদি তার কথা মত নন্দলাল ছবির রঙ পাল্টাইয়া থাকেন। ভোর হইতে তিনি তিন-চার মাইল দূরে শিষ্যের মেসে গিয়া দরজার টোকা মারিতে লাগিলেন। নন্দলাল তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিলেন। গুরু জিজ্ঞাসা করিলেন,“তোমার সেই ছবিটার রঙ ত পালটাও নাই?”

শিষ্য বলিলেন, “না, কাল সময় পাই নাই। এখন রঙটা পালটাব।”

গুরু হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। “না না, ওটার রঙ পালটাতে হবে না। তুমি যা রঙ দিয়েছ, সেটাই ঠিক।” এই বলিয়া গুরু ঘরে ফিরিয়া আসিলেন।

নন্দলাল গুরুর সঙ্গে দেখা করিতে আসিলে বাড়ির মেয়েদের তরফ হইতে ছোট ছেলেদের মারফতে নানা রকমের বায়না আসিত। কারো কানের দুলের ডিজাইন করিয়া দিতে হইবে, কারো হাতের চুড়ীর নকসা আঁকিয়া দিতে হইবে। অবসর-সময়ে নন্দলাল বসিয়া বসিয়া সেই ডিজাইনগুলি আঁকিতেন।

একদিন অবনবাবু বলিতে লাগিলেন, কি ভাবে তার শ্রেষ্ঠ ছবি ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ অঙ্কিত হয় :

“আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। শোকে তাপে আমি জর্জরিত। হাভেল সাহেব বললেন, করোনেশন উপলক্ষে দিল্লীতে একজিবিশন হচ্ছে। তুমি একটা কিছু পাঠাও। আমি কি করি মনও ভাল না। রঙ-তুলি নিয়ে আঁকতে আরম্ভ করলাম। আমার মেয়ের মৃত্যুজনিত সমস্ত শোক আমার তুলিতে রঙিন হয়ে উঠল। শাহজাহানের মৃত্যুর ছবি আঁকতে আরম্ভ করলাম। আঁকতে আঁকতে মনে হল, সম্রাটের চোখে মুখে তার পিছনের দেয়ালের গায়ে আমার সেই দুঃসহ শোক যেন আমি রঙিন তুলিতে করে ভরে দিচ্ছি। ছবির পিছনের মর্মরদেয়াল আমার কাছে জীবন্ত বলে মনে হল। যেন একটা আঘাত করলেই তাদের থেকে রক্ত বের হবে। দিল্লীতে সেই ছবি প্রথম পুরস্কার পেল। কিছুদিন পরে হাভেল সাহেব আমাকে বললেন, এই ছবিটার একটি নকল আমাকে দাও। আমি ছবিটা কপি করতে আরম্ভ করলাম। নন্দলাল আমার পেছনে বসা। ছবি আঁকতে আঁকতে আমার মনে হচ্ছে, ছবির পেছনে মর্মর-দেয়াল যেন যুগ-যুগান্তর ধরে আমার সামনে বিস্তৃত হয়ে আছে। ছবির যা-কিছু সব যেন আমার কাছে জীবন্ত। এই ভেবে আমার তুলি নিয়ে সেই পেছনের প্রসারিত দেয়ালের উপর তুলির টান দিতে যাচ্ছি, অমনি নন্দলাল আমার হাত টেনে ধরেছে : করেন কি, ছবিটা ত নষ্ট হয়ে যাবে! অমনি আমার জ্ঞান ফিরে এলো।

একবার অবনীন্দ্রনাথ চলিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে বক্তৃতা দিতে। আমি আর মোহনলাল স্থির করিলাম, তার বক্তৃতা আমরা লিখিব। আমরা দুইজনে নোট লইয়া বক্তৃতাটি লিখিয়া তাকে দিলাম। তিনি তাহার বহু অংশ পরিবর্তন করিয়া আবার মোহনলালকে দিয়া নকল করাইলেন।

এই প্রবন্ধটি উদয়ন পত্রিকায় ছাপা হইল। পত্রিকার সম্পাদক প্রবন্ধের সঙ্গে আমাদের নাম প্রকাশ করিলেন না। আমরা তাহাতেও খুশি ছিলাম কিন্তু তাকে ধরিলাম, এই লেখার থেকে যে টাকা আসিবে তা দিয়া আমরা সন্দেশ খাইব। প্রবন্ধের জন্য টাকা পাঠাইতে পত্র লেখাইলাম। সম্পাদক মাত্র পাঁচটি টাকা পাঠাইয়া দিলেন। মোহনলাল ক্ষোভের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “আচ্ছা, দাদামশায়ের  লেখা নিয়ে ওরা মাত্র পাঁচ টাকা পাঠাল? ওদের লজ্জা হল না?” তিনি কিন্তু নির্বিকার ভাবে পাঁচটি টাকাই গ্রহণ করিলেন। সন্দেশের কথা মনে করাইয়া আমরা আর তাকে লজ্জা দিলাম না।

অবনঠাকুরের কথা ভালমত জানিতে হইলে তাঁর বাড়ির অন্যান্যদের কথাও জানিতে হয়। যে সুন্দর পরিবারের কথা আমি বলিতেছি, তাহা আজ ভাঙিয়া চৌচির হইয়াছে। ফিউডাল যুগেরও শেষ হইয়া আসিতেছে। সেই জন্যই এদের কথা লিখিয়া রাখিলে হয়ত কাহারো কোন কাজে আসিতে পারে—অন্তত, ইতিহাসসন্ধানীর কিছুটা খোরাক মিলিবে।

এদের পরিবারে খুবই একটা সুন্দর শৃঙ্খলা দেখা যাইত। বহুভাবে এদের সঙ্গে মিশিবার সুযোগ হইয়াছে। কখনো এদের কাউকে আমি রাগারাগি করিতে দেখি নাই। ছোটর গুরুজনদের খুব সম্মান এবং ভক্তি করিত। গুরুজনেরা ছোটদের কিছু করিতে বলিলে তারা খুব মনোযোগ সহকারে তাহা করিত। বাড়ির মেয়েরা থিয়েটার করিতেন, কেহ কেহ স্টেজে নাচিতেন, গান করিতেন; কিন্তু আত্মীয়-পরিজন ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে  কথা বলিতেন না।

বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়টি কোঠাঘর ভাড়া লইয়া আমি একবার প্রায় এক বৎসর ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সেই উপলক্ষে আমি তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া যাইবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। তখনো দেখিয়াছি, বাড়ির মেয়েরা বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলিতেন না। কনকবাবুর মেয়েরা ইস্কুলে কলেজে পড়িতেন। তাঁহাদের ছোট ভাইদের মারফৎ কাউকে কাউকে দিয়া আমি মাঝে মাঝে কাজ করাইয়া লইয়াছি। জনান্তিকে অনুরোধ পাইয়া আমিও তাদের কাজ করিয়া দিয়াছি। আমি তাদের পরীক্ষার ফল জানিয়া দিতে টেবুলেটরদের বাসায় ঘোরাফেরা করিয়াছি। কিন্তু তাহারা কেহই আমার সঙ্গে কথা বলেন নাই। এর ব্যতিক্রম হইয়াছিল শুধু কয়েক জনের ক্ষেত্রে। তারা হইতেছেন অবনীন্দ্রনাথের গৃহিণী, এবং তাঁর পুত্রবধু অলকবাবুর স্ত্রীমোহনলালের মামীমা। ভাল কিছু খাবার তৈরি হইলে তারা আমাকে ডাকিয়া খাওয়াইতেন। ছোট ছোট ছেলে দুইটি—বিশেষ করিয়া ‘বাদশা’ আমার বড়ই প্রিয় ছিল। কনকবাবুর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার চারপাশে গুঞ্জরণ করিয়া বেড়াইত। তার ছোট মেয়েটির নাম মনে নাই। ভারি সুন্দর দেখিতে। আমি তাকে আদর করিতে কাছে ডাকিতাম। এতে বাড়ির আর আর ছোটরা তাকে ক্ষেপাইত, জসীমুদ্দীনবাবু তোর বর। সেই হইতে আমাকে দেখিলেই দৌড়াইয়া পালাইত। কনকবাবুর স্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলিতেন না। আমি রাত্রে রুটি খাইতাম। একবার আমার জন্য তিনি এক বোতল আমের মোরববা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে দীপালিকে আমার বড়ই ভাল লাগিত। সে তার মামাদের লইয়া খুব গল্প করিত। মোহনলাল তাকে ক্ষেপাইত, জসীমুদ্দীন তোমার মামা।” এতে সে খুব চটিয়া যাইত। কিন্তু আমার আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইত। আমিও তাকে দেখিলেই জিজ্ঞাসা করিতাম, “দিদি কেমন আছে?” সে হাসি গোপন করিয়া কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বলিত, “আমার মা আপনার দিদি হতে যাবে কেন?” দীপালিকে কোনদিন তার মার সঙ্গে দেখিলেই জিজ্ঞাসা করিতাম, “দিদি ভাল আছেন ত?” দীপালি মায়ের আঁচলে মুখ লুকাইয়া আমাকে কিল দেখাইত।

মোহনলালও মাঝে মাঝে দীপালিকে ক্ষেপাইত, “আমি তোমার মোহন মামা, না দীপালি?” দীপালি রাগিয়া টং হইত। একবার দীপালির জন্মদিনে আমি আর মোহনলাল মিলিয়া দীপালিকে খুশি করিবার জন্য এক পরিকল্পনা করিলাম।

আমরা নিউমার্কেট হইতে বড় এক বাক্স চকলেট কিনিয়া আনিলাম। একটি কবিতা আমি আগেই লিখিয়া রাখিলাম। তাহা সেই বাক্সের মধ্যে পুরিয়া প্রকাণ্ড আর একটি বাক্সে সেই চকলেটের বাক্সটি পুরিয়া এক বাচ্চা কুলির মাথায় উঠাইয়া দীপালির ঠিকানা লিখিয়া পাঠাইয়া দিলাম ঠাকুরবাড়িতে। কুলি আমাদের নির্দেশমত পার্শেলটি ঠাকুরবাড়ি দিয়া গেল। জন্মদিনে এতবড় একটি উপহার পাইয়া দীপালি খুশিও হইল, আবার শঙ্কিতও হইল। পার্শেলের গায়ে লেখা ছিল “মামাবাড়ির উপহার।” কিন্তু তার মামারা ত কোন জন্মদিনে তার নামে উপহার পাঠায় না। আর উপহার দিলে তারা নিজে আসিয়া দিয়া যাইত। এমন কুলির মাথায় করিয়া উপহার পাঠাইবার উদ্দেশ্য কি? দীপালি পার্শেল লইয়া অন্দরমহলে ঢুকিল। অন্দরমহল আমার পক্ষে রুদ্ধদ্বার। মোহনলাল কোন একটা কাজের ছুতা করিয়া দীপালির পাছে পাছে ছুটিল। পার্শেল দেখিতে বাড়ির সবাই একত্র হইলেন। কিন্তু কী জানি ভয়ে দীপালি আর পার্শেল খোলে না। যদি ইহার ভিতর হইতে অন্যকিছু বাহির হয়। কিন্তু ভালও ত কিছু বাহির হইতে পারে। পার্শেল না খুলিয়াই বা উপায় কি? বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টি লইয়া চারিদিক ঘিরিয়া আছে।

অনেক ভয়ে ভয়ে দীপালি বাক্স খুলিল। পরতে পরতে  কাগজের আবরণী খুলিয়া চকলেটের বাক্স। তাহার ডালা খুলিতেই আমার কবিতার সঙ্গে অসংখ্য চকলেটের টুকরা বাহির হইয়া পড়িল। আমার কবিতায় দীপালির মামাবাড়ির সম্পর্কে অহেতুক শ্রদ্ধার জন্য কিঞ্চিৎ বক্রোক্তি ছিল। কিন্তু অসংখ্য চকলেটের গন্ধে এবং স্বাদে তাহা কেহই লক্ষ্য করিল না। দীপালির জন্মদিনের কবিতা আমার ‘হাসু’ নামক পুস্তকে ছাপা হইয়াছে।

বাড়ির ছেলে বুড়ো যুবক সবাই খুব আমুদে প্রকৃতির ছিল। একটা কৌতুকের ব্যাপার পাইলে সকলে মিলিয়া তাহাতে যোগ দিত।

অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির পাশে অ্যাডভোকেট বিপুল সাহার বাড়ি। ইনি নলিনীরঞ্জন সরকারের প্রসিদ্ধ মামলায় পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিলেন। বিপুল সাহার বাড়িতে সাধুসন্ন্যাসীর খুব আদর। একবার এক ভণ্ড সাধু আসিয়া তাদের পরিবারে প্রতারণা করিয়া বহু অর্থ আত্মসাৎ করিয়া লইয়া গিয়াছিল।

তবু সাধুসন্ন্যাসীতে তাদের বিশ্বাস কমে নাই। বিপুল বাবুর ছোটভাই ঘেটুবাবু একদিন মোহনলালের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে। মোহনলাল আমাকে দেখাইয়া বলিল, “ইনি জসীমুদ্দীন বাবু। ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ কালীসাধক। মা কালীকে সশরীরে দেখিতে পান।” শুনিয়া ঘেটুবাবু আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল।

আমি বললাম, “মোহনলাল মিছে  কথা বলেছে।”

মোহনলাল আমাকে চোখ ইসারা করিয়া বলিল, “কেন বিনয় করছ? ইচ্ছা করলেই তুমি মা-কালীকে দেখাতেও পার।”

আমি তখন ইঙ্গিত বুঝিতে পারিয়া বলিলাম, “যাকে তাকে কি দেখানো যায়?”

ঘেটুবাবু আমার পা-দুখানি ধরিয়া কাদ-কাঁদ ভাবে বলিল, “দাদা, আপনি সাক্ষাৎ ভগবান। দেখাবেন একদিন মা কালীকে?”

আমার মনে তখন দুষ্টবুদ্ধি আসিল। “মা-কালীকে আমি দেখাতে পারি সাতদিন পরে। এই সাতদিন তুমি রাগ করতে পারবে না, আর নিরামিষ খাবে।”

ঘেটু বলিল, “দাদা, আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব। কিন্তু মা-কালী আমাকে দেখাতেই হবে।”

তখন আমি তার ভক্তি আর ও জাগ্রত করিবার জন্য দুই-একটি গল্প ফাঁদিলাম। কোথায় কোন্ শ্মশানঘাটে মড়ার উপর যোগাসন করিয়া বসিয়াছিলাম, কোন সাধকের মন্ত্রে সেই মড়াসুদ্ধ আমি আকাশে উড়িয়া চলিলাম, তারপর কৈলাসে বাবা শিবের সঙ্গে দেখা করিয়া কী করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। আবার, কোথায় কার ছেলে মরিয়া গিয়াছিল, কোন সাধনায় আমি মা-কালীকে ডাকিয়া আনিয়া সেই মরা ছেলেকে বাঁচাইয়া দিলাম।

ভক্ত আমার কথাগুলি শুধু শুনিলই না, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়া যেন গিলিয়া ফেলিল। দেখিলাম, যাহারা বিশ্বাস করিতে চাহে তাহাদের ঠকাইতে বিশেষ কোন উপায় অবলম্বন করিবার প্রয়োজন হয় না। ফিরিবার সময় মোহনলালকে কানে কানে বলিয়া আসিলাম, “এই সাতদিন তোমরা সবাই মিলে ওকে রাগাতে চেষ্টা করবে। রাগ হওয়া সত্ত্বেও ও যখন রাগবে না, তখন দেখতে খুব মজা।”

আমি মেছুয়াবাজার ওয়াই. এম. সি. এ. হোস্টেলে চলিয়া আসিলাম। ভাবিলাম, ব্যাপারটি এখানেই খতম হইল। কিন্তু মোহনলাল খতম করিবার লোক নয়। তিন দিন পরে মোহনলাল আমাকে ফোন করিল, “তুমি যাবার পরে ঘেটু একেবারে কী রকম হয়ে গেছে। সব সময় তোমার নাম করে আর পাগলের মত ফেরে। তুমি তাকে শুধু মাছ-মাংস খেতে নিষেধ করেছ, খাওয়া-দাওয়াই সে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। আমার পড়ার ঘরে সে বসে আছে এখন। আমি তাকে ফোনে ডেকে দিই, তুমি তাকে কিছু সান্ত্বনা দাও।”

ঘেটু আসিয়া ফোন ধরিল। আমি তাকে বললাম, “ধ্যান ভরে আমি জানতে পেরেছি, তুমি একেবারে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছ। কিন্তু শরীরকে কষ্ট দিলে মা কালী বেজার হবেন। তুমি ভালমত খাও।”

ঘেটুর কণ্ঠস্বর গদগদ। সে বলিল “দাদা, আপনি দেবতা। আপনি সব জানতে পারেন। মা কালী কিন্তু আমাকে দেখাতেই হবে।”

আমি বলিলাম, “আচ্ছা, দেখা যাবে।”

পরের দিন মোহনলাল নিজে আমার হোস্টেলে আসিয়া উপস্থিত। “ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে যে কালী তোমাকে দেখাতেই হবে। ঘেটুর বাড়ির সবাই জেনে গেছে। আরও অনেকের কাছে বলেছি। সুতরাং যেমন করেই হোক কালী তুমি দেখাবেই।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি করে দেখাব?”

মোহনলাল বলিল, “আমি সব ঠিক করেছি। গবামামা (অর্থাৎ ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সুজনকে কালী সাজিয়ে দেবে। অন্ধকারের মধ্যে সে এসে ঘেটুকে দেখা দেবে।”

তখন দুই বন্ধুতে মিলিয়া নানারূপজল্পনা-কল্পনা করিতে লাগিলাম। মোহনলালের মামাত ভাইদের সাত-আটজনকে আমাদের দলে রাখিতে হইবে। তাহারা কে কেমন অভিনয় করিবে, তাহারও পরিকল্পনা তৈরী হইয়া গেল।

নির্দিষ্ট দিনে আমি হগ-মার্কেট হইতে নানা রকমের ফল কিনিলাম। অসময়ের আম, লকেটফল—যা সচরাচর পাওয়া যায় না; কলা, কমলা আরও কত কি! এগুলি একটি থলিয়ায় পুরিয়া মোহনলালকে ফোন করিলাম। আমি বাড়ির পিছনের দরজা দিয়া এগুলি মোহনলালের কাছে পৌঁছাইয়া দিব। আমার মন্ত্র-পড়া শুনিয়া কালী যখন আসিয়া দেখা দিবেন, তখন আমাদের নির্দেশমত দর্শকদের মধ্যে যে যাহা খাইতে চাহিবে কালী তাহা দিয়া যাইবেন। তবেই ত হইবে সত্যকার কালী। টেলিফোনে মোহনলালের কাছে ওবাড়ির আরও নানা খবর জানিয়া লইলাম। ঘেটুর দাদা বিপুল সাহাও কালী দেখিতে আসিবেন। তাকে কালী দেখান ঠিক হইবে না। উকিল মানুষ, যদি ধরিয়া ফেলেন।

ঘড়িতে পাঁচটা বাজিল। আমি খদ্দরের ময়লা পাঞ্জাবি পরিয়া খালি পায়ে ঠাকুরবাড়ির পথে রওয়ানা হইব, এমন সময় বন্ধুর মনোজ বসু আসিয়া উপস্থিত। তখনও মনোজ বসুর তত নাম হয় নাই। মাত্র দুই-একটি কবিতা ও ছোটগল্প বাহির হইয়াছে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে সাহিত্যিক সঙ্গ করিতে আসিত।

সমস্ত শুনিয়া মনোজ বলিল, “আমি তোমার সঙ্গে যাব?”

আমি বলিলাম, “তা কি করে হবে?”

মনজ বলিল, “কেন? আমি তোমার শিষ্য হয়ে তল্পিবাহক হয়ে যাব।”

আমি খুশি হইয়া বলিলাম, “বেশ, চল তবে।”