☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
৬
অবনীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন সাদাসিধে রকমের ভালমানুষটি। গল্প করিতে খুব ভালবাসিতেন। মোহনলাল তাকে দাদু বলিয়া ডাকিত। সেই সঙ্গে আমিও তাকে দাদু বলিতাম। তিনি রেডিও শুনিতে খুব পছন্দ করিতেন। আমি মাঝে মাঝে রেডিও সম্পর্কে গল্প বলিয়া তাকে খুশি করিতাম। তাঁর ঘরে গিয়া রেডিও শুনিতে চাহিলে তিনি যেন হাতে-স্বর্গ পাইতেন। অতবড় বাড়িতে সবাই আর্ট-কালচার লইয়া বড় বড় চিন্তাধারা লইয়া মশগুল থাকিত। স্বামীর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কত বিরাট কত বিস্তৃত। তিনি সেখানে হয়ত হারাইয়া যাইতেন। তাই তাঁর ক্ষুদ্র রেডিও-যন্ত্রটি বাজাইয়া নিজের স্বল্পপরিসর একটি জগৎ তৈরী করিয়া লইতেন।
সন্ধ্যা হইলে অবনীন্দ্রনাথ ঘরে আসিয়া বসিতেন। কখনও খবরের-কাগজ পড়িতেন না। তিনি বলিতেন, “খবর শুনতে হয়। পড়ার জন্য ত ভাল ভাল বই আছে।”
তাঁর আদরের চাকর ক্ষিতীশ। সন্ধ্যার পরে তার পায়ে তৈল মালিশ করিত আর নানা রকম সত্য-মিথ্যা গল্প বলিয়া যাইত। কোন পাড়ায় একটা মাতাল ঢুকিয়া পড়িয়া কী সব কাণ্ড-বেকাণ্ড করিয়াছিল; কোথায় কংগ্রেসসেবকের উপর গোরা সৈন্যেরা গুলি চালাইয়াছিল, কী করিয়া একজন সাধু আসিয়া সেই বন্দুকের গুলি খাইয়া ফেলিয়াছিল; গান্ধী সৈন্যের কোন কোন দেশ জয় করিয়া কত দূরে আসিয়া পড়িয়াছে—এই সব আজগুবি কাহিনী। রূপকথার শিশু-শ্রোতার মত শিল্পী এই সব খবর শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িতেন।
কোন কোন দিন গৃহিণীর রেডিও-যন্ত্রটি কোন অনুষ্ঠানের চটকদার সুর লইয়া জোরে বাজিয়া উঠিয়া গল্প শোনার কাজে ব্যাঘাত ঘটাইলে অতি-মৃদুস্বরে তিনি বলিতেন, “বলি, তোমার যন্ত্রটি একটু থামাও না।” গৃহিণী লজ্জিত হইয়া রেডিওর শব্দ কমাইয়া দিতেন।
শুনিয়াছি, রেডিও-যন্ত্রটি লইয়া মাঝে মাঝে গৃহিণীর সঙ্গে তার মত-বিরোধ হইত। স্বামী যে একটা মহান সৃষ্টিকার্যে নিমগ্ন, সেটা তিনি বুঝিতেন। নানা রকমের সেবা লইয়া পূজার হস্ত প্রসারিত করিয়া এই নরদেবতাকে তিনি তাঁর ক্ষুদ্বপরিসর মনের আকুতি দিয়া সর্বদা অর্চনা করিতে প্রস্তুত থাকিতেন।
জমিদারীর আয় কমিয়া যাইতেছে। আদরের চাকর রাধু বিবাহ করিতে বাড়ি যাইবে। তাকে কিছু টাকা দেওয়ার প্রয়োজন। আগেকার দিনে এসব ব্যাপারে তিনি কতবার হাজার টাকার ছোড়া ফেলিয়া দিয়াছেন। এখন আর সে দিন নাই। তবু কিছু দিতে হইবে। কিন্তু হাতে উঠাইয়া কিছু দিতে গেলে বড় ছেলে হয়ত অসন্তুষ্ট হইবে। তিনি রাধুর একটা ছবি আঁকিলেন—সে যেন পুকুরের ধারে1 ছিপ হাতে মাছ ধরিতেছে। একজিবিশনে ছবিখানি বহুমূল্যে বিক্রিত হইল। ছেলেদের ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “দেখ, ছবিখানি আঁকতে আমার বিশেষ কিছু কষ্ট হয় নি। আমি ত অমনি বসে বসে ছবি আঁকি-ই। রাধু বেচারারই এ জন্যে পরিশ্রম হয়েছে বেশি। তাকে তিন দিন সমানে ছিপ-হাতে বসে থাকতে হয়েছে। সুতরাং ছবির দামটি তার প্রাপ্য।”
ছেলেরা সবই বুঝিতে পারিয়া মৃদু হাসিয়া পিতার কথায় সায় দিলেন। রাধু নাচিতে নাচিতে টাকা লইয়া বিবাহ করিতে বাড়ি ছুটিল। এই গল্পটি আমি মোহনলালের নিকট শুনিয়াছি।
চাকরবাকরদের সঙ্গে কেহ রাগারাগি হাঁকাহাঁকি করিত না। এত বড় একান্নবর্তী পরিবার—সকলেই যেন সুরে-বাঁধা বাদ্যযন্ত্র। কোনদিন এই তার-যন্ত্রে বেসুরো রাগিণী বাজিতে শুনি নাই। এত লোক একত্র থাকিয়া এই মহৎ সংযম কী করিয়া আয়ত্ত করিয়াছিলেন, ভাবিতে বিস্ময় লাগে। শুনিয়াছি, তিনি যদি কখনো কোন চাকরের উপর একটু গরম কথা বলিয়াছেন, তৎক্ষণাৎ নিজের শাস্তিস্বরূপ তাকে দশটাকা বখশিস করিতেন। কোন কোন দুষ্ট চাকর তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিত। ইচ্ছা করিয়াই কাজে অবহেলা করিয়া তাকে রাগাইয়া এইভাবে বখশিস আদায় করিত। একদিন তিনি তাঁর নিজের অতীত-জীবনের একটি ঘটনা বলিলেন। সব কথা মনে নাই। ভাসা-ভাসা যাহা মনে আছে, তাহাই এখানে উল্লেখ করিব।
একবার তিনি পুরী বেড়াইতে গেলেন। সেখানে একটি মুসলিমপরিবারের সঙ্গে তার আলাপ হইল। কোথাকার কোন বৃদ্ধ জমিদারের পরিবার। বুড়োর তিন পুত্রবধূ আর দুই মেয়ে। তারা কেউ অবনবাবুকে দেখিয়া ঘোমটা দিত না। তাঁকে নিমন্ত্রণ করিয়া নানা রকমের মুসলমানি খানা খাওয়াইত। তাদের সঙ্গে করিয়া তিনি সমুদ্রতীরে নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন।
একদিন সকালবেলা বাড়ির সবাইকে লইয়া তিনি গল্পগুজব করিতেছেন। এমন সময় কয়েকজন ভদ্রলোক আসিয়া তাঁর সঙ্গে পরিচিত হইলেন। অমুক স্থানের মহারাজা, অমুক সমিতির সভাপতি, অমুক কাগজের সম্পাদক ইত্যাদি কয়েকজন বিখ্যাত লোক তাকে ঘিরিয়া বসিলেন। পানির মাছ শুকনায় পড়িলে যেমন হয়, তার যেন সেই অবস্থা। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তা কি মনে করে আপনারা আমার কাছে এসেছেন?”
আগন্তুকের মধ্যে একজন একটু কাশিয়া বলিলেন, “মুসলমানেরা আজকাল শতকরা পঞ্চাশটি চাকরির জন্যে আবদার ধরেছে। আমাদের হিন্দুসমাজের যুবকেরা বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তারা এতগুলো চাকরি নিয়ে নেবে—এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া উচিত। আজকাল গভর্নমেন্টও ওদের কথায় কান দিচ্ছে। আমরা রাজনৈতিক নেতারা এ জন্য বহু প্রতিবাদ করেছি। যাঁরা রাজনীতি করেন না, অথচ দেশের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, তাদের দিয়ে একটা প্রতিবাদ করাতে চাই। প্রতিবাদ-পত্র লিখে এনেছি। এতে জগদীশচন্দ্র, পি. সি রায় প্রভৃতি বহু মনীষী সই প্রদান করেছেন।”
অবনীন্দ্রনাথ শিশুর মত বিস্ময়ে বলিলেন, “তা আমাকে কি করতে হবে?”
তাঁর সামনে কাগজ-খাতা মেলিয়া ধরিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, “বিশেষ কিছু না। শুধুমাত্র এখানে একটি সই।”
তিনি বলিলেন, “মুসলমানেরা যদি বেশি চাকরি পায়, তাতে আমার কি। আমার প্রজাদের মধ্যে প্রায় সবাই মুসলমান। তারা যদি দুটো বেশি চাকরি পায় তাতে আমি বাদ সাধতে যাব কেন?”
ভদ্রলোক তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে যাইতে ছিলেন। পাশে আমি বসিয়া আছি। ভদ্রলোকের সমালোচনা শুনিয়া মনে ব্যথা পাইব, সেইজন্য অবনবাবু তাকে থামাইয়া দিয়া বলিলেন, “এই যে, আমার জসিম মিঞা বসে আছে। ওর একটা চাকরির জন্যে আমি কত চেষ্টা করছি। ওর চাকরী হলে আমি কত খুশি হই।”
ভদ্রলোকেরা নানা ভাবে তাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই সহি করিলেন না। তিনি বলিলেন, “মশায়, আমি রঙ আর তুলি নিয়ে সময় কাটাই, রাজনীতির কি বুঝি। রবিকাকার কাছে যান। তিনি ওসব ভাল বোঝেন।”
অগত্যা ভদ্রলোকেরা চলিয়া গেলেন। তিনি আবার আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব আরম্ভ করিলেন।
আমি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়িতাম। সেই সময় দীনেশবাবু আমাকে পল্লীগান সংগ্রহ করার ভার দেন। কলেজের ছুটির সময় আমি নানা গ্রামে ঘুরিয়া পল্লী-সংগীত সংগ্রহ করিয়া তাঁকে পাঠাইতাম। বিশ্ববিদ্যালয় এজন্য আমাকে মাসিক সত্তর টাকা করিয়া দিতেন। বি. এ. পাশ করিয়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়িতে কলিকাতা আসিলাম। দীনেশবাবু আমাকে বলিলেন, “এখন থেকে তুমি আর পল্লী-গান সংগ্রহ করে মাসে মাসে টাকা পাবে না এতদিন তুমি গ্রামে ছিলে, সেখানে পড়াশুনো করেছে, আর কি কি করেছে কেউ জানত না। এখন তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করবে। লোকে আমার নিন্দে করবে, আমি তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিচ্ছি।”
আমি বলিলাম, “আমি আগেও পড়াশুনো করেছি। ছুটির সময় শুধু গ্রাম-গান সংগ্রহ করতাম। আপনি আমার কাছে কাজ চান। আমি যদি আগের মত আপনাকে গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করে এনে দিতে পারি, তবে আপনার অসুবিধা কিসের?”
দীনেশবাবু বলিলেন, “তুমি জান না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বহু শত্রু আছে। তারা যদি টের পায়, আমার জীবন অস্থির করে তুলবে।”
বহু অনুনয়-বিনয় করিয়াও আমি দীনেশবাবুকে বুঝাইতে পারিলাম না। বস্তুত এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশবাবুর পূর্ব সম্মান অক্ষুণ্ণ ছিল না। স্যার আশুতোষের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পুত্র শ্যামাপ্রসাদ তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করিয়া উঠিতে পারেন নাই।
দীনেশবাবু বিশ্বকোষ লেনে থাকিতেন। দুপুরবেলা ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়া বেহালা যাইতেন তাঁর নূতন বাড়ি তৈরীর কাজ দেখাশুনা করিতে। আমি প্রতিদিন দীনেশবাবুর সঙ্গে বেহালা যাই। সারাদিন তার সঙ্গে কাটাই। আর খুঁজি, কোন মুহুর্তে তাকে ভালমত বলিয়া তার মতপরিবর্তন করাইতে পারিব। দুই-তিন দিন যায়। একদিন আমার কথাটি পাড়িলাম। দীনেশবাবু তার পূর্বমতে অটল। আমার পরিবর্তে গ্রাম-গান সংগ্রহ করিবার জন্য তিনি একজন লোককে স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন।
এ সব কথা আমি অবনীন্দ্রনাথকে কিছু বলি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তাঁর কি হাত আছে? একদিন তার সামনে বসিয়া আছি। তিনি আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, মুখখানা যে বড় বেজার দেখছি।”
আমি তাঁকে সমস্ত খুলিয়া বসিলাম। তিনি বলিলেন, “এটা বড় আশ্চর্য! আগে যদি পড়াশুনো করেই তুমি গ্রাম-গান সংগ্রহ করতে পেরেছে, এখন পড়াশুনো করে তা পারবে না কেন? তুমি এক কাজ কর। আমার একখানা চিঠি নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলার মিঃ আরকুহার্টের সঙ্গে দেখা কর।”
আমি বলিলাম, “এতে দীনেশবাবু যদি অসন্তুষ্ট হন?”
হাসিয়া বলিলেন, “তোমাকে যতদিন তিনি মাসে সত্তর টাকা করে দিয়েছেন, ততদিন তিনি রাগলে তোমার ক্ষতি হত। সেই টাকাই যখন শেষ হল, তখন রাগলে তোমার কি আসে যায়? তুমি আমার চিঠি নিয়ে আরকুহার্ট সাহেবের সঙ্গে দেখা কর।”
পত্র লইয়া আমি ভাইস-চ্যান্সেলারের সঙ্গে দেখা করিলাম। তিনি আমার সব কথা খুব মনযোগের সঙ্গে শুনিয়া বলিলেন, “এখন আমি তোমাকে কোন কথা দিতে পারি না। তুমি আমার নিকট একখানা দরখাস্ত কর। সিনেটে এ বিষয়ে আলোচনা হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
আমি আসিয়া দীনেশবাবুকে সমস্ত বলিলাম। তিনি বলিলেন, “ভাইস-চ্যান্সেলর যখন তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন, তখন তুমি দরখাস্ত কর।” সেই দরখাস্তের মুসাবিদা দীনেশবাবুই লিখিয়া দিলেন। সেনেটে আমার বিষয়ে আলোচনা হইবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে আমার বন্ধু অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী আমাকে লইয়া সেনেটের প্রত্যেক মেম্বরের বাড়ি ঘুরাইয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথ নিজেও শ্যামাপ্রসাদবাবুকে ও স্যার রাধাকৃষ্ণনকে ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়া আমাকে সাহায্য করিতে অনুরোধ করিলেন। সেনেটের আলোচনার দিনে, শুনিয়াছি, সকলেই আমাকে সমর্থন করিয়াছিলেন। আমি পূর্বের মত অবসর সময়ে গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিয়া মাসে সত্তর টাকা করিয়া পাইতে লাগিলাম। অবনবাবু শুনিয়া কতই খুশি হইলেন। এই টাকা দিয়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. পড়ার খরচ চালাইলাম। অবনঠাকুর সাহায্য না করিলে ইহা হইত না।