» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

রোজ সকাল হইতে দুপুর, আবার বিকাল হইতে সন্ধ্যা সমানে পুঁথি পড়া চলিয়াছে। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া চলিয়াছে। কেহ দেখা করিতে আসিলে তাকে পুঁথি পড়িয়া শোনান—গাজীকালুর পুঁথিতে যেখানে বাঘের বর্ণনা, মামুদ হানিফের সঙ্গে সোনাভানের লড়াই-এর বর্ণনা, নানা গ্রামের নাম ও নায়ক-নায়িকার পোশাকের বর্ণনা। রঙ-গোলার কোটা শুষ্ক হইয়া পড়িয়া আছে। তুলিতে ধূলি জমিয়াছে। কোথায় রঙ, কোথায়  কাগজ কোনদিকে খেয়াল নাই। এই রূপে তিন-চার মাস কাটিয়া গেল। আর বই পাওয়া যাইতেছে না। মজার গল্পে-ভরা যত পুঁথি, সব পড়া শেষ হইয়া গিয়াছে।

এমন সময় রবীন্দ্রনাথ আসিলেন শান্তিনিকেতন হইতে। খুড়ো-ভাইপোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুসলমানী পুঁথি লইয়া আলাপ চলিল। রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, পুঁথির একটি সংকলন বিশ্বভারতী হইতে ছাপাইবেন। পুঁথি-সংকলনের খাতা বিশ্বভারতীতে চলিয়া গেল। (সেগুলি হয়ত সেখানেই পড়িয়া আছে; আজও ছাপা হয় নাই।)

অবনীন্দ্রনাথ আবার ছবি আঁকায় মন দিলেন। কোথায় রঙের কৌটা শুষ্ক হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে পানি ঢালিলেন, ধূলিমাখা তুলিটি ঝাড়িয়া মুছিয়া লইলেন।

একবার তাঁর খেয়াল চাপিল, মানুষের ছবি আঁকিবেন। বাড়ির সবাইকে ডাকিলেন সিটিং দিতে। অনেকের ছবি আঁকা হইয়া গেল। একদিন আমাকে বলিলেন, “এসো, তোমার একটি ছবি আঁকি।”

আমি সঙ্কোচবোধ করিতেছি। পাশে ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি সিটিং দিতে বসিয়া গেলেন। আজ মনে বড়ই অনুতাপ হইতেছে। সেদিন যদি সঙ্কোচ না করিতাম, তবে সেই অমর তুলিকার জাদুস্পর্শে নিজেকে কতকটা অমর করিয়া লইতে পারিতাম।

মহাত্মা গান্ধী যেদিন ডাণ্ডী-যাত্রা করিলেন লবণ-আইন অমান্য করিতে, তিনি সেইদিন আরব্য রজনীর ছবিগুলি আঁকা আরম্ভ করিলেন। এক একখানা ছবি আঁকিতে বিশ-পঁচিশ দিন লাগে। আমি সামনে বসিয়া বসিয়া দেখি আর তার কাছে আমার পল্লীবাংলার গল্প বলি।

কোথায় কোন গ্রামে এক বেদে সাপ ধরিতে যাইয়া সাপের ছোবলে মৃত প্রায় হইয়াছিল, তারপর বেদেনী আসিয়া কেমন করিয়া তাকে মন্ত্র পড়িয়া সারাইয়া দিয়াছিল; কোন গ্রামে ভীষণ মারামারি হইতেছিল, হঠাৎ আফাজদ্দি বয়াতি আসিয়া গান গাহিয়া সেই কলহপ্রবণ দুই দলকে মন্ত্র-মুগ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল; কোন গ্রামে মেয়েরা পিঠার উপর নক্সা আঁকিতে আঁকিতে গান করে, কোথায় এক বৈষ্ণবী গান গাহিতে থাকে আর তার বৈষ্ণব কাঁদিয়া কাঁদিয়া তার পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়ে; কোথায় কোন জঙ্গলে একটা বৃষকাষ্ঠ আছে, তার ছবিগুলি যেন জীবন্ত হইয়া  কথা কহিতে চায়। আমি বলি এই সব কথা, আর তিনি ছবি আঁকিয়া চলেন।

বুড়া হইয়া যাইতেছেন। মুখের চামড়া ঝুলিয়া পড়িতেছে। কিন্তু তিনি বলেন, “সমস্ত আরব্য রজনীর গল্প ছবিতে ছবিতে ভরে দেব।”

আমি জিজ্ঞাসা করি, “দাদামশাই, এক একটা ছবি আঁকতে এতদিন সময় নিচ্ছেন, এতবড় বিরাট আরব্য রজনীর বই-এর ছবিগুলি কি আপনি শেষ করে যেতে পারবেন?

দাদামশাই হাসিয়া উত্তর করেন, “আমি শিল্পীর কাছে শিল্প সীমাবদ্ধ, কিন্তু শিল্পীর জীবন—eternal অনন্ত। এর কোন শেষ নেই, কতদিন বেঁচে থাকব সে প্রশ্ন আমার নয়, আমায় কাজ করে যেতে হবে।”

দিনের পর দিন ছবি আঁকা চলিল। তখন বাংলার রাজনৈতিক আকাশে অসহযোগের ডামাডোল চলিতেছে। মহাত্মা গান্ধী জেলে গেলেন। সমস্ত ভারত রাজনৈতিক চেতনায় উন্মাদ হইয়া উঠিল। খবরের কাগজে নিত্য নূতন উত্তেজনাপূর্ণ খবর বাহির হইতেছে। ইস্কুল-কলেজ ভাঙিতেছে, জেলে রাজবন্দীদের উপর অত্যাচার হইতেছে, কিন্তু শিল্পী একান্তে বসিয়া বসিয়া আরব্য রজনীর ছবি আঁকিতেছেন। কোনদিন খবরের কাগজের পাতা উল্টাইয়া দেখেন না। সকাল হইতে দুপুর, আবার বিকাল হইতে সন্ধ্যা-সমানে চলিয়াছে ছবি আঁকার সাধনা। সেই ছবিগুলিতে শিল্পীর বাড়িরই ছেলেমেয়েরা, তারাই যেন আরব্য রজনীর পোশাক পরিয়া নাটক করিতে নামিয়াছে। এমনি করিয়া প্রায় এক বৎসর কাটিয়া গেল। শান্তিনিকেতন হইতে রবীন্দ্রনাথ আসিলেন বসন্ত-উৎসবের নাচের দল লইয়া। অবনীন্দ্রনাথ চলিলেন এম্পায়ার থিয়েটার-হলে অভিনয় দেখিতে।

পরদিন সকালে দেখি, তিনি চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, কাল শান্তিনিকেতনের বসন্ত-উৎসব দেখে এলাম। ওরা কী আবিরের গুড়ো ছড়িয়ে দিল। তাতে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তোমাদের মোগলযুগের ছবি আর চোখে দেখতে পাচ্ছিনে।”

সেইদিন হইতে তার আরব্য রজনীর ছবি আঁকা শেষ হইল। সেই অসমাপ্ত ছবিগুলি রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত আছে।

বি. এ. পাশ করিয়া এম. এ. পড়িতে আমি কলিকাতায় আসিলাম। তখন থাকিতাম মেছুয়াবাজার ওয়াই. এম. সি. এ. হোস্টেলে। কিন্তু আমার মন পড়িয়া থাকিত অবনঠাকুরের দরবারে। অবসর পাইলেই আমি অবনীন্দ্রনাথের সামনে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। তিনি ধীরে ধীরে ছবির উপরে তুলি চালাইয়া যাইতেন। একটি বাঁশের চোঙায় তার ছবি আঁকার সাজ-সরঞ্জাম রাখিতেন।

তিনি ছবির উপরে খুব আবছা রঙ দেওয়া পছন্দ করিতেন। একখানা কাঠের তক্তার উপর  কাগজ রাখিয়া তিনি ছবি আঁকিতেন। হাতের তুলিটি যেন ইচ্ছামত নরম হইত, ইচ্ছামত শক্ত হইত। এ-রঙে ও-রঙে তুলি ঘষিয়া তিনি মাঝে মাঝে সামান্য জল মিশাইয়া ছবির উপরে মৃদু প্রলেপ মাখাইয়া যাইতেন। প্রথমে কাগজের উপর তিনি শুধু রঙ পরাইয়া যাইতেন। সেই রঙের উপর ধীরে ধীরে ছবির মূর্তিগুলি ভাসিয়া উঠিত। আমার মনে হইত, কোন ইন্দ্রপুরীর জাদুকর নিজের ইচ্ছামত কাগজের উপর রঙের কয়েকটি রেখার বন্ধনে স্বর্গ-মর্ত্য-রসাতলের দেব-নর-যক্ষ-কিন্নরদের আনিয়া ইচ্ছামত অভিনয় করাইয়া যাইতেছেন। সেই অভিনয়ের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত দেখিতে প্রতিদিন কে যেন আমাকে সেখানে টানিয়া লইয়া যাইত। মাঝে মাঝে তিনি তার অঙ্কিত ছবির কাগজখানি পানিতে ডুবাইয়া লইতেন। রঙ আরও ফ্যাকাশে হইয়া যাইত। কাগজ কিঞ্চিৎ শুকাইলে আবার তাহার উপরে তিনি নতুন করিয়া রঙ পরাইতেন। এ দৃশ্য দেখিতে আমার বড়ই ভাল লাগিত।