☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
৪
অতি সঙ্কোচের সঙ্গে একদিন জিজ্ঞাসা করি, “দাদামশাই, (মোহনলালের সঙ্গে আমিও তাকে দাদামশাই বলিয়া ডাকিবার অধিকার পাইলাম) আপনি ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর জন্মদাতা। আপনার মুখে একবার ভাল করে শুনি ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে।”
ছবিতে রং লাগাইতে লাগাইতে অবনবাবু বলেন, “আমি জানিনে বাপু, ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে।”
আমি বলি, “তবে যে ওরিয়েন্টাল আর্ট নিয়ে লোকের এত লেখালেখি। সবাই বলে, আপনি ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর পথের দিশারী।”
হাসিয়া অবনবাবু বলেন, “তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করো, ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে। আমি করেছি আমার আর্ট। আমি যা সুন্দর বলে জেনেছি, তা আমার মত করে এঁকেছি। কেউ যদি আমার মত করে আঁকতে চেষ্টা করে থাকে, তারা আমার অনুকরণ করেছে। তারা তাদের আর্ট করতে পারেনি।”
নিজের ছবির বিষয়ে তার কি মত, জানিতে কৌতূহল হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ছবির পাত্র-পাত্রীদের আপনি সুন্দর করে আঁকেন না কেন? লোকে বলে আপনি ইচ্ছে করেই আপনার চরিত্রগুলোকে এবড়ো-খেবড়ো করে আঁকেন।”
অবনবাবু বলেন, “আমি সুন্দর করেই আঁকি। আমার কাছে আমার সুন্দর। তোমাদের কাছে তোমাদের সুন্দর। আমি ইচ্ছে করে কোন ছবি অসুন্দর করে আঁকিনে।”
আমি তবু বলি,“আপনার বনবাণীর ছবিখানার কথাই ধরা যাক। অত বয়সের করে এঁকেছেন কেন? অল্প বয়সের করলে কি দোষ হত?”
অবনবাবু হাসেন : “আমি ওই বয়সেই তাকে সুন্দর করে দেখেছি।”
এখন নিজের ভুল বুঝিতে পারি। বন কত কালের পুরাতন; সেই বনের রাণীও অমনি পুরাতন বয়সের হইবেন। তাছাড়া অবনবাবুর বয়সও সেই বনের মত প্রবীন।
আর একদিন অবনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, কিছু লিখতে মন আসছে না। কি করি?”
তিনি বলিলেন, “চুপ করে বসে থাক। পড়াশুনো কর।”
আমি জিজ্ঞাসাকরি, “আচ্ছা দাদামশাই, মনের ভাবকে বাড়াবার জন্য আপনি কিছু করেন না?”
দাদামশাই হাসেন : “আমার যা ভাব আছে, তারই জন্যে রাতে ঘুম হয় না। সারাদিন তাই ভাব কমানোর জন্য ছবি আঁকি। আর ভাব বাড়ালে ত মরে যাব।”
অবন আর গগন দু-ভাই আঁকেন। ওপাশে সমর বসিয়া বসিয়া শুধু বই পড়েন। কত দেশী-বিদেশী গুণীব্যক্তিরা আসেন। অবনের কাছে আর গগনের কাছে তাদের ভিড়। সমরের দিকে তাঁরা ফিরিয়াও চাহেন না। সমর তাঁর বই-এর পাতার পর পাতা উল্টাইয়া চলেন। আরব্য রজনীর ইংরাজী অনুবাদ, কালীসিংহের মহাভারত, কুট হ্যামসুন, টলস্টয় ইত্যাদি কত দেশের কত মহামনীষীর লেখা। স্বপনপুরীর রাজপুত্র বই-এর পাতায় ময়ুরপঙ্খীতে চড়িয়া দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। মাঝে মাঝে বই হইতে মুখ তুলিয়া গগনের ছবি দেখেন—অবনের ছবি দেখেন। দুই ভাই-এর সৃষ্টির গৌরব যেন তাঁরই একার। এই রঙ-রেখার জাদুকরদের দ্বারপ্রান্তে তিনি যেন প্রহরীর মত বসিয়া আছেন। কতবার কত সময়ে আমি সেই বারান্দায় গিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়াছি। কোনদিন ভাই-এ ভাই-এ কথা-বলাবলি করিতে শুনি নাই। ঝগড়া ত তাহারা জানিতেনই না; সাংসারিক কোন আলাপ, কি কোন অবসর বিনোদনের কথাবার্তা—কোন কিছুতেই এই তিন ভাইকে কোনদিন মশগুল দেখিতে পাই নাই। গগন খুশি আছেন, এপাশে অবন ছবি আঁকিতেছেন ওপাশে সমর বই পড়িতেছেন। অবন খুশি আছেন,— পাশে গগনের তুলিকাটা কাগজের উপর উড়িয়া চলিয়াছে তেপান্তরের রূপকথার দেশে। সমর ত দুই ভাই এর সৃষ্টি কার্যের গৌরবে ডগমগ। কথা যদি এদের কিছু থাকে, সে কথা হয় মনে মনে। পাশে ভাইরা বসিয়া আছেন, ইহাই ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনন্দ।
এক একদিন সন্ধ্যাবেলায় অবন নামিয়া আসেন নিচের তলায় হলঘরে। সেখানে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের নাতিপুতিরা অবনদাকে ঘিরিয়া ধরে, “গল্প বল।”
অবনের গল্প বলার সে কী ধরন। অবন যেমন ছবি আঁকেন, রঙ দিয়া মনের কথাকে চক্ষুর গোচর করাইয়া দেন—তেমনি তার গল্পের কাহিনীকে হাত নাড়িয়া ইচ্ছামত চোখমুখ ঘুরাইয়া কোনখানে কথাকে অস্বাভাবিকভাবে টানিয়া কোন কথাকে দ্রুতলয়ে সারিয়া তার গল্পের বিষয়বস্তুকে চক্ষুগোচর করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে ইকিড়ি-মিকিড়ি কথা ভরিয়া শব্দের অর্থের সাহায্যে নয়, ধ্বনির সাহায্যে গল্পের কথাকে রূপায়িত করেন।
অবনের দুই অস্ত্র-রঙ আর কথা, আঁচড় আর আখর। তাঁকে ঘিরিয়া শিশুদলের মৌমাছি সর্বদা গুনগুন করে।
কোন কোন দিন তিনি ভূতের গল্প বলিয়া শিশুদের ভয় পাওয়াইয়া দেন। বলেন, ভূতের গল্প শুনিয়া ওদের হার্ট বলবান হইবে।
সেদিন ছিল বর্ষা। অবন নিচে নামিয়া আসিলেন। বাড়ির সকলে তাকে ঘিরিয়া বসিল। ভাইপোরা নাতি-নাতনীরা সকলে। তিনি উদ্ভট ধাঁধা রচনা করিয়া সবাইকে তার মানে জিজ্ঞাসা করেন। নাতিনাতনীরা শুধু নয়, বয়স্ক ভাইপোরা পর্যন্ত সেই ধাঁধার উত্তর দিতে ঘামিয়ে অস্থির। কত রকমের ধাঁধা রচনা করেন! ধাঁধার কথাটি মুখে উচ্চারণ না করিয়া হাত নাড়িয়া চোখমুখ ঘুরাইয়া ধাঁধার ছবি তৈরী করেন, সঠিক উত্তর না পাইলে উত্তরটিকে আরও একটু ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দেন। নাতিপুতিরা উত্তর দিলে খুশিতে উজ্জ্বল হইয়া ওঠেন।
সেবার গ্রীষ্মের ছুটির পর দেশ হইতে ফিরিয়া মোহনলালের কাছে শুনিলাম, খেয়াল হইয়াছিল কয়টি মোরগ পুষিবেন। সকালবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাতিপুতিদের লইয়া জল্পনাকল্পনা চলে, কি রকম মোরগ হইবে, কেমন তার গায়ের রঙ, কেমন তার চলনবলন। তারপর গাড়িতে করিয়া দুপুরের রোদে শেয়লদার হাট। এমনি তিন-চার হাট ঘুরিলেন। মনের মত মোরগ পাওয়া গেল না।
আমার কাছে ছিল একখানা শহীদে-কারবালার পুঁথি। তাকে পড়িতে দিলাম। সে বই তিনি শুধু পড়িলেন না, যে জায়গা তার ভাল লাগিল দাগ দিয়া রাখিলেন। হাতের চিহ্ন-আঁকা সেই বই এখনো আমার কাছে আছে।
তারপর খেয়াল চাপিল, আরও পুঁথি পড়িবেন। আমাকে বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, চল তোমাদের মুসলমানী পুঁথির দোকানে মেছুয়াবাজারে।”
তাঁকে লইয়া গেলাম কোরবান আলী সাহেবের পুঁথির দোকানে। দোকানের সামনে অবনীন্দ্রনাথের গাড়ি। জোব্বাপাজামা পরা এ কোন শাহজাদা পুঁথির দোকানে আসিয়া বসিলেন। পুঁথিওয়ালারা অবাক! এমন সুন্দর শাহজাদা কোন দিন তাদের পুঁথির দোকানে আসে নাই। এটা-ওটা পুঁথি লইয়া নাড়াচাড়া করেন। দোকানী আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করেন, “কে ছদ্মবেশী বাদশাজাদা?” আমি বলি, “বাদশাজাদা নন, ইনি রঙের রেখার আর কথার আতসবাজ, পাশ্চাত্ত্য ও দেশীয় চিত্রকলার শাহানশাহ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
দোকানী ব্যস্ত হইয়া ওঠে মেছুয়াবাজারের মালাই-দেওয়া সিঙ্গল চা ও পান আনিয়া হাজির করে।
দোকানীর কানে কানে বলি, “ওসব উনি খাবেন না। পেয়ালাগুলো দেখুন না কেমন ময়লা?
দোকানীর আন্তরিকতা দেখিয়া চায়ের পেয়ালায় মুখ দিয়া বলিলেন, “দেখ জসীমিঞা, কেমন সুন্দর চা।”
দোকানী খুশি হইয়া যেখানে যত ভাল পুঁথি আছে, তার সামনে আনিয়া জড় করে। ছহি সোনাভান, জয়গুন বিবির কেচ্ছা, আলেফ লায়লা, গাজী কালু চম্পাবতী—আরও কত বই। শিশু যেমন মুড়ি কুড়াইয়া খুশি হইয়া বাড়িতে লইয়া আসে, তেমনি এক তাড়া বই কিনিয়া অবনীন্দ্রনাথ ঘরে ফিরিলেন। তারপর দিনের পর দিন চলিল পুঁথি পড়া। শুধু পড়া নয়—পুঁথির যেখানে নায়িকার বর্ণনা, গ্রামদেশের প্রকৃতির বর্ণনা, বিরহিনী নায়িকার বারোমাসের কাহিনী, অবনবাবু তার খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া যায়। সবগুলি পুঁথি শেষ হইলে আবার একদিন চলিলেন সেই মেছুয়াবাজারে। এমনি করিয়া বার বার গিয়া এ-দোকান ও-দোকান ঘুরিয়া শুধু পুঁথিই কিনিলেন না, পুঁথির দোকানদারদের সঙ্গে রীতিমত বন্ধুত্ব করিয়া আসিলেন।