» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

আমার সঙ্গে আলাপ করিয়া আমার লেখাগুলি শুনিয়া অবন বাবুর ছবি আঁকার কাজের ব্যাঘাত হইত না। বরঞ্চ আমার মত কেহ তার কাছে বসিয়া গল্প করিলে ছবি আঁকা আরও সুন্দর হইত। এইজন্য বাড়ির লোকে আমার ঘন ঘন তার কাছে যাওয়া-আসা খুব পছন্দ করিতেন।

একদিন মোহনলালের বাবা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বলিলেন, “অবনবাবু তোমার ‘নকসী কাঁথার মাঠ’এর কথা বললেন। তোমার বই তার ভাল লেগেছে। আমাকে আদেশ করলেন বইএর ছন্দের বিষয়ে তোমাকে নির্দেশ দিতে। তা ছন্দের রাজা অবনবাবুই যখন তোমার সমস্ত বই দেখে দিয়েছেন, আমার আর কি প্রয়োজন।” আমি বুঝিতে পারিয়া আনন্দিত হইলাম। আমার সামনে না করিলেও অগোচরে তিনি পুস্তকের প্রশংসা করিয়াছেন।

বার বার অবনবাবুর বাড়ি আসিয়া তাহার দৌহিত্র মোহনলালের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠে। ঠাকুর-পরিবারের মধ্যে এমন নিরহঙ্কার মিশুক লোক খুব কমই দেখিয়াছি। মোহনলালের বন্ধুগোষ্ঠী এমনই বিচিত্র, এবং পরস্পরে এমন আকাশ-জমীন তফাৎ, তাহা ভাবিলে আশ্চর্য হইতে হয়।

আমি যখন কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিতাম তখন মোহনলালের সঙ্গে সুদীর্ঘ পত্রালাপের মাধ্যমেঠাকুরবাড়ির সঙ্গে পরিচিতির যোগসূত্র বজায় রাখিতাম। আমি লিখিতাম পল্লীবাংলার গ্রামদেশের অলিখিত রুপকাহিনী। বর্ষাকালে কোন ঘন বেতের ঝাড়ের আড়ালে ডাহুকের ডাক শুনিয়াছি, কোথায় কোন ডোবায় সোলপোনাগুলি জলের উপরে আলপনা আঁকিতে আঁকিতে চলিয়াছে, বসন্তের কোন মাসে কোন বনের মধ্যে নতুন গাছের পাতার ঝালর দুলিয়া উঠিয়াছে, তাহার উপরে আমগাছের শাখায় হলদে-পাখিটি ডাকিয়া ডাকিয়া হয়রান হইতেছে, এই সব কাহিনী। আর মোহনলাল লিখিত তার দাদামশায়ের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের বহু বিচিত্র ঘটনা; আমার মানসলোকের রবীন্দ্রনাথের রহস্যময় আনাগোনার কথা, কোন মাসে তিনি শান্তি নিকেতনের রূপকারদের সঙ্গে লইয়া আসিয়া কোন কথাকাহিনীর উপহার দিয়া গেলেন কলিকাতার বুকে—সেই সব ঘটনা। চিঠির ঘুড়িতে চড়িয়া তখন দেবলোকের ইন্দ্রজিতের মনের গগন-কোণে আসিয়া ভিড় জমাইত। চিঠিতে যে কথা সবটা স্পষ্ট হইয়া না উঠিত, কলিকাতা গিয়া বন্ধুর সঙ্গে একান্তে বসিয়া সেই সব কথা ইনাইয়াবিনাইয়া ওলট করিয়া পালট করিয়া নতুন ভাবে উপভোগ করিতাম।

তারপর অবনঠাকুরের বারান্দায় দিনের পর দিন, সকাল হইতে দুপুর পর্যন্ত, একাগ্র বসিয়া থাকিতাম। দুই ভাই অবনবাবু আর গগনবাবু রঙের জাদুকর; কথার সরিৎসাগর। তুলির গায়ে রঙ মাখাইয়া কাগজের উপরে রঙ মাখামাখি খেলা—দেখিয়া দেখিয়া সাধ মেটে না। দূর-অতীতে মোগল-হেরেমের নির্জন মণিকোঠায় সুন্দরী নারীর অধরের কোণে যে ক্ষীণ হাসিটি ফুটিতে না ফুটিতে ওড়নার আড়ালে মিলাইয়া যায়—একজন তারই এতটুকু রেস রঙিন তুলির উপরে ধরিয়া বিশ্বের রূপপিয়াসীদের মনে অনন্তকালের সান্ত্বনা আঁকিয়া দিতেছেন, আরজন কথাসরিৎসাগরে সাঁতার কাটিয়া ইন্দ্রধনুর দেশ হইতে রূপকথার রূপ আনিয়া  কাগজের উপরে সাজাইতেছেন। এ রূপ দেখিয়া মন তৃপ্তি মানে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, সকাল হইতে দুপুর, বিকাল হইতে সন্ধ্যা চলিয়াছে দুই জাদুকরের একান্ত সাধনা। এদের বন্ধু নাই, আত্মীয় নাই, স্বজন নাই, প্রতিবেশী নাই। নীড়হীন দুই চলমান বিহঙ্গ উড়িয়া চলিতে চলিতে পথে পথে ছবির রঙিন ফানুস ছড়াইয়া চলিয়াছেন। এরা চলিয়া যাইবেন আমাদের গ্রহপথ হইতে হয়ত আর কোন সুন্দরতর গ্রহপথে। যাওয়ার পথখানি ছবির রঙিন আখরের দান-পত্রে রাঙাইয়া চলিয়াছেন। দুইজনের মুখের দিকে একান্তে চাহিয়া থাকি। গগনবাবু  কথা বলেন না মাঝে মাঝে মৃদু হাসেন। সে কী মধুর হাসি! অবনবাবু কাগজের উপর রঙ চড়ান, আর মধ্যে মধ্যে কথা বলেন। কথার সরিৎসাগরে অমৃতের লহরী খেলে।

অবনবাবু মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেন, “কি হে, জসীমিঞা, কোন কথা যে বলছ না?”

কথা আর কী বলিব। হৃদয় যেখানে শ্রদ্ধা হইয়া ওই দুই সাধকের চরণতলে লুটাইয়া পড়িতেছে, সেখানে সকল কথা নীরব। মনে মনে শুধু বলি অমনই একান্ত সাধনার শক্তি যেন আমার হয়। আমার যা বলার আছে, তা যেন একান্ত তপস্যায় অঙ্কুরিত হইয়া ওঠে।