☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
২
এই ভাবে সুদীর্ঘ এক বৎসর গল্প বলার সাধনা করিয়া আবার কলিকাতা অসিয়া প্রথমে মোহনলালের সঙ্গে দেখা করিলাম। তাহাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতার একটি ছোটদের স্কুলে গিয়া গল্প বলিলাম। গল্পের যে স্থানটি খুব করুণ রসের, দেখিলাম, সে স্থানটিতে ছোটদের চোখ হইতে টসটস করিয়া জল পড়িতেছে। গল্প বলা শেষ হইলে মোহনলাল বলিল ‘এবার তোমার গল্প বলা ঠিক হয়েছে। এবার দাদামশায়কে শুনাতে পার।’
পরদিন অবনবাবুর দরবারে আসিয়া হাজির হইলাম।
এবার গল্পের আসরে পূর্বের মত তিনি সবাইকে আহ্বান করিলেন না। শুধু অবনবাবু আর তার দুই ভাই—সমর আর গগন। আর তার ছোট ছোট নাতি-নাতনীরা। এবার আর পূর্ববারের মত গল্প বলিতে বলিতে ঠেকিয়া গেলাম না। আগাগোড়া গল্পটি সুন্দর করিয়া বলিয়া গেলাম। গল্প শেষ করিয়া নিজেরই ভাল লাগিল। ভাবিলাম অবনবাবু এবার আমার গল্পের তারিফ করিবেন। কিন্তু খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, আমার সেই কথিত গল্পটি তিনি একটু-আধটু ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আমি যেখানে করুণরসের অবতারণা করিয়াছিলাম সেখানে হাস্যরস করিয়া এমন সুন্দর করিয়া গল্পটি বলিলেন যে তার কথিত গল্পটি একেবারে নূতন হইয়া গেল।
ফেরার পথে মোহনলাল বলিল, “এবার তোমার গল্প বলা ভাল হয়েছে। সেইজন্যই দাদামশায় ওটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে শুনিয়ে দিলেন। ওটাই তোমার গল্প বলার পুরস্কার।”
আমি কিছু নক্সী কাঁথা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। একদিন অবনবাবু এই কথা শুনিয়া খুব উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তাঁর ড্রয়ার হইতে তিনি এক তাড়া কাগজ বাহির করিলেন। তাহার মধ্যে নানান রঙের বহু কাঁথার নক্সা ঝলমল করিতেছে। কথা সেলাই করিতে এক এক রকম নক্সায় এক এক রকমের ফোড়নের প্রয়োজন হয়। বয়কা সেলাই, বাঁশপাতা সেলাই, তেরসী সেলাই প্রভৃতি যত রকমের কাঁথা-সেলাই প্রচলন আছে, তাহার প্রত্যেকটি নক্সা সেই কাগজগুলিতে আঁকা। নানা কাঁথা সংগ্রহ করিয়া এই নক্সাগুলি তৈরী করিতে অবনবাবুর বহুদিন একান্ত তপস্যা করিতে হইয়াছে। আমি ভাবিয়া বিস্মিত হইলাম, আমাদের কত আগে তিনি এইসব অপূর্ব পল্লীসম্পদের সন্ধান করিয়াছিলেন।
নক্সী কাঁথার প্রশংসা করিতে অবনবাবুর মুখ দিয়া যেন নক্সী কথার ফুল ঝরিয়া পড়ে। রাণী ইসাবেলাকে কে যেন একখানা নকসী কাঁথা উপহার দিয়াছিলেন। মহাভারতে চামড়ার উপর নক্সা-করা এক রকমের কাঁথার বর্ণনা আছে। সিলেট জেলার একটি বিধবা মেয়ে একখানি সুন্দর কাঁথা তৈরী করিয়াছিলেন; তার জীবনের বালিকা বয়স হইতে আরম্ভ করিয়া বিবাহের উৎসব, শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, নববধূর ঘরকন্না, প্রথম শিশুর জন্ম, স্বামীর মৃত্যু প্রভৃতি নানা ঘটনা তিনি এই কাঁথায় অঙ্কিত করিয়াছিলেন।
দেশে ফিরিয়া সিলেট জেলার এই মহিলার কাহিনী বারবার আমার মনে উদয় হইত। আমার ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকে আমি যে কাঁথার উপর এতটা জোর দিয়াছি, তাহা বোধ হয় অবনীন্দ্রনাথের-ই প্রভাবে।
আর একবার কলিকাতা আসিয়া ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি লইয়া অবনীন্দ্রনাথকে দেখাইলাম। ইতিপূর্বে দীনেশবাবু এই পাণ্ডুলিপির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। অবনবাবু ছবি আঁকিতে আঁকিতে আমাকে আদেশ করিলেন, “পড়।”
আমি খাতা খুলিয়া ‘নকসী কাঁথার মাঠ’-এর প্রথম পৃষ্ঠা হইতে পড়িতে আরম্ভ করিলাম। খানিক পরে দেখি, ও-পাশে সমরেন্দ্রনাথ তাঁহার বই পড়া রাখিয়া আমার কাব্য শুনিতেছেন। গগনবাবুর তুলিও আস্তে আস্তে চলিতেছে। আমি পড়িয়া যাইতেছি, বইএর কোন জায়গায় আধুনিক ধরনের কোন প্রকাশভঙ্গিমা আসিয়া পড়িলে অবনবাবু তাহা পরিবর্তন করিবার উপদেশ দিতেছেন। মাঝে মাঝে আমার হাত হইতে খাতাখানা লইয়া তারই স্বভাবসুলভ গদ্যছন্দে সমস্ত পৃষ্ঠাটি পরিবর্তন করিয়া দিতেছেন। আমি বাড়িতে আসিয়া রাত্রি জাগিয়া সেই পৃষ্ঠাগুলি আবার নূতন করিয়া লিখিয়া লইয়াছি। কারণ অবনবাবুর সমস্ত নির্দেশ গ্রহণ করিলে তাহার ও আমার রচনায় মিলিয়া বইখানা একটি অদ্ভুত ধরনের হইত।
সকালে আসিয়া আমি কবিতা শুনাইতে বসিতাম। বেলা একটা বাজিয়া যাইত, চাকর আসিয়া তাহাকে স্নানের জন্য লইয়া যাইত। আমিও বাসায় ফিরিতাম। এইভাবে চার-পাঁচ দিনে বই পড়া শেষ হইল। বলা বাহুল্য যে এতটুকু বই পড়িয়া শুনাইতে এত সময় লাগিবার কথা নয়। কিন্তু বইয়ের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে অবনবাবু অনেক সময় লইতেন।
এই কয়দিন তিনি শুধু আমার বই পড়াই শোনেন নাই, তাঁর হাতের তুলিও সামনের কাগজের উপরে রঙের উপর রঙ মেলিয়া নানা ছবির ইন্দ্রধনু তৈরী করিয়াছে। দীনেশবাবু এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া এত প্রশংসা করিলেন, অবনবাবুর কাছেও সেই ধরনের প্রশংসা আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু অবনবাবু শুধু বলিলেন, “মন্দ হয় নাই। ছাপতে দাও।”
গগনবাবু কোন কথা বলিলেন না। শুধু সমরবাবু এক দিন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমার কবিতাটি বড়ই ভাল লাগল। নজরুলের চাইতেও ভাল লাগল।”
অবনবাবুর সংশোধন-করা নকসী কাঁথার মাঠের পাণ্ডুলিপি বন্ধুবর মোহনলালের নিকট আছে।
‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ছবি সহ প্রকাশ করিবার বড়ই ইচ্ছা ছিল। শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের পরিচয়-লিপিতে বন্ধুবর রমেন্দ্র চক্রবর্তী এই পুস্তকের ছবিগুলি আঁকিয়া দিতে রাজী হইলেন। কিন্তু আমি লিখিয়াছি পূর্ববঙ্গের কথা। রমেন্দ্র কোন দিন পূর্ববঙ্গ দেখেন নাই। পূর্ববঙ্গের মাঠ আঁকিতে তিনি শান্তিনিকেতনের মাঠ আঁকেন। আমাদের এখানে মেয়েরা কলসী কাখে করিয়া জল আনিতে যায়, ও-দেশের মেয়েরা কলসী মাথায় করিয়া জল আনে। আমাদের দেশে কাঁথা সামনে মেলন করিয়া ধরিয়া তার উপরে বসিয়া মেয়ের কথা সেলাই করে। রমেন্দ্র ছবি আঁকিলেন, একটি মেয়ে কাঁথাটি কোলের উপর মেলিয়া সেলাই করিতেছে। ছবিগুলি দেখিয়া আমার বড়ই মন খারাপ হইল। তাছাড়া তখন পর্যন্ত আমার কোন লেখাকে ছবিতে প্রতিফলিত হইতে দেখি নাই। তখনকার কবি-মন কবিতায় যাহা লিখিয়াছে, মনে মনে ভাবিয়াছে তার চাইতেও অনেক কিছু। সেই অলিখিত কল্পনাকে রূপ দিবেন শিল্পী। কিন্তু এরূপ শিল্পী কোথায় পাওয়া যাইবে? এখন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। এখন কোন কবিতা কেহ চিত্রিত করিলে চিত্রকরকে অনেকখানি স্বাধীনতা দিয়া তবে তার বিচার করি।
ছবিগুলি আনিয়া অবনবাবুকে দেখাইলাম। বলিলাম, আমার বইএর সঙ্গে ছবিগুলি মেলে না। তিনি কিছুক্ষণ ছবিগুলি দেখিয়া বলিলেন, “তোমার কবিতা অন্য ধরনের। আমি ছাড়া এর ছবি আর কেউ আঁকতে পারবে না।”
আমি বোকা। তখন যদি বলিতাম, আপনি ছবি আঁকার ভার নেন, হয়ত তিনি রাজি হইয়া যাইতেন। কিন্তু আমি বলিলাম, “ছবিগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে না। রমেন্দ্রবাবুকে এই কথা কী করে বলি?”
অবনবাবু উত্তর করিলেন, “রমেনকে বল গিয়ে আমার নাম করে। বলো যে ছবিগুলি আমি পছন্দ করি নি।”
বন্ধুবর ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইয়ের ছবিগুলি আঁকিয়া দিবেন, কথা দিয়াছিলেন। কয়েকটি ছবি তিনি আঁকিয়াও ছিলেন। কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হইলেন না।
গগনবাবুকে একদিন এইকথা বলিলাম। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তোমার বইয়ের ছবি আমি করে দেব।” কিন্তু ইহার কিছুদিন পরেই গগনবাবু রোগে আক্রান্ত হইলেন। এবং এই রোগেই তিনি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইলেন। গগনবাবুর মত এমন সুন্দর প্রাণ গুণীলোক দেখি নাই। তাঁর মত গুণের আদর কেহ করে নাই। আমার ওস্তাদ দীনেশবাবুর মুখে শুনিয়াছি, গগনবাবু যদি কাউকে পছন্দ করিতেন, তাকে সর্বস্ব দান করিতে পারিলে খুশি হইতেন। দীনেশবাবুর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ পুস্তক পড়িয়া তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই জন্য তিনি বিশ্বকোষ লেনে দীনেশবাবুকে একখানা বাড়ি তৈরি করিয়া দিয়াছিলেন। কলিকাতার বুকে কাউকে একখানা বাড়ি তৈরী করিয়া দেওয়া কতটা ব্যয়সাপেক্ষ তাহা সহজেই বোঝা যায়।
কিছুতেই ছবি দিয়া ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ প্রকাশ করা সম্ভব হইল না। অবনবাবু উপদেশ দিলেন, তোমার পুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের পূর্বে কয়েক লাইন করিয়া গ্রাম্য কবিদের রচনা জুড়িয়া দাও। তাহারাই ছবির মত তোমার বইকে চিত্রিত করিবে। অবনীন্দ্রনাথের উপদেশ অনুসারেই ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের প্রত্যেক অধ্যায়ের পূর্বে নানা গ্রাম হইতে আমার সংগৃহীত গ্রাম্য-গানগুলির অংশবিশেষ জুড়িয়া দিলাম। গানের পিছনে তার-যন্ত্রের ঐক্যতানের মত তাহারা আমার পুস্তকের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে বর্ণিত ভাবধারাকে আরও জীবন্ত করিতে সাহায্য করিয়াছে। অবনবাবু ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের একটি সুন্দর ভূমিকা লিখিয়া দিয়া আমাকে গৌরবান্বিত করিয়াছিলেন। প্রচ্ছদপটের জন্য তিনি একটি ছবি আঁকিয়া দিয়াছিলেন। পানির উপরে একখানা মাঠ ভাসিতেছে। সেই ছবিতে খুব সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম তুলি ধরিয়া তিনি এমন ভাসা-ভাসা আবছায়া রঙের মাধুরী বিস্তার করিয়াছেন, আমার প্রকাশক হরিদাসবাবু বলিলেন, ব্লক করিলে এ ছবির কিছুই থাকিবে না। সুতরাং ছবিখানি ব্যবহার করা গেল না। অমূল্য সম্পদের মত আমি উহা সঙ্গে রক্ষা করিতেছি।
‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ছাপা হইবার সময় মাঝে মাঝে অবনবাবু তাহার প্রুফও দেখিয়া দিয়াছিলেন। দীনেশবাবুও ইহার অনেক গুলি প্রুফ দেখিয়া দিয়াছিলেন। আজ এ কথা বলিতে লজ্জায় মরিয়া যাইতেছি। কত ক্ষুদ্র কাজের জন্য কষ্ট বড় দুটি মহৎ লোকের সময়ের অপব্যয় করাইয়াছি। আমি যখনই কলিকাতায় যাইতাম, প্রতিদিন সকালে গিয়া অবনবাবুর সামনে বসিয়া থাকিতাম। তিনি আরামকেদারায় বসিয়া ছবির উপরে রঙ লাগাইতে থাকিতেন। মাঝে মাঝে সেই ছবিকে পানির মধ্যে ডুবাইয়া ধুইয়া ফেলিতেন; আবার তাহা শুখাইয়া তাহার উপরে নিপুণ তুলিকায় রঙের উপরে রঙ লাগাইয়া যাইতেন। ও-পাশে গগনবাবুও তাহাই করিতেন। আমি বসিয়া বসিয়া এই দুই বয়স্ক শিশুর রঙের খেলা দেখিতাম। ছবি আঁকিতে আঁকিতে অবনবাবু আমাকে গ্রাম্য গান গাহিতে বলিতেন। আমি ধীরে ধীরে গান গাহিয়া যাইতাম। বাড়ির ছেলেমেয়েরা আড়াল হইতে আমার গান শুনিয়া মুচকি হাসি হাসিয়া চলিয়া যাইতেন। কিন্তু আমার বয়স্ক শ্রোতাদের কোন দিনই অবহেলা লক্ষ্য করি নাই। নতুন কোন গ্রাম্য কাহিনী সংগ্রহ করিলে তাহাও অবন বাবুকে শুনাইতে হইত। নতুন কোন লেখা লিখিয়া আনিলে তিনি ত শুনিতেনই। সেইসব লেখা শুনিয়া তাহার কোথায় কোথায় দোষত্রুটি হইয়াছে, তাহাও বলিয়া দিতেন। কোন লেখারই কখনও তারিফ করিতেন না। কোন লেখা খারাপ লাগিলে তিনি আমাকে বলিতেন। লেখার ভিতরে ইঙ্গিত থাকিবে বেশি; সব কথা খুলিয়া বলিবে; কলম টানিয়া লইবার সংযম শিক্ষা কর।