☼ জসীম উদ্দীন ☼
ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়
১৩
আমি ঢাকা চলিয়া আসিলাম দেশ-বিভাগের পরে। অবনীন্দ্রনাথের জমিদারী সংক্রান্ত বহু কাজ আমাদের পূর্ব-পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট-ভবনের সঙ্গে জড়িত ছিল। অবনবাবু বড় ছেলে অলকবাবু আমাকে সেই বিষয়ে খবরাখবর লইতে প্রায়ই পত্র লিখিতেন। আমিও তাহার ত্বরিৎ জবাব দিতাম।
একদিন সকালে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া প্রায় তিনটার সময়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। দেখি, গবাদা আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। আমার স্ত্রী পরিচয় পাইয়া আগেই তাহাকে কিছু নাস্তা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। শুনিলাম, গবাদা ঢাকা আসিয়াছেন রাত একটায়। সারারাত্রি স্টেশনে কাটাইয়া সকালে আমার খোঁজে বাহির হইয়াছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকায় কত নতুন নতুন লোক আসিয়াছে। কে কাহার সন্ধান রাখে! প্রায় সারাদিন ঘুরিয়া তিনি আমার বাসার খোঁজ পাইয়াছেন। এত বেলা পর্যন্ত এক কাপ চা-ও অন্য কোথাও পান করেন নাই। শুনিয়া আমার দুইচোখে পানি বাহির হইবার উপক্রম হইল। সেই ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর—আহারবিহারে কত বিলাসের মধ্যে মানুষ! রাত্রি একটার সময় হইতে পরদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত অভুক্ত অনিদ্রায় ঘুরিয়া আমার বাসা খুঁজিয়াছেন। ঢাকায় কত হোটেল, ভাল ভাল থাকিবার জায়গা। তাহা সত্ত্বেও কতখানি অসুবিধা থাকিলে ঠাকুর পরিবারের ছেলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমার বাসার সন্ধান করেন। ভাবিয়া নিজের উপরে ধিক্কার আসিল। কেন এমন হইল! দেশে আজ এমন কেহ নাই যে এই পরিবারের বিরাট দানের এতটুকুও আজ পরিশোধ করিতে পারে।
আমার স্ত্রীকে গিয়া বলিলাম, “দেখ, রাজপুত্র আজ আমাদের অতিথি। তোমার যতটুকু আদর-আপ্যায়নের ক্ষমতা আর রন্ধনবিদ্যা আছে, জাহির কর।”
দুই বন্ধুতে মিলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ,—আমাদের বিগত জীবনের নানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি। স্নেহময় অবনঠাকুর আজ পরলোকগত। তাঁর জীবনের ঘটনাগুলিকে অতীতের গহন অন্ধকার হইতে টানিয়া আনিয়া দুই বন্ধু সামনে মেলিয়া ধরিলাম। বায়স্কোপের চিত্রগুলির মত তারা একে অপরের হাত ধরাধরি করিয়া উপস্থিত হয়। সকাল কাটে, সন্ধ্যা কাটে। রাতও বুঝি ভোর হইবার জন্য ঢুলুঢুলু আঁখি। কিন্তু আমাদের বিরাম নাই। দুপুরে রেভেনিউ-বিভাগের সম্পাদক ফজলুল করিম সাহেবের সঙ্গে গবাদার বিষয় সংক্রান্ত আলাপ হইল। তিনি অতিশয় অমায়িক ব্যক্তি। গবাদার যা-কিছু কাজ তিনি করিয়া দিতে অঙ্গীকার করিলেন।
দুই-তিন দিন গবাদা আমাদের এখানে ছিলেন। যে মানুষটি সব সময় পরের কাজ করিয়া বেড়াইতেন, আজ তিনি নিজের জন্য কাজ খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। বোম্বেতে সিনেমা-লাইনে কিছুদিন কাজ করিয়াছিলেন। তারপর দেশে ফিরিয়া একেবারে বেকার। বন্ধুকে পরামর্শ দিই, “আপনি এখানে চলে আসুন। নতুন করে এখানে নাটক সৃষ্টি করি—আর্ট সৃষ্টি করি।”
গবাদা রাজী হইয়া যান। তার পর চলে দুই জনে নানা পরিকল্পনা।
জানি যে, রাত্রি ভোর হইলে এই পাখি তার ক্ষণিকের নীড় ছাড়িয়া সুদূর আকাশে পাড়ি দিবে। তবু যারা কল্পনাবিলাসী, তাদের রাত্রি কল্পনার পাখা বিস্তার করিয়াই ভোর হয়। কয়েকদিন থাকিয়া গবাদা চলিয়া গেলেন। তাঁকে গাড়ীতে উঠাইয়া দিয়া আমার-লেখা “যাদের দেখেছি” বইখানা পথে পড়িবার জন্য উপহার দিলাম। এই পুস্তকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কাহিনী লেখা আছে। তাতে অবনঠাকুরের বাড়ির অনেকের কথা আছে।
বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে নিমন্ত্রণ পাইয়া সেবার কলিকাতা গেলাম। গিয়া উঠিলাম সুজনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। সুজন সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। অবনঠাকুরের বাড়ি নিলামে বিক্রী হওয়ার পরে তাঁরা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির নিচের তলায় দুইখানা ঘর লইয়া কোন রকমে বসবাস করিতেছেন। সেই অল্প-পরিসর জায়গায় তাঁদেরই স্থান-সঙ্কুলান হয় না। কিন্তু তবু কতই না আদর করিয়া তাঁহারা আমাকে গ্রহণ করিলেন।
আজ ঠাকুরবাড়ির সেই ইন্দ্রপুরী শ্মশানে পরিণত হইয়াছে। সে লোক নাই; সে জাঁকজমক নাই। বাড়িখানি ভাঙিয়া চুরিয়া রবীন্দ্রভারতীর জন্য নতুন নক্সায় ইমারৎ তৈরী হইয়াছে। সেই গাড়ীবারান্দা, সেই হল-ঘরগুলি, সেই উপরে সিঁড়ি, সেই দক্ষিণদুয়ারী বারান্দা—যেখানে বসিয়া দাদামশাই ও তাঁর দাদা গগনেন্দ্রনাথ শিল্পসাধনা করিতেন, নির্মম বর্তমান তার কোন চিহ্ন রাখে নাই। শুনিয়াছি শেক্সপীয়ারের অতি-পুরাতন বাড়িখানি যেমনটি ছিল, তেমনি করিয়া সংরক্ষিত হইয়াছে। আজ অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের বাড়িটি কি সেই ভাবে রক্ষিত করা যাইত না? দেশের জন্য বক্তৃতা করিয়া যাহারা গোলদীঘি-লালদীঘিতে আলোড়ন তুলিতেন, দেশের লোকের কৃতজ্ঞতা কি শুধু তাদেরই জন্য? মহাভারতের মর্মকথা শুনাইবার জন্য যাহাদিগকে আমরা শ্রেষ্ঠ আসন দিই, তারা কি কারো চাইতে কম ছিলেন?
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর, যাঁরা সর্বভারতের ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান ঢুড়িয়া দেশবাসীর জন্য গৌরবের ইন্দ্রসভা রচনা করিয়াছেন, যাদের তুলির স্পর্শে জনগণ মহান দেশকে অনুভব করিতে শিখিয়াছে, তাদের প্রতি কি কারো কৃতজ্ঞতা নাই।
সুজন কিছুই উপার্জন করে না। সে বিনা বেতনে কোথায় কোথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখাইয়া সময় কাটায়। ছোট ভাই কোন অফিসে সামান্য কিছু উপার্জন করে, তাই দিয়া অতি কষ্টে তাদের দিন চলে। সমর ঠাকুরের আদরের পুত্রবধু সুজনের মা পরিবারের কত বিলাস-উপকরণের মধ্যে লালিত-পালিত। আজ পরনে তাঁর শতছিন্ন বস্ত্র। ঘরের আসবাবপত্রের দৈন্য যেন আমাকে শত বৃশ্চিকদহনে দগ্ধ করিতেছিল।
উপরে থাকেন সৌম্যের মা। কত আদর করিয়া চা খাইতে ডাকিলেন। চা খাইতে খাইতে কথা বলি। নানা কথার অবতারণা করিতে অতীত আসিয়া পড়ে। অতীত কথা আসিতে শোকের কথা আসিয়া পড়ে। ঐ শোক-সন্তপ্ত পরিবারে নিজের অজ্ঞাতে তাদের সঞ্চিত দুঃখকে আরও বাড়াইয়া দিয়া আসি।
নীচে সুজনের মা–উপরে সৌম্যের মা—এ-বাড়ির বধূ ও-বাড়ির বধুতে কথা কওয়া-কওয়ি হয়, একের কাহিনী অপরের কাছে বলিয়া জ্বালাইয়া রাখে সেই অতীত যুগের কথা সরিৎসাগরের কাহিনী।
প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে, মহানাটকের চরিত্রগুলি আজ একে একে বিদায় লইতেছেন। এ কাহিনী আর দীর্ঘ করিব না। যে বিয়োগব্যথা আমার অন্তরের অন্তস্তলে মোহময় কান্নার বাঁশী বাজাইয়া সেই অতীত কাল হইতে ছবির পর ছবি আনিয়া আমার মানসপটে দাঁড় করায়, তাহা আমারই নিজস্ব হইয়া থাকুক। লোকালয়ে টানিয়া আনিয়া আর তাহা ম্লান করিব না।