» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

১২

একদিন গিয়া দেখি, অবনীন্দ্রনাথ অনেকগুলি খবরের কাগজ লইয়া কাঁচি দিয়া অতি সাবধানে ছবিগুলি কাটিয়া লইতেছেন। কত রকমারি বিজ্ঞাপনের ছবি—সেগুলি কাটিয়া কাটিয়া যাত্রার পাণ্ডুলিপির এখানে ওখানে আঠা দিয়া আটকাইয়া লইতেছেন। যেন বয়স্ক-শিশুর ছেলেখেলা। ছবিগুলির কোনটার মাথা কাটিয়া অপরটার মাথা আনিয়া সেখানে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। ছবিগুলি তাতে এক অদ্ভুত রূপ পাইয়াছে। তিনি বলিলেন, “আমার যাত্রার বই ইলাসট্রেট করছি।”

একবার খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ায় তিনি মন দিলেন। কাগজে প্রতিদিন কত রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রকাশিত হয়, দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কত উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়, তিনি সেদিকে ফিরিয়াও তাকান না। খবরের কাগজ হইতে তিনি খুঁজিয়া খুঁজিয়া বাহির করেন, বুড়া লুকাইয়া হিমানী মাখিতেছেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই ছবিটি তিনি তাঁর রামায়ণ-খাতার এক জায়গায় আঠা দিয়া আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন। অতি-আধুনিক কবিদের মধ্যে কেহ কেহ খবরের  কাগজের এখান হইতে ওখান হইতে ইচ্ছামত কয়েকটি লাইন একত্র সমাবেশ করিয়া কোন নূতন রকমের ভাব প্রকাশ হয় কি না তার পরীক্ষা করেন। তেমনি তিনিও এই ভাবে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের ছবিগুলি লইয়া কোন একটা বিশেষ সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন কি না বলিতে পারি না। তার যাত্রা-গানের খাতাখানা আবার দেখিতে পাইলে সে বিষয়ে বিশদ করিয়া বলিতে পারিতাম।

একদিন গিয়া দেখি, রাশি রাশি খবরের কাগজ—আনন্দবাজার, যুগান্তর ইত্যাদি লইয়া তিনি মসগুল হইয়া পড়িতেছেন। আমাকে দেখিয়া সহাস্যে ডাকিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, দেখ, দেখ, কেমন সুন্দর বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছে : সুন্দরী কন্যা, গৌরবর্ণ, এম. এ. পড়ে। তার জন্য পাত্র চাই। আর একটা দেখ : মেয়ের বর্ণ উজ্জ্বলশ্যাম; পিতা ধনী ব্যক্তি; ভাল পাত্র পাইলে বিলাত যাওয়ার খরচ দেওয়া হইবে।— কেমন, বিয়ে করবে?”

এমনি খবরের কাগজ লইয়া তিনি খেলা করিতেন। তাঁকে কোনদিনও গুরুগম্ভীর হইতে দেখি নাই। তিনি যে ছবি আঁকিতেন, তাতেও যেন খেলা করিতেন। কখনো কখনো নিজের বাগান হইতে একটুখানি মাটি আনিয়া কিংবা একটি গাছের পাতা আনিয়া ছবির এক জায়গায় ঘষিয়া দিতেন খুব অস্পষ্ট করিয়া, একেবারেই চোখে মালুম হয় না। এমনি করিয়া ছবির উপরে সারাটি সকাল ধরিয়া রঙ ঘষিয়া দুপুরবেলা তাহা পানির মধ্যে ডুবাইয়া লইতেন। সমস্ত ফ্যাকাশে হইয়া যাইত। ছবিখানা শুকাইলে তাহার উপর আবার নতুন করিয়া রঙ পরাইতেন। অতি সূক্ষ্মভাবে ছবিতে রঙ লাগাইতে তার বড় আনন্দ। কাছের আকাশে দু-একটি রেখায় পাখি উড়াইয়া, আকাশটিকে দূরে সরাইয়া দিতেন। দূরের গ্রামখানায় দু-একটি গাছ আঁকিয়া তাকে নিকটের করিয়া লইতেন। রঙের যাদুকর রঙের আর রেখার কৌশলে যা-কিছু নিকটের ও দূরের সমস্ত চোখের চাউনির জগতে টানিয়া আনিতেন।

ঠাকুরবাড়ির সুপরিসর বারান্দার উপর বসিয়া রঙ লইয়া এই বয়স্ক-শিশুরা অপরূপ খেলা খেলিতেন। যে বিরাট জমিদারীর আয় হইতে ঠাকুরবাড়ির এই মহীরূহ বর্ধিত হইয়াছিল, ধীরে ধীরে তাহার পত্রপুষ্প খসিয়া পড়িতেছিল। অপরিসীম দানে ও জমিদারীকার্য তদারকের অক্ষমতায় সেই মহাতরু মাটির যে গভীরতা হইতে রস সংগ্রহ করিত, তাহা ধীরে ধীরে শুখাইয়া আসিল। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের শৈশব-যৌবন বার্ধক্যের লীলা-নিকেতন ঠাকুরবাড়ি নিলামে বিক্রী হইয়া ধনী মাড়োয়ারীর হস্তগত হইল। যাহারা মানুষের জীবনে রূপ দিয়াছিলেন, কথাকাহিনীর সরিৎসাগর খনন করিয়া দেশের জনগণকে পুণ্যস্নান করাইয়াছিলেন, আজ কেহই আসিয়া তাহাদের পিছনে দাঁড়াইল না। কত দরিদ্র সাহিত্যিক, অখ্যাত শিল্পী, প্রত্যাখ্যাত গুণী তাঁহাদের দুয়ারে আসিয়া ধনধান্যে পরিপূর্ণ হইত। দিতে দিতে তারা সর্বস্ব দিয়া প্রায় পথের ভিখারী হইলেন। যাদের কীর্তিকাহিনী সাগর পার হইয়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দেশের নামে জয়ডঙ্কা বাজাইয়া আসিত, তাদেরই দানে দেশ আজ বড় হইয়া তাদের দিকে ফিরিয়াও তাকাইল না। রাজপুত্রেরা পথের ভিখারী হইলেন। বিরাট ঠাকুর-পরিবার শতধা বিচ্ছিন্ন হইয়া  কলিকাতার অজ্ঞাত অখ্যাত অলিতে গলিতে ছড়াইয়া পড়িল।

বরানগরের এক বাগানবাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ উঠিয়া আসিলেন। তার আগেই আমি কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকা চলিয়া আসিয়াছি।

সেবার কলিকাতা গিয়া বরানগরের বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করিলাম। কোন নূতন লেখা পড়িয়া শুনাইলে তিনি খুশী হইতেন। সেইজন্য আমার ‘বেদের মেয়ে’ নাটকের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলাম। তিনি তখন দুরারোগ্য শ্বাসরোগে কষ্ট পাইতেছিলেন।

বারান্দায় বসিয়াছিলেন। জোড়াসাঁকোর সেই দক্ষিণের বারান্দা আজ আর নাই। বলিলাম, “কথা বলতে আপনার কষ্ট হবে। আমার ‘বেদের মেয়ে’ নামক নাটকের পাণ্ডুলিপি এনেছি, যদি অনুমতি করেন, পড়ে শুনাই।”

তিনি বিশেষ কোন উৎসুক্য দেখাইলেন না। সস্নেহে হাতখানি ধরিয়া বলিলেন, “বস।”

সামনে গিয়া বসিলাম। দুই চোখ পানিতে ভরিয়া উঠিতে চাহিতেছিল। সেই রূপকথা বলার কহকুণ্ডপাখি বাক্‌হীন। ছবির পরে ছবি মনে ভাসিয়া উঠিতেছিল। সেই প্রথম পরিচয়ের দিন হইতে যতগুলি দিন এই মহান সৃষ্টিকারের সঙ্গে কাটাইয়াছি, কত হাসি, কত কাহিনী।—সব আজ চিরজনমের মত ফুরাইয়া যাইতেছে।

তিনি বলিলেন, “রাতে ঘুমোতে পারিনে। বড় কষ্ট পাচ্ছি।”

আমি বলিলাম, “শুনেছি, আমেরিকায় কি রকমের যন্ত্র আছে। গলায় লাগালে শ্বাসকষ্টের অনেক লাঘব হয়।”

বলিলেন, “কে এনে দেবে সেই যন্ত্র?”

ভাবিয়া দুঃখ হইল, দেশে বিদেশে তার এত গুণগ্রাহী, এত আত্মীয়স্বজন—তাকে রোগযন্ত্রণা হইতে মুক্তি দিতে কাহারো কী মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে না? হয়ত তাদের বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে তারাও রোগযন্ত্রণা-লাঘবের জন্য অনেক কিছু করিয়াছেন। আমারই ভাবিবার ভুল। আমার ভুল যেন সত্য হয়।

বলিলাম, “দাদামশায়, আপনাকে আমি যেমন দেখেছি, সমস্ত আমি বড় করে লিখব।”

এত যে শরীর খারাপ, তখনও সেই চিরকালের রসিকতা করিয়া কথা বলার অভ্যাস তিনি ভোলেন নাই। একটু হাসিয়া বলিলেন, “তোমার যা খুশী লিখে দিও। লিখে দিও, অবনঠাকুরকে আমি ছবি আঁকা শিখিয়েছি। কাগজে বের করে দাও। আমি বলব, সব সত্যি।”

এতগুলি কথা একসঙ্গে বলিয়া তিনি হাঁপাইতে লাগিলেন। দেখিলাম, নির্জন বরানগরে তিনি আরও একাকী। সঙ্গ দেবার কেহ নাই। মোহনলাল চলিয়া যায় অফিসে। ছেলে অলকবাবু ব্যবসায়ে কিছু উপার্জন করিতে এখানে-ওখানে ছুটিয়া বেড়ান। ছোট দুইটি নাতি—বাদশা বীরু, তারা থাকে শান্তিনিকেতনে। স্ত্রী বহুদিন গত হইয়াছেন। পুত্রবধূকে সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়। শ্বশুরকে দেখিবার শুনিবার কতটুকুই বা অবসর পান তিনি। নির্জন বরানগরের বাড়িতে একাকী শিল্পকার দারুণ ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করিতেন। ব্যাধির যন্ত্রণা হইতে তাকে কেহ মুক্ত করিতে পারিবে না—কিন্তু এই দুঃসময়ে কেহ যদি নিকটে থাকিয়া তাঁর যন্ত্রণায় সমব্যথী হইয়া কাছে কাছে থাকিত, তবে রোগযন্ত্রণা সহ্য করা তাঁর পক্ষে রাখার মত কতই সহজ হইত।

দুই হাতে পায়ের ধূলি লইয়া সালাম করিয়া বিদায় লইলাম। আমার হাত দুইটি শিথিল হাতে টানিয়া লইয়া বলিলেন, “মনে রেখো। তোমাদের কালে আমরা থাকব না। অনেক কিছু মনে পাবে। সেই সঙ্গে আমাকেও মনে রেখো।”

বলিলাম, “আমি একা কেন মনে রাখব দাদামশাই, আমার দেশের শত শত লোক আপনাকে মনে রাখবে।”

তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। রোগ-যন্ত্রণায় হাঁপাইতে লাগিলেন। নীরবে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। বহুকষ্টে নিজের দুই চোখের অশ্রুধারাকে সংযত করিতেছিলাম। মনে মনে কেবলই প্রার্থনার ধ্বনি জাগিতেছিল—হে অস্তাচল-পথযাত্রী,—তোমাকে জানাই আমার শেষ সালাম। তোমার তুলির রেখায় ও রঙে নতুন করিয়া জীবন পাইয়াছিল মহাভারতের সেই বিস্মৃতপ্রায় মহামহিমা। ইলোরা-অজন্তার প্রস্তর-গাত্রে পুরীর মন্দির-চত্বরে কাহিনী যুগ-যুগান্তর ঘুমাইয়াছিল, তুমি তাহাকে নূতন করিয়া আবার তোমার দেশবাসীর উপভোগের সামগ্রী করিলে। যদি দেশে সত্যকার একজনও দেশপ্রেমিক জন্ম গ্রহণ করে, তোমার কাহিনী সে অমর অক্ষরে লিখিয়া রাখিবে। অমনি স্নেহ-মমতা আর রঙের রেখার মাধুরী বিস্তার করিয়া তুমি অপেক্ষা করিও সেই চির-অজানা তুহিন রহস্যময় দেশে। আমরাও একদিন গিয়া তোমার সঙ্গে মিলিত হইব।

বহুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় ফিরিয়া ফিরিয়া সেই স্নেহময় মুর্তিখানি দেখিলাম। সেই দেখাই যে শেষ দেখা হইবে, তাহা সেদিন বুঝিতে পারি নাই। আজ তাঁহার কথা ভাবিতে কেবলই মনে হইতেছে, দূরে বহুদূরে কোন করুণ গোধূলি-আলোকের তলে এক পথশ্রান্ত উট পিঠের বোঝার ভারে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়া আছে বালুকার উপরে। দূরের আকাশ কান্নায় করুণ হইয়া আছে ওপারের রঙিন ম্লান রশ্মির উপর। তাঁর নিজের হাতে আঁকা সেই ‘বোঝা’ ছবিটির মতন তিনিও বুঝি সেখানে লুটাইয়া পড়িয়াছেন।