» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

১১

নানা রকম রাজনৈতিক সমস্যার মাঝে মাঝে সৌম্য সাহিত্য লইয়াও আলোচনা করিত। তাহার বিচিত্র ভ্রমণ-কাহিনীর  কথা বলিত। একবার অসুস্থ অবস্থায় লেনিন একটি পাড়াগাঁয়ে গিয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন। তিনি ত কোন রকম ধর্মই মানিতেন না; বড়দিনের উৎসবের সময় পাড়ার ছেলেরা লেনিনকে আসিয়া ধরিল, আমরা এখানে ক্রিসমাস-ট্রি লাগাইয়া উৎসব করিব। লেনিন অতি আগ্রহের সঙ্গে সেই উৎসবে যোগ দিলেন। তিনি রাজনৈতিক কার্যে বহুলভাবে ব্যস্ত থাকিতেন; কিন্তু প্রত্যেক বড়দিনের ছুটিতে সেই গ্রামের শিশুবন্ধুদের জন্য তিনি ক্রিসমাস-উপহার পাঠাইতেন।

এরূপ বহু রকমের গল্প সৌম্যের নিকট শুনিতাম। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলার অধ্যাপক ডাঃ ভার্গনারের সঙ্গে সৌম্য আমায় পরিচয় করাইয়া দেয়। তিনি জার্মানীর এক মাসিকপত্রে আমার নক্সী-কাঁথার মাঠ পুস্তকের সমালোচনা করেন। সৌম্য সবাইকে গালাগাল দিত, সমালোচনা করিত, দেশের সাহিত্যিক ধর্মনেতা রাষ্ট্র নেতা কাহাকেও বাদ দিত না। কিন্তু এক জনের প্রতি তার মনের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাটক—এগুলির উপরে তার কথকতা শুনিতে প্রাণ জুড়াইয়া যাইত। রবীন্দ্রনাথেরও সৌম্যের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং মমতা ছিল। সৌম্য সেবার ইউরোপে। আমি রবীন্দ্রনাথের সামনে বসিয়া আছি। হঠাৎ খবর আসিল, হিটলারকে হত্যা করিবার ষড়যন্ত্রে একজন বাঙালী যুবক ধরা পড়িয়াছে— সে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ খবরটি শুনিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন, “সৌম্যের মধ্যে যে প্রদীপ্যমান বহ্নি দেখে এসেছি, তাতে সে যে এই ষড়মন্ত্রে লিপ্ত হবে সে বিষয়ে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।” তিনি বহুক্ষণ সৌম্যের নানা গুণের প্রংশসা করিতে লাগিলেন।

সৌম্য প্রায়ই অসুস্থ থাকিত। দুরারোগ্য তার যক্ষ্মারোগ তার দেহকে মাঝে মাঝে একেবারে নিস্তেজ করিয়া তুলিত, কিন্তু দেশের সর্বহারা জনগণের জন্য তার মনের দাবদাহন এতটুকুও ম্লান হইত না। তার মা-বোন-ভাই আত্মীয়স্বজন সকলেই বড় শঙ্কিত ছিলেন—কোন সময়ে সৌম্যকে পুলিশে ধরিয়া লইয়া গিয়া জেলে আটক করিয়া রাখে। জেলে গেলে এই অসুস্থ শরীর তার ভালমত যত্ন লইবার কেহ থাকিবে না, ভালমত চিকিৎসাও হইবে না।

আগেই বলিয়াছি, অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিচের তলায় কয়টি ঘর ভাড়া লইয়া আমি এক সময়ে ঠাকুরবাড়িতে থাকিতাম। একদিন আমার ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় মোহনলাল আসিয়া আমাকে বলিল, অলক-মামার এক বন্ধু পুলিশের বড় অফিসার; অফিসার তাকে গোপনে বলিয়াছেন, জসীমউদ্দীন আমাদের মাইনে-করা লোক; সৌম্য ঠাকুরের বিষয়ে সবকিছু জানার জন্য আমরা তাকে নিয়োগ করেছি। এই খবর বাড়ির সবার মধ্যে একটা ত্রাসের সঞ্চার করেছে। সৌম্যের মা-বোন খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অতএব তুমি এখানকার পাততাড়ি গুটাও।”

শুনিয়া আমি যেন আকাশ হইতে পড়িয়া গেলাম। সৌম্যের মাবোন ছোট ভাগ্নেভাগ্নিরা আমাকে কতই স্নেহের চক্ষে দেখেন। এদের কাছে আমি কেমন করিয়া প্রমাণ করিব, আমি সি. আই. ডি. নই, পুলিশের কোন লোক নই। নিজেরই মনের জানার তাগিদে আমি সৌম্যের সঙ্গে মিতালী করিতে গিয়াছিলাম। এ বাড়ির সব কিছু আকাশ-বাতাস, মাটি-পাথর, সবাই যেন আমাকে আজ সন্দেহের চক্ষে দেখিতেছে। এ অপবাদ হইতে আমি নিজেকে কেমন করিয়া মুক্ত করিব?

যবনিকার অন্তরালে মোহনলাল নিশ্চয়ই আমার হইয়া অনেক লড়াই করিয়াছে। সুতরাং তার সঙ্গে এ আলোচনা করা বৃথা। রান্নাঘরের হাঁড়িতে ভাতগুলি অর্ধসিদ্ধ হইয়া আসিয়াছিল; সেগুলি পাশের ড্রেনে ফেলিয়া দিলাম। একদল কাক আসিয়া একটা পথচারী কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি লাগাইল। নিজের বই-পুস্তক বিছানা-বালিশ গুছাইতে গুছাইতে শরীর অবশ হইয়া আসিতে চায়। মোহনলাল বাড়ির খিড়কি-দরজায় একখানা রিক্সা ডাকিয়া আনিল। সে হয়ত বুঝিয়াছিল, আজ বাড়ির সদর-দরজা দিয়া চলিয়া যাওয়া আমার পক্ষে কতখানি অসহ্য হইবে।

সমস্ত কিছু রিক্সার উপর উঠাইয়া দিয়া ক্ষণেকের জন্য সৌম্যের ঘরে বিদায় লইতে আসিলাম। সৌভাগ্যের কথা, সেখানে আর কেউ ছিল না। সৌম্য বলিল, “আমি সবই শুনেছি। পুলিশের লোকেরা অনেক সময় এই ভাবে মিথ্যে কথা রটিয়ে আমাদের মধ্যে বন্ধুবিচ্ছেদ করতে চায়। এটাও ওদের এক রকমের কৌশল। তবে বাড়ির লোকে এ বিষয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন। তুমি আপাতত এখান হতে চলে যাও।”

সৌম্যের আড্ডায় আমার যাওয়া বন্ধ হইল, কিন্তু অবনঠাকুরের দরজা আমার জন্য আগের মতই খোলা রহিল। কারণ সে বাড়িতে কোন রাজনীতি ছিল না।

ইহার পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হইয়া ঢাকা চলিয়া আসিলাম। ছুটির সময়ে  কলিকাতা গিয়া, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতাম। সেবার গিয়া দেখিলাম, তিনি একাকী বসিয়া আছেন।

বহুদিন আগে তিনি রামায়ণের কাহিনীর উপর একখানা মাত্রাগানের বই লিখিয়াছিলেন। তাহারই পাণ্ডুলিপির উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি যেন হিজিবিজি লিখিতেছেন। আমাকে দেখিয়া বড়ই খুশী হইলেন। বলিলেন, “সামনের টুলটা টেনে নিয়ে বস।”

টুলের উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, কেমন আছেন?”

ম্লান হাসিয়া বলিলেন, “ভালই আছি। আগে ভাল ছিলাম না। আমার ছেলে মেম বিয়ে করে ফিরছে। কত আশা ছিল মনে! ওদের ছেলেমেয়ে হবে—আমার কাছে গল্প শুনবে, ছড়া শুনবে; আমার বৃদ্ধ বয়সের নির্জন দিনগুলোকে মুখর করে তুলবে। কিন্তু মেম সাহেবের ছেলেমেয়েরা ত আমাকে বুঝবে না। তাই মন বড় খারাপ ছিল। এখন ভেবে দেখলাম, আমি নিমিত্তমাত্র। আমার পেছনে একজন কর্তা আছেন। তার ইচ্ছেই পূর্ণ হবে।”

ইহা বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস লইলেন। এত দিন এভাবে তার সঙ্গে মিশিয়াছি। কোন দিনই তাকে আমার কাছে এমন ভাবে আত্মবিশ্লেষণ করিতে দেখি নাই। কথার মোড় অন্যদিকে ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, এখন কি আঁকছেন?”

দাদামশাই বলিলেন, “বিশেষ কিছুই না। ছবি-আঁকা আসছে না, কী করে সময় কাটাই? তোমরাও দূরে চলে গেছ। সেই পুরানো যাত্রাগানের পালাটি সামনে নিয়ে বসে আছি। এটা যে এমন কিছু হয়েছে, তা মনে করি না। কিন্তু সময় কাটাবার একটা অবলম্বন খুঁজে নিতে হয়।”

এই বলিয়া তার যাত্রাগানের সংশোধনে মন দিলেন। সেই আগের লেখা পাণ্ডুলিপির পাতাগুলির ধারে ধারে ছোট ঘোট করিয়া অক্ষর বসাইয়া যাইতেছেন। এত ছোট অক্ষর যে পড়া যায় কি যায় না। পাতার দুই পাশে যেন কতকগুলি বর্ণমালার মৌচাক সাজাইয়া রাখিয়াছেন। সামনে বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে আমার দুইটি নয়ন অশ্রুভারাক্রান্ত হইতে চাহিল।

মহাভারতের রঙ-রেখার এই সার্থক উত্তরাধিকারীর শেষ জীবন কি নির্মম দুঃসহ একাকী হইয়া চলিয়াছে। রূপে, রঙে, রেখায় সারাজীবনের তপস্যা দিয়া যে মহামনীষী যুগযুগান্তরের ব্যথাতুরদের জন্য চিরকালের সান্ত্বনা রচনা করিয়াছেন, আজ জীবনের সায়াহ্নকালে তার জন্য কেহ এতটুকু সান্ত্বনা-বারি বহন করিয়া আনিছে না। আমাদের পৃথিবী এমনি অকৃতজ্ঞ।

কিছুক্ষণ পরে তিনি তার খাতা হইতে মুখ তুলিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুনবে, কেমন হয়েছে আমার যাত্রা-গান?”

আমি বলিলাম, “নিশ্চয়ই শুনব দাদামশাই।”

খাতা খুলিয়া, যাত্রা-গানের অভিনেতাদের মত করিয়া পড়িয়া চলিলেন। মাঝে মাঝে জুড়ি ও কুশীলবগণের গান। তাহাও তিনি সুর করিয়া গাহিয়া শুনাইলেন। সারাটি বিকাল কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন আর অক্ষর চোখে পড়ে না, তখন যাত্রা-পাঠ বন্ধ হইল।

তাঁর নিকট বিদায় লইয়া বাসায় ফিরিলাম। তিনি একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না, যাত্রা-গান আমার কেমন লাগিয়াছে। সত্য বলিতে কি—তিনি চাহিয়াছিলেন, আমারই মত একজন নীরব শ্রোতা। আমাকে শুনাইতে পারিয়াই তাঁর আনন্দ। আমাকে শুনাইতে গিয়া তিনি যেন তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলের সৃষ্টির গোপন কোঠাটিকে বিস্তার করিয়া দেখিলেন। এমনি নীরব শ্রোতা সৃষ্টিকার্যে বড়ই সহায়ক। আমার মতামতের জন্যে তাঁর কি আসে যায়? বই সরাইয়া রাখিয়া ধীরে ধীরে তিনি অন্দরমহলের দিকে চলিলেন। তাঁর মুখে-চোখে যেন নূতন প্রশান্তি।