» » অবন ঠাকুরের দরবারে

বর্ণাকার

জসীম উদ্‌দীন

ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়

১০

দিনুদা সকলের নিকট অবারিতদ্বার। কারও কোন উপকার করিতে পারিলে যেন কৃতার্থ হইয়া যাইতেন। শৈলেনবাবু নামে এক ভদ্রলোক ময়মনসিংহ হইতে কলিকাতা আসেন। পল্লী-সঙ্গীতে তাহার খুব নৈপুণ্য ছিল। কিন্তু অর্থাভাবে কলিকাতা আসিয়া তিনি বিশেষ কিছু করিয়া লইতে পারেন নাই। দিনুদা তাকে একটি হারমোনিয়াম উপহার দিয়াছিলেন। দিনুদার মৃত্যুর পর আমি একটি কবিতা লিখিয়া বিচিত্র কাগজে প্রকাশ করিয়াছিলাম।

এ বাড়ির এতসব লোকের কথা এমন করিয়া ইনাইয়া-বিনাইয়া কেন বলিতেছি, পাঠক হয়ত জিজ্ঞাসা করিবেন। রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের কথা সকলেই জানিবেন, কিন্তু সেই মহাতরুদ্বয়ের ছায়াতলে তিলে তিলে যারা নিজেদের দান করিয়া তরুর বুকে শত শাখাবাহুবিস্তারে সাহায্য করিয়াছিলেন, তাঁদের কথাও কিছুই লিখিত থাকা উচিত। সঙ্গীত-জগতে দিনুদা যদি অন্য পথ ধরিতেন, তবে হয়ত আরও বেশী সুনাম অর্জন করিয়া যাইতে পারিতেন। কিন্তু মহাকবি যশ-সমুদ্রের তরঙ্গে তিনি সব কিছু স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বড় হইয়াছিলেন, এ যেন দিনুদার নিজেরই সাফল্য। এ কথা শুধু দিনুদার বিষয়েই খাটে না। ঠাকুর-পরিবারের সমস্ত লোক এই প্রতিভাদ্বয়কে নানা রকম সুযোগ সুবিধা করিয়া দিতে যে-কোন সময় প্রস্তুত হইয়া থাকিতেন।

অবনীন্দ্রনাথের নীচের তলায় এক ঘরে বসিয়া গবাদা (ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছবি আঁকিতেন। পাশে তাঁর শিষ্য অম্বি, প্রশান্ত এরাও ছবি আঁকিতেন। ওঘরে অলক বাবু ছবি আঁকিতেন। সমস্ত বাড়িটা যেন ছবির রঙে ঝকমক করিত। গবাদা এখন ছবি আঁকেন না। সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম আকাশের মেঘ কাটিয়া গেলে সবুজ ধানের ক্ষেতের উপর যে আবছা আলোর একটু মৃদুপেলব স্পর্শ দেখা যায়, তারই মোহময় রেশ তিনি ছবিতে ধরিয়া রাখিতে পারিতেন। আমার ধানক্ষেত পুস্তকের প্রচ্ছদপটের জন্য তিনি অমনি একখানা ছবি আঁকিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু ব্লক করিয়া ছবি ছাপাইয়া দেখা গেল, সেই আবছা আলোর মোহময় রেশটি ছবির ধানক্ষেতের উপর রক্ষিত হয় নাই। আমার মন খারাপ হইয়া গেল। গবাদাকে এ কথা বলিতে তিনি বলিলেন, “হ্যাঁ ছবিতে যা এঁকেছি হাফটোন ব্লকে তার অর্ধেকটা মাত্র ধরা দেবে। সবটা পাওয়া যাবে না। এ জন্য দুঃখ করো না।”

সারাটি সকাল গবাদা ছবি আঁকিতেন। তারপর আর তাঁকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইত না। ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউটে কোথায় একজিবিশন হইবে, কোন কলেজে ছেলেরা নাটক অভিনয় করিবে—সাজানোগোছানোর ভার গবাদার উপর। ভারবোঝ তাহাকে দিতে হইত না, তিনি নিজেই যাচিয়া ভার গ্রহণ করিতেন। কোন কোন অনুষ্ঠানে তিন-চার দিন অনাহারে অনিদ্রায় একাদিক্রমে কাজ করিতেন। অনুষ্ঠানের কার্যসূচিতে তার নাম পর্যন্ত ছাপা হইত না। এ সব তিনি খেয়ালও করিতেন না।

বহুদিন বহু গ্রামে ঘুরিয়া আমি নানা রকমের পুতুল, নক্সীকাঁথা, গাজীর পট, পিঁড়ি-চিত্র, আলপনা-চিত্র, ব্যাটন, সিকা, পুতুলনাচের পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন এইগুলি দিয়া কলিকাতায় প্রদর্শনী খুলিতে। কিন্তু কে আমার প্রদর্শনী দেখিতে আসিবে? প্রদর্শনী খোলার আগে বড় বড় নামকরা দুএকটি মতামত সংগ্রহের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের ঘরের ছাতে গবাদা এই সংগ্রহগুলি উত্তম করিয়া সাজাইয়া রবীন্দ্রনাথকে ডাকিয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথও আসিলেন। তখন আমার মনে কত আনন্দ! এতদিনের পরিশ্রম সার্থক বলিয়া মনে হইল। রবীন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথ আমার সংগ্রহগুলির এটা-ওটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ত পুতুল নাচের পুতুলগুলি দেখিয়া খুশিতে বিভোর।

সমস্ত দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমার ইচ্ছা করে, এমনি পল্লীশিল্পের রকমারি সংগ্রহ আমার শান্তিনিকেতন সংরক্ষিত করি।”

দিনে দিনে আমার সংগ্রহগুলির বহর বাড়িতেছিল। এই সংগ্রহগুলি কোথায় রাখিব, সেই ছিল আমার মস্তবড় সমস্যা। কবিকে বলিলাম, “আপনি যখন পছন্দ করেছেন, এগুলি শান্তিনিকেতনে নেবার ব্যবস্থা করুন। এগুলি আপনাকে যে আমি দিতে পারলাম, এটাই আমার বড় গৌরবের কথা। আপনার ওখানে থাকলে দেশবিদেশের কলারসিকেরা দেখে আনন্দ পাবেন। নতুন শিল্পীরা তাদের শিল্পকাজে প্রেরণা পাবে। এটাও কি কম  কথা?”

রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি নন্দলালকে এগুলি নিয়ে যাবার কথা বলব।”

নন্দলাল বাবু আমার সংগ্রহগুলি একবার আসিয়া দেখিলেন, কিন্তু লইয়া যাইবার আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। দুই-একদিন তাকে তাগিদ দিয়া আমিও নিরস্ত হইলাম। পল্লী-শিল্পের এই প্রদর্শনী দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ যে বিবৃতি দিয়াছিলেন, তাহা তৎকালীন পত্রিকা গুলিতে ছাপা হইয়াছিল।

পরে আমার এই শিল্পকলার নিদর্শনগুলি দিয়া কতিপয় বন্ধুর সাহায্যে  কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে আমরা একটি প্রদর্শনী খুলিয়াছিলাম। এই উপলক্ষে সেখানে আমাকে কয়েকটি বক্তৃতা দিতে হয়। এই শিল্পগুলির কোনটি কি ভাবে কাহারা তৈরী করে, কোথায় কি উপলক্ষে ব্যবহৃত হয়, এর সঙ্গে কি কি পল্লীগান ও ছড়া মিশিয়া রহিয়াছে, এই শিল্পগুলি আমাদের গ্রাম্যজীবনের আনন্দবর্ধনে ও শোকতাপ হরণে কতটা সাহায্য করে, রঙে ও রেখায় কোথায় এই শিল্প কোন রূপময় কাহিনীর ইঙ্গিত বহিয়া আনে, আমি আমার বক্তৃতায় এই সব কথা বলিয়াছিলাম।

সভাপতির ভাষণে শ্রদ্ধেয় কালিদাস নাগ মহাশয় যাহা বলিলেন, তাহা আমার সমস্ত বলাকে ম্লান করিয়া দিল। কিন্তু বক্তৃতা শুনিয়া গর্বে আমার বুক সাত হাত ফুলিয়া গেল। সমস্ত পৃথিবীর শিল্পকলা তার নখদর্পণে। তিনি বলিলেন, “আজ ইউরোপের একদল শিল্পী তাঁদের যুগযুগান্তরের শিল্পকলার পথকে নিতান্ত বাজে আখ্যা দিয়ে লোকশিল্পের সুধা-আহরণে মশগুল হয়েছেন। সেই আলো-আঁধারী যুগের স্তম্ভের গায়ে পাথরের গায়ে যে সব ছবির ছাপ রয়েছে, তারই উপরে তারা নতুন শিল্পকলা গড়ার সাধনা করছেন।”

সেই বক্তৃতার মধ্যে তিনি গগাঁর জীবনের কাহিনী অবতারণা করিলেন। সারা জীবনের শিল্প-সাধনাকে পশ্চাতে ফেলিয়া তিনি টিহিটি দ্বীপে গিয়া সমুদ্রতীরে উলঙ্গ হইয়া সেই আদিম যুগের বাসিন্দাদের মত সূর্যোদয় দেখিয়া তাহাদের মত বিস্ময় অনুভব করিতে চেষ্টা করিতেন। এই কাহিনী তিনি এমন সুন্দর করিয়া বলিলেন, যাহার রেশ আজও ছবির মত আমার মনে আঁকিয়া আছে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন ঘোষ, বীরেন ভঞ্জ এবং আরও কয়েকজনের চেষ্টায় ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউটের হলে আমার সংগ্রহগুলির আর একটি প্রদর্শনী হয়। তারা সকলেই চাহিতেন, গ্রাম্য লোক-শিল্প এবং লোক-সংস্কৃতির প্রতি আমার যে অনুরাগ, তাহা আরও দশজনে অনুভব করেন; কোন অর্থবান লোক আসিয়া আমার এই প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করেন।

আজ তারা কে কোথায়, জানি না। আমার সেই নিঃসহায় প্রথম জীবনে তারা যে ভাবে আমাকে উৎসাহিত করিতেন, তাহা ভাবিয়া আজিকার অসাম্যের দিনে আমার দুই নয়ন অশ্রুপ্লাবিত হয়।

গবাদা পূর্বের মতই আমায় এই প্রদর্শনীর দ্রব্যগুলিকে যথাস্থানে সাজাইবার ভার নেন। প্রতিদিন স্ত্রী-পুরুষ বহুলোক আসিয়া এই প্রদর্শনীতে ভীড় করিত।

গ্রীষ্মের ছুটিতে একটি বড় বাক্সের মধ্যে এই শিল্পনিদর্শনগুলি সাজাইয়া বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে রাখিয়া আমি দেশে যাই। ছুটির পরে আসিয়া দেখিলাম, ঠাকুরবাড়ির দারোয়ান আমার সংগ্রহগুলি বাক্স হইতে ফেলিয়া দিয়া সেখানে তাহার কাপড়চোপড় বোঝাই করিয়াছে। সংগ্রহগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিল, আবর্জনা মনে করিয়া সে ফেলিয়া দিয়াছে। একথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হইল না। আজও মন বলে, কোন বিশিষ্ট পল্লীশিল্প সংগ্রাহক কোন দালালের সাহায্যে আমার সংগ্রহগুলি কবলস্থ করিয়াছিলেন। তাঁর সংগৃহীত নিদর্শনগুলি তিনি বহুলোককে দেখাইয়াছিলেন, কিন্তু আমাকে দেখান নাই।

আজও একান্ত মনে বসিয়া থাকিলে আমার মানসনয়নে কে যেন সেই নক্সীকাঁথাগুলি মেলিয়া ধরে। তার উপরে পুতুলগুলি, গাজীর পট, মনসাপূজার সরা, বিবাহের পিঁড়ি চিত্র একের পর এক আসিয়া কেহ নাচিয়া কেহ গান করিয়া যার যার অভিনয় নিখুঁতভাবে সমাধা করিয়া যায়। এক এক সময় ভাবি, এই সব জিনিস ভালবাসিবার মন যদি বিধাতা দিলেন, এগুলি সংগ্রহ করিয়া ধরিয়া রাখিবার অর্থসঙ্গতি আমাকে দিলেন না কেন? ভাবিয়া কিছু সান্ত্বনা পাই, আমার বন্ধু দেবপ্রসাদ ঘোষ কলিকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে, ও শিল্পী জয়নুল আবেদীন তাঁর আর্ট-ইস্কুলে পল্লী-শিল্পের নিদর্শনগুলি অতি যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছেন।

পূর্বেই বলিয়াছি, ১৯৩২ সনে কিছুদিনের জন্য আমি বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীচের তলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া লইয়া ঠাকুর-বাড়িতে থাকিতাম। ও-পাশে দোতলায় থাকিতেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বহুকাল ইউরোপ ঘুরিয়া তিনি দেশে ফিরিয়াছেন—নানান দেশের নানান অভিজ্ঞতা লইয়া বহুজন-সমাগমপূর্ণ বাড়ির এই ভদ্রলোক যেন আর এক দেশের মানুষ। আর সব বাড়িতে আর্টের  কথা, সাহিত্যের কথা, নাট্যকলার কথা। সৌম্যেন ঠাকুরের ঘরে কুলীমজুরের কথা, চাষীর কথা—লোকের অন্নবস্ত্রের কথা। এ বাড়িতে ও-বাড়িতে লোক আসিত মোটরে করিয়া। তাহাদের গায়ের সুগন্ধী প্রলেপের বাসে বাতাস সুরভিত হইত। সৌম্যেন ঠাকুরের ওখানে আসিত ছোঁড়া খদ্দর-পরা কোন প্রেসের পদচ্যুত কম্পোজিটর; নিকেলের আধরঙা চশমাজোড়া কোন রকমে কানের সঙ্গে আটকাইয়া আসিত গোবিন্দ-মিলের ফোরম্যান। বুকপকেটে রাঙা রেশমী রুমালেব আর্ধেকটা ঝুলাইয়া চটিজুতা পায়ে আসিত চট্টগ্রামের জাহাজী রহিমুদ্দীন, ছেড়া পাঞ্জাবীর উপর ওভারকোট পরিয়া জর্দাকিমাম সহ পান চিবাইতে চিবাইতে আসিত মেছুয়াবাজারের বছিরদ্দি। এদের লইয়া সৌম্যেন সারাদিন কী সব গুজুর-গুজুর করিত। এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকেরা ঠাট্টা করিয়া বলাবলি করিত, “দেখ গিয়ে ওখানে নতুন কাল মার্কসের উদয় হয়েছে।”

এই সামান্য লোকদের লইয়া সৌম্য মহাশক্তিমান বৃটিশসিংহের কি ক্ষতি করিত, জানি না। কিন্তু প্রতিমাসে দুইবার তিনবার তার বাড়ি খানাতল্লাসী হইত।

এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকে ঠাট্টা করিয়া বলিত, ওসব সাজানো খানাতল্লাসী। খানাতল্লাসী করাইয়া সে পলিটিক্সে নাম করিতে চায়; খবরের  কাগজে নাম উঠাইতে চায়। কিন্তু খবরের কাগজগুলি যাঁদের হাতে, সৌম্য তাদেরও গাল পাড়িত; তাদের বরখাস্ত কর্মচারীদের লইয়া ফুসুর-ফুসুর করিত। খবরের কাগজে তার নাম উঠিত না। এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকদের চলা-বলার ভঙ্গীর অনুকরণ করিয়া সৌম্য তাদের ঠাট্টা করিত, গাল দিত, আর ভবিষ্যৎবাণী করিত “এদের তাসের ঘর ভাঙল বলে। দেশের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই। মানুষের অভাবের কথা এরা বোঝে না, বুঝতে চেষ্টাও করে না। মিথ্যার উপরে এদের বেশাতি; প্রজার রক্তের উপর এদের জমিদারী। এদের সব-কিছু একদিন ভেঙে পড়বে। দেখছ না, এরা সব কেমন অলসের দল! এদের নিত্যকার গল্প ওখানে গেলুম। অমুক এলেন, অমুক গেলেন, গল্পটা এমন জমল জান! ওদের বাড়ি সেদিন যা খেলুম—এমন ভাল হয়েছিল রান্নাটা! সেদিনকার অভিনয় বেশ ভাল জমেছিল।—এইসব হল এদের নিত্যকার আলোচনা। যাঁরা প্রতিভা, তারা দিনরাত খাটছেন, তপস্যা করেন। কিন্তু সেই প্রতিভাগুলির সঙ্গে পরগাছাগুলো কী মধুর আলস্যে দিন কাটাচ্ছে। কোন কাজ করে না; কোনকিছু জানতে চায় না। এদের পতন একদিন হবেই।” সন্ধ্যার সময় সৌম্যের গুণগ্রাহীর দল চলিয়া যাইত। তখন ছাদে বসিয়া তাহার কাছে শুনিতাম নানান দেশের গল্প; ইতিহাসের নানা রকমের কাহিনী। সৌম্য কিছুই মানে না। গান্ধী হইতে আরম্ভ করিয়া নাজিমুদ্দীন সাহেব পর্যন্ত সবাইকে গাল দেয়। হিন্দু দেবদেবী, আল্লা, ভগবান, ব্রহ্মসমাজের কাহাকেও সে বাদ দেয় না। নিজের আত্মীয়স্বজনের ত কথাই নাই। সৌম্য সবাইকে সমালোচনা করে। আমার পক্ষে তার সঙ্গে তাল রাখিয়া চলা বড়ই মুস্কিল। মাঝে মাঝে তুমুল তর্কের অগ্নিদহনের পাশ দিয়া স্নেহের প্রতিমূর্তি সৌম্যের মা আমাদের দিকে একটু চাহিয়া মৃদু হাসিয়া চলিয়া যাইতেন।

সৌম্যের তর্কের আর এক মজা, সে আপোস করিতে জানে। তার মত হইতে সে এক ইঞ্চি ও এদিক-ওদিক হইতে চায় না। যখন তর্কে হারিয়া যাই, তাকে গাল দিই: “তুমি সেই চিরকালের ভুৎমার্গী বামুনপণ্ডিত। তোমার ছোঁয়াছুয়ির ছুৎমার্গ আজ রূপগ্রহণ করেছে তোমার উৎকট মতবাদে। তোমার সঙ্গে যার মতের মিল নেই, তাকে তুমি অস্পৃশ্য বলে মনে কর।” সৌম্যও আমাকে বলে, “কাঠমোল্লা তোমার মুখে দাড়ি নেই, কিন্তু তোমার দাড়ি ভর করেছে তোমার সেকেলে মতবাদে।”

সৌম্যকে বলি, “তুমি ঈশ্বর মান না, কিন্তু আর্ট-সাহিত্য ত মান? আজ ঈশ্বরকে বাদ দিলে জগতের কত বড় ক্ষতি হবে জান? মধ্যযুগের খৃস্টান-গির্জাগুলিতে দেখে এসো, রঙের রেখার ইন্দ্রজালে অচির সৌন্দর্যকে চিরকালের করে রেখেছে। ভারতবর্ষের মন্দির আর মসজিদগুলিতে দেখ, যুগে যুগে কত রঙ-পিপাসুর দল তাদের কালের যা-কিছু সুন্দর, অমর অক্ষরে লিখে রেখে গেছে। এগুলি দেখে আজ আমরা কত সান্ত্বনা পাই।”

সৌম্য আমার কথাগুলি বিকৃত ভঙ্গীতে উচ্চারণ করিয়া উত্তর দেয়, “আহা মরি মরি রে! কালীর মন্দিরে মানুষ বলি দেওয়া, দেবস্থানে দেবদাসী রাখা, গঙ্গাসাগরে সন্তান  বিসর্জন দেওয়া, পুরুষের চিতার উপরে জোর করে স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা ধর্মের কী অপরূপ কীর্তি! পৃথিবীতে ধার্মিক লোকেরা যত নরহত্যা করেছে, কোন তৈমুরলং বা নাদির শাহ, তা করতে পারেনি।”

সৌম্যের সঙ্গে তর্ক করিয়া পারি না। নানা যুগের ইতিহাস লইয়া সৌম্য নূতন নূতন ব্যাখ্যা করে। তার সঙ্গে সব সময় একমত হইতে পারি না। কিন্তু তার কথা শুনিতে ভাল লাগে।

এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে ক্বচিৎ রাজনীতি লইয়া আলোচনা হয়। সবাই আলোচনা করেন সাহিত্য লইয়া, শিল্পকলা লইয়া। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানে বিরাট পার্থক্য থাকিলেও পরস্পর মিশিতে কোন অসুবিধা হয় না। সৌম্যের আলোচনা দেশের রাজনীতি লইয়া। হিন্দু-মুসলমান কোন রাজনৈতিক নেতা তার কঠোর সমালোচনা হইতে বাদ যান না। কংগ্রেসের নেতা, হিন্দুমহাসভার নে, সমাজতন্ত্রী নেতা—এদের সৌম্য এমনই কঠোরভাবে সমালোচনা করে যে কোন গোঁড়া মুসলমান রাজনৈতিকের সমালোচনাও তার ধারকাছ দিয়া যাইতে পারে না। মুসলিম নেতারা অনেক সময় হিন্দু নেতাদের গাল দেন কোন রকমের যুক্তি না দেখাইয়াই। হিন্দু নেতারাও মুসলিম নেতাদের সেই ভাবে গাল দেন। যুক্তির বহর কোন দলেই ততটা শক্ত হয় না, কিন্তু সৌম্য এদের দুই দলকেই গাল দেয় যুক্তির অবতারণা করিয়া। সেইজন্য সৌম্যের সমালোচনায় হুল থাকিলেও তাহাতে বিষ মেশানো থাকিত না।

দুই দলকে সমান ভাবে সে গাল পাড়িল। হিন্দু নেতাদের গাল দিতে সে যেসব যুক্তির অবতারণা করিত, তাহা শুনিয়া মাঝে মাঝে আনন্দ পাইতাম। কারণ, তাঁদের সকলকে আমি সমর্থন করিতাম না। আবার যেসব মুসলিম নেতাকে আমি সমর্থন করিতাম, তাদের বিরুদ্ধে সে কিছু বলিলে প্রাণপণে তার যুক্তির বিরুদ্ধে তর্ক করিতাম, হারিয়া গিয়া কিছুটা ব্যথা পাইতাম।

সৌম্য বলিত, “আস্তে আস্তে দেশ থেকে ধর্মে ধর্মে ভেদ উঠে যাবে। ধর্মের ভেদ জিইয়ে রেখেই দেশের নেতারা সমাজতন্ত্রের প্লাবন দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এই যে মানুষে প্রভেদ—একদল ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, আর একদল না খেয়ে মরছে—এই অসাম্য দেশ থেকে কখনো যাবে না যদি ধর্মের লড়াই এমনি ভাবে চলতে থাকে। দেখছ না—এই যে তোমাদের মুসলানদের শক্তির লড়াই, এ শক্তি কার জন্য? মুষ্টিমেয় কয়েকজন সুবিধাবাদীর জন্য। দেশের না-খাওয়া ভুখা জনগণের জন্য নয়। আর হিন্দুরা যে তোমাদের বাধা দেয়, তা-ও সেই বনিয়াদি কয়েক ঘর ধনীর স্বার্থ নষ্ট হবে বলে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মুসলিম দলের ভুখা জনগণ বুঝতে পারে না, হিন্দুদলের সর্বহারারাও তা বোকে না। দুই সমাজের ধনিক লোকেরা নিজ নিজ সমাজের শ্রমিক লোকদের একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দেয়। কত জীবন নষ্ট হয়। বড়লোকেরা কিন্তু ঠিকই থাকে। সেই জন্যে আমরা চাই, দেশের জনগণ ধর্ম সমাজ সব-কিছু ভুলে রুটির লড়াইয়ে নেমে আসুক।”

আমি বলি, “তোমার রুটির লড়াইয়ে আজ যারা তোমার সঙ্গে, ‘তাদের সংখ্যা হাতের আঙুলে গণা যায়। মনে কর, আমরা একদল মুসলিম তোমার সঙ্গে এসে যোগ দিলাম; ধর্মের কোন ধার ধারলাম না। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান, দুই সমাজেই ত সাম্প্রদায়িক লোকেরা একে অপরের বাড়ি আগুন ধরাবে। যেহেতু আমরা কয়েকজন তোমার সঙ্গে রুটির লড়াই করছি, এ জন্যে কি হিন্দু সাম্প্রদায়িকবাদী আমাদের বাদ দেবে? আমাদের ঘর যখন পুড়বে, তখন আমাদের রক্ষা করবে কে? তোমার সমাজতন্ত্রবাদ যখন আসবে, মেনে নিলাম, সেদিন কোন সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই কারো কোনো ভয় থাকবে না। কিন্তু যতদিন সমাজতন্ত্রবাদ না আসে, ততদিন আমাদের রক্ষা করবে কে?”

সৌম্য বলে, “তবে কি তুমি দেশকে এই ভাবেই চলতে দিতে চাও? দুই দলের সুবিধাবাদী কয়েকজন সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালিয়ে রেখে সমস্ত দেশকে এইভাবেই শোষণ করে যাবে?

তর্কের উপর তর্ক চলিতে থাকে। কোন কোন রাতে আকাশে শুকতারা আসিয়া উদয় হয়।

সৌম্যের  কাগজ গণবাণীতে আমি মহাত্মা গান্ধীকে সমালোচনা করিয়া বেনামীতে একটি কবিতা প্রকাশ করিয়াছিলাম। এতেই বোঝা যাইবে, সৌম্যের মতবাদ তখন কতটা প্রভাবিত করিয়াছিল। মোপলা-বিদ্রোহের উপর সৌম্য একখানা বই লিখিয়াছিল, সেই বিদ্রোহ সম্পর্কে মতভেদ হইয়া আলী-ভ্রাতারা মহাত্মা গান্ধীর দল হইতে বাহির হইয়া যান। সৌম্য তার ছোট্ট বইখানায় যুক্তি এবং তথ্যসহ প্রমাণ করিয়াছিল, মোপলা-বিদ্রোহ বনিয়াদি ধনিকদের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের স্বতস্ফুর্ত ফরিয়াদ।

তৎকালীন কংগ্রেস-নেতা কিদোয়াই এবং আরও অনেকের মতামত উদ্ধৃত করিয়া সৌম্য দেখাইয়াছিল, মোপলা-বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক বলিয়া মহাত্মা গান্ধী ভুল করিয়াছিলেন। সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় যে, তখনকার দিনের সব চাইতে অধিক মুসলিম স্বার্থরক্ষাকারী স্যার নাজিমুদ্দীন সেই পুস্তকখানা গভর্নমেন্টের তরফ হইতে বাজেয়াপ্ত করিয়াছিলেন।