চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বৈধব্য

তথাপি অনুপমা একটু কাঁদিল। স্বামী মরিলে বাঙালীর মেয়েকে কাঁদিতে হয়, তাই কাঁদিল। তাহার পর স্ব-ইচ্ছায় সাদা পরিয়া সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিল। জননী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, অনু, তোর এ বেশ ত আমি চোখে দেখতে পারি না, অন্তত হাতে একজোড়া বালাও রাখ।

তা হয় না, বিধবার অলঙ্কার পরতে নেই।

কিন্ত তুই কচি মেয়ে।

তাহা হোক, বাঙালীর মেয়ে বিধবা হইলে কচি-বুড়ো সমস্ত এক হইয়া যায়। জননী আর কি বলিবেন? শুধু কাঁদিতে লাগিলেন। অনুপমার বৈধব্যে লোকে নূতন করিয়া শোক করিল না।

দুই-এক বৎসরেই সে যে বিধবা হইবে তাহা সকলেই জানিত। কেহ বলিল, মড়ার সঙ্গে বিয়ে দিলে কি আর সধবা থাকে? কর্তাও এ কথা জানিতেন, গৃহিণীও বুঝিতেন, তাই শোকটা নূতন করিয়া হইল না। যাহা হইবার তাহা বিবাহরাত্রেই হইয়া গিয়াছে—স্বামীকে ভালবাসিত না, জানিল না, শুনিল না, তথাপি অনুপমা কঠোর বৈধব্য-ব্রত পালন করিতে লাগিল। রাত্রে জলস্পর্শ করে না, দিনে একমুষ্টি স্বহস্তে সিদ্ধ করিয়া লয়, একাদশীর দিন নিরম্বু উপবাস করে। আজ পূর্নিমা, কাল অমাবস্যা, পরশু শিবরাত্রি, এমনি করিয়া মাসের পনর দিন সে কিছু খায় না। কেহ কোনও কথা বলিলে বলে, আমার ইহকাল গিয়াছে, এখন পরকালের কাজ করিতে দাও। এত কিন্তু সহিবে কেন? উপবাসে অনিয়মে অনুপমা শুকাইয়া অর্ধেক হইয়া গেল। দেখিয়া দেখিয়া গৃহিণী ভাবিলেন, এইবার সে মরিয়া যাইবে। কর্তাও ভাবিলেন, তাহা বড় বিচিত্র নহে। তাই একদিন স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, অনুর আবার বিয়ে দিই।

গৃহিণী বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তা কি হয়? ধর্ম যাবে যে!

অনেক ভেবে দেখলুম, দু’বার বিবাহ দিলেই ধর্ম যায় না। বিবাহের সঙ্গে ধর্মের সঙ্গে এ বিষয়ের কোনও সম্বন্ধ নাই, বরং নিজের কন্যাকে এমন করে খুন করলেই ধর্মহানির সম্ভাবনা।

তবে দাও।

অনুপমা কিন্তু এ কথা শুনিয়া ঘাড় নাড়িয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, তা হয় না।

কর্তা তখন নিজে ডাকিয়া বলিলেন, খুব হয় মা।

তা হলে আমার ইহকাল-পরকাল—দুই কালই গেল।

কিছুই যায় নাই, যাবে না—বরং না হলেই যাবার সম্ভাবনা। মনে কর, তুমি যদি গুণবান পতিলাভ কর, তাহলে দুই কালেরই কাজ করতে পারবে।

একা কি হয় না?

না মা, হয় না। অন্তত বাঙালীর ঘরের মেয়ের দ্বারা হয় না। ধর্মকর্মের কথা ছেড়ে দিয়ে সামান্য কোন একটা কর্ম করতে হলেই তাদিকে অন্যের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়; স্বামী ভিন্ন তেমন সাহায্য আর কে করতে পারে বল? আরও, কি দোষে তোমার এত শাস্তি?

অনুপমা আনতমুখে বলিল, আমার পূর্বজন্মের ফল।

গোঁড়া হিন্দু জগবন্ধুবাবুর কর্ণে এ কথাটা খট্‌ করিয়া লাগিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন, তাই যদি হয়, তবুও তোমার একজন অভিভাবকের প্রয়োজন; আমাদের অবর্তমানে কে তোমাকে দেখবে?

দাদা দেখবেন।

ঈশ্বর না করুন, কিন্তু সে যদি না দেখে? সে তোমার মার পেটের ভাই নয়; বিশেষ, আমি যতদূর জানি, তার মনও ভাল নয়।

অনুপমা মনে মনে বলিল, তখন বিষ খাব।

আরও একটা কথা আছে অনু, পিতা হলেও সে কথা আমার বলা উচিত—মানুষের মন সব সময়ে যে ঠিক এক রকমেরই থাকবে, তা কেউ বলতে পারে না; বিশেষ, যৌবনকালে প্রবৃত্তিগুলি সর্বদা বশ রাখতে মুনি-ঋষিরাও সমর্থ হন না।

কিছুকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া অনুপম কহিল, জাত যাবে যে!

না মা, জাত যাবে না—এখন আমার সময় হয়ে আসছে—চোখও ফুটছে।

অনুপমা ঘাড় নাড়িল। মনে মনে বলিল, তখন জাত গেল, আর এখন যাবে না! যখন চক্ষুকর্ণ বন্ধ করে তোমরা আমাকে বলিদান দিলে, তখন এ কথা ভাবলে না কেন? আজ আমারও চক্ষু ফুটেছে—আমিও ভালরূপ প্রতিশোধ দেব।

কোনরূপে তাহাকে টলাইতে না পারিয়া জগবন্ধুবাবু বলিলেন, তবে মা, তাই ভাল; তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি বিবাহ দিতে চাই না। তোমার খাবার-পরবার ক্লেশ না হয়, তা আমি করে যাব। তার পর ধর্মে মন রেখে যাতে সুখী হতে পার, ক’রো।