» » তারও আগে যা ঘটেছিল

বর্ণাকার

রাতে পত্রিকা অফিসে এসে দারওয়ানের হাতে একখানা চিঠি পেলো মাহমুদ।

দারওয়ান বললো, ‘এক মেমসাবে দে গিয়া।’

চিঠিখানা খুলে পড়লো সে। মরিয়ম লিখেছে।

 

‘ভাইয়া,

আজ দুদিন তুমি বাসায় এলে না। মারা ভীষণ অসুখ। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। মাকে এভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছে তুমি?

আশা করি আজ নিশ্চয় বাসায় ফিরবে।’

নিচে নিজের নাম সই করেছে।

চিঠিটা পড়ে টুকরো করে ছিড়ে ফেললো মাহমুদ। ‘মা ভীষণ অসুস্থ, ইয়ার্কির আর জায়গা পায়নি’ মনে মনে বললো মাহমুদ। এ শুধু ওকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে একটা মিথ্যে কথার আশ্রয় না-নিয়ে সরাসরি বাসায় যাবার জন্যে লিখলেই তো পারতো মরিয়ম। মাহমুদ ভাবলো, রাতে বাসায় ফিরে মরিয়মকে এক প্রস্থ গালাগাল দিতে হবে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলে, সামনে একফালি সরু বারান্দা। ডান হাতে ম্যানেজারের দপ্তর। বাঁ হাতে নিউজ সেকসনের লম্বা ঘর। টেবিলের ওপর কাগজের স্তুপ। আলপিনের বাক্স। শূন্য চায়ের পেয়ালা। পেপার কাটার আর দোয়াত কলম। একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো মাহমুদ। প্রথম প্রথম এ ঘরটিতে এসে ঢুকতে আশ্চর্য রোমাঞ্চ অনুভব করতো সে। এখন কোন অনুভূতিই জাগে না। বরঞ্চ বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে মন। সাংবাদিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে আজ সে লজ্জা বোধ করে। সে তো সাংবাদিক নয়, মালিকের হাতের একটি যন্ত্রবিশেষ। কর্তার ইচ্ছেমতো সংবাদ তৈরি করতে হয় তাকে। তাঁরই ইচ্ছেমত বিকৃত খবর পরিবেশন করতে হয়। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। তখন সে ভাবে, যদি তার টাকা থাকতো তা হলে নিজে একখানা পত্রিকা বের করতো মাহমুদ। সুস্থ সাংবাদিকতা হতো যার আদর্শ। কিন্তু এসব উদ্ভট কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যহ প্রয়োজন মেটানোর যার সামথ্য নেই, সে স্বপ্ন দেখে দৈনিক পত্রিকা বের করবার। ‘দুত্তোর আদর্শ’-পিনের বাক্সটা একপাশে ঠেলে রেখে, কলামটা হাতে তুলে নিলো মাহমুদ।

মাসখানেক পরে, একদিন সেলিনাকে পড়াতে আসার পথে দূর থেকে ওদের বাসার সামনে একটা চকলেট রঙের নতুন গাড়ি দেখতে পেলো মরিয়ম। ভাবলো, বোধ হয় নতুন কোন অতিথি এসেছে বাসায়।

এ একমাসে বৈচিত্র্যের দিক থেকে না হলেও, ঘটনার দিক থেকে অনেক নতুন কিছু ঘটেছে তার জীবনে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে সে। যে চাকরিটা হবে আশা করেছিলো, তা হয়নি। আরো দু একটা নতুন টিউশনি পাবার আশ্বাস পেয়েছে মরিয়ম। মনসুরের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক বজায় রেখেছে সে। গত এক মাসের মেলামেশার মধ্য দিয়ে লোকটাকে কখনো খারাপ মনে হয় নি। অন্তত সে রকম কোন ধারণা জন্মাবার মত ব্যবহার করে নি মনসুর। যে ক’দিন এখানে এসেছে, যাবার পথে গলির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে মরিয়মকে। একদিন তো সে নিজেই আমন্ত্রণ করেছিলো তাকে, আসুন না আমাদের বাসায়, একটু বসে যাবেন।

‘না, আজ থাক। আরেকদিন যাবো।’ উপেক্ষা নয়, বরং সলজ্জ সংকোচে আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেছে মনসুর।

মরিয়ম তাতে দুঃখ পেয়েছে তা নয়। সে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করায়, নিজের দৈন্য আর প্রতিপক্ষের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছে মরিয়ম। যদি সে আসতো। তাহলে তাকে কোথায় বসতে দিতো মরিয়ম। কী খাওয়াতো তাকে?

যে কোনদিন মনসুর বাসায় যাওয়ার কথা তুলতে পারে এই আশঙ্কায় সুন্দর দেখে দুটো চায়ের কাপ দুটো পিরিচ কিনে রেখেছে সে বাসায়। এলে আর কিছু না হোকক এক কাপ চা তো দিতে হবে। মরিয়ম আরো ভেবেছে, দুটো চেয়ার আর একটা গোল টিপয় যদি কিনতে পারে তাহলে হয়তো ভদ্রভাবে সাজানো যাবে ঘরটাকে। বাইরে থেকে কেউ এলে তাকে বসানো যাবে।

দূর থেকে মটরটাকে দেখছিলো মরিয়ম, পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাবার সময় আরেক বার চোখ বুলিয়ে নিলো সে।

বৈঠকখানায় সবার সাথে এক সঙ্গে দেখা। বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করছিলো ওরা। সেলিনা, তার আম্মা আর মনসুর। সেলিনার বাবাকে দেখা গেলো না সেখানে। একটা ছাই রঙের প্যান্ট পরেছে মনসুর। গায়ে একটা সিল্কের সাদা সার্ট। সেলিনার পরনে আকাশ রঙের শাড়ি, গায়ে বাদামি ব্লাউজ।

ওকে দেখতে পেয়ে সেলিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো, এই যে আপা এসে গেছে, কি মজা, এবার সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বেরুবো আমরা।

মনসুর হাসলো। সেলিনার আম্মাও।

অপ্ৰস্তুত মরিয়ম তিনজনের দিকে তাকালো একবার করে। মনসুর হেসে বললো, আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। সেলিনা আজ পড়বে না। চলুন বেরিয়ে আসবেন আমাদের সঙ্গে।

সেলিনার আম্মা—আনিসা বেগমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মরিয়ম জানতে চাইলো, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

সেলিনা আর আনিসা বেগম দুজনে এক সঙ্গে বলে উঠলো, নিউ মার্কেট। উপলক্ষটা তেমন কিছু নয় আসার পথে বাইরে যে গাড়িটা দেখে এসেছে মরিয়ম কিছুদিন হলো মনসুর কিনেছে ওটা। ওর নতুন গাড়িতে করে ওদের একটু ঘুরিয়ে আনতে চায় সে।

এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও পারবে না মরিয়ম, তা জানতো সে। তাই রাজী হয়ে বললো, আমায় একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হয় আজ।

মনসুর বললো, ঘাবড়াবেন না। ঠিক সময়ে বাসায় পৌঁছে দেবো আপনাকে ৷

সেলিনা অহেতুক ফিক করে হাসলো একটু। আনিসা বেগম কেন যেন একটু গভীর হয়ে গেলেন।

গাড়িতে মনসুর আর সেলিনা সামনের সিটে বসলো। মরিয়ম আর আনিসা বেগম পেছনে।

হ্যাঁ, গত এক মাসে আরো একটি সত্য আবিষ্কার করেছে মরিয়ম। একদিন কথায় কথায় আনিসা বেগম হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিলেন তাকে মনসুরকে কেমন মনে হয় তোমার মরিয়ম?

এ ধরনের প্রশ্ন আশা করেনি মরিয়ম, তাই মুহূর্ত কয়েক বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো। সহসা কোন জবাব দিতে পারে নি। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলেছে, কেন, বেশ ভালোই তোI

আনিসা বেগমের মুখখানা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার উত্তর শুনে। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে চাপা স্বরে বলেছেন, সেলিনার সঙ্গে ওকে কেমন মানাবে বলতো?

প্রশ্নের হেতুটা এতক্ষণে বুঝতে পেরে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছে মরিয়ম।

কিন্তু এরকম কিছু মুহূর্ত আগেও ভাবে নি সে। পরন্তু অন্য একটি সম্ভাবনার কথা ভেবে শঙ্কিত হয়েছিলো। উত্তরটা দিতে আবার বিলম্ব হয়েছিলো মরিয়মের, মন্দ কি? বেশ ভালোই মানাবে ওদের।

আমারো তাই মনে হয়, আনিসা বেগম বলেছিলেন, কিন্তু কথাটা কোথাও আলোচনা করো না তুমি, কেমন?

মরিয়ম মাথা নত করে কথা দিয়েছিলো তাকে। না, এ কথা কাউকে জানাবে না সে।

গাড়িটা তখন নবাবপুর রোড ধরে এগুচ্ছিলো। দুধারে সারি সারি বাতিগুলো একে-একে পেছনে রেখে আসছিলো ওরা। বাইরে দৃষ্টি গলিয়ে দেখছিলো মরিয়ম। আঁচলে টান পড়তে মুখ ফিরিয়ে তাকালো সে। আনিসা বেগম কিছু বলতে চান তাকে। কাছে সরে আসতে ফিসফিসিয়ে তিনি বললেন, পাশাপাশি ওদের কেমন লাগছে বলতো?

শুনে হাসি পেলো মরিয়মের। অতি কষ্টে সামলে নিয়ে জবাব দিলো, বেশ ভালো।

আনিসা বেগম গলাটা আরো খাটো করে বললে, দুজনের গায়ের রঙ এক রকম, তাই না?

মরিয়ম বললো, হ্যাঁ।

স্বভাবের দিক থেকেও বেশ মিলবে, তাই না?

হ্যাঁ।

আনিসা বেগম মুখখানা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন বাইরের দিকে। রমনা এলাকাটা অনেকটা নির্জন। দুপাশে দোকানপাট, লোকজনের ভিড় নেই। কোলাহল নেই।

জানালার পাশে ঘেঁষে বসতে এক ঝলক বাতাস এসে সারা মুখখানা শীতল করে দিয়ে গেলো মরিয়মের।

নিউমার্কেট এসে অনেক কেনাকাটা করলো ওরা–সেলিনা আর আনিসা বেগম। দু-খানা শাড়ি কিনলো সেলিনা। একখানা ব্লাউজ পিস। এক টিন পাউডার, একটা টুথপেস্ট, কয়েকখানা সাবান কিনলো ওরা এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে।

মনসুর একফাঁকে গলাটা নামিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কিছু কিনবেন না? মরিয়ম অন্যমনস্কভাবে একটা সেন্টের শিশি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো ঈষৎ অপ্ৰতিভ হয়ে বললো, না।

কথাটা কানে গেলো আনিসা বেগমের। সেলিনাসহ একটা নকল পাথরের তৈরি মালার দর করছিলেন তিনি। ওর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ওকি, তুমি তো কিছুই কিনলে না, একটা-কিছু কেনা উচিত তোমার।

মরিয়ম নিষেধ করতে যাচ্ছিলো। এক জোড়া মালা কিনে একটা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন আনিসা বেগম, লজ্জা করছে কেন, তুমিতো আমার মেয়ের মতো।

এ কথার পর মালাটা ফিরিয়ে দিতে পারলো না মরিয়ম। আনিসা বেগম হয়তো মনে আঘাত পাবেন।

মনসুর চুপচাপ কেনাকাটা দেখছিলো। ওদের। মাঝেমাঝে দু-একটা মন্তব্য করছিলো। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দু-শিশি সেন্ট কিনলো সে। একটা সেলিনার জন্যে আরেকটা মরিয়মের জন্যে। মরিয়মকে সরাসরি দিতে হয়তো সাহস হচ্ছিলো না। সেলিনার হাতে তুলে দিয়ে বললো, আমার তরফ থেকে এ দুটো দিলাম তোমাদের। তারপর আনিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, খালাম্মা, আপনাকে কি দেয়া যেতে পারে বলুন তো?

আনিসা বেগম হেসে বরলেন, না বাবা, আমাকে দিতে হবে না, আমি বুড়োমানুষ।

সেলিনা পরক্ষণে বললো, মাকে একটু চুল না-ওঠার তেল কিনে দিন, মাথার চুলগুলো উঠে যাচ্ছে ওঁর।

মেয়ের প্রতি কুপিত দৃষ্টি হানলেন আনিসা বেগম।

মরিয়মের মুখখানা অনেক আগেই কালো হয়ে গেছে।

মার্কেট থেকে বেরুবার পথে মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। বোধ হয় কোন কাজে এসেছে সে, মরিয়ম ভাবলো। চোখে চোখ পড়তে মৃদু হাসলো সে। মাহমুদের কোন ভাবান্তর হলো না। বাকি সকলের দিকে একটি সন্ধানী দৃষ্টি হেনে, ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, এরা কারা?

ওরা তখন সামনে এগিয়ে গেছে। মরিয়ম পেছনে পড়ে ছিলো। একবার ওদের দিকে আরেকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললো, এসো না, ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তোমার।

আমি আলাপ করতে চাইনে মরিয়ম। ওরা কারা, তাই জানতে চেয়েছি। মাহমুদ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো।

মরিয়ম অপ্রস্তুত গলায় বললো, একজন আমার ছাত্রী সেলিনা, আরেকজন তার মা।

আর লোকটা কে?

সেলিনার বড় বোনের দেওর।

যাও, ওরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।

মরিয়ম তাকিয়ে দেখলো গাড়িতে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই। গাড়িতে উঠতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো মনসুরের মুখখানা কেমন ভার-ভার।