» » তারও আগে যা ঘটেছিল

বর্ণাকার

পরদিন শঙ্কিত মন নিয়ে ছাত্রীর বাড়িতে এলেও একটা ব্যাপারে মরিয়ম নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। মনসুরের সঙ্গে অমন দুব্যবহার করা উচিত হয় নি। আজ যদি তার সঙ্গে দেখা হয়, এবং দেখা হবে তা জানতো, তাহলে তার ক্ষমা চাইবে সে। ক্ষমা যদি নাও চায়, তবু ভালোভাবে-ভদ্রভাবে কথা বলবে মনসুরের সঙ্গে। যতদিন তার কাছ থেকে কোন অশোভন প্ৰকাশ না পায় ততদিন সহজ সম্পর্ক বজায় রাখবে মরিয়ম।

বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেলিনা কি যেন করছিলো। ওকে আসতে দেখে মৃদু হেসে অভ্যর্থনা জানালো।

মরিয়ম বললো, আমার আজ একটু দেরি হয়ে গেছে সেলিনা।

সেলিনা বললো, আমি ভাবছিলাম আজ তুমি আসবে না আপা?

অহেতুক চমকে উঠলো মরিয়ম। সেলিনাকে কিছু বলে নি তো মনসুর?

পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, কেন বলতো?

সেলিনা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো, রোজ ঠিক সময়টিতে আসো কিনা, তাই।

ওর কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু মনসুরকে আজ না দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার একটা অস্বস্তি জেগে উঠলো ওর ভেতরে। পড়াতে বসে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো মরিয়ম। বাইরের ঘরে কোন গলার আওয়াজ পেলেই কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো কার গলা। আর যখন বুঝলো এ মনসুরের নয় তখন হতাশ হলো সে।

সেলিনা পড়ার ফাঁকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি শরীরটা আজ ভালো নেই আপা?

মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মরিয়মের। ইতস্তত করে বললো, কই নাতো। কেন আমায় দেখে কি অসুস্থ মনে হচ্ছে?

সেলিনা বললো, হ্যাঁ।

‘না। আমার কিছু হয়নি, তুমি পড়ো’। ছাত্রীকে বইয়ের প্রতি মনোযোগী হতে আদেশ করলো মরিয়ম। তারপর সে ভাবলো, না–এসবের কোন অর্থ হয় না। যা ঘটে গেছে তার জন্যে অনুতাপ কেন করবে মরিয়ম। অন্যায় সে কিছু করে নি। লোকটার যে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই তার নিশ্চয়তা আছে? উদ্দেশ্য মহৎ হওয়ারও কোন কারণ খুঁজে পেলো না সে। যেভাবে রোজ রোজ পিছু নেয় তাতে তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু লোকটাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাতেই বা শুরু করেছে কেন মরিয়ম?

পড়ানো শেষ করে সবে বিদায় নেবে এমন সময় মনসুরকে হঠাৎ দোরগোড়ায় দেখে প্রথমে অবাক হলো, পর মুহূর্তে ফ্যাকাশে এবং তারপর রক্তাভ হলো মরিয়ম।

মনসুর এগিয়ে এসে বললো, কি খবর, কেমন আছেন?

ওর গলার স্বরে কোন জড়তা নেই, গতকালের ঘটনার কোন রেশ নেই, শুনে ঈষৎ বিস্মিত হলো মরিয়ম। পরক্ষণে সে মৃদু হেসে বললো, ভালো, আপনি কেমন? এতটুকু কথায় এত উচ্ছাস প্ৰকাশ নিজের কাছেই ভালো লাগলো না মরিয়মের।

মনসুর একটুকাল সন্ধানী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। কণ্ঠস্বরটা ওর কাছেও বড় নতুন ঠেকছে আজ।

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত।

কী যে হলো, বড় ভয় করতে লাগলো মরিয়মের। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে সাহস হলো না। ‘চলি সেলিনা।’ এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মরিয়ম।

কিছুদূর এসে একবার পেছনে ফিরে দেখলে সে।

না। আজ আসছে না। মনসুর।

প্রথমে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেও, খানিক পরে মরিয়মের মনে হতে লাগলো, বোধ হয়। লোকটা অসন্তুষ্ট হয়েছে। ওর ব্যবহারে তাই আজ এলো না এগিয়ে দিতে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো মরিয়মের।

বাসায় ফিরতে একটা মিহি কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো মরিয়ম।

খোকনকে সামনে পেয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে রে খোকন? কাঁদছে কে?

খোকনের চোখজোড়া ছলছল করছিলো। ভাঙ্গা গলায় বললো, ছোট আপাকে বাবা মেরেছে।

‘কেন?’ প্রশ্নটা খোকনকে করলেও, তার উত্তরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো না মরিয়ম। অন্ধকার ঘরে পা দিতে হাসিনার কান্নাটা আরো জোরে শোনা গেলো। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে সে, আবছা দেখা যাচ্ছে তাকে।

ওর গায়ের ওপর একখানা হাত রেখে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো মরিয়ম, কি হয়েছেরে হাসি?

এক ঝটিকায় ওর হাতখানা দূরে সরিয়ে দিলো হাসিনা।

খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে স্যান্ডেলটা চৌকির নিচে রেখে দিলো মরিয়ম। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ব্লাউজটা ধীরে ধীরে খুললো সে। বডিসটা খুলে রাখলো আলনার ওপরে। শাড়িটা পাল্টে নিলো। তারপর নিঃশব্দে মায়ের ঘরে এলো সে। কি হয়েছে মা, হাসিনা কাঁদছে কেন? বলে মায়ের দিকে চোখ পড়তে রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল মরিয়ম, একি! কি হয়েছে মা? চওড়া চৌকিটার ওপর শুয়ে মা। মাথাটা আগাগোড়া ব্যাণ্ডেজ করা।

বাবা পাশে বসে মৃদু পাখা করছেন তাকে। হাসমত আলী হাতের ইশারায় মরিয়মকে জোরে কথা বলতে নিষেধ করলেন। সালেহা বিবি ঘুমোচ্ছেন এখন। তাকে জাগানো ঠিক হবে না।

একটু পরে বাবার কাছ থেকে সব জানতে পেলো মরিয়ম। কতদিন তিনি বারণ করেছেন। সকলকে, ছাদে দৌড়-ঝাঁপ না দিতে। পুরোনো বাড়ি নড়বড়ে ছাদ। কখন ভেঙ্গে পড়ে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তবু রোজ ছাদে উঠে খেলবে হাসিনা। আজও বিকেল বেলা খেলছিলো সে। নিচে তোর মা বসে বসে চাল বাছছিলেন, বাইরে ওই কুয়োতলায় রাখা আছে গিয়ে দেখে আয় তুই। পোয়াখানেক ওজনের একটা ইট, ছাদ থেকে খসে তার মাথার উপর এসে পড়লো। ঘরের কোণে আলো নিয়ে দেখ, কত রক্ত জমে আছে সেখানে।

হাসমত আলী থামলেন।

তিনি তখন বাসায় ছিলেন। আয়োডিন আনিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন সালেহা বিবির মাথায়। রাতের রান্না-বান্না কিছুই হয় নি। দুলুটা কাঁদতে কাঁদতে এই একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। খোকনটারও ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়। যদিও মুখ ফুটে সে কিছু বলে নি এখনো। হারিকেনের মৃদু আলোতে বসে বসে পড়ছে সে। মাঝে মাঝে উস্‌খুস করছে, চোখ তুলে তাকাচ্ছে ওদের দিকে।

হ্যারিকেনের আগুনে কুপিটা ধরিয়ে নিয়ে পাকঘরে চলে গেলো মরিয়ম।

হাসিনার কান্নাটা এখান থেকে শোনা যাচ্ছে। রাগের মাথায় ভীষণ মেরেছেন তাকে বাবা।

একটা তরকারি আর দুটো ভাত সিদ্ধ করে নামাতে বেশ রাত হয়ে গেলো। ঘুম থেকে তুলে দুলুকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো মরিয়ম। খোকনকে খাওয়ালো। তারপর সবার জন্য ভাত সাজিয়ে হাসিনাকে ডাকতে এসে মরিয়ম দেখলো, কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে হাসিনা।

প্রথমে দূর থেকে ডাকলো মরিয়ম, তারপর ওর গায়ে হাত রেখে জোরে নাড়া দিয়ে বললো, হাসি উঠ, বাবা বসে আছেন তোর জন্যে।

বড় ক্লান্তি লাগছিলো ওর। হাত ধরে টেনে বললো, কইরে ওঠ।

হাসিনা নড়েচড়ে আবার চুপ করে রইলো।

হাসি ভাত খাবি ওঠ।

আমি খাব না, হাসিনা জবাব দিলো তোমরা খাওগে যাও।

ওঠ মিছিমিছি রাগ করে না। নরম গলায় বললো মরিয়ম। তারপর দুহাতে ওকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করলো সে।

এই ভালো হবে না বলছি, এই-এই। ওর হাতে একটা কামড় বসিয়ে দিলো হাসিনা।

উহ! বলে ছেড়ে দিলো মরিয়ম। হাসিনা আবার চুপচাপ।

ওকে একা ফিরে আসতে দেখে হাসমত আলী শুধালেন, কী, হাসিনা এলো না?

মরিয়ম আস্তে করে জবাব দিলো, ও খাবে না।

হাসমত আলী মাটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে কি যেন ভাবলেন, মুখখানা গভীর এবং বিরক্তিপূর্ণ। একটু পরে নিজেকে শোনাচ্ছেন যেন এমনি করে বললেন, বয়স কি কম হয়েছে ওর? তবু একটু কাণ্ডজ্ঞান হলো না। বিয়ে হলে ও স্বামীর ঘর করবে কেমন করে?

মরিয়ম বললো, ভাত খাবে এসো বাবা।

হাসমত আলী বললো, তুমি খাওগে আমার ক্ষিধে নেই। স্ত্রীর পাশে বালিশটা টেনে কাৎ হয়ে শুলেন তিনি। মরিয়মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাও, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে।

আরো অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মরিয়ম।

তারপর পাকঘরে গিয়ে ভাত-তরকারিগুলো চাপা দিয়ে দুগ্ৰাস জল খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। থাক, সেও খাবে না আজ।

হাসিনা ঘুমোচ্ছে। মৃদু নাক ডাকছে ওর।

বাইরের দরজাটা বন্ধ করা হয়েছে কিনা দেখে এসে শুয়ে পড়লো মরিয়ম।

শুধু এই বাড়িতে নয়, পুরো পাড়াটায় ঘুম নেবেছে এখন। দুএকটা বাড়ি থেকে অন্ধকার কাঁপিয়ে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দুএকটা গলার স্বর। গলির হ্যাংলা কুকুরগুলো ডাকছে কখনো কখনো। আর কোন শব্দ নেই। কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘুমোতে পারলেন না। হাসমত আলী। রাতে ঘুম না হওয়া বড় বেদনাদায়ক। বিশেষ করে এই নিরবতার মাঝখানে এক রাত জগতে গেলে, অনেক চিন্তা এসে জমাট বাঁধে মাথায়। একান্তভাবে কোন কিছু চিন্তা করার এটাই বোধ হয় প্রকৃত সময়।

অতীত। ভবিষ্যৎ। বর্তমান।

ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে জীবনটাকে বিশ্লেষণ করার মত প্রবৃত্তি না হলেও, জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে দেখা দেয় মনে। সেখানে আনন্দ আছে, বিষাদ আছে। ব্যর্থতা আছে, সফলতা আছে, হাসি আছে, অশ্রু আছে। অতীতের মত বর্তমানও যেন ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত উঠা আর পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে কেউ তা বলতে পারে না। তা-কি খুব সুন্দর হবে, না আরো মলিনতায় ভরা হবে ভাবতে ভাবতে একটুখানি তন্দ্ৰা এসেছিলো। একটা ধাড়ি ইঁদুরের কিচকিচি ডাকে তন্দ্ৰা ছুটে গেলো তাঁর। চোখ মেলে চারপাশে তাকালেন হাসমত আলী। আবার চোখের পাতাজোড়া বন্ধ করলেন। তারপর ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে লাগলেন তিনি।

বড় ছেলে মাহমুদ। সবার বড় ও। কিন্তু ওর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে পারেন না তিনি। কি যে হবে ওর খোদা জানেন। লেখাপড়া শিখেছে। বছর তিনেক হলো বি. এ. পাশ করেছে। তার এই গ্রাজুয়েট হবার পেছনে নিজের কোন অবদান খুঁজে পান না হাসমত আলী। পত্রিকায় চাকরি করে নিজের টাকায় পড়েছে মাহমুদ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবার কাছে বেশি কিছু দাবি করে নি। দাবি করলেও দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ। নিম্নপদস্থ কেরানীর পক্ষে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো শুধু কষ্টসাধ্য নয়, দুরূহও বটে। তাই মাহমুদের নিজের ইচ্ছার ওপরে কোন রকম খবরদারী করার সাহস পান না। তিনি। জোর করে কিছু নির্দেশ দেবার পিতৃসুলভ ইচ্ছে থাকলেও তাকে দমন করেন হাসমত আলী। নিজেকে অপরাধী মনে হয় ছেলের কাছে। মরিয়মের কাছেও অপরাধী হাসমত আলী।

ম্যাট্রিক পর্যন্ত ওর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন তিনি, তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি ছাত্রী পড়িয়ে কলেজে পড়েছে মরিয়ম। এই তো মাস দুয়েক হলো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে সে।

তারপর হাসিনা–

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন। হাসমত আলী। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন।

সেই যে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ তারপর দুদিন তার কোন দেখা নেই।

এমনি হয়।

মাঝে মাঝে বাসার সবার সঙ্গে ঝগড়া করে কয়েক দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মাহমুদ। বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় গিয়ে থাকে। হোটেলে রেস্তোরাঁয় খায়। পকেটে পয়সা না থাকলে উপোসে কাটায়।

সকালে তখনও মাথার যন্ত্রণায় গায়ে জ্বর ছিলো সালেহা বিবির। মরিয়মকে ডেকে শুধোলেন তিনি, হ্যাঁরে, মাহমুদ ফিরেছে?

মায়ের পাশে এসে বসে মরিয়ম সংক্ষেপে বললো, না।

মা যন্ত্রণায় কাতর গলায় বললেন, কার যে স্বভাব পেলো ও। কিছু বলবার উপায় নেই, অমনি রাগ করবে। ওকে নিয়ে আমি কি করি বলতো? মায়ের দুচোখে জল।

মরিয়ম কিছু বলতে যাবার আগে হাসমত আলী উষ্ণ গলায় বললেন, কি দরকার ছিলো ওকে রাগাবার। জানতো ও ওরকম, তবু ওসব কথা বলতে গেলে কেন।

খোকনের কাছ থেকে মাহমুদের বাড়ি না আসার কারণটা জানতে পেরেছিলেন তিনি। তখন থেকে স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন হাসমত আলী। মাহমুদকে কোন কারণে রাগাবার পক্ষপাতী তিনি নন। স্বভাবে উদ্ধৃঙ্খলতা দােষ থাকলেও সে নিশ্চয় বখাটে ছেলে নয় তা বোঝেন হাসমত আলী। সংসারে টাকা-পয়সা দিয়ে প্রতিমাসে সাহায্য করছে সে। লেখাপড়া আর জানাশোনার দিক থেকেও বাবার চেয়ে সে অনেক বড়। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের সকলের ভবিষ্যৎ ওর হাতে নির্ভর করছে। নিজে যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সে জ্ঞান রাখেন হাসমত আলী। তখন মাহমুদ না থাকলে কে দেখবে ওদের? মরিয়ম-মেয়ে, ওর ওপর কতটুকু ভরসা করা যেতে পারে? দিন সব সময় এক রকম যায় না। মাহমুদ একদিন একটা ভালো চাকরি পেয়ে যেতে পারে সে আশাও রাখেন হাসমত আলী।

হাসমত আলীর কথার জবাবে উচ্চবাচ্য করলেন না সালেহা বিবি। নীরবে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মরিয়ম উঠে যেতে যেতে বললো, তুমি এ নিয়ে বেশি ভেবো না মা। দুপুরে অফিসে গিয়ে ওর খোঁজ নেবো আমি।

হাসমত আলী অফিসে গেলে, মায়ের পাশে অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করলো হাসিনা। ইট পড়ে তার মাথা ফেটে গেছে। সেজন্য মনে মনে অনুতপ্ত সে।

সালেহা বিবির চোখে তন্দ্রা ছিলো, তাই প্রথমে নজরে আসে নি। পরে দৃষ্টি পড়তে ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন তিনি। ইতস্তত করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো হাসিনা।

সালেহা বিবি আবার ডাকলেন, এদিকে আয় হাসি।

এবারে গুটি গুটি পায়ে পাশে এলো হাসিনা। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বললেন, তোর মুখখানা এত শুকনো কেন রে?

মায়ের বুকে মুখ গুঁজে হঠাৎ কেঁদে উঠলো হাসিনা। মা, আর উঠবো না মা। আর ছাতে উঠবো না। সালেহা বিবি তার চুলে সিঁথি কেটে দিয়ে বললেন, ও মা, এতে কাঁদবার কী আছে। কাঁদে না মা। ছাতে যাবি না কেন, একশ বার যাবি।

হাসিনা তবুও বললো, না। আর যাবো না, মা।

আপাকে কাঁদতে দেখে, গালে আঙুল পুরে দুলু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। ওর দিকে চোখ পড়তে সালেহা বললেন, দেখ হাসি, দুলুটা কেমন নোংরা হয়ে আছে। ওকে একটু কুয়োতলায় নিয়ে ভালো করে চান করিয়ে দে না মা।

অন্য সময় হলে ঠোঁট বাঁকিয়ে সেখান থেকে দূরে সরে যেতো হাসিনা। এখন গেলো না। মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে একটু হাসলো। তারপর খুশি মনে দুলুকে কুয়োতে চান করাতে নিয়ে গেলো হাসিনা।