ঘর থেকে সেই যে হন হন করে বেরিয়ে এলো মাহমুদ, তারপর অনেকপথ মাড়িয়ে এ গলি ও গলি পেরিয়ে, বিশ্রামাগারের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। দুটো বাই লেন এসে যেখানে মিলেছে তারই সামনে একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁ। ভেতরে ঢুকতে কেরোসিন কাঠের কাউন্টারের ওপার থেকে ম্যানেজার খোদাবক্স বলে উঠলো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?
কোণের টেবিলে তিনটে ছেলে গোল হয়ে বসেছিলো, তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাহমুদ জবাব দিলো, না, আজকের কাগজ তো আমি পড়িনি। ওর গলার স্বরটা রুক্ষ।
খোদাবক্স বুঝতে পারলো আজ মেজাজটা ভাল নেই ওর। তাই গলাটা আরো একটু মোলায়েম করে বললো, একটা ভালো চাকরির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে আজ।
মাহমুদ কিছু বলার আগেই বাকি তিনজন একসঙ্গে কথা বলে উঠলো, তাই নাকি, দেখি দেখি পত্রিকাটা।
কোলের ওপর থেকে পত্রিকাটা নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলো খোদাবক্স। তার খদ্দেরদের বেকারত্ব ঘুচুক, তারা ভালো চাকরি পাক এটা সে আন্তরিকভাবে কামনা করে। অবশ্য ভালো চাকরি পেলে হয়তো এ রেস্তোরাঁয় আর আসবে না, অভিজাত রেস্তোরাঁয় গিয়ে চা খাবে। এদিক থেকে ওদের হারাবার ভয়ও আছে খোদাবক্সের। কিন্তু বাকি টাকাগুলো ওদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে, এই তার সান্ত্বনা। তাছাড়া ভালো চাকরি পেলেই যে ওরা তাকে ত্যাগ করবে সেটা ভাবাও ভুল। হাজার হোকক চক্ষু লজ্জা বলে একটা প্রবৃত্তি আছে মানুষের। দুর্দিনে ওদের বাকিতে খাইয়েছে খোদাবক্স, সে কথা কি এত সহজে ভুলে যাবে ওরা? অবশ্য না-ছেড়ে যাবার আরেকটা কারণ আছে।
সেটা হলো শ’খানেক হাত দূরের মেয়ে-স্কুলের ওই লাল দালানটা। ওখানকার সব খবরই রাখে খোদাবক্স। কোন মেয়েটি বিবাহিতা, আর কোনটি কুমারী। কোন মেয়েটির বাবা বড় চাকুরে আর কোনটির বাবা কেরানী। সব খবর রাখে খোদাবক্স। উৎসাহী খদ্দেরদের পরিবেশন করে সে। তাদের অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করে।
পত্রিকাটি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর বিছিয়ে চারজন এক সঙ্গে ঝুঁকে পড়লো ওরা।
একটা প্ৰাইভেট ফার্মে পার্সেনাল এ্যাসিস্টেন্টের চাকরি।
মাসে দেড়শ টাকা বেতন।
খোদাবক্সের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে, নাম-ঠিকানা টুকে নিল মাহমুদ।
খোদাবক্স একগাল হেসে বললো, কেমন বলি নি, খুব ভালো চাকরি?
মাহমুদ বললো, হবে না, শুধু শুধু কাগজ-কালি খরচ করা।
রফিক বললো, তবু দেখা যাক না একবার কপাল ঠুকে।
নঈম বড় রোগাটে, চেহারাখানাও তার বড় ভালো নয়, বললো, আমার মুখ দেখেই ব্যাটারা বিদায় করে দেবে।
খোদাবক্স বললো, সব খোদার ইচ্ছে, চারজন একসঙ্গে চেষ্টা করে দেখুন না–একজনের হয়েও যেতে পারে।
এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মাহমুদ চুপচাপ পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগলো। চা খাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ এখানে বসে থাকবে সে। এটা সেটা নিয়ে তর্ক করবে। আর মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাববে, আশা নামক প্রবৃত্তিটি কত দুৰ্দমনীয়। পুরো একটা বছর ‘মিলন’ পত্রিকার চাকরি করার পর আশার ক্ষীণ অস্তিত্বও লোপ পাওয়া উচিত ছিলো। তবু এখনো যে কেমন করে তার রেশ জেগে আছে মনে, ভেবে বিস্মিত হয় মাহমুদ। লুই ফিশার হওয়ার কল্পনায় যে-একদিন বিভোর ছিলো। সে আজ আর তেমনি স্বপ্ন দেখতে পারে না।
প্রাত্যহিক ঘটনার অভিজ্ঞতায় স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে তার।
একদিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন রাতে ডিউটি ছিলো তার। নিউজ সেকশনের লম্বা টেবিলটায় সকলে কর্মব্যস্ত। এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলি পৌঁছায় এসে। তাই কাজের ভিড় বেড়ে যায়। হাতের কাছে একটা ছোট্ট সংবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো মাহমুদ। পঁচিশ বছরের একজন শিক্ষিত যুবক বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবরটা কি ছাপতে দিবো? নিউজ এডিটরের দিকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
কাগজটা হাতে নিয়ে খবরটা পড়লেন নিউজ এডিটর। তারপর ওটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, বাদ দিন, স্পেস নেই।
কেন স্পেস তো অনেক আছে! কথাটা হঠাৎ বলে ফেললো মাহমুদ।
সরোষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নিউজ এডিটর গম্ভীর গলায় বললেন, স্পেস আছে কি নেই সেটা আপনার জানবার কথা নয়।
তারপর নীরব হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়। ছিলো না তার। এমনি ঘটনা প্ৰায়ই ঘটতো।
একদিন কোন একটা জনসভায় লোক সমাবেশ নিয়ে তর্ক বেধে গেলো স্টাফ রিপোর্টারের সঙ্গে।
রিপোর্টার বলছিলেন, সভায় পাঁচহাজারের বেশি লোক হয় নি। মাহমুদ বললো, মিথ্যে কথা। পঞ্চাশ হাজারের উপরে এসেছিলো লোক।
রিপোর্টার বললেন, আপনি চোখে বেশি দেখেন।
মাহমুদ বললো, আমি যদি বেশি দেখে থাকি আপনি তাহলে কম দেখেন।
কম দেখতে হয় বলেই দেখি। দুঠোঁটে এক টুকরো হাসি ছড়িয়ে চুপ করে গেলেন স্টাফ রিপোর্টার।
সিনিয়র সাব-এডিটর আমজাদ হোকসেন এতক্ষণ নীরবে ঝগড়া শুনছিলেন। ওদের। দুজনে থামলে একটা পান মুখে পুরে দিয়ে বললেন, মাহমুদ সাহেব এখনো একেবারে বাচ্চা রয়ে গেছেন আপনি। লোক যে কেমন করে বাড়ে আর কেমন করে কমে তার কিছুই বোঝেন না–বলে শব্দ করে এক প্রস্থ হেসে উঠলেন তিনি।
বয় এসে সামনে চা নামিয়ে রাখতে ভাবনায় ছেদ পড়লো।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মাহমুদ বললো, তুমিও ঘাবড়িয়ো না খোদাবক্স, সামনের মাস থেকে দশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে আমার, তার থেকে কিছু কিছু করে এক বছরে সব পাওনা পরিশোধ করে দেবো তোমার। বুঝলে?
খোদাবক্স একমুখ হেসে বললো, তাই নাকি? বড় ভালো কথা, বড় ভালো কথা, শুনে বড় খুশি হলাম।
নঈম বললো, এর পরে আমাদের এক কাপ করে চা খাওয়ান উচিত তোমার মাহমুদ।
মাহমুদ নির্বিকার গলায় বললো, ‘খাও’ বলে বয়কে ওদের তিন কাপ চা দেবার জন্যে আদেশ করলো সে। খোদাবক্সকেও এক কাপ দিতে বললো। বয় চা নিয়ে এলে পর সামনে ঝুঁকে পড়ে মাহমুদ বললো, দশ টাকা যদি বাড়ে আমার, তাহলে রোজ একটা করে সিগারেট খাওয়াবো তোমাদের।
নঈম খুশি হয়ে বললো, আমার যদি এ চাকরিটা হয়ে যায়, তাহলে রোজ এক কাপ করে চা খাওয়াবো।
রফিক কিছু বললো না। ও একটু অন্যমনস্ক আজ।
তাহলে এ চাকরিটার জন্য তুমি দরখাস্ত করছাে? মাহমুদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।
হ্যাঁ। তুমিও করো। নঈম জবাব দিলো।
রফিক উঠে যাচ্ছিলো। নঈম চেঁচিয়ে উঠলো, ওকি যাচ্ছে কোথায়, বসো।
রফিক বললো, আর কতো বসবো? বোধ হয় আসবে না আজ।
মাহমুদ জিজ্ঞেস করবে ভাবছিলো, সে কে?
নঈম বললো, আরেকটু বসো, এই এসে পড়বে আজ বোধ হয় ঘোড়ার গাড়িটা কোথাও আটকে পড়েছে; কে জানে হয়তো রেলওয়ে ক্রসিং-এর ওখানে হবে।
মাহমুদ এতক্ষণে বুঝলো একটি মেয়ের অপেক্ষা করছে রফিক। ঘোড়ার গাড়িতে করে আসবে মেয়েটি। এখান থেকে রফিক দেখবে তাকে। শুধু চোখের দেখা।
মেয়ের কথা উঠতে খোদাবক্স বললো, আপনাকে কত করে বলেছিলাম মাহমুদ সাহেব, সেই মেয়েটার সঙ্গে ঝুলে পড়ুন, তাহলে কি আজকে আপনার এই অবস্থা হতো? এতদিনে হ্যাট-টাই পরে মোটর গাড়ি হাঁকতেন।
তার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো মাহমুদ। কিছু বললো না। নঈম বললো, হ্যাঁ, তাইতো আজকাল যে মেয়েটিকে আর দেখি নে তো, বিয়ে হয়ে গেছে বুঝি?
খোদাবক্স মুখখান বিকৃত করে বললো, বিয়ে হয়ে যাবে না তো কী? ওরা হলো বড় লোকের মেয়ে, বড় মহাৰ্য বস্তু। ও কি ফেলনা যে পড়ে থাকবে? কত ছেলে লাইন বেঁধে থাকে বিয়ে করার জন্য।
হয়েছেও তাই। এইতো গেলো মাসে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ছেলেটির বড় জোড় বরাত, বিয়ের কিছুদিন পরেই স্কলারশিপ বাগিয়ে আমেরিকায় চলে গেছে।
নঈম প্রশ্ন করলো, আর সে মেয়েটি?
মেয়েটিকে কি রেখে যাবে নাকি? খোদাবক্স জবাব দিলো, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে আমেরিকায়।
পত্রিকার উপর ঝুঁকে পড়ে মাহমুদ একটা খবর পড়ায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতে মন বসাতেই পারলো না সে। কাগজটা মুড়ে রেখে অনেকটা বিরক্তির সাথে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর আকস্মিক ভাবে ‘চলি’ বলে বিশ্রামাগার থেকে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। বেরুবার পথে সে শুনতে পেলো নঈম বলছে–আহা, যাবে আর কি, বসো না। ঘোড়ার গাড়িটা আসতে আজ বড় দেরি হচ্ছে, এসে পড়বে এক্ষুণি। বসো, আরেক কাপ চা খাও।
বুঝতে কষ্ট হলো না মাহমুদের, রফিককে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে নঈম।