» » তারও আগে যা ঘটেছিল

বর্ণাকার

পাশাপাশি আসছিলো মনসুর। ইতিমধ্যে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়েছে সে। বার কয়েক তাকিয়েছে মরিয়মের দিকে। মৃদু ঘামছিলো মরিয়ম।

হঠাৎ হাত বাড়িয়ে একটা রিক্সা থামালো সে। মনসুরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনেকটা তাড়াহুড়ার সাথে রিক্সায় উঠে বসলো মরিয়ম।

বেশ কিছুদূর আসার পর একবার পেছন ফিরে তাকালো সে। দেখলো এদিকে চেয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে মনসুর। দেখে প্রথমে হাসি পেলো তার। হেসে নিয়ে সে ভাবলো এমন ব্যবহারটা হয়তো উচিত হয় নি। লোকটা তাকে অভদ্র বলে মনে করতে পারে কিংবা অতি দাম্ভিক। এর কোনটিই নয় মরিয়ম। মনসুরের এই গায়েপড়াভাব তার ভালো লাগে না, এটাই হলো আসল কথা। কথাটা মনসুরকে ভদ্রভাবে বলে দিলেও তো পারতো সে। তাই ভালো ছিলো হয়তো। একটু আগের অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্যে মনে মনে অনুতপ্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু পরক্ষণে আবার মনে হলো, সে অন্যায় কিছু করে নি। জাহেদের সঙ্গেও এমনি রূঢ় ব্যবহার করা উচিত ছিলো তার। পারে নি বলেই মরিয়মকে তার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আজও। সব পুরুষই সমান। ওরা চায় শুধু ভোগ করতে। প্রেমের কোন মূল্যই নেই ওদের কাছে। আর এই দেহটাকে পাবার জন্য কত রকম অভিনয়ই না করতে পারে ওরা।

গলির মাথায় রিক্সাটাকে বিদায় দিয়ে দিলো মরিয়ম।

এ পথটা হেঁটে যেতে হবে তাকে।

অন্ধকার গলিতে বিজলী বাতির প্রসার এখনো হয় নি। কয়েকটা কেরোসিনের বাতি আছে। টিমটিম করে সেগুলো জ্বলে। তাও সব সময় নয়। মাঝে মাঝে দুষ্ট্র ছেলেরা ঢিল মেরে চিমনিগুলো ভেঙ্গে দেয়। তখন অন্ধকারে ডুবে থাকে গলিটা।

বাঁ হাতে শাড়িটা গুটিয়ে নিয়ে আবর্জনার স্তুপগুলি এড়িয়ে সাবধানে এগুতে লাগলো মরিয়ম। দুপাশে জীর্ণ দালানগুলোতে এর মধ্যে ঘুমের আয়োজন চলছে। সামনের বারান্দায় বসে কেউ কেউ গল্প করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সুর করে পড়ার আওয়াজও আসছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে। বুড়োদের সাংসারিক আলাপ-আলোচনা। আদেশ-উপদেশ। আশাআকাজক্ষার অভিব্যক্তিগুলোও গলি বেয়ে হাঁটতে গেলে সহজেই কানে আসে।

বাসার কাছাকাছি আসতে ও পাশের দোতলা বাড়ি থেকে ঝপ্‌ করে এক বালতি পানি কে যেন ঢেলে দিলো মরিয়মের গায়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে গেলো। প্রথম কয়েক মুহূর্ত একেবারে হকচকিয়ে গেলো মরিয়ম। মুখ তুলে উপরের দিকে তাকাতে দেখলো, যে পানি ফেললো সে এইমাত্র মুখখানা সরিয়ে নিয়ে গেলো তার। এমনি প্রায় হয়। রাস্তায় কেউ আছে কি নেই দেখে না তারা। ময়লা আবর্জনা এমন কি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের পায়খানাও জানালা গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। কারো মাথায় পড়লো কিনা লক্ষ্য নেই। রাগে সমস্ত দেহ জ্বালা করে উঠলো মরিয়মের। পরক্ষণে রীতিমত কান্না পেলো তার। সবে গতকাল শাড়িটা ধুয়ে পরেছে। কে জানে কিসের পানি। ভাবতে গিয়ে সারা দেহ রিরি করে উঠলো। মনে হলো সে এক্ষুণি বমি করবে।

ওকে দেখে হাসিনা হট্টগোল বাঁধিয়ে দিলো। একি আপা ভিজে চুপসে গেছিস যে? কি হয়েছে অ্যাঁ। উপর থেকে পানি ফেলেছে বুঝি, এ হে হে, কি নোংরা পানি গো। মেঝেতে থুথু ফেললো হাসিনা। ওমা, মা, দেখে যাও।

মরিয়ম স্যান্ডেলজোড়া দ্রুত খুলে রেখে কুয়োতলার দিকে যেতে যেতে বললো, আমার ছাপা শাড়িটা আর গামছাটা একটু দিয়ে যা হাসিনা।

মা নামাজ পড়ছিলেন।

বাবা হ্যারিকেনের আলোয় বসে খোকনকে পড়াচ্ছিলেন। ‘হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন।’ হাসিনার চিৎকার শুনে এবং মরিয়মের সাবান নিয়ে কুয়োতলার দিকে তাড়াহুড়া করে চলে যেতে দেখে বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, কি হয়েছে অ্যাঁ। কী হয়েছে? মরিয়ম কিছু বললো না।

শাড়ি আর গামছা হাতে চাপা আক্রোশে পাড়ার লোকদের যমের বাড়ি পাঠাতে পাঠাতে একটু পরে এ ঘরে এল হাসিনা।

হাসমত আলী আবার মুখ তুললেন, বই থেকে, কি হয়েছে অ্যাঁ?

হাসিনা মুখ বিকৃত করে বললো, আপার গায়ে কারা নোংরা পানি ঢেলে দিয়েছে।

কারা ঢাললো কোথায় ঢাললো? হাসমত আলী ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। হাসিনা কুয়োতলায় শাড়ি আর গামছাটা রেখে এসে বললো, আপা আসছিলো, উপর থেকে কারা এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে ওর গায়ে।

হাসমত আলী শুনে বললেন, চোখ বন্ধ করে হাঁটে নাকি, দেখে হাঁটতে পারে না।

তোমার যত বেয়াড়া কথা। নামাজের সালাম ফিরিয়ে সালেহা বিবি বললেন, উপর থেকে যারা ময়লা পানি ফেলে তাদের চোখ কি কানা হয়েছে? তারা মানুষ দেখে না? খোদা কি তাদের চোখ দেয় নি?

স্ত্রীর কথায় প্রতিবাদ না করে চুপ হয়ে গেলেন হাসমত আলী। একটুকাল নীরব থেকে সালেহা বিবি বাকি নামাজটা শেষ করবার জন্যে নিয়ত বাধলেন। সহজে ঘটনাটার ইতি করে দিয়ে হাসিনা শান্তি পাচ্ছিলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এসে পাশের বাড়ির বউটিকে ডেকে সব কিছু শোনালো সে। আপা আসছিলেন হঠাৎ তার মাথায় এক বালতি ময়লা পানি ঢেলে দিয়েছে কে। আল্লা করুক, যে হাতে পানি ঢেলেছে সে হাতে কুষ্ঠ হোক তার, কুষ্ঠ হয়ে মরুক।

উত্তরে, পাশের বাড়ির বউটি জানালো–কিছুদিন আগে তার ছোট দেবর আসছিলো এমনি রাতে, তার মাথার উপর একরাশ ছাই ফেলে দিয়েছিলো। লোকগুলো সব ইয়ে–।

নিচে এসে হাসিনা দেখলো মরিয়ম স্নান সেরে ফিরে এসেছে। বসে বসে চুলে চিরুনি বুলাচ্ছে সে। সামনে টেবিলের ওপর তিনখানা দশ টাকার নোট। দেখে চোখজোড়া বড় বড় করে ফেললো হাসিনা। তারপর ছোঁ মেরে নোটগুলো তুলে নিয়ে বললো, তুই বুঝি আজ টাকা পেয়েছিস আপা? আমাকে লিলি আপার মত একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে, নইলে আমি এগুলো আর দেবো না,–সত্যি দেবো না বলছি, কিনে দিবি কিনা বল না আপা। দুহাতে মরিয়মকে জড়িয়ে ধরলো হাসিনা। মরিয়ম বললো, এখন না, স্কুলের চাকরিটা যদি পেয়ে যাই তাহলে কিনে দেবো, কথা দিলাম।

তার কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? অনিশ্চয়-নির্ভর হতে রাজী হলো না হাসিনা। কবে যে চাকরি হবে–হয় কি না তাই কে জানে। শাড়ি যদি না কিসে দিস, একটা ব্লাউজ পিস কিনে দিবি বল?

মরিয়ম কথা দিলো, একটা ব্লাউজ-পিস সে কিনে দেবে। আশ্বস্ত হয়ে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে রাজী হলো হাসিনা। কিন্তু তক্ষুণি দিলো না, ওগুলো কিছুক্ষণ থাকে ওর কাছে। হাতে নিয়ে, আঁচলে বেঁধে ব্লাউজের মধ্যে রেখে এবং আবার বের করে নানাভাবে নোটগুলোর উষ্ণতা অনুভব করলো সে।

ভাত খেতে বসে সালেহা বিবি বললেন, দে ওগুলো ট্রাঙ্কে রেখে দি, তোর কোন ঠিক আছে, কোথায় হারিয়ে ফেলবি। দে এদিকে।

এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিয়ে হাসিনা সরোষ দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে, তারপর নীরবে ভাতগুলো চিবোতে লাগলো।

গোল হয়ে তারা বসেছিলো খেতে। বুড়ো হাসমত আলী, আর তার দুই মেয়ে মরিয়ম আর হাসিনা। সালেহা বিবিও খাচ্ছিলেন এবং পরিবেশন করছিলেন সকলকে। খোকন আর দুলু খেয়েদেয়ে অনেক আগে শুয়ে পড়েছে। মাহমুদ রোজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে যায় ডিউটিতে, ফেরে সেই ভোর রাতে। আজ তার অফ-ডে। তবু রাত এগারোটার আগে ফিরবে না সে। অফিসে, রেস্তোঁরায় বন্ধুদের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে তবে ফিরবে বাসায়। খাবারটা ওর ঘরে ঢেকে রেখে দেন সালেহা বিবি। ফিরে এসে খেয়ে ঘুমোয় মাহমুদ।

মরিয়মের পাতে এক চামচ ঝোল পরিবেশন করে সালেহা বিবি বললেন, কাল গিয়ে একখানা শাড়ি কিনে এনো নিজের জন্যে। একটা বাড়তি শাড়ি নেই–।

মরিয়ম কিছু বলবার আগে হাসিনা জবাব দিলো, আর আমার জন্যে একটা ব্লাউজ-পিস।

সালেহা বিবি ধমকে উঠলেন, ওসব বাজে আবদার করো না।

হাসিনা সরোষ দৃষ্টিতে আরেকবার তাকালো মায়ের দিকে।

হাসমত আলী এতক্ষণ নীরবে ভাত খাচ্ছিলেন, সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে বহু আগে, উপর পাটির দাঁতগুলো বড় নড়বড়ে, যে-কোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, তাই কতার সাথে ভাত খান খুব আস্তে আস্তে। দাঁতের ফাঁকে আটকে-যাওয়া একটা সরু কাঁটা আঙুল দিয়ে বের করে নিয়ে হাসমত আলী বললেন, তোমার স্কুলের চাকরিটার কি হলো?

কথাটি মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে।

মুখের কাছে তুলে আনা হাতের গ্লাসটা থালার ওপর নামিয়ে রেখে বাবার দিকে চালো মরিয়ম। বাবার প্রশ্নটা যেন ঠিক বুঝতে পারে নি সে।

ওকে চুপ থাকতে দেখে হাসিনা বললো, তোর স্কুলের চাকরিটার কি হলো জিজ্ঞেস করছেন বাবা। এতক্ষণ কি ভাবছিলি আপা?

মরিয়ম অপ্রতিভ গলায় জবাব দিলো, তিন-চার দিনের মধ্যে জানা যাবে। বলে ভাতের থালায় মুখ নামালো সে। এতক্ষণ সেই অবাঞ্ছিত ঘটনাটির কথা ভাবছিলো মরিয়ম। সত্যি মনসুরের সঙ্গে অমন বিশ্রী ব্যবহার না করলেই ভালো হতো। কে জানে, লোকটার হয়তো কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো না। নেইও। মরিয়ম মিছামিছি সন্দেহ করছে তাকেই নিজের অশোভনতার জন্যে মনে মনে লজ্জিত হলো সে।

খাওয়া হলে পরে, রোজ এঁটো থালা-বাসনগুলো ধুয়ে-মুছে গুছিয়ে রাখার কাজে মাকে সহায়তা করে মরিয়ম।

সালেহা বিবি মেয়ে-ভাগ্যে সুখ অনুভব করলেও মাঝে মাঝে বাধা দিয়ে বলেন, থাক না, এগুলো আমিই করবো, তুই ঘরে যা।

মরিয়ম বলে, তুমি সারাদিন খাটো মা, তুমি যাও। ওগুলো আমি গুছিয়ে রাখবো।

আনন্দে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সালেহা বিবির। মেয়ে তাঁর দুঃখ কষ্ট বোঝে। তাঁর শ্রমের স্বীকৃতি দেয়। এতেই তাঁর আনন্দ। তারা সুখী হোক। মা-বাবাকে সন্তুষ্ট রাখুক, এই চান তিনি। আর বেশি কিছু নয়।

খেয়েদেয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো মরিয়ম।

হাসিনা বসে বসে পড়ছিলো, নিচে মাদুর পেতে। বুকের নিচে একটা বালিশ রেখে আড় হয়ে শুয়ে পড়ে সে। পড়ার ফাঁকে, মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেয়। জেগে আবার পড়ে। আবার ঘুমোয়। এ তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।

এ জন্যে ওকে ধমকায় মরিয়ম। আজও ধমকালো, ও কী হচ্ছে, উঠে সিধে হয়ে বসে পড়। শুয়ে শুয়ে পড়তে নেই ক’দিন বলেছি তোমায়?

বই থেকে মুখ না তুলেই হাসিনা জবাব দিলো, আমার যেভাবে ভালো লাগবে সেভাবে পড়বো, তোমার তাতে কি?

মরিয়ম বললো, এভাবে পড়লে বুকে ব্যথা করবে।

করুক, তাতে তোমার কি? বইটা বন্ধ করে রেখে একটু ঘুমিয়ে নেবার জন্যে বালিশে মাথা রাখলো হাসিনা। মরিয়ম কী যেন বলতে যাচ্ছিলো। দুয়ারে কড়া নাড়ার শব্দ হতে কথাটা আর বললো না উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।

মাহমুদ এসেছে বাইরে থেকে বগলে কতকগুলো বই। হাতে একটা কাগজের মোড়ক। মোড়কটা ওর হাতে তুলে দিয়ে মাহমুদ বললো, নাও, এটা তোমাদের জন্যে এনেছি।

মরিয়ম সকৌতুকে তাকিয়ে বললো, এর মধ্যে কী?

কী, তা আলোতে নিয়ে গিয়ে দেখতে পাচ্ছো না? বিরক্ত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ। যাও একটা বাতি নিয়ে এসো চটপট করে।

ওঘর থেকে সব শুনতে পেয়ে বাতি হাতে দৌড়ে এলো হাসিনা, কি এনেছেরে আপা, দেখি দেখি।

দাঁড়াও দেখবে, অমন আদেখলেপনা করো না। এসব ভালো লাগে না আমার।

নিজের ঘরে এসে বইগুলো মেঝেতে নামিয়ে রাখলো মাহমুদ। তার ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। একটা কাপড় রাখার আলনাও নয়। মেঝেতে পাশাপাশি তিনটে মোটা মাদুর বিছানো। এক পাশে তার স্তুপীকৃত খবরের কাগজ। তায়ে তায়ে রাখা। বাকি তিন পাশে শুধু বই, মাঝখানে ওর শোবার বিছানা। বিছানা বলতে একটা সতরঞ্জি, একটা চাদর আর একটা বালিশ।

মরিয়মের হাত থেকে মোড়কটা নিয়ে ওদের বসতে বললো মাহমুদ। নিজেও বসলো। তারপর আস্তে করে বললো, এর ভেতরে কী আছে তা দেখবার আগে তোমাদের কিছু বলতে চাই আমি।

হাসিনা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, বলো।

মরিয়ম গম্ভীর।

মাহমুদ ওদের দুজনের দিকে ক্ষণকাল স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বললো, দুর্ঘটনাবশত হোক আর যেমন করেই হোক, তোমরা আমার বোন। তাই নয় কি?

হাসিনা আঁচলে মুখ টিপে বললো, হ্যাঁ।

মরিয়ম কিছু বললো না। নীরবে মাথা নাড়লো।

মাহমুদ আবার বললো, তোমাদের প্রতি আমার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে, তা বিশ্বাস করো?

দুজনে ঘাড় নোয়ালো ওরা। হ্যাঁ।

মোড়কটা খুলতে খুলতে মাহমুদ বললো, তোমাদের জন্য কিছু চুলের ফিতা আর মাথার কাটা এনেছি আমি। দেখো পছন্দ হয় কিনা?

ফিতাজোড়া মাহমুদের হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে হাসিনা বললো, কি সুন্দর নাচতে নাচতে মাকে দেখাবার জন্যে নিয়ে গেলো সে।

মরিয়ম উঠলো, মাহমুদ বললো, বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।

মরিয়ম বললো, তুমি ভাত খাবে না?

না, এক বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে এসেছি আমি। মাথা নেড়ে ওকে নিষেধ করলো মাহমুদ। তোমার সঙ্গে যে মেয়েটি আজ এসেছিলো সে কে জানতে পারি কি? অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে।

মরিয়ম বললো, ওর নাম লিলি, আমার সঙ্গে পড়তো কলেজে।

মাহমুদ বললো, থাক তার নাম আমি জানতে চাই নি। জানতে চেয়েছিলাম ওর সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কি, জেনে খুশি হলাম।

সহসা দুজন ওরা নীরব হয়ে গেলো। পাশের ঘর থেকে মা, বাবা আর হাসিনার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মৌনতা ভেঙ্গে মাহমুদ বললো, তুমি কি করবে ঠিক করেছো?

মরিয়ম বললো, এখনো কিছু ঠিক করি নি, দেখি স্কুলের চাকরিটার কি হয়।

মাহমুদ বললো, তোমার বান্ধবী লিলি না কি নাম বললে, সে কি করে শুনি?

মরিয়ম দাদার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, সেও একটা চাকরির খোঁজে আছে।

হুঁ। মাহমুদ ক্ষণকাল চুপ থেকে বললো, যাও, এখন ঘুমোবো আমি।

কাগজে মোড়ানো চুলের কাটাগুলো তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম। ও চলে গেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো মাহমুদ। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিলো সে।

এখন সমস্ত ঘরটা অন্ধকারে ঢাকা।

চারপাশে তাকালে এই অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

সিগারেটের মাথায় শুধু এক টুকরো আলো। বিড়ালের চোখের মত জ্বলছে। ভাষা নামক মানুষের আদিম প্রবৃত্তিও বোধ হয় চিরন্তন এমনি করে জ্বলে। পাশ ফিরে শুয়ে মাহমুদ ভাবলো। প্রধান সম্পাদক আজ কথা দিয়েছেন, আসছে মাস থেকে দশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে তার। যদি তিনি তার কথা রাখেন তাহলে, এই বাড়তি দশ টাকা প্রতি মাসে ভাই বোনদের জন্যে খরচ করবে মাহমুদ। আর যদি ছলনার নামান্তর হয়, তাহলে?

আর ভাবতে ভালো লাগে না মাহমুদের। সিগারেটটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু সহসা তার ঘুম আসে না। সহস্ৰ চিন্তা এসে মনের কোণে ভিড় জমায়। মাঝে মাঝে মনে হয় রোজ রাতে এমনি এমনি ভাবনার জাল বুনতে বুনতে হয়তো জীবনটা একদিন শেষ হয়ে যাবে তার। জ্বলে জ্বলে ক্ষয়ে যাওয়া মোমবাতির মত ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাবে সবকিছু।

নিউজ সেকশনের লম্বা ঘরটা এখন চোখের ওপর ভাসে।

অনেক আশা নিয়ে একদিন ‘মিলন’ পত্রিকায় চাকরি নিয়েছিলো মাহমুদ। সাব-এডিটরের চাকরি। মাসে পঞ্চাশ টাকা বেতন। অর্থের চেয়ে আদর্শ সাংবাদিক হওয়ার বাসনাই ছিলো প্রবল। কালে কালে একদিন লুই ফিশার হবে।

শুনে সিনিয়ার সাব-এডিটর আমজাদ হোসেন শব্দ করে হেসে উঠেছিলেন সেদিন। লুই ফিশার হবে? বেশ বেশ। অতি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বটে। বছর খানেক কাজ করো। তারপর লুই ফিশার কি চিংড়ি ফিশার দুটোর একটা নিশ্চয় হতে পারবে।

বুড়োটার ওপর চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছিলো মাহমুদের। গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছিলো তাকে।

আহা, শুধু শুধু বেচারাকে অমন হতাশ করে দিচ্ছেন কেন?

আরেকজন বলেছিলো, টেবিলের ওপাশ থেকে।

তারপর।

তারপর আর ভাবতে পারে না মাহমুদ। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

সকালে ঘুম ভাঙতে মুখ-হাত ধুয়ে বাইরে বেরুবে বলে ভাবছিলো মাহমুদ। এক টুকরো পাউরুটি আর এক কাপ চা এনে ওর সামনে নামিয়ে রেখে সালেহা বিবি বললেন, তুই কি বেরুবি এখন?

হ্যাঁ, দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা জামা নাবিয়ে নিয়ে মাহমুদ বললো, আমায় একটা কাজে যেতে হবে।

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সালেহা বিবি বললেন, তোর বাবার শরীরটা আজ ভালো নেই। বাজারটা একটু দিয়ে যা।

মাহমুদ কোন জবাব দিলো না তার কথার। যেন শুনতে পায় নি এমনি ভাব করে নীরবে পাউরুটির টুকরোটা ছিঁড়ে খেতে লাগলো সে। মা আবার বললেন, কিরে কিছু বলছিস না। যে? টাকা আনবো?

‘না।’ মাহমুদ নির্বিকারভাবে জবাব দিলো, আমার কাজ আছে বললাম তো।

কোনদিন তোর কাজ না থাকে? সালেহা বিবি গভীর হয়ে গেলেন। বুড়োটা রোজ বাজার করে এনে খাওয়ায়, এ বুড়ো বয়সে তাকে কষ্ট দিতে লজ্জা হয় না তোদের?

রুটির টুকরোটা পিরিচের উপর নামিয়ে রেখে মাহমুদ বললো, আর আমি আহ্লাদে ঘুরে বেড়াই তাই না মা? রাতের পর রাত যে আমায় তোমাদের জন্য জেগে কাজ করতে হয় তার কোন মূল্য নেই, না? চায়ের পেয়ালাটা সামনে থেকে সরিয়ে দিলো মাহমুদ। রুটির পিরচটাও দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেলো সালেহা বিবির। উষ্ণ গলায় তিনি জবাব দিলেন, তুই সারারাত জেগে কাজ করিস আর বুড়োটা কি বসে খায়? সারা জীবনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রোজগার করে এনে খাইয়েছেন।

হয়েছে, এবার থামো তুমি মা। জামাটা গায়ে দিতে দিতে জবাব দিলো মাহমুদ, ও কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তবু রোজ এক বার শোনাবে তুমি।

ওকি, চা-টা কি অপরাধ করলো? খেয়ে নে না। ওটা। বাজারের প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে ছেলেকে চা খাওয়ানোর প্রতি লক্ষ্য দিলেন সালেহা বিবি। ওকি, চলে যাচ্ছিস কেনো, চা-টা খেয়ে যা।

থাক, ওটা তুমি খাওগে।। হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ। ও চলে যেতে ক্ষোভে দুঃখে চোখ ফেটে কান্না এলো সালেহা বিবির। আঁচলে চোখ মুছে ব্যথা জড়ানো স্বরে নিজেকে ধিক্কার দিলেন তিনি, কোন দুঃখে পেটে ধরেছিলাম তোদের।

কথাটা কানে এলো হাসমত আলীর। ও ঘর থেকে গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে নীরব হয়ে গেলেন সালেহা বিবি। এসব কথা স্বামীকে জানতে দিতে চান না। তিনি। তাহলে তিনি মনে আঘাত পাবেন। হাসমত আলীও কোন উত্তর না পেয়ে চুপ করে গেলেন।

মরিয়ম এসে বললো, একটু পরে আমি বাইরে বেরুবো মা। বাজারের টাকাটা দিয়ে দিও।

মা অবাক হয়ে বললেন, তুই যাবি?

মরিয়ম বললো, তাতে কিছু এসে যাবে না, খোকনকে সঙ্গে দিও।

হাসমত আলী এতক্ষণ মা-মেয়ের আলাপ শুনছিলেন, শেষ হলে বললেন, ও কেন, আমি যাবো বাজারে।

সালেহা বিবি বললেন, তোমার শরীর খারাপ লাগছে, বলেছিলে না?

ও, কিছু না। আস্তে আস্তে জবাব দিলো হাসমত আলী।