[ গ ]
নৌশেরা
এস আমার বোবা সাথী এস! আজ কতদিন পরে তোমায় আমায় দেখা! তোমার বুকে এমনি করে আমার প্রাণের বোঝা নামিয়ে না রাখতে পারলে এতদিন আমার ঘাড় দুমড়ে পড়ত!
আহ্ কী জ্বালা! এত হাড়ভাঙা পরিশ্রম, এত গাধাখাটুনির মাঝেও সেই একান্ত অন্ধস্মৃতিটার ব্যথা যেন বুকের উপর চেপে বসে আছে! … আজ তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে! হৃদয়, শক্ত হও– বাঁধন ছিঁড়তে হবে। যে তোমার কখনও হয়নি, যাকে কক্খনো পাও নি, যে তোমার হয়ত কক্খনো হবে না, যাকে কক্খনো পাবে না, যার অজানা ভালবাসার স্মৃতিটাই ছিল–তোমার সারা বক্ষ বেদনায় ভরে, সেই শাহিদার স্মৃতিটাকেও ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে! উঃ! তা … পারবে? সাহস আছে? ‘না’ বললে চলবে না, এ যে পারতেই হবে! মনে পড়ে কি আমাদের দেশের মা ভাই-বোনের দেওয়া উপহার? বুঝেছিলে কী যে, ওগুলি তাঁদের দেওয়া দায়িত্বের, কর্তব্যের গুরুভার? আমাদের কাজের উপর আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কষ্টিপাথরের মত সহ্যগুণ আমাদের থাকা চাই, তবে না জগতের লোকে যাচাই করে নেবে যে, বাঙালিরাও বীরের জাতি। এ সময় একটা গোপন স্মৃতি-ব্যথা বুকে পুষে মুষড়ে পড়লে চলবে না। তাকে চাপা দিতেও পারবে না নিঃশেষে বিসর্জন দিতে হবে! একেবারে বাইরের ভিতরের সব কিছু উজাড় করে বিলিয়ে দিতে হবে, তবে না রিক্ততার–বিজয়ের পূর্ণরূপ ফুটে উঠবে প্রাণে! অনেকে জীবন দিয়েছে, তবু এই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকা মধু-স্মৃতিটুকু বিসর্জন দিতে পারেনি। তোমাকে সেই অসাধ্য সাধন করতে হবে! পারবে? সাধনার সে জোর আছে?–যদি না পার, তবে কেন নিজেকে ‘মুক্ত’, ‘রিক্ত’, ‘বীর’ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছ? যার প্রাণের গোপনতলে এখনও কামনা জেগে রয়েছে, সে ভোগী-মিথ্যুক আবার ত্যাগের দাবি করে কোন্ লজ্জায়? সে কাপুরুষের আবার বীরের পবিত্র শিরস্ত্রাণের অবমাননা করবার কী অধিকার আছে? দেশের জন্য প্রাণ দিবে যারা, তারা প্রথমে হবে ব্রহ্মচারী, ইন্দ্রিয়জিৎ!–
মাথার ওপর মা আমার ভাবী-বিজয়ী বীর-সন্তানের মুখের দিকে আসা-উৎসুক নয়নে চেয়ে রয়েছেন, আর পায়ের নীচে এক তরুণী তার অশ্রুমিনতি-ভরা ভাষায় সাধছে, ‘যেও না গো প্রিয়, যেও না।’ কী করবে? … নিশ্চয়ই পারবে! তুমি যে মায়ামমতাহীন কঠোর সৈনিক। ….
শক্ত হও হৃদয় আমার, শক্ত হও! আজ তোমার বিসর্জনের দিন! আজ ঐ কাবুল নদীর ধারে ঊষর প্রান্তরটার মতই বুকটাকে রিক্ত শূন্য করে ফেলতে হবে। তবে না তোমার সমস্ত তৃষ্ণা, সমস্ত সুখ-দুঃখ বৈরাগ্যের যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিতে পূর্ণ রিক্ততার গান ধরবে,–
‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ
আরো কি তোমার চাই?
ওগো ভিখারি, আমার ভিখারি,–
পলকে সকলই সঁপেছি চরণে আর তো কিছুই নাই।–
আরো কি তোমার চাই?’
* * *
কুর্দিস্তান
পেয়েছি,–পেয়েছি! ওঃ, আজ দীর্ঘ এক বৎসর পরে আমার প্রাণ কেন পূর্ণ-রিক্ততায় ভরে উঠেছে বলে বোধ হচ্ছে! … এই এক বৎসর ধরে সে কী ভয়ানক যুদ্ধ মনের সাথে! এ সমরে কত কিছুই না মারা গেল! … বাইরের যুদ্ধের চেয়ে ভিতরের যুদ্ধ কত দুরন্ত দুর্বার! রণজিৎ অনেকেই হতে পারে, কিন্তু মনজিৎ ক-জন হয়?–সে কেমন একটা প্রদীপ্ত কাঠিন্য আমাকে ক্রমেই ছেয়ে ফেলেছে! সে কী সীমাহীন বিরাট শূন্য হয়ে গেছে হৃদয়টা আমার!–এই কি রিক্ততা? … ভোগও নেই–ত্যাগও নেই; তৃষ্ণাও নেই–তৃপ্তিও নেই; প্রেমও নেই–বিচ্ছেদও নেই;–এ যেন কেমন একটা নির্বিকার ভাব! না ভাই, না এমন রিক্ততা-ভরা তিক্ততা দিয়ে জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে পড়ে! এমন কঠিন অকরুণ মুক্তি তো আমি চাইনি! এ যেন প্রাণহীন মর্মর-মন্দির! …
তবু কিন্তু রয়ে রয়ে মর্মরের শক্ত বুকে শুক্লা চাঁদিনীর মত করুণ মধুর হয়ে সে কার স্নিগ্ধশান্ত আলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়?–হায় ছুঁয়ে যায় বটে, কিন্তু আর তো নুয়ে যায় না! … দেখেছ? আমার অহঙ্কারী মন তবু বলতে চায় যে, ওটি নিজেকে নিঃশেষ করে বিলিয়ে দেওয়ার একটা অখণ্ড আনন্দের এক কণা শুভ্র জ্যোতি!–তবু সে বলবে না যে ওটা একটি বিসর্জিতা প্রতিমার প্রীতির কিরণ! …
আঃ, আজ এই আরবের উলঙ্গ প্রকৃতির বুকে-মুখে মেঘমুক্ত শুভ্রজ্যোৎস্না পড়ে তাকে এক শুক্লবসনা সন্ন্যাসিনীর মত দেখাচ্ছে! এদেশের এই জ্যোৎস্না এক উপভোগ করবার জিনিস। পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি জ্যোৎস্না এত তীব্র আর প্রখর নয়। জ্যোৎস্না রাত্রিতে তোলা আমার ফটোগুলো দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এগুলো জ্যোৎস্নালোকে তোলা ফটো। ঠিক যেন শরৎ প্রভাতের সোনালি রোদ্দুর।
হাঁ,–এতে মস্ত আর এক মুশকিলে পড়লুম দেখছি। … ডালিম ফুলের মতই সুন্দর রাঙা টুকটুকে একটি বেদুইন যুবতি পাকড়ে বসেছে যে, তাকে বিয়ে করতেই হবে! সে কী ভয়ানক জোর-জবরদস্তি। আমি যত বলছি ‘না’, সে তত একরোখা ঝোঁকে বলে, ‘হাঁ, নিশ্চয়ই হাঁ!’ সে বলেছে যে, সে আমাকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছে, আমি বলছি যে, আমি তাকে একদম ভালবাসিনি। সে বলছে, তাতে কিছু আসে যায় না,–আমাকে ভালবেসেছে, আমাকেই তার জীবনের চিরসাথী বলে চিনে নিয়েছে–বাস! এই যথেষ্ট! আমার ওজর-আপত্তির মানেই বোঝে না সে! আমি যতই তাকে মিনতি করে বারণ করি, সে ততই হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে বলে, ‘বাঃ–রে, আমি যে ভালবেসেছি, তা তুমি বাসবে না কেন?’–হায়, একী জুলুম!
ওরে মুক্ত! ওরে রিক্ত! তোর ভয় নেই, ভয় নেই! এই যে হৃদয়টাকে শুষ্ক করে ফেলেছিস, হাজার বছরের বৃষ্টিপাতেও এতে ঘাস জন্মাবে না, ফুল ফুটবে না! এ বালি-ভরা নীরস সাহারায় ভালবাসা নেই।
যে ভালবাসবে না, তাকে ভালবাসায় কে? যে বাঁধা দেবে না, তাকে বাঁধবে কে?–“আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন, সে কি অমনি হবে?” …
কারবালা
এই সেই বিয়োগান্ত নিষ্করুণ নাটকের রঙ্গমঞ্চ,–যার নামে জগতের সারা মোসলেম নরনারীর আঁখি-পল্লব বড় বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে! এখানে এসেই মনে পড়ে সেই হাজার বছর আগের ধর্ম আর দেশ রক্ষার জন্যে লক্ষ লক্ষ তরুণ বীরের হাসতে হাসতে ‘শহীদ’ হওয়ার কথা! তেমনই বয়ে যাচ্ছে সেই ফোরাত নদী, যার একবিন্দু জলের জন্য দুধের ছেলে, ‘আসগর’ কচি বুকে জহর-মাখা তীরের আঘাত খেয়ে বাবার কোলে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটি চিরতরে মুদেছিল! ফোরাতের এই মরুময় কূলে কূলে না জানি সে কত পবিত্র বীরের খুন বালির সঙ্গে মাখানো রয়েছে। আঃ, এ বালির পরশেও যেন আমার অন্তর পবিত্র হয়ে গেল।
কয়েকটা পাষাণময় নিস্তব্ধ গৃহ খাড়া রয়েছে জমাট হয়ে,–উদার অসীম আকাশেরই মত বিব্রত মরুভূমি তার বালুভরা আঁচল পেতে চলেই গিয়েছে,–ছোট্ট দুটি তৃষ্ণাতুর দুম্বা-শিশু ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করতে করতে ফোরাতের দিকে ছুটে আসছে,–শিশির-বিন্দুর মত সুন্দর কয়েকটি বুভুক্ষু বালিকা ফোরাতের এক হাঁটু জলে নেমে আঁজলা জল পান করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করছে,–বালিতে আর বাতাসে মাতামাতি,–এইসব মিলে কারবালার একটি করুণ চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠছে!
কারবালা! কারবালা!! আজ তোমারই আকাশ, তোমারই বাতাস, তোমারই বক্ষের মত আমার আকাশ বাতাস বক্ষ সব একটা বিপুল রিক্ততায় পূর্ণ!…
সেদিনও সেই বেদুইন যুবতিগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।—এই অবাধ্য অবুঝ তরুণী সে কী উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল আমার পিছু পিছু ছুটছে। আমি বাইরে বেরোলেই দেখতে পাই, সে একটা মস্ত আরবী ঘোড়ায় চড়ে ফোরাতের কিনারে কিনারে আরবী গজল গেয়ে বেড়াচ্ছে! সে সুরের গিটকারি কত তীব্র–কী তীক্ষ্ণ। প্রাণে যেন খেদং তীরের মত এসে বিঁধে!
আমি বললুম, ‘ছিঃ গুল, এ কী পাগলামি করছ?–আমার প্রাণে যে ভালবাসাই নেই, তা ভালবাসব কী করে?’ সে তো হেসেই অস্থির। মানুষের প্রাণে যে ভালবাসাই নেই, তা সে নতুন শুনলে।–আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘আমায় ভালবাসবার তোমার তো কোনো অধিকার নেই গুল!’–সে আমার হাতটা তার কচি কিশলয়ের মতো কম্পিত ওষ্ঠপুটে ছুঁইয়ে আর মুখটা পাকা বেদানার চেয়েও লাল করে বললে, ‘অধিকার না থাকলে আমি ভালবাসছি কি করে হাসিন?–এ সরল যুক্তির পরে কি আর কোনো কথা খাটে?