ভোরবেলায় স্বপ্নেন্দু বলল, ‘চলো, ঘুরে আসি।’
মাঝরাত্রে একটি ঝগড়া হয়েছিল। স্বপ্নেন্দুর পক্ষে সারারাত একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা সম্ভব নয় অথচ আত্রেয়ীর কানে হৃৎপিণ্ডের শব্দ পৌঁছানো চাই। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। স্বপ্নেন্দু বলেছিল, ‘এটা উদ্ভট আবদার। বড্ড বেশি চাওয়া।’
তারপর থেকে আত্রেয়ী চুপচাপ হয়ে গেছে। কোনও কথা বলেনি এতক্ষণ। স্বপ্নেন্দু প্রস্তাব করতেও উত্তর দিল না। স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে হল একাই বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ফুলটাকে এই ঘরে আত্রেয়ীর সঙ্গে একা রেখে যাওয়া অসম্ভব। সে কাছে এলো, ‘আত্রেয়ী, আমার সঙ্গে কথা বলবে না!’
আত্রেয়ী মুখ ফেরাল, ‘আমি যে বড্ড বেশি চাই।’
‘একটু কম চাও তাহলেই তো সব মিটে যায়।’
‘বেশ, সেইটুকু হল তুমি।’ আত্রেয়ী হাসল।
এখন সবে আঁধার সরেছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে বেশ মানুষ। যেহেতু কারও চোখে ঘুম নেই তাই রাস্তা রাত্রেও ফাঁকা হয় না। বের হবার সময় আত্রেয়ীর আর পোশাক পরেনি। স্বপ্নেন্দু আপত্তি জানালে বলেছিল, ‘এখন আর লজ্জা কী? লোকে তো মেয়ে বলে বুঝবে না। বরং কাপড় থাকলে কেড়ে নিতে পারে।’
স্বপ্নেন্দু তবু ইতস্তত করেছিল, ‘কেমন ল্যাংটো ল্যাংটো দেখায়। তাছাড়া হাড়ের গঠন দেখেও ছেলে মেয়ের পার্থক্য বোঝা যায়।’
উড়িয়ে দিয়েছিল আত্রেয়ী, ‘ওটা যারা হাড় নিয়ে পড়াশুনো করেছে শুধু তারাই পারে। পাবলিক চিরকাল মুখ্যু।’
এখন রেডিও থেকে বারংবার ঘোষণা করছে, ‘শান্তি বজায় রাখুন। গুজবে কান দেবেন না। ভোর ছ’টায় মুখ্যমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ শুনুন।’
বের হবার সময় পকেট ট্রানজিস্টারটা সঙ্গে নিয়েছিল স্বপ্নেন্দু। তার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। গলির মোড়ে আসতেই দুটো লোক এগিয়ে এলো, ‘এই যে দাদা, জামাকাপড় ছাড়ুন।’
‘ছাড়ব মানে?’ স্বপ্নেন্দুর গলায় বিস্ময়।
‘এখন এসব পরা চলবে না। পোশাক ব্যবধান সৃষ্টি করে। খুলে ফেলুন।’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘বোঝার কিছু নেই। আপনার সঙ্গে যে দাদা আছেন তিনি তো পোশাক পরেননি। আপনি ডাঁট মেরে পাঞ্জাবি চাপিয়েছেন। জানেন, কলকাতার লোকের গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই? এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই এক হতে হবে। পোশাক মানুষ পরতো লজ্জা নিবারণের জন্যে। সেইটি যখন নেই তখন পোশাক খুলে সব মানুষ এক হয়ে যাক।’
স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীর দিকে তাকাল। ওরা ওকে বলল, ‘চমৎকার।’ এর মধ্যে ভিড় জমে গেছে। সবাই নগ্ন। একজন বলল, ‘অত কথায় কাজ কী? জোর করে খুলে নিলেই তো হয়।’
প্রথমজন বলল ‘না না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন শান্তি বজায় রাখতে। উনি নিজেই খুলবেন। আমরা ওঁকে ঘেরাও করে রাখব যতক্ষণ না খোলেন। কোনও জোর জবরদস্তি কেউ করবেন না।’
‘এই ঘেরাওটা জোর জবরদস্তি নয়?’ স্বপ্নেন্দু অসহায় হয়ে পড়েছিল। ‘না। এটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার।’
আত্রেয়ী মুখ খুলতে গিয়ে থেমে গেল। ওর মনে হল কথা বললেই সে যে পুরুষ নয় তা বুঝে যাবে ওরা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল স্বপ্নেন্দু। মুহূর্তেই জামাকাপড় উধাও হয়ে গেল। সমস্ত শরীরের হাড় ভোরের হাওয়ায় শীতল হল। এমন কি ট্রানজিস্টারটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। শুধু ঘরের চাবিটা কোনক্রমে বাঁচাতে পারল স্বপ্নেন্দু। প্রথম লোকটি বলল, ‘এতক্ষণে আপনি জনতার সঙ্গে মিলে গেলেন ভাই। যে পোশাক পরবে তাকেই বাধা দেবেন। শান্তি বজায় রাখুন।’
ভিড় ছাড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে আত্রেয়ী কথা বলল, ‘তোমাকে তখনই সাবধান করেছিলাম। কিন্তু শুনলে না। যা মন খারাপ করো না। তোমার শরীরের কাঠামো সত্যি চমৎকার।’
স্বপ্নেন্দু কাঁধ নাচালো। চায়ের দোকানটায় আজ বেশ ভিড়। সেখানে অবনীদা কোন্ জন বুঝতে পারল না স্বপ্নেন্দু। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় পাশে চলে আসতেই দেখল সার সার ট্রাম জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে আছে। চারধারে শুধু থিকথিকে নরকঙ্কাল। তারা চিৎকার করছে, এ ওকে আক্রমণ করছে। আত্রেয়ীকে নিয়ে স্বপ্নেন্দু একটা গাড়ি বারান্দার তলায় সরে আসতেই চোখে পড়ল দুজন কঙ্কাল রকে বসে একটা ট্রানজিস্টার চালিয়েছে। তারপরেই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এখন কলকাতাবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী।’
স্বপ্নেন্দু সরে এল লোক দুটোর কাছে। এবং তখনই সে চিনতে পারল নিজের ট্রানজিস্টারটাকে। হুবহু সেই দাগটা। এই ব্যাটারাই পোশাক খোলার সময় হাতিয়েছে। ওরা এখন স্বপ্নেন্দুকে চিনতে না পারায় মনোযোগ দিয়ে ট্রানজিস্টার শুনছে। স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে হল ওটা কেড়ে নেয়। কিন্তু তখনই মুখ্যমন্ত্রী বলতে শুরু করলেন, ‘বন্ধুগণ, আমরা এখন গভীর সমস্যাময় সময়ে রয়েছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি উদ্ভূত অভাবনীয় সুযোগগুলো বানচাল করে দেবার জন্যে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সক্রিয় হয়েছে। তারা এই অতিবৈপ্লবিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছে না। শহরের চারিদিকে অশান্তি এবং গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে। এই ষড়যন্ত্রের আমরা ধ্বংস করবই। এমন কি এইসব ষড়যন্ত্রকারীরা এখন মৃত্যুকামনা করছে। আপনারা জানেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মৃত্যু হল একটি জঘন্য ব্যবস্থা যা শুধু দালালরাই কামনা করে। এই অতিবৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা মৃত্যুকে জয় করেছি। এখন সমস্ত মানুষ এক এবং অবিনশ্বর। এই দালালগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে যাতে মৃত্যু এসে আমাদের নবীন সমাজব্যবস্থাকে বানচাল করে দেয়। আমি একথা জোর গলায় ঘোষণা করতে চাই, সমস্ত ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনারা এদের প্রতিরোধ করুন। শহরে শান্তি বজায় রাখুন।’
ভাষণ শেষ হওয়া মাত্রই যার হাতে ট্রানজিস্টার ছিল সে প্রচণ্ড আক্রোশে ওটাকে ফুটপাথে আছড়ে ফেলতেই সেটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘শালা জ্ঞান দিচ্ছে। কী বলল অর্ধেক কথা আমি বুঝতেই পারি নি। কি ভাষায় যে কথা বলে!’
তার সঙ্গী বলল, ‘ওটা ভাঙলি কেন? বিবিধ ভারতী শোনা যেত।’
‘একটা গেল তাতে কি আর একটা ছিনতাই করে নেব।’
ওরা চলে যাওয়ার পর স্বপ্নেন্দু বলল, ‘ওই ট্রানজিস্টারটা আমার ছিল।’
‘সত্যি! তুমি ওদের বললে না কেন?’
‘বললে শুনত? দেখছে না ওরা কিরকম মাস্তান।’
‘এই জন্য তোমাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছিলাম।’
‘সারাক্ষণ ঘরে বন্দি হয়ে থাকা যায়?’
‘বন্দি বলছ কেন?’
‘বন্দি নয় তো কী? ঘরে বসে কী করব?’
‘কেন?’ আত্রেয়ী অন্যরকম গলায় বলল, ‘ভালবাসব।’
চকিতে মুখ ফেরাল স্বপ্নেন্দু। আত্রেয়ী কি পাগল হয়ে গিয়েছে। কোনও কোনও পাগলকে নাকি সাদা চোখে ঠিক ঠাওর করা যায় না। তাদের ব্যবহার ও কথাবার্তায় সেটা প্রকাশ পায়। আত্রেয়ী কি সেই ধরনের। নইলে ভালবাসা ছাড়া অন্য চিন্তা ওর মাথায় নেই?
সে বলল, ‘আমাকে একটু যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘হেনার বাড়িতে। অনেক দূর। তোমাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’
‘কিন্তু তুমি যাবে কী করে? দেখছ না আজ ট্রামবাস চলছে না।’
‘চলে যাব। তুমি বরং চারপাশ ঘুরে দ্যাখো।’
‘বাব্বা। এ যেন বিপ্লবকেও হার মানাচ্ছে। বেশ, যাও, তোমাকে তো আমি বাধা দেব না কিছুতেই। আমি রইলাম। চাবিটা দাও।’
‘কীসের চাবি?’
‘ঘরের।’
‘না। ঐ ঘরে তোমাকে একা একা যেতে দিতে পারি না।’
‘কেন?’ আত্রেয়ী এত বিস্মিত যে ওর গলা দিয়ে স্বর বের হল না ভাল করে।
‘রাগ করো না। নিশ্চয়ই এমন একটা কারণ আছে যা এই মুহূর্তে তোমাকে বলতে পারছি না। আত্রেয়ী, ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে পরে সব খুলে বলব। তুমি অপেক্ষা করো। আমি ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই চলে আসছি।’
‘কিন্তু আমি তোমাকে চিনব কী করে?’ আত্রেয়ীর গলার স্বর বরুণ।
‘তিন ঘণ্টা পরে ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা করো। অন্য জায়গায় থেকো না। আমি ঠিক চলে আসব।’ স্বপ্নেন্দু হাঁটতে শুরু করল।
দূরত্ব কম নয়। কিন্তু স্বপ্নেন্দুর হাঁটতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। এই কয়দিনের নতুন শরীর বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। পায়ে কোনও ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না।
আজ রাস্তায় ট্রাম-বাস নেই। মুখ্যমন্ত্রী বারংবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি। তার বদলে কাতারে কাতারে নগ্ন কঙ্কাল রাস্তায় আক্ষেপ করছে, উন্মাদের মত ছোটাছুটি করছে। তারা কী করবে সেটাই জানে না, কিন্তু চুপচাপ ঘরে বসে থাকা বোধ হয় আরও কষ্টকর। অথচ আত্রেয়ী তাকে নিয়ে ঘরেই থাকতে চাইছিল। আত্রেয়ী বলছে ও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। ভালবাসলে বোধহয় ওইভাবে নির্জনে থাকা যায়। কিন্তু সে তো হেনাকে ভালবেসেছে। তবে এতক্ষণে আত্রেয়ীকেও তার খারাপ লাগছে না। কাল রাত্রে আত্রেয়ী তাকে সুন্দর সুন্দর গান শুনিয়েছে। সে শুনতে চায়নি কিন্তু আত্রেয়ী গেয়ে গেছে। পুরনো দিনের আবেগ মাখানো গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই পরিবেশে সেগুলো মোটেই খারাপ লাগেনি তার। ভালবাসলে মানুষ গান গাইতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। হেনার সঙ্গে বসে আত্রেয়ীর ব্যাপারটা ফয়সালা করতে হবে। কী করে তা সম্ভব সেটাই জানা নেই।
রাজাবাজারের কাছাকাছি পৌঁছে ভিড়টা নজরে এল। অন্তত কয়েক শ’কঙ্কাল ভিড় করে কিছু দেখছে। স্বপ্নেন্দু ঠেলে ঠুলে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু একজন খেঁকিয়ে উঠল, ‘আঃ মরণ, নজরের মাথা খেয়েছেন নাকি!’
স্বর মেয়েলি, স্বপ্নেন্দু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।’
‘বুঝবেন কী করে। দেখার জন্যে তো তর সইছে না।’
‘আপনি মহিলা তা তো বোঝার উপায় নেই।’
‘ঢং। বোঝার উপায় নেই। ভাল করে চেয়ে দেখলেই তো বোঝা যায়।’ বলতে বলতে কনুই দিয়ে একটা মৃদু ধাক্কা দিল সে। স্বপ্নেন্দু খুব তাজ্জব হল। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষ একাকার হয়ে গিয়েছে। কাল সারারাত আত্রেয়ীর সঙ্গে থেকেও তাকে নিজের শরীরের থেকে আলাদা বলে মনে হয়নি। সে খুঁটিয়ে দেখল তারপর স্থির করল, মেয়েকঙ্কালের মুখের গঠন ছোট হয়, হাড়গুলো একটু পলকা এবং নরমভাবে মেশানো। সেক্ষেত্রে বালকদের সঙ্গে খুব বেশি তফাৎ হবার কথা নয়। স্বপ্নেন্দু কথা ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’
স্ত্রী-কঙ্কালটি বলল, ‘ওরা একটা লোককে ধরেছে। তার বিচার হচ্ছে।’
স্বপ্নেন্দু ততক্ষণে দেখতে পেয়েছে। ভিড়ের মাঝখানে চার-পাঁচজন আসামীকে বসিয়ে রেখেছে। এবার জেরা শুরু হয়, ‘আপনি মরতে চেয়েছেন, শুধু তাই নয় আপনি আর পাঁচজনকে মরতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। কেন?’
লোকটি নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে মরতে চাওয়ার।’
‘মোটেই না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যারা মরতে চায় তারা ষড়যন্ত্রকারী। তারা এই অতি-বৈপ্লবিক ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে চায়। একবার যদি কেউ মরে যেতে পারে তাহলে সবাই সেই পথ ধরবে। এই অতি-বৈপ্লবিক ব্যবস্থায় কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূর্ণ হতে পারে না।’
‘আমি এসব জানি না। আপনারা কি শাস্তি দেবেন আমাকে? আমি বলি, বরং আমাকে মেরে ফেলুন। এখানে কারও কোনও সুখ নেই। মুখ নেই। সব মুখ এক। কারও কোনও যন্ত্রণা নেই। কারও সামনে কোনও রহস্য নেই। উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার আইডেণ্টিটি। এইভাবে বেঁচে থাকা যায় না।’
‘আপনি দালালদের মত কথা বলছেন।’
‘জানি না। তবে যে দেশে ফুল নেই, জল নেই, একটুও সবুজ নেই সেই দেশে আমি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চাই না।’ লোকটা মাথা নাড়ল, ‘এমনকী একটা মেয়ে পর্যন্ত নেই।’
‘ওমেনস লিব কথাটা শুনেছেন? মেয়েরা এতকাল পুরুষদের সমান হবার জন্যে আন্দোলন করছিলেন। আর আপনাদের মত পুরুষেরা সেই আন্দোলন দাবিয়ে রেখেছিলেন। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মেয়েদের সেই আশা পূর্ণ হয়েছে।’
স্বপ্নেন্দু শুনল স্ত্রী-কঙ্কালটি চাপা স্বরে বলল, ‘ঝাঁটা মার। গতর গেলে মেয়েমানুষের আর কি থাকল।’
‘যা হোক, আপনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করেছেন। এই জন্যে আপনাকে শাস্তি দিচ্ছি।’
‘চমৎকার। মেরে ফেলুন।’
‘না ওটা করলে মুখ্যমন্ত্রীর হাত নরম হবে।’
লোকটি হাসল, ‘আপনার হাত-পায়ের প্রতি জোড়ে ইলেকট্রিক করাত চালাব যাতে শুধু আপনার বুকের খাঁচাটা ফুটপাতে পড়ে থাকে। হৃৎপিণ্ড তো ভাঙা যাবে না। আপনি চিরকাল ওই অবস্থায় পড়ে থাকবেন। হাঁটচলা করার স্বাধীনতা থাকবে না।’
স্বপ্নেন্দু ভিড় থেকে বেরিয়ে এল। লোকটা নিশ্চয়ই গর্দভ। নইলে মৃত্যুর জন্যে এঁড়ে তর্ক করে। হঠাৎ তার খেয়াল হল কেউ সঙ্গে আসছে। স্ত্রী কঙ্কালটিকে সে চিনতে পারল, ‘আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?’
‘যাবার তো জায়গা নেই। ওসব দৃশ্য সহ্য করতে পারি না আমি। আপনি বেরিয়ে এলেন বলে আমিও চলে এলাম।’
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘বাড়ি নেই। ঘর ছিল। ভাসতে ভাসতে হাড়কাটায় ঠেকেছিলাম। এখন আমাকে বেবশ্যে বলে চেনা যায় না; না?’ স্ত্রী কঙ্কালটি খিলখিলিয়ে হাসল।
স্বপ্নেন্দু আড়ষ্ট হল। কঙ্কালটি এক সময় বেশ্যাবৃত্তি করত। অথচ এখন ওকে দেখলে নিজেদের মতই লাগছে। সে বলল, ‘আমি এবার বাঁ দিকে যাব। আপনি যেখানে ইচ্ছে যান।’
‘তা তো বলবেই। এখন আমি বেকার। কিন্তু তখন ধাক্কা দিলে কেন?’
‘আমি তো বললাম আপনাকে লক্ষ্য করিনি।’
‘ইল্লি আর কী! ধান্দাবাজ লোকেরাই ধাক্কা দেয়।’
স্বপ্নেন্দুর হঠাৎ ভয় এল বুকে। এই স্ত্রী কঙ্কালটির উদ্দেশ্য সে বুঝতে পারছিল না। সে দৌড়ে পাঁচজন কঙ্কালের সঙ্গে মিশে হাঁটতে লাগল। স্ত্রী কঙ্কালটি ছুটে এল সেখানে। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল বেচারা ধাঁধায় পড়েছে। ছয়জনের মধ্যে কোন্ জন তা বুঝে উঠছে না। তারপর একজনের হাত চেপে ধরে স্ত্রী কঙ্কালটি চিৎকার করে উঠল, ‘এই শালা, ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে আসা হয়েছে না?’
সেই লোকটি অবাক ও বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল, ‘আরে, আমার হাত ধরেছিস কেন, ফোর্ট।’ আর একজন হেসে বলল, ‘ইয়ে শালী রাণ্ডী থি।’
স্ত্রী কঙ্কালটি বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়লে স্বপ্নেন্দু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত পা চালাতে লাগল সে। লস্ট আইডেণ্টিটি। তা না হলে সে রক্ষা পেত না ওই জাঁহাবাজ স্ত্রী কঙ্কালটির হাত থেকে। পরিচয় হারিয়ে যাওয়ায় একটা বড় উপকার হল। এখন যে কেউ যে কোনও ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে।
এখন শরীর খুব দ্রুত হাঁটতে পারছে। তবু সময় কম লাগল না। রাস্তায় যেতে যেতে অনেক দৃশ্য দেখেছে স্বপ্নেন্দু। যে যেখানে ইচ্ছে আগুন ধরাচ্ছে। তাতে কারও কোনও আপত্তি নেই যেন। দমকলের গাড়িই নেই কারণ জল অদৃশ্য। এমনকি যার ঘর পুড়েছে তারও যেন সম্পত্তির ওপর মায়া চলে গেছে। সমস্ত মানুষ এখন উন্মাদ। হেনাদের বাড়ির সামনে এসে দেখল প্রচণ্ড ভিড় জমেছে। অনুমানে বুঝল সেখানেও কোনও বিচার পর্ব চলছে। কৌতূহল হলেও সেদিকে আর পা বাড়ালো না সে। একবারে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
দরজা খোলা। ঘরের আসবাবগুলো নেই। সব খাঁ খাঁ করছে। স্বপ্নেন্দু ডাকল, ‘হেনা।’
ভেতর থেকে কোনও সাড়া এল না। স্বপ্নেন্দু এগোল। কোনও ঘরে কেউ নেই। হতভম্ব হয়ে গেল সে। হেনারা গেল কোথায়। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করল, ‘হেনা।’
স্বপ্নেন্দু বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল তিনজনে একজনকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে আসছে। যাকে টানছে তার স্বর চিনতে পারল স্বপ্নেন্দু। সে ছুটে গেল সামনে, ‘হেনা, তোমার কী হয়েছে? আমি স্বপ্নেন্দু।’
সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ল হেনা। মাটিতে উবু হয়ে বসে কান্না জড়ানো স্বরে বলল, ‘ওরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গেল।’
‘কেন?’
যারা হেনাকে এনেছিল তাদের একজন বলল, ‘ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘মাথায় ঘিলু নেই খারাপ হবে কী করে?’
‘তাহলে হৃৎপিণ্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে। জানলা দিয়ে নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন মরার জন্যে। হাত পা ভেঙেছে, মরেননি। সেই অবস্থায় পাগলের মত মরতে চাইছিলেন। সেই অবস্থায় বিচার করে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মত পাতাল কূপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এক বছরের জন্যে বন্দি করে রাখতে। আপনি যখন এঁর পরিচিত তখন এঁকে সামলান। আমরা চলি। লোকগুলো চলে গেল।
ধাক্কাটা সামলে স্বপ্নেন্দু হেনার মাথায় হাত দিল, ‘হেনা, শান্ত হও।’
‘ওরা মাকে ধরে নিয়ে গেছে। তুমি কিছু করবে না?’ কান্না আছে কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায় জলের তো দেখা পাওয়া যাবে না।
‘এখনই তো কিছু করা যাবে না। তুমি ওঁকে বাধা দাওনি কেন?’
‘দিয়েছিলাম। শোনেননি আমার কথা। উল্টে বলল, তোর তো একটা প্রেমিক আছে আমি কী নিয়ে থাকব। ভাবতে পার আমার মা আমাকে ওই কথা বলল।’
‘কী পরিবর্তন। এখন আমি কী করব!’
হেনাকে তুলে দাঁড় করাল স্বপ্নেন্দু, ‘আমি আছি, তোমার ভয় নেই হেনা।’
‘মাকে কি আমি ফিরে পাব না?’
‘পাবে। এখন তো কেউ মরে না। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব আমি। আমার ওপর ভরসা রাখো হেনা। আমি তোমাকে গ্রহণ করতে এত দূরে চলে এসেছি।’
‘সত্যি?’ হেনার স্বরে উত্তাপ।
‘সত্যি। তুমি আমার সঙ্গে চল।’
‘আমাকে কোনদিন কষ্ট দেবে না?’
‘না।’
‘কিন্তু কিভাবে থাকব। এখন তো আমাদের বিয়ে হবে না।’
‘আমরা সার্টিফিকেট জোগাড় করব সরকার থেকে। আমি কথা বলেছি।’
‘কিন্তু আমাকে নিয়ে তুমি কি করবে?’
‘আমি ভালবাসব। আমি তোমাকে সুখী করব।’
‘সত্যি সুখে রাখবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’
কিন্তু এখন তো কলকাতা থেকে সুখ উধাও হয়ে গিয়েছে। তুমি কী করে আমাকে সুখী করবে? তোমার কাছে কি সুখের গোপন মন্ত্র আছে?’
‘কি সুখ তুমি চাও হেনা?’
‘জানি না। একটা অসহায় মেয়ে কী সুখ চাইতে পারে!’
‘আমি তার থেকে অনেক বেশি সুখ দেব তোমাকে। তুমি এসো।’
‘কি সে সুখ?’
‘এখন বলব না। তুমি আমার ঘরে চল। তারপর তোমাকে দেখাব।’ হেনা বোধহয় অবিশ্বাস করল কিন্তু অবাধ্য হল না। ধীরে ধীরে সম্মত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কয়েক পা হাঁটবার পর স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল, ‘তোমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। বন্ধ করবে না?’
‘কী হবে বন্ধ করে? ওখানে যা ছিল সব লুঠ হয়ে গেছে মা চলে যাওয়ার পরে। তোমার সঙ্গে গেলে আমি আর এখানে ফিরে আসছি না।
স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করেছিল হেনার শরীরে পোশাক নেই। অথচ হেনা এ ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল। নিশ্চয়ই উত্তেজনায় ওর এ বিষয়ে আর লক্ষ্য ছিল না। সে হেনার দিকে তাকাল। হাড়ের গঠনেও যেন একটা ছন্দ ছড়ানো আছে।
হেনার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। সারাটা পথ সে কেবল ঘুরে ফিরে মায়ের কথা বলেছে। স্বপ্নেন্দু তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, পরিচিত কর্তাব্যক্তিকে ধরে সে নিশ্চয়ই হেনার মাকে উদ্ধার করবে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা রাজাবাজারে কাছে পৌঁছে একটা ছোট্ট ভিড় দেখল। ফুটপাতে হাত-পা-মুণ্ডহীন অবস্থায় একটা বুকের খাঁচা পড়ে আছে। অথচ সেই খাঁচায় আটকে থাকা নিরেট আবরণের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ড সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘মেরে ফেলো, মেরে ফেলো…।’
হেনা চমকে উঠল, ‘কী হয়েছে ওর?’
স্বপ্নেন্দু ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। এর মধ্যেই শাস্তি দেওয়া হয়ে গেছে। একে প্রকাশ্যে রাখা হয়েছে যাতে সাধারণ নাগরিকরা মৃত্যুর কথা বলতে ভয় পায়। কিন্তু কী লাভ হচ্ছে ওতে। শাস্তি পাওয়ার পরও তো লোকটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কথা হেনাকে বলা যায় না। ঘটনাটা জানালে হেনা চট করে মায়ের অবস্থা ভাববে। ভদ্রমহিলা যদি সচেতন না হন তাহলে তারও এই পরিণতি ঘটবে। সে উদাস গলায় বলল, ‘হয়ত পড়েটড়ে হাড়গোড় ভেঙেছে। তুমি আমার হাত ধরো।’
হেনা যেন একটু কাঁপলো, ‘যাঃ, খোলা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটব কি!’
‘তাতে কী হয়েছে? এখানে কেউ বুঝতে পারবে নাকি আমরা ছেলেমেয়ে ছিলাম।’
‘ছিলাম।’ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল হেনা।
‘হাত না ধরেলে ভিড়ের মধ্যে নিজেদের গুলিয়ে ফেলতে পারি।’
এবার হেনা হাত বাড়াল। শীতল না উষ্ণ বোঝা গেল না কারণ স্বপ্নেন্দু আবিষ্কার করল তার নিজের হাতের অনুভূতি হারিয়ে গেছে। সে তবু বলল, ‘তোমার হাত খুব নরম ছিল, না?’
সঙ্গে সঙ্গে ফুঁপিয়ে উঠল হেনা। ত্রস্ত স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল তোমার?’
‘কেন মনে করিয়ে দাও ওসব?’
‘সরি। আসলে, তুমি এখনও খুব নরম। তোমার মনটা এত নরম।’
চারধারে অশান্তি বাড়ছে। ওরা থেমে থেকে এগোচ্ছিল। রাস্তায় যে যাকে পারছে আঘাত করছে। হাড়ে হাড়ে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। একটা জায়গায় বিচার চলছিল বোধ হয়। হঠাৎ জনতা ক্ষেপে গিয়ে বিচারকদের ধাওয়া করল। বিচারকরা পালাতে পালাতে চিৎকার করছিল ‘শান্তি বজায় রাখুন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন….।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা।
বড় রাস্তা তবু নিরাপদ। জনতার মধ্যে মিশে গিয়ে কোনরকমে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু গলিতে ঢোকা বিপদজ্জনক। সেখানে আগুন জ্বলছে। জল নেই দমকল নেই অতএব আগুনের পোয়াবারো। চোখের সামনে বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে—এটা দেখার মধ্যে বেশ মজা আছে বোধহয়। মানুষগুলো এতকাল কোন উত্তেজনা পাচ্ছিল না। এখন আগুনের খেলা দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। কেউ কেউ আবার সেই আগুনে স্নান করা মত পাক খেয়ে আসছে। হেনা স্বপ্নেন্দুর হাত ধরে বলল, ‘কলকাতায় যখন আর কিছুই পোড়াবার থাকবে না তখন কী করবে ওরা? কিসে উত্তেজনা পাবে?’
‘জানি না।’
হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে হেনা প্রশ্ন করল, ‘তুমি তখন আমাকে কী দেখাবে বলেছিলে?’
স্বপ্নেন্দু হাসল, ‘অধৈর্য হচ্ছ কেন? আমার ওখানে চলো, তারপর দেখবে।’
হেনা বলল, ‘ভাবতে কেমন লাগে, না? তুমি ডাকলে আর আমি চলে এলাম। একবারও ভবিষ্যতের কথা ভাবলাম না।’
‘তোমার ভবিষ্যৎ তো আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।’
‘কি জানি।’
আর এই সময় আত্রেয়ীর কথা মনে পড়ল স্বপ্নেন্দুর। ও যদি চলে না যায় তাহলে বাড়িতে যাওয়া মাত্র দেখা হবে। ওর কথা শুনলে হেনা কি ভাববে? তাকে যদি বিশ্বাঘাতক মনে করে চলে আসে?
স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! বলি বলি করেও বলতে পারল না সে। তার মনে হল এর চেয়ে হেনাদের বাড়িতেই থেকে গেলে হত। আত্রেয়ী তার খোঁজ পেত না। কিন্তু যখন মনে হয়েছিল হেনাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে, হেনার কাছে থাকার কথা খেয়াল আসে নি। স্বপ্নেন্দুর হঠাৎ মনে হল সে আত্রেয়ীকে এত ভয় পাচ্ছে কেন? আত্রেয়ী তাকে ভালবাসে এইটুকু কি হেনা সহ্য করবে না? কোনও পুরুষ যদি তাকে ভালবাসত তাহলে হেনা কি করত! এখন তো আত্রেয়ী আর মেয়ে নয়। সে স্থির করল যা হবার হবে। যেমন করেই হোক হেনাকে রাজী করাবে তার সঙ্গে থাকতে।
শেষ পর্যন্ত পাড়ায় পৌঁছাল ওরা। হেনা বলল, ‘এদিকটা বেশি ঘিঞ্জি না?’
উত্তর কলকাতায় থাকার জন্যে এই প্রথম খারাপ লাগল স্বপ্নেন্দুর। তবু বলল, ‘এসব তো বনেদী পাড়া। প্ল্যান করে তৈরি হয় নি তখন। তবে আমার ঘরে হাওয়া আসে।’ একমাত্র তারাই হাত ধরাধরি করে যাচ্ছে। আর বাকি মানুষ পাগলের মত চিৎকার করছে। গলিতে ঢুকেই ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। স্বপ্নেন্দুর ভয় হচ্ছিল তাদের বাড়ি ছাই হয়ে গেছে কিনা। বাড়ির কথা মনে হতেই চাবির কথা খেয়াল এল। চাবিটা কোথায়। হাতে নেই তো। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওরকম দামী গা-তালা চাবি ছাড়া খোলা মুশকিল। কখন যে হাত থেকে টুক করে পড়ে গেছে সেটা তার খেয়ালেই নেই। এখন একটা তালাওয়ালা যদি না পাওয়া যায় তাহলে দরজা ভাঙতে হবে। সে চাপা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ।’
হেনা চমকে উঠল, ‘কী হয়েছে? তোমার বাড়িতে আগুন দিয়েছে নাকি?’
‘না। কিন্তু আমি ঘরের চাবি হারিয়ে ফেলেছি।’
‘সেকি?’
‘হ্যাঁ। খুব শক্ত তালা। এখন দরজা খুলব কী করে?’
হেনা এবার হেসে উঠল, ‘তোমার বুকে হাত দিয়ে দ্যাখো?’
‘বুকে?’ স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের দিকে তাকাল। এবং তখনই সে তার চাবিটাকে পেল। হৃৎপিণ্ডের চারদিকের শক্ত স্বচ্ছ মোড়কের গায়ে চাবিটা আটকে আছে। ওটা ওখানে কী করে গেল? স্বপ্নেন্দু হাত বাড়িয়ে চাবিটাকে টানতে গিয়ে টের পেল। মোড়কটিতে চুম্বক কাজ করছে। যা কিছু শক্ত তাই বোধহয় এই হৃৎপিণ্ড টেনে নেয়। অদ্ভুত ব্যাপার।
কয়েক পা এগিয়ে অবনীদার চায়ের দোকানটার দিকে নজর যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল স্বপ্নেন্দু। ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে সেখানে। একটা লোক সমানে উবু হয়ে বসে সেদিকে তাকিয়ে। দোকানটা এখন প্রায় ছাই। স্বপ্নেন্দুর মনে হল লোকটা নিশ্চয়ই অবনীদা। খুব কষ্ট না পেলে কোনও মানুষ ওইভাবে বসে থাকতে পারে না। আর এই দোকান ছাই হওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন একমাত্র অবনীদা।
সে ডাকলো, ‘অবনীদা, না?’
‘হু। তুমি কে ভাই?’ অবনীদার ভঙ্গির পরিবর্তন হল না।
‘আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘দ্যাখো, ওরা কিছু না পেয়ে দোকানটাকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।’
‘কেন? আপনি কী করেছিলেন?’
‘কিছু না। ওদের তো কোনও কাজ করার নেই অথচ কিছু একটা করতে হবে। এই দোকানটা চোখে পড়তেই পুড়িয়ে দিল। খুব হই হই করল যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল। তারপর চলে গেল। ওই দ্যাখো ন্যাড়ার বাপ এখনও পড়ে আছেন ফুটপাতে।’
স্বপ্নেন্দু চোখ ফেরাল। সেই বৃদ্ধ যিনি দড়িতে ঝুলছিলেন, আগুনের ছ্যাকা খেয়েছিলেন তিনি এখন হাত পা-হীন অবস্থায় ফুটপাতে পড়ে আছেন। কোনও কথা বলছেন না কিন্তু তার শরীর নড়ায় বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু ধারে কাছে আসেনি।
স্বপ্নেন্দু হেনার হাত ধরে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। হেনা জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর কী হয়েছে?’
‘পড়ে-টড়ে গেছে বোধহয়।’ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল স্বপ্নেন্দু।
‘মিথ্যে কথা। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। ঠিক আছে, আমিই জিজ্ঞাসা করছি।’ ফুটপাথে উঠে সামান্য ঝুঁকে হেনা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার এরকম হল কেন?’
বৃদ্ধের মুণ্ডু হেনার দিকে ফিরল, ‘বলব না।’
‘কেন বলবেন না?’
‘আমার ইচ্ছে তাই বলব না। আবার বলে মুণ্ডুটাকে হারাই আর কি?’
হেনা একটু হকচকিয়ে সরে এল। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘তেমনি কিছু না হলে কি বলত না?’
হেনার কিন্তু তখনও খুঁতখুঁতুনি যাচ্ছিল না।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই স্বপ্নেন্দু থমকে দাঁড়াল। একটা কঙ্কাল মুখ ঝুঁকিয়ে বসে আছে দরজার গোড়ায়। ওদের দেখেই সে উঠে দাঁড়াল, ‘স্বপ্নেন্দু?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি হেনা?’
হেনা এবার বিস্মিত। স্বপ্নেন্দুর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইনি কে?’
‘আমি?’ হি হি করে হাসলো আত্রেয়ী, ‘আমি কেউ না! পথের ভিখিরি। দূর ছাই, আমি শুধু ভুলে যাই, এখন তো একটা ভিখিরিও নেই।’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘হেনা, এর নাম আত্রেয়ী। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। তারপর ওর বিয়ে হয়ে যায়, যোগাযোগও ছিল না। কাল এই বিপর্যয়ে আমার এখানে এসেছে।’
‘তবু বলতে পারলে না আমরা বন্ধু।’ চিৎকার করে উঠল আত্রেয়ী।
‘ঠিক আছে, বন্ধু।’
হেনা অবাক হয়ে বলল, ‘তোমরা কাল একসঙ্গে ছিলে? তুমি আমাকে একথা বলনি কেন স্বপ্নেন্দু?’
সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো আত্রেয়ী, ‘এই বোকা, তুমি ওকে ভালবাস?’
‘জানি না।’
‘কিন্তু ও তোমাকে ভালবাসে। তুমি তো মেয়ে ছিলে আমিও। আমরা কি চাইতাম? ছেলেদের সমান হব, তাই না? আজ তো ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনও তফাত নেই। তাহলে শুধু শুধু মেয়েলিপনা করব কেন?’
‘আপনি আমার হাত ছাড়ুন।’
‘না, ছাড়ব কেন? তোমাকে আমার বন্ধু হতে হবে।’
‘খামোকো বন্ধু হতে যাব কেন?’
‘কারণ তোমাকে স্বপ্নেন্দু ভালবাসে।’
‘তার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?’
আত্রেয়ী বলল, ‘কারণ আমি স্বপ্নেন্দুকে ভালবাসি।’
চকিতে হেনা জিজ্ঞাসা করল, ‘ও আপনাকে ভালবাসে?’
‘না। ও তোমাকে ভালবাসে তাই।’
‘তাহলে?’
‘কি তাহলে? এখন তো আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। আমাদের শরীর নেই, নারীত্ব নেই। শুধু হৃৎপিণ্ড আছে যা দিয়ে আমরা ভালবাসতে পারি। এসো আমরা বন্ধুর মত থাকি।’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।’
‘আমি পারছি।’
‘আপনি পাগল।’
ঠিক এই সময়ে সিঁড়ির নিচে একটি কঙ্কাল এসে দাঁড়ালো, ‘স্বপ্নেন্দু আছ?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘কে আপনি?’
‘আমি অবনীদা।’
‘ও, কী ব্যাপার?’
‘আমাকে একটু জায়গা দেবে স্বপ্নেন্দু, আজকের রাতটার জন্যে। আমার খুব ভয় করছে। ওরা নাকি আবার আসবে।’
‘কারা?’
‘যারা পাগল হয়ে এসব করছে।’
‘আসুন।’
অবনীদা উঠে এলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না। নিচের দরজা খোলা। ওরা দেখলে এখানেও উঠে আসতে পারে।’
স্বপ্নেন্দু দ্রুত নেমে নিচের দরজা বন্ধ করে এল। তারপরে ঘরের চাবি খুলে দিতেই সবাই ভেতরে ঢুকল। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘দুটো ঘরে ভাগ করে থাকো। আত্রেয়ী, আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে যাবে। তোমাকে বারংবার বলেছি যে আমি হেনাকে ভালবাসি।’
‘কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালবাসি।’
‘উঃ, আমি পাগল হয়ে যাব।’ স্বপ্নেন্দু চেঁচিয়ে উঠল।
আত্রেয়ী হেসে উঠল খিলখিল করে। তারপর এগিয়ে গেল হেনার কাছে, ‘এখন তো কোনও উপায় নেই, নইলে তোমার শরীরের গন্ধ নিতাম।’
‘মানে?’
‘কি করে ওকে মজালে ভাই?’
হেনা বিরক্ত হল, ‘ভদ্রভাবে কথা বলুন।’
আবার হাসল আত্রেয়ী। তারপর অবনীদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে আমি চিনি না। কিন্তু বলুন তো আমি কি অন্যায় করেছি?’
অবনীদা মাথা নাড়লেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এই সময় বাইরের হল্লা আরও বেড়ে গেল। শুধু হাড়ে হাড়ে শব্দ হচ্ছে। সমস্ত কলকাতা শহরে যেন হাড়ের বাজনা বাজছে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘আমার বুকটা কেমন করছে হেনা, আমার বুকের ভেতরটা দুলছে।’
হেনা এবার এগিয়ে এলো তার সামনে, ‘কিন্তু আমার সুখ? কী সুখ দেবে তুমি?’
‘সুখ?’
‘হ্যাঁ। মিথ্যে বলার চেষ্টা কোর না।’
‘মিথ্যে?’
‘নিশ্চয়ই। তুমি মিথ্যেবাদী। আমাকে ভালবাসার বুলি শুনিয়ে ভাওতা দিয়েছ। ওই পাগলের সঙ্গে রাত কাটিয়ে গেছ আমার কাছে। কী নেবে তুমি আমার কাছ থেকে? কী লোভ তোমার?’
‘হেনা!’ চিৎকার করে উঠল স্বপ্নেন্দু।
‘চেঁচিও না। আমি আর কিছুতেই ভুলছি না।’ হেনা অবনীদার দিকে তাকাল, ‘এই যে, আপনি শুনুন, এই লোকটা বলেছিল ওর সঙ্গে এলে আমাকে নাকি সুখ দেবে। বলুন ওকে সেই সুখ দিতে!’
অবনীদা বললেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এই সময় আত্রেয়ী এগিয়ে এলো, ‘সুখ চাইলেই কি পাওয়া যায়? কাল রাত্রে আমি সুখ পেয়েছিলাম। সুখ পেতে জানতে হয়।’
হেনা চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি ওকে সুখ দিয়েছ?’
‘আমি জানি না, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকেই ভালবাসি।’
‘মিথ্যে কথা। কী প্রমাণ আছে এর?’
‘আছে, প্রমাণ আছে। আমি তোমার হৃদয় শান্ত করে দিতে পারি।’
‘কীভাবে?’
‘তোমার একটুও উত্তেজনা থাকবে না হৃদয়ে।’
এবার অবনীদা বললেন, ‘তুমি কি ম্যাজিক জানো স্বপ্নেন্দু?’
‘তার চেয়ে বেশি। আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা কলকাতার মানুষ চিন্তাও করতে পারবে না। বসুন আপনারা ওখানে।’ স্বপ্নেন্দুর স্বরে এমন কিছু ছিল যে বাধ্য হল ওরা খাটে বসতে। স্বপ্নেন্দুর এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। তারপর সন্তর্পণে চাদরটা সরাল। আবছা লালচে আভা দেখা গেল। হেনা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ওটা?’
আত্রেয়ী শিশুর গলায় বলল, ‘বাঃ সুন্দর।’
এবার কাচের বড় জারটা। সেটা সরাতেই কাচের বাটির তলায় লাল টকটকে ডাঁটো গোলাপটাকে দেখতে পেল সবাই। উদ্ধত ভঙ্গিতে যেন তাকিয়ে রয়েছে। সেই জলের ফোঁটাটাও তেমন টলটলে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘এটা রক্ত গোলাপ। কোলকাতায় কোথাও আর ফুল নেই। শুধু আমার কাছে, আমার কাছে ও বেঁচে আছে। তোমরা ওর দিকে একটু তাকাও, দেখবে হৃৎপিণ্ড শান্ত হয়ে যাবে। আরাম পাবে।’
ওরা তিনজন মুগ্ধ চোখে ফুলের দিকে তাকাচ্ছিল। প্রত্যেকের উত্তেজনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হেনা অস্ফুটে বলল, ‘আঃ কী আরাম! স্বপ্নেন্দু, আমি তোমার কাছ থেকে সত্যিকারের সুখ পেলাম। আর একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার। তুমি কী ভাল!’
অবনীদা বললেন, ‘স্বপ্নেন্দু, আমি কৃতজ্ঞ। আমার হৃৎপিণ্ড জুড়িয়ে গেল।’
শুধু আত্রেয়ী কোনও কথা বলল না।
স্বপ্নেন্দু ডাকলো, ‘আত্রেয়ী!’
আত্রেয়ী দুহাতে মুখ ঢাকল ‘আমি চাই না। সুখ চাই না। সারাজীবনে যে একটুও সুখ পেল তার আর সুখের দরকার নেই। ঢেকে ফেল ওটাকে।’
হেনা বলল, ‘না। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে এল, আমি তোমাকে ভালবাসি স্বপ্নেন্দু। তুমি আমার ওপর রাগ করো না।’
এই প্রথম শব্দটা শুনে স্বপ্নেন্দু আপ্লুত হল। তার হাত ধরল হেনা, ‘তুমি ওই ফুলটা আমাকে দাও।’
‘কেন?’
‘ওটা আমার।’
‘না। এই ফুল তুমি চেয়ো না।’
‘কেন? আমাকে তুমি দিতে পারবে না?’
এবার আত্রেয়ী উঠে এল, ‘আমি কী দোষ করলাম? আমাকে দাও ফুলটা।’
সে হাত বাড়ালে হেনা বাধা দিল, ‘না। আমি নেব। ও আমাকে দেবে। আমি স্বপ্নেন্দুকে ভালবাসি।’
‘না, আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি ওকে।’ হেনাকে সরিয়ে দিতে চাইল আত্রেয়ী। তারপরেই ঘরে দৃশ্যটা অভিনীত হল। একদা-রমণী দুটো শরীর পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আক্রোশে। এতক্ষণ বাইরের রাস্তায় যে হাড়ের শব্দটা হচ্ছিল সেটা এখন চলে এল ঘরের ভেতরে। স্বপ্নেন্দু পাথরের মত দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। তার যেন কিছুই করার নেই। সমস্ত আত্মসম্মান চক্ষু লজ্জা খুইয়ে দুটো মানুষ নিজেদের অহঙ্কার বাঁচাতে একটা ফুলের জন্যে লড়ছে।
এই সময় অবনীদা বাধা দিলেন। জোর করে ওদের ছাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ছি ছি, আপনারা পাগল হয়ে গেলেন নাকি?’
দুজনেই একসঙ্গে চিৎকার করল, ‘আমার ফুলটা চাই।’
অবনীদা বললেন, ‘বেশ, স্বপ্নেন্দু যাকে দেবে সেই ফুলটা পাবে। যে পাবে না তাকে এটা মেনে নিতে হবে।’
কিন্তু স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘না। ওই ফুলে আমি হাত দেব না।’
‘কেন?’ তিনটে গলা একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
‘বিশ্বাস করো, ওই ঢাকনার তলা থেকে বের করে আনলে ফুলটা আর বাঁচবে না। একে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ঢাকনা সরানো চলবে না।’
‘বিশ্বাস করি না।’ আত্রেয়ী বলল।
‘তুমি প্রমাণ করো কাকে তুমি ভালবাস।’ হেনা দাবি জানাল। স্বপ্নেন্দু বাটিটাকে স্পর্শ করল। তারপর এক ঝটকায় সেটাকে সরিয়ে ফুলটাকে হৃৎপিণ্ডে চেপে ধরতেই স্বপ্নেন্দুর সমস্ত শরীর থরথর করে উঠল। তারপর কঙ্কালের ওপর ধীরে ধীরে মাংস চামড়া ধমনী দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণ মানুষের চেহারায় ফিরে গিয়ে স্বপ্নেন্দু উচ্চারণ করল, ‘মাগো!’ এবং তারপর একটি সম্পূর্ণ মানুষের শরীর ক্রমশ নত হল, নত হয়ে হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ওরা তিনজন ছুটে এল সেই শরীরের পাশে। বুকের ওপর ফুলটা শুকিয়ে ছাই হয়ে আছে। স্বপ্নেন্দুর মুখে তৃপ্তির ছাপ, শরীরে প্রাণ নেই। ওরা তিনজন পাগলের মত কিছুক্ষণ স্বপ্নেন্দুকে ডাকাডাকি করল। তারপর অবনীদা ছুটে গেলেন জানলায়, শেষ পর্যন্ত দরজায়। আত্রেয়ী এবং হেনার সামনে একটি রক্তমাংসের পূর্ণ নগ্ন মানুষ। ওরা দুজন পাগলের মত সেই মানুষকে স্পর্শ করছিল। একটি মানুষ, তার চোখ নাক মুখ গলা বুক পেট নিয়ে যে সম্পূর্ণ তাকে দুহাতে আস্বাদ করতে চাইছিল একদা রমণীরা।
অবনীদা ততক্ষণে ছুটে গিয়েছেন, রাস্তায়। পাগলের মত চিৎকার করে বলেছেন, ‘শুনুন আপনারা। একটা মানুষ মরে গেছে। সত্যিকারের মৃত্যু। সম্পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ। আমাদের মধ্যে একজনই মরে যেতে পারল। সেই ভাগ্যবান পুরুষটিকে দাহ করতে হবে। শুনুন আপনারা।’ কলকাতার নরকঙ্কালরা অবাক হয়ে শুনছিল একটা রক্তমাংসের মানুষ মরে যেতে পেরেছে। ঘোর কাটতেই সমস্ত কঙ্কাল ছুটে আসছিল সেই গলিতে। ঈর্ষান্বিত, বিহ্বল সেই নরকঙ্কালের মিছিলের দিকে তাকিয়ে উন্মাদ অবনীদা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, ‘রক্তমাংসের পুরুষ। মরে গেছে, একদম মরে গেছে। সেই ভাগ্যবানের নাম স্বপ্নেন্দু।’