আজও ছুটি। তার কিছুই করবার নেই। রেডিওটা খুলতেই বাজনা শুনতে পেল সে। আর মাঝে মাঝেই সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতাবাসীদের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করার জন্যে। খবর শুনল সে। আজ সকালে ট্রামবাস আগের মত চলতে শুরু করেছে। কলকাতার মানুষ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে তারা ওই ঘটনার প্রাথমিক আঘাত খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠেছেন। আজ ছুটির দিন। মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন কাল থেকে সবাই যেন নিয়মিত অফিস-কাছারিতে যোগ দেন।
দুপুরে বাড়ি থেকে বের হল স্বপ্নেন্দু। সেই পাজামা পাঞ্জাবি এবং চাদর জড়িয়ে। আজ রাস্তায় অনেক লোক। স্বপ্নেন্দুর ভাল লাগল প্রত্যেকেই যে যার মত পোশাক পরেছে। ট্রাম স্টপেজের কাছে আসতেই সে একটা স্বর শুনতে পেল, ‘এই যে দাদা, খুব শীত নাকি?’
সে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে দেখতে পেল চারটি মাঝারি সাইজের কঙ্কাল একটা রকে বসে আছে। প্রত্যেকের পরনে চাপা প্যাণ্ট এবং রঙিন জামা। করোটির দিকে তাকালে বোঝা যায়। ওদের বয়স খুব বেশি নয়। সে দেখছে বুঝে একজন বলল, ‘অত লজ্জা কেন? আপনার মাথা কি আলাদা? খুলে ফেলুন খুলে ফেলুন। পাঁচজনে দেখুক।’
আর একজন পিনিক কাটল, ‘যেন লজ্জাবতী বউ!’
স্বপ্নেন্দুর চোয়াল শক্ত হল। এরা যে রকবাজ তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না! সামনে বস্তির কিছু ছেলে এখানে এসে বসে আড্ডা মারে, খিস্তি করে, প্রয়োজনে বোমাটোমাও ছোড়ে। এই দলটা তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এখন সে কিছুই করতে পারে না। এই শরীরে নিয়ে মারামারি করার কথা চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু এত কাণ্ডের পরও ওরা ওদের স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি সেটাই আশ্চর্যের কথা। এই জেনারেশনের ছেলেগুলো কি কোন কিছুতেই রিঅ্যাক্ট করে না? তার মনে হল, ওরা আগের মতই আছে, হয়ত ভালই আছে।
ধর্মতলার ট্রাম আসছিল। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করল ড্রাইভারের শরীরে ওভারকোট, মাথায় মাফলার জড়ানো! কিন্তু লোকটা যে কঙ্কাল তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। লোকটা নিশ্চয়ই তারই মত। নইলে এই গরমে ওসব জড়িয়ে বের হয়। ট্রামটা থামতে, উঠে পড়ল স্বপ্নেন্দু। বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালে সিটগুলো ভরে আছে। কিছু দাঁড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে ছুটির দিন সবাই কলকাতার নতুন চেহারা দেখতে বেরিয়েছে। এবং তখনই তার চোখে পড়ল লেডিস সিটে দুজন মহিলা বসে আছেন। মহিলা, তার কারণ ওঁদের পরনে শাড়ি ব্লাউজ। আঁচল ঘোমটার মত মাথায় জড়ানো। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড থরথরিয়ে উঠল। মুখের দিকে তাকালে কেমন ছ্যাঁক করে ওঠে। সে আরও একটু সরে এল। লেডিস সিটে কিছু জায়গা খালি আছে। যারা দাঁড়িয়ে তারা ইচ্ছে করেই বসে নি। সে দুই মহিলার মুখের দিকে তাকাল। গোলগাল ছোট্ট করোটি। নাক এবং গালের হনুতে স্পষ্ট পার্থক্য আছে পুরুষদের সঙ্গে। হাতের হাড় সরু সরু। দেখলেই বোঝা যায় খুব পলকা শরীর। পাশে দাঁড়ানো একজন বলল, ‘বসতে চান বসে পড়ুন। লেডিস উঠলেই হয়ে যাবে।’
একজন মহিলা সেকথা শুনে মুখ তুলেই ফিরিয়ে নিলেন! এর নাকের ডগাটা বসা, কপাল উঁচু। কোনও মেয়ের চেহারা এত বীভৎস হতে পারে? মনে হতেই হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। রাস্তায় বের হলেই বোঝা যাচ্ছে পুরুষরাও কতখানি কুৎসিত দেখতে। এতকাল মাংস চামড়া এবং রঙ প্রত্যেকের খামতি আড়াল করে রাখত। আজ কলকাতার কোনও দোকানপাট খোলেনি। ধর্মতলাটা ছুটির দিনে যেমন তার থেকেও বেশি খাঁ-খাঁ। যেন হরতাল হয়ে গেছে। শুধু কাতারে কাতারে মানুষ উৎসুক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বাস চলছে গোটা কয়েক। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ল বেশ কিছু। যারা চালাচ্ছে তাদের ভঙ্গি ঠিক আগের মতনই। ট্যাক্সি একটাও বের হয় নি রাস্তায়।
গড়ের মাঠের অবস্থা খারাপ হয়েছিল পাতাল রেলের কল্যাণে। এখন তো তাকানোই যায় না। সব ঘাস উধাও হয়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে চারধার। গাছগুলো পর্যন্ত পোড়া কয়লা। ইডেন গার্ডেন একটা পোড়া বাগানের চেহারা নিয়েছে। আরও কয়েক পা হাঁটার পর চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। গঙ্গায় এক ফোঁটা জল নেই। চাপ চাপ শক্ত কাদার ওপর মৃত জলচর প্রাণীর হাড় ছড়িয়ে আছে। নদীর কঙ্কালটাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল। লঞ্চ এবং জাহাজগুলো নদীর কাদায় আটকে রয়েছে। জল নেই, কথাটা মনে পড়ল। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন বহির্জগতের সঙ্গে কলকাতা বিচ্ছিন্ন। তাহলে এই গঙ্গার শেষ যেখানে সেখানে কী আছে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না নিশ্চয়ই গোটা সমুদ্রটা উধাও হয়ে যায় নি। অবশ্য কলকাতার বাইরে।
সারাদিন স্বপ্নেন্দু ঘুরে বেড়াল। মানুষের আচরণ এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালের অকারণ ভিড়। তালতলায় এসে ওর মণ্টুদার কথা মনে পড়ল। প্রচণ্ড আড্ডার লোক। বিয়ে থা করেও ঠিক সংসারি হয় নি। বউদি সংসার চালিয়ে এসেছেন, মণ্টুদা টাকা দিয়ে খালাস। স্বপ্নেন্দু ট্রাম থেকে নেমে পড়ল। মণ্টুদার বাবার এ অঞ্চলে বড়লোক বলে খ্যাতি ছিল। গোটা তিনেক বাড়ি আছে। সেগুলোর ভাড়াটেরা আদ্যিকালের ভাড়ায় বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই নিয়ে কোর্ট-কাছারি চলছে। এইটেই মণ্টুদার একমাত্র অশান্তির কারণ।
গলির মুখে একগাদা কঙ্কাল ভিড় করেছে। স্বপ্নেন্দু দরজার কড়া নাড়ল। প্রথমে কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা স্বর শোনা গেল, ‘কে?’
‘আমি স্বপ্নেন্দু। দরজা খোলো।’
তবু সময় লাগল। যে খুলল তার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দু ঠাহর করতে পারল না পরিচয়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মণ্টুদা আছে?’
বসার ঘরে ঢুকে ইজিচেয়ারটার দিকে তাকাতে স্বপ্নেন্দু চমকে উঠল। মণ্টুদার শরীর ছিল ছফুট লম্বা। গায়ের রঙ টকটকে লাল। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। আর পঞ্চাশ বছর বয়সেও মাথা ভরতি চুল দেখে ঈর্ষা হত ওদের। অনেক বিখ্যাত পরিচালক মণ্টুদাকে ফিল্মে নামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেকথা শুনলেই হো হো করে হাসত মণ্টুদা, ‘বায়োস্কোপ? ও স্কোপ আর নাই বা নিলাম। এই বেশ আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি। কী বলিস?’
সেই মণ্টুদা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। পরনে পাঞ্জাবি আর সিল্কের লুঙ্গি। করোটির সাইজটা লম্বাটে। কি বীভৎস সাদা দেখাচ্ছে ওটা। এই সময় মণ্টুদা কথা বলল, ‘ভেবলে গিয়েছিলি মনে হচ্ছে। বসে পড়।’
‘মণ্টুদা।’ স্বপ্নেন্দু সন্তর্পণে চেয়ারটায় বসল।
‘তুই যদি নাম না বলতিস তাহলে চিনতাম না।’
‘কেন?’
‘আমি এখন কাউকে চিনতেই পারছি না। তুই ভাবতে পারিস, আমার বউ আর বড়মেয়েকে গুলিয়ে ফেলেছি দুবার। একবারে এক সাইজের প্রোডাকশন। বহুৎ ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে।’ মণ্টুদা সোজা হয়ে বলল।
‘তোমার কোনও রিঅ্যাকশন হয়নি?’
‘রিঅ্যাকশন! নিশ্চয়ই! এর চেয়ে আরাম আর কিছুতে কল্পনা করা যায়। চাকরি করতে হবে না এ জীবনে। বেশ পায়ের ওপর পা তুলে বই পড়ব। পৃথিবীর কত বই। তুই সিরিয়াসলি পড়লেও এক হাজারের এক ভাগও একটা জীবনে পড়ে শেষ করতে পারবি না। কিন্তু এখন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর। ডাল ভাতের ঝামেলা নেই। পৃথিবীর সব বই শেষ করব এখন।’
আরামদায়ক একটা শব্দ উচ্চারণ করল মণ্টুদা।
‘কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই।’
‘বয়ে গেল। এই কলকাতায় বই-এর অভাব?’
‘হঠাৎ বই নিয়ে পড়লে?’
‘কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে যে রে! নিজেকে খুব অশিক্ষিত মনে হয়। এবার শোধ তুলব। তোর বউদির ঘ্যানর ঘ্যানর করার দিন খতম।’
‘কেন?’
‘সংসারে কোন কাজ করো না। বাজার করো না রেশন করো না। এইসব টিকটিকানি আর শুনতে হবে না। তারও জ্বালা জুড়োলো আমিও বেঁচে গেলাম।’ মণ্টুদা বলল, ‘শুধু সিগারেটের অভাব ফিল করছি।’
‘সেকি? এত জিনিস থাকতে সিগারেটের?’
‘অভ্যেস ভাই অভ্যেস। সেই পনেরো বছর বয়সে শুরু করেছিলাম। যাক, তোর খবর কি বল। অনেকদিন বাদে এলি।’
‘মাইরি মণ্টুদা, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। যেন আগের অবস্থায় আছ। তোমার প্রতিক্রিয়া হয়নি।’
‘উপনিষদ পড়েছিস?’
‘না।’
‘ওই তো জ্ঞান হবে কোত্থেকে? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাও শিক্ষা হল না। তিনি বলেছেন সব কিছু স্বাভাবিক মনে মেনে নিতে তাহলে আর কোনও কষ্ট থাকবে না। আরে একটা বিপ্লব করতে কত পরিশ্রম, কত সংগ্রাম কত রক্তক্ষয়। অথচ দ্যাখ, আমাদের কিছুই লাগল না অথচ বিপ্লব হয়ে গেল, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।’
‘মুখ্যমন্ত্রীর এত বাধ্য হলে কবে থেকে?’
‘কারণ, বিরোধী নেতাদের বাণী এখনও কানে আসেনি। সমস্ত খবরের কাগজ এখন বন্ধ। আরে জীবনটাকে এবার চুটিয়ে উপভোগ কর। পড়বি, গান শুনবি গান গাইবি। আমরা তো এখন দেবতাদের মতন। রোগ যন্ত্রণার বালাই নেই।’
মণ্টুদার কথা শেষ হওয়া মাত্র একটি বালক দরজায় এসে দাঁড়াল। তার পরনের হাফপ্যাণ্ট দড়ি দিয়ে কোনরকমে কোমরে বাঁধা।
মণ্টুদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি সমাচার বৎস?’
‘বাবা আমি খেলতে যাব?’
‘আমার অনুমতি কিবা প্রয়োজন?’
‘মা নিষেধ করছে। বলছে মাঠের ঘাস ছাই হয়ে গেছে, ওখানে যেতে হবে না।’
‘চমৎকার। মাকে ডেকে দাও।’
ছেলেটি চলে গেল। মণ্টুদা বললেন, ‘খোকা কি লাকি বল তো। সারা জীবন খেলে কাটাবে। ওর শৈশব কোনদিন কাটবে না। আমরা বলতাম মানুষের শৈশব হল তার জীবনের গোল্ডেন ডেজ। ও চিরকাল সেই গোল্ডেন ডেজে থাকবে। এর চেয়ে সুখবর আর কি আছে।’
এই সময় কেউ দরজার বাইরে দাঁড়াল। তার শাড়ির একাংশ দেখা যাচ্ছিল। মণ্টুদা ডাকলেন, ‘হায় তুমি ওখানে কেন প্রিয়ে! ভেতরে এসো। এখানে স্বপ্নেন্দু বসে আছে। তোমার দেবর। ওকে দেখে এত লজ্জা কেন?’
বউদি যেন আরও সঙ্কুচিত হলেন। তার নিচু গলা শোনা গেল, ‘কি বলছ?’
‘কি আশ্চর্য! তোমার এ ঘরে ঢুকতে এত লজ্জা কেন?’
‘না, আমি যেতে পারব না।’
মাথা নাড়লো মণ্টুদা। তারপর বলল, ‘খোকাকে মাঠে পাঠাও। ও খেলুক।’
‘ওখানে শুধু ছাই।’
‘ছাই মাখুক। মহাদেব ছাই মাখতেন।’
‘যা ইচ্ছে করো।’
‘তোমার মনটা আগের মত আছে। আরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চল। তোমার কত কাজকর্ম কমে গেছে, তা দেখছ না!’
বউদি অন্যরকম গলায় বললেন, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।’
‘চেষ্টা করলেও পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর।’ কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠল মণ্টুদা। স্বপেন্দু বুঝল বউদি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছে দরজার আড়াল থেকে।
হঠাৎ মণ্টুদা বলল, ‘দাবা খেলবি?’
‘দাবা?’
‘চমৎকার সময় কাটানোর খেলা। তুই তো জানিস।’
‘এখন ভাল লাগছে না।’
‘ও।’ মণ্টুদা আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল, ‘তুই এখনও শক্ কাটিয়ে উঠতে পারিসনি। চেষ্টা কর। জলের মত হয়ে যা, যখন যেমন পাত্র তখন তেমন আকার।’
স্বপ্নেন্দু উঠল, ‘আজ চলি মণ্টুদা।’
‘চলে আসিস। মন খারাপ হলেই চলে আসিস, আমি ভাল করে দেব।’
স্বপ্নেন্দু হেসে ফেলল, ‘তুমি সত্যি নমস্য ব্যক্তি। সন্ধে হয়ে এসেছিল। রাস্তায় নেমে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একটা নগ্ন কঙ্কাল চেঁচাচ্ছে, বেরিয়ে আয় শালা, এক বাপের বাচ্চা হলে সামনে আয়।’ তার ডান হাতে একটা গোলমত বস্তু দেখা যাচ্ছে। সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস্ফালন করছে লোকটা। স্বপ্নেন্দু এগিয়ে যাচ্ছিল। পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘যাবেন না দাদা, ওর হাতে পেটো আছে।’
‘পেটো?’
‘পুরনো ঝগড়া। আজ বদলা নিতে এসেছে।’
স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। যাদের মণ্টুদার বাড়িতে যাওয়ার সময় এখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল তারা আশেপাশে আড়াল খুঁজে সেঁধিয়েছে। পুরনো অভ্যেসে এরা প্রাণভয়ে ভীত। কিন্তু যে লোকটা পেটো ছুঁড়তে এসেছে? স্বপ্নেন্দু লোকটার দিকে তাকাল। সমানে তড়পে যাচ্ছে লোকটা অকথ্য ভাষায়, এই যে এত বড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল কলকাতায়, মানুষ বিপর্যস্ত, তার কোন প্রতিক্রয়া কি ওর মধ্যে হয়নি? এখন পুরোনো আক্রোশ টিকে থাকতে পারে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না। এ বোধ হয় শুধু কলকাতাতেই সম্ভব হতে পারে।
স্বপ্নেন্দু এগিয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এখন কলকাতাবাসী অমর। তিনি মিথ্যে কথা বলবেন। তাই ওই লোকটা যতই শাসাক তার কিছু করতে পারবে না।
গলির ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে দেখে লোকটা চিৎকার থামিয়ে মুখ ঘোরাল। ওর হাত ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু চেঁচাল, ‘আমি স্বপ্নেন্দু, তুমি যাকে খুঁজছ সে নই। হাত নামাও।’
‘বুঝব কী করে? সব শালাকে যে একরকম দেখতে হয়ে গেছে।’
ততক্ষণ লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে। না, লোক নয়। হাড়ের গঠন এবং শারীরিক চাঞ্চল্য প্রমাণ করছে এ তরুণ। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘তুমি খামোখা মাথা গরম করছ। তার গলার স্বর কি আমার মত?’
একটু চিন্তা করল ছেলেটা, তারপর বলল, ‘এক মনে হচ্ছে না।’
‘তাহলে হাত নামাও। তুমি একটা বুদ্ধু, এখন পেটো ছুড়ে কাউকে মারলেও তার কিছু হবে না। রক্ত মাংস নেই তো পেটো কী করবে?’
‘সে আমি জানি।’
‘জানো মানে?’
গলার স্বর নামিয়ে আনল ছেলেটি, ‘ফালতু ভয় দেখাচ্ছি। দেখুন না, শালারা কেমন ছাগলের মত লুকিয়েছে। দেখে যে কি আরাম লাগছে, কি বলব!’
স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। ট্রাম রাস্তায় এসে সে হতভম্ব হয়ে গেল। না, কোনও গাড়ি ঘোড়ার চিহ্ন নেই। সন্ধে হয়ে গেছে। রাস্তায় আলোগুলো এদিকে জ্বলছে না। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। তাকে যেতে হবে অনেক দূর। আগে হলে কেয়ার করত না। কিন্তু এখন এতটা পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এমনিতে তার পায়ের হাড় কনকন করছে। সন্ধে হচ্ছে বলে লোকজন রাস্তা থেকে কমে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। একটু একটু করে হেঁটে সে ওয়েলিংটনের মোড়ে চলে এল। জায়গাটা শ্মশানের মত ফাঁকা। কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে এমন অসহায় সে আর কখনও হয়নি। এই সময় একটা শিস শুনতে পেল সে। কেউ যেন মনের আনন্দে শিস দিয়ে যাচ্ছে। ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি।’ চারপাশে চোখ বোলাতে সে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে ভিখিরিটাকে দেখতে পেল। দুটো ছেঁড়া চট গায়ে চাপিয়ে রাজার মত হেলান দিয়ে বসে বসে শিস্ দিচ্ছে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও বস্ত্র নেই। হঠাৎ তাকালে আনন্দমঠের মম্বন্তর গ্রামের ছবিটি মনে পড়ে যায়। চোখাচোখি হতে লোকটা খুকখুক করে হাসল, ‘এই যে বাবু, দুটো পয়সা হবে!’
স্বপ্নেন্দু অবাক হল। ভিখিরিটা এখনও পয়সা চাইছে! কিন্তু হাসল কেন? সে কোন কথা বলার আগেই ভিখিরিটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘লাথি মারি টাকার মুখে। আর আমাকে কারও কাছে পয়সা চাইতে হবে না। কি আনন্দ! আর শালা মানুষের গালাগালি শুনব না। মেরা জুতা হ্যায় জাপানি। এই যে দাদা, দুটো পয়সা হবে।’ নিজের গলাটাকেই বিকৃত করে শোনাল লোকটা।
ঠিক তখন একটা প্রাইভেট গাড়িকে আসতে দেখল স্বপ্নেন্দু। ফিয়াট। গাড়িটা যাচ্ছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। স্বপ্নেন্দু হাত তুলল। সেটা পর্যাপ্ত নয় ভেবে রাস্তায় মাঝখানে নেমে গিয়ে ইশারা করতে লাগল থামাবার জন্যে। ড্রাইভার যেন খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থামাল গাড়িটা। স্বপ্নেন্দু ছুটে গেল জানলায়, ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
‘শ্যামবাজার।’
‘আমিও যাব। কোনও কিছু পাচ্ছি না। যদি—’
‘উঠে বসুন।’
গাড়িতে উঠে স্বপ্নেন্দু বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘কোনও দরকার নেই। আগে আমি কাউকে লিফ্ট দিতাম না। এখন তো কোনও ভয় নেই। এই যে হৃৎপিণ্ড দেখছেন ওটা এমন একটা প্রটেকশনে আছে আণবিক বোমা মারলেও ভাঙবে না। ডু য়ু নো, এটা কী?’
‘না।’
‘আমাদের পাপ। সারাজীবন আমি যে পাপ করেছি এটা তাই দিয়ে তৈরি।’
হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু, ‘তাহলে একটি এক বছরে শিশুর বেলায় কী বলবেন?’
‘সে তার বাপ মায়ের কাছ থেকে রক্তের সূত্রে ওটা পেয়েছে।’
স্বপ্নেন্দু দেখল গাড়ির কাচে রেডক্রশ চিহ্ন রয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ডাক্তার?’
‘আই ওয়াজ। আমার একটা মরণাপন্ন পেশেণ্ট ছিল নার্সিংহোমে। আজ গিয়ে দেখি সে নাকি হেঁটে বাড়ি চলে গেছে। নার্সিংহোমের সবাই বেকার। সুতরাং আমিও। আমি এখন কী করব? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমাদের মৃত্যু নেই। শরীর নেই যখন তখন অসুখ বিসুখ করবে না কারও। আমি বেকার হয়ে গেলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে তাদের দেখবেন। বাট হোয়াট অ্যাবাউট আস? তাছাড়া কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন রোগী দেখে বেড়াচ্ছি, চেম্বারে পেশেণ্ট গিজ গিজ করছে। সবসময় টেনশন। সারা জীবনে তো কম আর্ন করিনি। সেগুলো নিয়ে আমি কি করব এখন?’ ডাক্তার স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকালেন, ‘আই ডোণ্ট ওয়াণ্ট টু লিভ। জানেন, আমার কাছে কিছু সায়েনায়েড ছিল। এক ফোঁটা জিভে লাগলে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। মুঠোয় করে মুখে ঢাললাম, হৃদপিণ্ডে মাখালাম। নো রেসপন্স। হাতুড়ি দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করলাম বুকের বাক্সটা। একটুও টসকাল না।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।
স্বপ্নেন্দু নিচু গলায় বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই পরিবর্তিত অবস্থাকে সহজ মনে মেনে নিতে। অ্যাকচুয়ালি, আপনি আপনার সঞ্চিত টাকা এখন মানুষের উপকারে খরচ করতে পারেন। খাওয়া পরা অথবা অসুখ বিসুখ ছাড়াও তো মানুষের অনেক প্রয়োজন আছে। যেগুলো এতকাল আমরা পারতাম না।’
বাধা দিলেন ডাক্তার, ‘আপনি কমুনিস্ট?’
‘না। মোটেই না।’
‘তাহলে রাবিশ কথাবার্তা বলবেন না। আমি সারাজীবন এত কষ্ট করে যা উপার্জন করেছি তা পাঁচজনের জন্যে বিলিয়ে দেব? তার চেয়ে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেললে বেশি আরাম লাগবে।’
স্বপ্নেন্দু কথা বলল না। গাড়ি ততক্ষণ কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গেছে। পথঘাট নির্জন। এবার ডাক্তারের গলায় হাহাকার শোনা গেল, ‘আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটাকে চিরকালের জন্য হারালাম।’
‘কী সেটা।’
ডাক্তারের করোটিটা দুললো, ‘ইঞ্জেকশন। যখন আমি কারও শরীরের কাছে সিরিঞ্জ নিয়ে যেতাম অদ্ভুত প্লেজার হত। দিনে অন্তত গোটা পাঁচেক ইঞ্জেকশন না দিলে আমার রাত্রে ঘুম আসত না।’
‘সেকি?’
‘আমি অ্যাদ্দিন কাউকে বলি নি। এখন অবশ্য বাধা নেই। কাউকে বলিনি ঠিক নয়, আমার এক মনস্তাত্ত্বিক বন্ধুকে বলেছিলাম। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কি ইমপোটেণ্ট? স্বীকার করিনি তখন। এখন কলকাতার মানুষ আর সেসবের কথা ভাববে না। তাই বলছি, হি ওয়াজ রাইট।’
স্বপ্নেন্দু নড়ে চড়ে বসল। লোকটা পাগল নাকি? দু মিনিটের আলাপে যে সব কথা বলছে তা কোনও সুস্থ মানুষ বলে? হয় পাগল, নয়— স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, এসোব পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফল। এখন মানুষের কিছুই হারাবার ভয়ডর নেই। অতএব নিজের গোপন তথ্য খুলে বললেও ক্ষতি নেই।
‘শ্যামবাজার কোথায়?’
স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার নাম বলল। ডাক্তার বললেন, ‘অয়েল ইণ্ডিকেটারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওটা শূন্যে আটকে আছে। অথচ গাড়িটা সুন্দর চলছে। জল নেই এক ফোঁটা তবু ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে না। আগে শুনলে পাগল বলতাম। তাই না?’
‘সেকি পেট্রোল নেই তবু গাড়ি চলছে।’
‘দেখছেন তো।’
‘হয়ত আপনার ইণ্ডিকেটারটা ঠিক কাজ করছে না।’
‘নো। ওটা ঠিক আছে।’
‘তাহলে?’
‘এটাও বোধহয় পরিবর্তিত পরিস্থিতির রেজাল্ট। আরে মশাই, গাড়িতে যে এক ফোঁটা জল নেই সেটা বিশ্বাস করেন তো। ওই দেখুন হেদোর কি অবস্থা!’
স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। এখন থেকে গাড়ির জন্য আর পেট্রোলের দরকার হবে না? কি আশ্চর্য! স্বপ্নেন্দুর মোড়ে এসে গাড়িটা থামালেন ডাক্তার। ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে যাচ্ছিল সে। ডাক্তার বললেন, ‘শুনুন মশাই, আপনার নাম জানি না। কোনদিন দেখা হবে কি না তারও ঠিক নেই। তবে আমাকে পাগল ভাবার কোনও কারণ নেই। যে যে কারণে আগে পাগল ভাবা হত, এখন সেইসব কারণগুলো বাতিল হয়ে গিয়েছে। বরং আপনার যদি কোনও পাপ টাপ থাকে তাহলে বলাবলি করতে শুরু করুন, দেখবেন বেশ হালকা লাগবে।’