সেই মধ্যরাতে কলকাতার বায়ুমণ্ডলে গুরুতর প্রতিক্রিয়া শুরু হল। কোনও হঠাৎ সরে আসা নক্ষত্রের আকর্ষণে পৃথিবীর এই বিশেষ শহরটি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সামান্য ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় কলকাতার মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নেন্দু লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে দেখল জানলা দিয়ে প্রচণ্ড তপ্ত বাতাস ঘরে ঢুকছে। এত তার তাপ যে গায়ে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। এবং সমস্ত শহর জুড়ে মানুষের চিৎকার শুরু হয়েছে। যারা ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল তারা আবার একটা আচ্ছাদন খুঁজছে। মানুষের আর্তনাদে শহরটা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। টলতে টলতে জানলা বন্ধ করে দিতে যেটুকু সময় তাতেই সমস্ত শরীর ঝলসে গেল স্বপ্নেন্দুর। চিৎকার করে উঠল সে। মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরেও উত্তাপ কমছিল না। স্বপ্নেন্দু হাত মুখ ঘষতেই অনুভব করল চামড়া উঠে আসছে। উন্মাদের মত সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিছানাটা গরম কিন্তু আশ্চর্য, পোড়ে নি।
জ্ঞান ফেরার পর স্বপ্নেন্দুর প্রথম খেয়াল হল সে বেঁচে আছে। আর আশ্চর্য, তার শরীরে সেই প্রচণ্ড জ্বলুনিটা নেই। প্রথমে মনে হল কাল রাত্রে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিল। যা শুনেছিল তা স্বপ্নে! হাতটা মুখে ঘষতে গিয়ে সে চমকে উঠল। স্পর্শ পাচ্ছে না। হাড়ে হাড়ে যেন সামান্য শব্দ হল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল স্বপ্নেন্দু। লাফাতে গিয়ে শরীরটাকে এতটা হালকা লাগলো যে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল। তারপর নিজেকে দেখে চিৎকার করে উঠল। রাত্রে পাজামা পরে শুয়েছিল স্বপ্নেন্দু। এখন উঠে দাঁড়াতেই সেটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্নেন্দুর গলা থেকে একটা জান্তব শব্দ বেরিয়ে এল। পাগলের মত সে ছুটে গেল বিশাল আয়নার সামনে। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পড়ে স্থির হয়ে গেল।
চেতনা ফিরতে স্বপ্নেন্দু আবার উঠে বসল। তার শরীরে কোথাও মাংস নেই, রক্ত নেই, চামড়া নেই। এমনকি শিরা উপশিরা পর্যন্ত নেই। শুধু শরীরের খাঁচাটা আস্ত রয়েছে। আর শুনছে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। ঘড়ির মত শব্দ করে চলছে সেটা। স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে দুঃস্বপ্নটা এখনও দেখে যাচ্ছে। একটু একটু করে উঠে দাঁড়িয়ে সে চলে এল আয়নার সামনে। মেডিক্যাল কলেজে এইরকম কঙ্কাল দেখেছে সে। আয়নায় একটা কঙ্কালের ছবি ফুটে উঠেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে কঙ্কালটা। আবার ঠিক কঙ্কালও না! কারণ বুকের খাঁচার মধ্যে ওটা কি। কালচে মতন একটা হৃদপিণ্ড দেখতে পেল সে। সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তার চোখ নেই। ডান হাতটাকে ধীরে ধীরে ওপরে তুলে হৃৎপিণ্ডটাকে ছুঁতে যেতে সেটা শব্দ করে উঠল। সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে বোঝা গেল কালচে হৃৎপিণ্ডটাকে একটা অদৃশ্য শক্ত বস্তু ঘিরে রয়েছে। নিরেট অথবা অদৃশ্য গোলকটির শরীরে আঘাত করল সে কিন্তু সে একটুও ব্যথা লাগল না। আয়নার খুব কাছে চলে এল স্বপ্নেন্দু। একটি পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির কঙ্কাল তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার কোথাও কোথাও কালচে চামড়া আটকে আছে। কিন্তু সামনে রক্তমাংসের চিহ্ন নেই।
চোখের গর্তে গর্ত আছে কিন্তু চোখ নেই। অথচ দেখতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছে। সোজাসুজি ছাড়া বাকিটা অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। ডাইনে বাঁয়ে দেখতে হলে মুখ ঘোরাতে হচ্ছে। নাক আছে কিন্তু কোনও ঘ্রাণশক্তি নেই। জোরে নিশ্বাস ফেলল সে। হৃৎপিণ্ডের আরাম হল কিন্তু কোনও গন্ধ পেল না।
মুখ হাঁ করল স্বপ্নেন্দু। জিভ নেই দাঁত আছে। অথচ দাঁতের গোড়ার মাংস না থাকায় সেগুলোকে নগ্ন বীভৎস দেখাচ্ছে। শরীরের নিম্ন অংশের দিকে তাকাল সে। তলপেট থেকে দুটো শক্ত মোটা হাড় দুপাশে ছড়িয়ে পা হয়ে নিচে নেমে গেছে। তার যৌন অঙ্গ ইত্যাদির চিহ্নমাত্র নেই।
স্বপ্নেন্দু এইসব ভাবতে ভাবতে কপালে হাত রাখল। তার মাথার মধ্যে কি চিন্তা করার নার্ভগুলো কাজ করছে? ব্রেইনবক্স কিংবা ক্ৰানিয়ামের ভেতরে কি মস্তিষ্ক অটুট আছে? নিশ্চয়ই আছে। তার ক্রানিয়াম মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখেছে নইলে সে এতসব ভাবতে পারছে কী করে।
স্বপ্নেন্দু থর থর করে কেঁপে উঠল। এই কি সে? এই কালচে শুকনো চামড়া মাঝে মাঝে সেঁটে থাকা কঙ্কাল? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে নিজের মাথাটা দেখতে চেষ্টা করছিল। হ্যাঁ তাইতো। মা মারা যাওয়ার পর মাথা ন্যাড়া করেছিল। তখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে মাথার আকৃতিটা যেমন দেখাত এখন অনেকটা সেইরকমই লাগছে। তবে আকারে ছোট হয়ে গেছে কিন্তু আদলটা পাল্টায়নি।
বন্ধ দরজার দিকে তাকাল স্বপ্নেন্দু। তার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগল। সে মরে যায় নি কিন্তু এইভাবে কঙ্কাল হয়ে বেঁচে থাকার কথা সে কবে শুনেছে। পাঁচজনের সামনে বের হলে কী প্রতিক্রিয়া হবে সবার? স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে কান্নাটা ছিটকে এল। সামান্য শব্দ হল। কিন্তু এক ফোঁটাও অশ্রু বের হল না। চোখের জল নেই অথচ আলোড়িত হৃৎপিণ্ড ঠিক কেঁদে যাচ্ছে। শব্দটার কথা খেয়াল হতে সে সচকিত হল। তার উদর নেই, পাকস্থলী নেই। তবু শব্দটা হল। শব্দটা যে মুখ থেকে বের হয়নি এ ব্যাপার সে স্থির নিশ্চিন্ত। তাহলে? বিছানায় এসে বসল স্বপ্নেন্দু তারপর খুব সন্তর্পণে কথা বলার চেষ্টা করল ‘স্বপ্নেন্দু?’
অবিকল নিজের গলাটা শুনতে পেল সে। শুনতে পেল কী করে? তার কি শ্রবণ ইন্দ্রিয় কাজ করছে? স্বরযন্ত্র যার নেই কথা বলে কি করে? বিশ্বাস হল না ঠিক, স্বপ্নেন্দু আবার একটু জোরে চিৎকার করে ডাকলো, ‘স্বপ্নেন্দু।’
আঃ। সত্যি। সে কথা বলতে পারছে। স্বপ্নেন্দু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল করল তার অক্ষিগোলক নেই তাই চোখের পাতা থাকার কথা নয়। তার মানে কখনও ঘুমুতে পারবে না সে। ঘুমুতে পারবে না, কিন্তু কথা বলতে পারবে। আচ্ছা, তার কথা কি সামান্য নাকি নাকি শোনাচ্ছে! ছেলেবেলায় গল্পের বইতে কঙ্কালদের যেরকম চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলতে দেখত সেইরকম? সে আর একবার শব্দ করল। খুব স্বাভাবিক শোনাচ্ছে না স্বর। প্রথমবার আনন্দে ঠাওর হয় নি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নাকি ভাব আছে। কিন্তু স্বরটা বের হচ্ছে কোত্থেকে? দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে গিয়ে স্বপ্নেন্দুর কাছে ধরা পড়ল। ওই প্রচণ্ড শক্ত অথচ অদৃশ্য গোলাকার বস্তুটি যা বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ডটাকে আড়াল করে রেখেছে, শব্দটা আসছে ওর ভেতর থেকে। সে কি শুনতে পাচ্ছে ওই গোলকটির কারণে? মাথাটাকে যতটা সম্ভব বুকের কাছাকাছি নামিয়ে সে কথা বলল। হ্যাঁ, এটাই সত্য। তার শরীরটাকে সচল রাখার সমস্ত জাদু ওই অদৃশ্য গোলকের মধ্যে রয়েছে। শরীর বলতে শুধু এই হাড়গুলো। অত্যন্ত যত্নে সে গোলকটির গায়ে হাত বোলাল। তারপর গুনগুন করে উঠল, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’ কি চমৎকার! তার স্বরে সুর আছে। একেই তো গান বলে। অথচ এতকাল সে একটা লাইনও সুরে গাইতে পারেনি।
সারাটা দিন স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিল স্বপ্নেন্দু। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে চিৎকার কান্না ভেসে আসছে! ব্যাপারটি কী জানার জন্যে তার কৌতূহল হলেও সে বিছানা ছাড়ল না। নিজের অতীতের শরীরটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার দাড়ি কামাতে খুব বিরক্ত লাগত একথা ঠিক কিন্তু কামানো হয়ে গেলে গালটা কি নরম লাগত! চিবুকের কাছটা কী আদুরে ছিল। শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি একটু একটু করে মনে পড়ায় স্বপ্নেন্দু আরও ভেঙে পড়ল। এত বছর ধরে সযত্নে লালিত শরীরটা আজ এক লহমায় উধাও, এখন শুধু একটা কঙ্কাল তার পরিচয়। কিছুক্ষণ কাটা ছাগলের মত ছটফট করল সে। তারপর নেতিয়ে রইল বিছানায়।
বিকেলে হয়েছে কখন? এক ফোঁটা ঘুম আসেনি চোখে। খিদের কোনও চিহ্ন নেই। স্বপ্নেন্দু ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে নিজেকে খুব হালকা বোধ করল। তারপর কাছে এসে সন্তর্পণে পাল্লাটা খুলতে নির্জন রাস্তাটা চোখে পড়ল। একটাও মানুষ নেই। গাড়িঘোড়া চলছে না। এবং বাতাসে একটা ঘোলাটে ভাব। তারপরেই নজরে এল। ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটার গায়ে বেশ ঝাঁকড়া বটগাছ ছিল। বিকেলবেলায় পাখিরা তাতে হাট বসাত। সেই বট গাছটাকে চেনা যাচ্ছে না। পাতা নেই, ছোট ডালগুলো অদৃশ্য হয়েছে। শুধু মোটা গুঁড়িটা পুড়ে কালচে হয়ে রয়েছে। স্বপ্নেন্দুর অস্বস্তি হচ্ছিল। পৃথিবীটা পাল্টে গেল নাকি? সব কিছু কেমন অচেনা দেখাচ্ছে। এই সময় সে শক্ত হল। একটা মানুষ আসছে। খুব দ্রুত হাঁটছে লোকটা। অনেকটা কমিক ফিল্মের মত। চ্যাপলিন এইরকম হাঁটতেন। লোকটা কে? কাছে আসতেই লোকটাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল স্বপ্নেন্দু। পরনে ফুলপ্যাণ্ট, ওভারকোট কিন্তু মাথাটা ন্যাড়া। চুল নেই, মাংস নেই। স্রেফ একটা কঙ্কালের মাথা। পায়ের দিকে নজর দিতে সে দেখল কিছুই নেই সেখানে। লোকটা মুহূর্তেই চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল।
জানলাটা বন্ধ করল স্বপ্নেন্দু। তার মানে, সে একা নয়। আরও কিছু মানুষের চেহারায় এই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কজন মানুষের? এই ঘরে বসে থাকলে কিছুই জানা যাবে না। চাকরটা থাকলে তাকে ডেকে দেখা যেত।
স্বপ্নেন্দু আর পারল না। পায়জামায় দুটো পা গলিয়ে দড়িটা বাঁধতে গিয়ে দেখল সেটা কোমরে থাকছে না। অনেক কায়দার পর মোটামুটি ভদ্রস্থ হল। গেঞ্জিটা এখন ঢলঢল করছে। তার ওপর পাঞ্জাবিটাকে মনে হচ্ছে হ্যাঙারে ঝোলানো হয়েছে। অভ্যাসে চুলে হাত বোলাতে গিয়ে হোঁচট খেল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল।
তুমি, স্বপ্নেন্দু, তোমার আসল চেহারা হল এই। অবিকল কাকতাড়ুয়া। এতকাল মাংস চামড়ার দৌলতে খুব ফুটুনি করেছ। আসল বস্তুটিকে চাপা দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছ। তোমার মুখের গড়নে কিঞ্চিত গরিলাদের ছায়া আছে। তোমার পূর্বপুরুষ যে বনমানুষ ছিল এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
জুতোগুলোর দিকে তাকল সে। ওগুলো এখন পায়ে সম্পূর্ণ বেমানান। ঢলঢল করবে, হাঁটা যাবে না। বরং হাওয়াইটা চেষ্টা করা যেতে পারে। পায়ে ঢুকিয়ে দেখা গেল সেটা বেশ বড় তবে হাঁটা যাচ্ছে। অভ্যেসবশে ঘড়ি পরতে গিয়ে জব্দ হল। স্টেনলেসের ব্যাণ্ডটা হাত গলে বেরিয়ে আসছে। ওটাকে ছোট করা দরকার। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু দম ফুরোয়নি ঘড়িটার। এটাকে নিয়ে আর কী হবে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে মনটা খুঁতখুঁত করছিল। ন্যাড়া মাথাটা ভীষণ কটকটে লাগছে। চট করে একটা চাদর বের করে একটা পাক বুকে জড়িয়ে মাথাটা ঢেকে নিল স্বপ্নেন্দু। তারপর সন্তর্পণে দরজা খুলল।
বাতাসটা এখনও গরম। তবে সহনীয় হয়ে এসেছে। কয়েক পা হাঁটতেই সে চমকে উঠল। ডানদিকের মোড়ে একটা চায়ের দোকান ছিল। দোকানটা অবিকল রয়েছে। কিন্তু সেখানে বসে আছে গোটা পাঁচেক কঙ্কাল। কঙ্কালগুলোর সাইজ বিভিন্ন রকমের। কেউ খুব মোটা কেউ রোগা, কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা। চায়ের দোকানের মালিক অবনীদাকে সে চিনত। ওদের মধ্যে অবনীদা কোনটে? অবনীদা বেঁটেখাটো গোল মাথার ভারি ভাল মানুষ ছিলেন। স্বপ্নেন্দু বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর একটি কঙ্কাল শনাক্ত করল। টেবিলের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। স্বপ্নেন্দু আরও লক্ষ্য করল পাঁচজনের মধ্যে দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন। প্রচণ্ড কুৎসিত দেখাচ্ছে তাদের। অবনীদার পরনে একটা ধুতি জড়ানো। ওপরে সেই শার্টটা। খাকি রঙের, দুদিকে পকেট।
এদের দেখে মন কিছুটা শান্ত হল। তার মানে সে একা নয়। এপাড়ার অনেকেরই এক অবস্থা। স্বপ্নেন্দু ধীরে এগিয়ে যেতে হঠাৎ একজনের নজর পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, আস্ত মানুষ।’
‘আস্ত মানুষ।’ বাকি চারজন এক সঙ্গে উচ্চারণ করল।
স্বপ্নেন্দু কাছাকাছি যেতেই অবনীদা টেবিল থেকে নেমে এদিকে তাকালেন। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, ‘অবনীদা।’
‘আরে এ আমাকে চেনে দেখছি।’
‘চিনব না কেন? আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘গলার স্বরটা চেনা চেনা লাগছে। কে ভাই আপনি?’
‘আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘স্বপ্ন?’ অবনীদা এবার চিনতে পারলেন, ‘ওঃ তুমি। কী হল বল তো, এ কী হল? আমরা কী করে বেঁচে আছি? এই অবস্থায় তো প্রেতেরা বেঁচে থাকে, আমরা কি সবাই প্রেত হয়ে গেলাম?’ অবনীদা আর্তনাদ করলেন।
‘সবাই?’ স্বপ্নেন্দুর মাথাটা সামান্য এগিয়ে গেল।
‘সবাই। এমন কি আমার তিন বছরের বাচ্চাটা পর্যন্ত। তার চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। অত হেলদি বাচ্চাটা একটা কঙ্কাল হয়ে ঘুরছে।’
‘পাড়াটা এত ফাঁকা লাগছে কেন? কেউ মারাটারা গেল নাকি?’
‘ফাঁকা? কাল সারারাত আজ সারাদিন তো লোকে পাগলের মত ছোটাছুটি কান্নাকাটি করেছে। এখন যে যার বাড়িতে ঢুকেছে কারণ যদি সন্ধে হতেই আবার কালকের সেই গরম লাভার মত কিছু কলকাতার ওপর বয়ে যায়। একবার তো মাংসমজ্জা শুষে নিয়ে গিয়েছে, এখন তো হাড়গুলো ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই।’
অন্য লোকগুলো কেউ কথা বলছিল না। এবার একজন বলল, ‘আজ সন্ধে সাতটায় রেডিও খুলবেন। মুখ্যমন্ত্রী রেডিও থেকে এই বিষয়ে ভাষণ দেবেন।’
‘মুখ্যমন্ত্রী? মুখ্যমন্ত্রী বেঁচে আছেন?’
‘বাঃ বেঁচে থাকবে না কেন? আমরা কেউ মারা যাই নি।’
‘কিন্তু কী করে জানতে পারলেন যে উনি ভাষণ দেবেন?’
‘তুমি কি এইমাত্র বের হলে?’ অবনীদা জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ।’
‘বিকেলে পুলিশের জিপ মাইকে করে বলে গেল।’
‘পুলিশ?’
‘হ্যাঁ। তারা ইউনিফর্ম পরে এসেছিল বটে কিন্তু শরীরের হাল আমাদের মতই। দেখি মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন।’
‘আপনার এখানে রেডিও আছে?’
‘হ্যাঁ চালালে এখন কোনও শব্দ হচ্ছে না। হয়ত স্টেশন খোলেনি। কিন্তু আগে ঢাকা দিল্লি গৌহাটি ধরতে পারতাম। এখন কিছুই আসছে না।’
‘ব্যাটারি ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ, সেটা দেখে নিয়েছি। তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো।’
ওরা জায়গা করে দিলে স্বপ্নেন্দু বেঞ্চিতে বসল। সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু চারধার অন্ধকারে ঢেকে যায়নি। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছিল। স্বপ্নেন্দু বুঝল কাল রাত থেকেই জ্বলছে। আজ সকালে নেভাতে হয়নি। সে আড়চোখে লোকগুলোর দিকে তাকাল। প্রত্যেকের বুকের খাঁচায় কালচে হৃৎপিণ্ড দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যমনস্ক হয়ে সেখানে হাত দিতে গিয়ে বাধা পেল। অর্থাৎ সেই অদৃশ্য গোলকে প্রত্যেকেরই হৃৎপিণ্ড আবদ্ধ। এক একজনের মাথার করোটিও এক একরকম। কোনওটা বেশি লম্বা, কোনটা সামনের দিকে ছুঁচল। মুখের হাড়ের গঠনে বনমানুষের স্পষ্ট ছাপ, অবনীদার মুখে বেশ গরিলা গরিলা ভাব আছে। তবে প্রত্যেকের করোটি বেশ মোটা।
স্বপ্নেন্দু দেখল চায়ের উনুনে আঁচ পড়েনি। জিনিসপত্র চারপাশে অবহেলায় ছড়ানো। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘অবনীদা, আপনার দোকানের ছেলেটা আসেনি?’
‘এসেছিল।’ মাথা নাড়াল, অবনীদা, ‘আর ওকে দিয়ে আমার কি হবে। ওই উনুন ধরিয়ে আর কী হবে। চা খাওয়ার মানুষ কোথায়? আমি একেবারে শেষ হয়ে গেলাম ভাই। ধনেপ্রাণে শেষ।’
এক ব্যক্তি বলল, ‘মানুষ কাজ করে পেটের জন্যে। সেই প্রয়োজন না থাকলে কী হবে কাজ করে। এ দায় থেকে বাঁচা গেল।’
‘যা বলেছেন। আজ সারাদিন কিছুই খাই নি। অথচ দেখুন, আমার একটুও খিদে পাচ্ছে না। অথচ আমার পেটে আলসার ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন নিয়ম করে খেতে। একদম যেন খালি পেটে না থাকি। তা পেটই যখন নেই।’
এই সময় তৃতীয়জন হেসে উঠল। সামান্য শব্দ হল। স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে লোকটাকে দেখল সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এই অবস্থায় কোনও মানুষ হাসতে পারে। আমাদের সব গিয়েছে কিন্তু প্রাণ এবং কঙ্কালটা আছে। তাই কিভাবে হাসি আসে? তারপরেই ওর খেয়াল হল, কালকের পর এই প্রথম সে হাসি শুনল। হাসির যদি অপব্যবহারও হয়ে থাকে তাহলেও হাসি ইজ হাসি। তবু লোকটার দিকে তাকিয়ে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। সে শান্ত স্বরে বলল, ‘আপনার একটা পোশাক পরা উচিত ছিল।’
‘উচিত ছিল?’ লোকটা আবার খুক খুক করে হাসল, ‘কেন উচিত ছিল?’
‘পোশাক পরা কেন উচিত ছিল তাই জিজ্ঞাসা করছেন?’
‘আগে করতাম না। এখন করছি। এখন আমার কোনও গোপন অঙ্গ নেই যে তাকে ঢেকে রাখব। এখন শীতকাল নয় যে হাড় কনকন করবে ঢেকে না রাখলে। গরমের সময় খোলাখুলি থাকলে আরাম হবে। হাওয়া এপাশ থেকে ওপাশ বইলে হাড় জুড়োবে। আপনি বললেই আমাকে শুনতে হবে?’ খুক খুকিয়ে হাসল লোকটা।
অবনীদা বলল, ‘অরবিন্দ, তুমি যা বললে তা খুব মিথ্যে নয়। তবে কিনা চোখেরও তো একটা ব্যাপার আছে। দেখতে বড় খারাপ লাগে।’
‘সে আলাদা কথা। উনি উচিত বলছেন। উচিত বলার কী? মুখ্যমন্ত্রী নাকি?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রী বললে শুনতেন?’
‘এই দ্যখো আমরা এখানে কী জন্যে বসে আছি? মুখ্যমন্ত্রী সাতটার সময় রেডিওতে কিছু বললেন বলেই তো। আমরা তো তাঁর কথা শুনব।’
স্বপ্নেন্দু আর কথা বাড়াল না। এক একটা লোক থাকে ঝগড়াটে টাইপের। যে কোনও ছুতো পেলে তাদের জিভ লকলকিয়ে ওঠে। এতবড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল তবু লোকটার স্বভাব পালটাল না।
স্বপ্নেন্দু আবার লোকগুলোর দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ ভৌতিক দৃশ্য। একদিন আগে হলে তবু লোকটায় এই রকম চেহারার সঙ্গে বসে আছে ভাবলে বুক শুকিয়ে যেত। এই সময় অবনীদা রেডিওটাকে খুলে দিলেন। সেই কু শব্দ শুরু হয়েছে। এখন চুপচাপ চারধার। গরম বাতাসটা থেমে গেছে। রেডিওর স্টেশন শুরু হওয়ার সিগন্যালটা বন্ধ হয়ে পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘আকাশবাণী কলকাতা। বিশেষ ঘোষণা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল থেকে আকাশবাণীর নিয়মিত অধিবেশন বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে আমরা দুঃখিত। এখন সমস্ত কলকাতাবাসীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ বক্তব্য রাখবেন।’ কয়েক সেকেণ্ড নীরবতার পর মুখ্যমন্ত্রীর পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘বন্ধুগণ। আমরা অভূতপূর্ব একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও এমন ঘটনার কথা এর আগে শোনা যায়নি। গতকাল রাত সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ দূর মহাকাশের একটি নক্ষত্র স্থানচ্যুত হয়। তারই আকর্ষণে পৃথিবীর একাংশে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আমাদের দুর্ভাগ্যের কিংবা সৌভাগ্যের বিষয় সেই একাংশটি হল কলকাতা শহর। হঠাৎ বাতাস উত্তপ্ত হয়। এবং পরমাণু বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া অথবা আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্ভূত লাভার মত একটি হাওয়া কলকাতার ওপর বয়ে যাওয়ায় মানুষের শরীর থেকে রক্ত মাংস ধমনী অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু মানুষ নয়, কলকাতার যত পশু-পাখি ছিল তাদেরও এই হাওয়া শিকার করে। মানুষ এবং সুগঠিত প্রাণীরাই শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকতে পেরেছেন। সেই সময় চালু থাকা কিছু ক্যামেরায় অদৃশ্য লাভার রঙ ছিল কালো।
‘মাত্র আধঘণ্টা ওই লাভাস্রোতের স্থায়িত্ব কিন্তু তার মধ্যেই আমাদের পরিচিত মানবীয় চেহারা লুপ্ত হয়। কলকাতার চৌহদ্দিতে যত গাছপালা, ফুলের বাগান এবং ঘাস ছিল সব ছাই হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমরা বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি আমাদের বিজ্ঞানীদের বলেছি তারা যেন অবিলম্বে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি তাদের এও বলেছি প্রাকৃতিক পরিবর্তনের হেতু আমাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। কোনও অবস্থায় আবার আগের চেহারায় আমার ফিরে যেতে পারি কি না।
‘বন্ধুগণ! আমি জানি এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া খুব কঠিন, এতদিন আমরা যে শরীর দেখে অভ্যস্ত হয়েছি তার ব্যতিক্রম অবশ্যই পীড়া দেবে। কিন্তু জনসাধারণকে অনুরোধ করছি এই যে পরিবর্তন ঘটে গেল তা আপাতত অনেকগুলো সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। প্রথমত, খাদ্যবস্তুর অভাব আমরা অনুভব করব না। পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং জীবিত থাকি কিছু কাজ করবার জন্যে। যা দেশের উপকারে লাগে এবং মনের শান্তি হয় কিন্তু এতদিন আমরা শরীর টিকিয়ে রাখতে অনেক বাজে সময় ব্যয় করতাম। খাদ্য উৎপাদন এবং অর্থ নষ্ট হত। এখন আমাদের আর এসোব নিয়ে ভাবতে হবে না। এ মুহূর্তে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং আধুনিক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু মজুত আছে। আমি কলকাতাবাসীর কাছে আন্তরিক আবেদন করছি তাঁরা যেন অবিলম্বে স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগ দেন। যে যা করছিলেন এতকাল আগামিকাল থেকেই সেই সব কাজ শুরু করেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে যারা কর্মচ্যুত হবেন সরকার তাদের সমস্ত দায়িত্ব নেবে। আমরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছি, আপনারা সাহায্য করুন। কাল থেকে যে যার কাজে যোগ দিন।
‘বন্ধুগণ, প্রথমেই আমি বলেছি কলকাতা দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যের অধিকারী। কেন সৌভাগ্য তা ব্যাখ্যা করা দরকার। এতকাল এই যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এবং সামাজিক পরিবেশে আমরা অনেক কাজ ইচ্ছে থাকলেও করতে পারিনি। আমরা একটা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনেক দূরে থাকতে বাধ্য করেছিল। গত রাত্রে আমরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি। এই শারীরিক পরিবর্তন আমাদের কী কী সুবিধে এনে দেবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়েও প্রধান কয়েকটি কথা জানাচ্ছি। এখন থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও শারীরিক পার্থক্য থাকবে না। কালার প্রবলেম বা গায়ের চামড়ার পার্থক্যপ্রসূত যে ব্যবধান তা দূর হবে। কলকাতার মানুষের চেহারা এক হয়ে যাওয়ায় কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাত হবে না। খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তাছাড়া অর্থনীতির নানান পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
‘বন্ধুগণ! কেউ কেউ আমার কাছে আর একটি বিষয়ে আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ায় আমাদের বংশধররা পৃথিবীতে আসবে না। এর ফলে কলকাতাবাসীরা একদিন লুপ্ত হবে। কিন্তু আমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন বিপ্লব আমাদের যা দিতে পারত না এই লাভাস্রোত তা আমাদের দিয়েছে। আমরা এখন অমৃতের সন্তান। মৃত্যুর কালো হাত আর আমাদের স্পর্শ করবে না। আমরা অমর। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আমরা বেঁচে থাকব। এই মহান সম্মানের অধিকারী হওয়া যে সত্যি সৌভাগ্যের সেকথা বলাই বাহুল্য। তবু আমি বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেছি তারা গবেষণা করুন। এমন একটা আবিষ্কার করুন, কলকাতাবাসীরা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হয়। আপনারা স্মরণ করুন, একদিন আগেও আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রচার চালিয়ে এসেছি। ওই লাল ত্রিকোণ চিহ্নের কোনও প্রয়োজন আর আমাদের নেই। অতএব আমরা আবার জনসাধারণকে অনুরোধ করছি অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনুন। নমস্কার।’
এরপরেই ঘোষকের স্বর শোনা গেল, ‘এতক্ষণ কলকাতাবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।’ গ্রামাফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসুর বাজানো হচ্ছে। স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। রেডিওতে তখন বাজানো হচ্ছে, ‘হে নূতন, দেখা দিক আর বার।’
অবনীদা করোটি ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘চললে?’
‘হ্যাঁ। একটু চারপাশ ঘুরে আসি।’
অবনীদা বলল, ‘কী করব বুঝতে পারছি না। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যে যার কাজে ফিরে যেতে। আমি যদি কাল থেকে উনুন ধরাই তাহলে চায়ের খদ্দের পাব? কে খাবে চা?’
অরবিন্দ নামক লোকটা বলল, ‘তুমি তো দেখছি সত্যি ভাল মানুষ। আরে তোমার উনুন ধরানোর কী দরকার? খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নেই। পায়ের ওপর পা তুলে দিনরাত গপ্পো করব। এই উনুনটা ভেঙে ফেল। এখানে আরও আড্ডা মারার জায়গা করো। তোমার তো খাটুনি বেঁচে গেল।’
‘দিনরাত গপ্পো করব? আমার তো সময় কাটবে না।’
স্বপ্নেন্দু বেরিয়ে এল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিক্রিয়া কি না কে জানে তবে এখন রাস্তায় নরকঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ কাঁদছে। কিন্তু বাকিরা খুব ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। এইসব কঙ্কালেরা পোশাক পরেছে এলোমেলোভাবে। বিছানার চাদর কোমরে জড়িয়ে নিয়েছে কেউ। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করল কোনও মহিলা কঙ্কাল নেই রাস্তায়। একটি শিশু কঙ্কালকে বুকের কাছে নিয়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া একটি কঙ্কাল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে। স্বপ্নেন্দুকে দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি রক্ত মাংসের মানুষ?’
স্বরে বোঝা গেল লোকটা বৃদ্ধ। উত্তর না দিয়ে স্বপ্নেন্দু মাথা থেকে চাদরের আড়ালটা সরিয়ে দিতে বৃদ্ধ মাথা নাড়াল, ‘ওঃ। একই অবস্থা। সব মানুষের একই হাল। এ যে নরক হয়ে গেল।’
‘নরক বলছেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শোনেননি?’
‘শুনেছি। কিন্তু তাতে কি মন মানে? দুদিন আগে আমার বউ মারা গেছে। কি সৌভাগ্যবতী ছিল সে। রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চিতায় চড়ে গেল।’ বুড়োর স্বরে কান্না মিশল।
‘কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন আমরাই একমাত্র সৌভাগ্যবান।’
‘সৌভাগ্য? কি জানি!’
‘আজকে আপনার শরীরের কী পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন?’
বৃদ্ধ এবার হাসলেন, ‘তা হয়েছে বইকি। প্রস্রাব করতে খুব কষ্ট হত। সেটা দূর হয়েছে। হাঁটতে গেলে পায়ের শিরায় টান ধরত, এখন হচ্ছে না।’
‘তাহলে বলুন, আপনি অনেক ভাল আছেন।’
‘আমার কথা ছেড়ে দাও! এই বাচ্চাটা। মোটে একবছর বয়স। এখনও ভাল করে হাঁটতে পারে না। এর কী হবে? এ কি কখনো বড় হবে?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘আমি জানি না।’
আর হাঁটতে তার ভাল লাগছিল না। শরীর যদিও হালকা তবু হয়ত অনভ্যাসে ক্লান্তি লাগছিল। স্বপ্নেন্দু বাড়িতে ফিরে এল। পায়ের তলাটা বেশ টনটন করছে। তার মানে এতকাল চামড়া এবং মাংস যে আড়াল রেখেছিল তা না থাকায় ব্যথা হয়েছে।
ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবিটা খুলতেই মন খারাপ হয়ে গেলে আবার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে। এই কাঠামোটা তার? অথচ এতকাল এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সজাগই ছিল না। স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল তার হাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে কালচে পোড়া চামড়া লেগে আছে। এগুলো পরিষ্কার করে ফেললে ভাল হয়। বাথরুমে ঢুকল সে। কল খুলতে অবাক হল সে। জল নেই। এক ফোঁটা জল বের হল না। এই বাড়ির ছাদে একটা ট্যাঙ্ক আছে। সারা দিনরাত জলের আজ পর্যন্ত কোনও অভাব হয় নি। তারপরেই মেরুদণ্ডের হাড় কেঁপে উঠল, কলকাতা শহরের সমস্ত জল গতকালের প্রতিক্রিয়ায় উধাও হয়ে যায় নি তো! জল ছাড়া কী চলছে? মুখ্যমন্ত্রী একবারও এ বিষয়ে কিছু বললেন না। জল হল জীবন, কলকাতায় যদি জল না থাকে। নিজেকে গালাগাল দিল সে। এখনও উল্টোপাল্টা ভেবে যাচ্ছে। কলকাতার মানুষের আর জলের প্রয়োজন নেই। এখন যে শরীর নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে জল তার কোনও কাজেই লাগবে না। তোয়ালে দিয়ে শরীরটাকে পরিষ্কার করল সে। ক্রমশ হাড়গুলোর চেহারা পাল্টে যেতে লাগল। বেশ তকতকে দেখাচ্ছিল সেগুলো। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের শরীরটাকে একটু পছন্দসই বলে মনে হল। আর তখনই সুজিতের কথা মনে পড়ল।
সুজিত গতকাল ফোন করে বলেছিল আজকে সন্ধ্যায় যেন সে যায়। এই চেহারা নিয়ে যাওয়া যায়? তাছাড়া সুজিত, সুজিতের কি অবস্থা? ও তো নামকরা চিত্রাভিনেতা। পাশের ঘরে টেলিফোন। খুব সন্তর্পণে ডায়াল করল স্বপ্নেন্দু। এটা এখন কাজ করছে কিনা কে জানে। কিন্তু ডায়াল টোন ছিল যখন, স্বপ্নেন্দু শুনল ওপাশে রিং হচ্ছে। তারপরেই সুজিতের নার্ভাস স্বর কানে এল, ‘হ্যালো।’
‘সুজিত? আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘ওঃ!’
‘তুমি কেমন আছ?’
‘আমি? আমি শেষ হয়ে গেছি। কমপ্লিট ব্রোক। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছি না। কি ভয়ঙ্কর! আমি এখন কী করব? ঘরের দেওয়াল জুড়ে আমার যে সুন্দর ছবি সেদিকে তাকালে বুক জ্বলে যাচ্ছে। কেউ আর আমার দিকে ফিল্ম অ্যাক্টর বলে তাকাবে? জানলা দিয়ে দেখলাম রাস্তার মানুষজন আমারই মত দেখতে। এমনকি আমার চাকরটার সঙ্গেও কোনও পার্থক্য নেই।’
‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বিপ্লবও এতটা আনত না।’
‘রেখে দাও বিপ্লব। এখন আর টালিগঞ্জে কাজ হবে ভেবেছ। আমি আজ সারাদিন আমাদের লাইনের সবাইকে কণ্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করেছি। তুমি জানো মিস মিত্র আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন!’
‘মিস মিত্র?’
‘ওঃ তুমি সিনেমা দ্যাখো না নাকি? বাংলার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নায়িকা। কিন্তু গলায় দড়ি দেওয়া সত্ত্বেও ওঁর মৃত্যু হয়নি। শুধু ঘাড়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা হেলে রয়েছে! এ কি হল স্বপ্নেন্দু?’
‘জানি না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মেনে নিতে।’
‘তোমাদের আর কী। এসোব এখন বলতে বাধা নেই। দেহপট সনে নট সকলই হারায়। উঃ, ভগবান, কি যে করি!’
‘তোমার ওখানে আজ আমার—’
‘সেসব ক্যানসেল্ড। ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার ফ্রিজে গাদাগাদা খাবার। কালকে তিনটে রয়্যাল স্যালুট এনেছিলাম। সবচেয়ে দামী হুইস্কি। সব চোখের সামনে অথচ আমি খেতে পারছি না।’ ওপাশে সজোরে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ পেল স্বপ্নেন্দু।
এই প্রথম তার হাসি পেল। মিস মিত্র আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেও পারেননি! মিস মিত্র সত্যিই সুন্দরী আর তখনই ওর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। আজ সারাদিন নিজেকে নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে হেনার কথা মনেই পড়ে নি। হেনা কেমন আছে? সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল স্বপ্নেন্দু। সেই লোভনীয় শরীর আর তার চলনের ভঙ্গিটা চোখের সামনে দেখতে পেল। না হতে পারে না। হয়ত হেনার ওদিকে অদৃশ্য লাভার স্রোত বয়ে যায়নি। হেনার তীক্ষ্ণ অথচ দিঘির মত ভারী বুক এবং নিতম্ব, চোখের কারুকাজ স্বপ্নেন্দুর মাথায় কিলবিল করতে লাগল আর তারপরেই একটা ভয় হৃৎপিণ্ডটাকে আঘাত করল। যদি হেনা সেন আক্রান্ত না হয়, যদি তার শরীর এখনও আগের মত মাদকতা জড়ানো থাকে তাহলে? স্বপ্নেন্দু ঝিম হয়ে বসে রইল। না, তা হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার ওপর দিয়ে সেই অদৃশ্য লাভা স্রোত বয়ে গিয়েছে। হেনা সেন কোনভাবেই বেঁচে যেতে পারে না। ঠিক হল না কথাটা, হেনা সেনের আগের শরীরটা অটুট থাকতে পারে না। যদি হেনা সেন আগের মত থাকে তাহলে সে কখনও তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। রক্তমাংসের ওই সুন্দরী কখনই একটি জীবন্ত কঙ্কালকে চোখে চেয়ে দেখতে পারবে না। ঘৃণা এবং ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবে। স্বপ্নেন্দু স্পষ্ট অনুভব করল তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হেনা সেনের জন্যে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করছিল সে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই এতটা কঠিন হবেন না। ওই অদৃশ্য লাভাস্রোত নিশ্চয়ই হেনার বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এখন এই রাত্রে কিছু জানবার উপায় নেই। ওর বাড়িতে টেলিফোন আছে কি না তা জানে না স্বপ্নেন্দু। কাছাকাছি হলে না হয় হেঁটে যাওয়া যেত।
ভীষণ কাহিল লাগছিল। আলোটা নেভাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। তার হৃৎপিণ্ড আবার কাঁপছে। শরীর স্থির। তারপর পায়ে পায়ে সে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। কাচের বাটিটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। উল্টো করে বসানো বাটিটার মধ্যে সেই লাল গোলাপটাকে এখন আরও জীবন্ত দেখাচ্ছে। আরও টাটকা। এমনকী ওর নিটোল নরম পাপড়ির গায়ে সেই জলের ফোঁটাও চকচক করছে। লোভীর মত ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল স্বপ্নেন্দু। কি উদ্ধত ভঙ্গি রক্ত গোলাপটার। হাত বাড়াল সে। কিন্তু তারপরেই কথাটা খেয়াল হল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার কোনও গাছ কিংবা বাগান যদি বেঁচে না থাকে, মাঠের ঘাসগুলো যদি শুকিয়ে ছাই হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এই লাল গোলাপটা এখনও অমন গর্বিত ভঙ্গিতে বেঁচে আছে কী করে? স্বপ্নেন্দুর মনে হল হয়ত সমস্ত কলকাতায় এই একটি মাত্র জীবিত ফুল। যদি ওটা কোনও ফুলদানি কিংবা টেবিলে খোলা থাকত তাহলে আজ সকালে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু কাচের পাত্রে নিচ্ছিদ্র আড়াল ফুলটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এবার প্রচণ্ড লোভীর মত মাথাটাকে কাচের বাটির গায়ে নিয়ে গেল সে। পাপড়ির শরীরের কোষগুলোকে যেন অনুভব করতে পারবে সে। এই কলকাতার কোথাও এই মুহূর্তে আর কোনও উদ্ভিদ নেই শুধু এই ফুলটি ছাড়া। কিন্তু কতদিন এ এই রকম থাকবে? আস্তে আস্তে তো শুকিয়ে মরে যাবেই। স্বপ্নেন্দুর মাথা নাড়ল। না, কাল রাত্রের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার পরও যখন এ বেঁচে আছে তখন নিশ্চয়ই অনেককাল অটুট থাকবে। ওই কাচের বাটিটাকে সরালে চলবে না। কোনও অবস্থায় ওই বাটিতে হাত দেবে না সে। তাহলে ফুলটা বেঁচে থাকবে। ওকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে। হবে। স্বপ্নেন্দু কাচের বাটিটার দিকে তাকাল। খুব জোর হাওয়া বইলে কি ওটা উল্টে যাবে? ঠিক ভরসা হয় না। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। তারপর আরও একটা কাচের বড় জার এনে সেটাকে উল্টে বাটিটাকে চাপা দিল সন্তর্পণে যাতে দুটোয় ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়ে যায়। তারপরে সে ফিরে এল বিছানায়। দুটো কাচের আড়ালে থাকলেও ফুলের লালরঙটা বোঝা যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দুর সেই রূপকথার গল্পটা মনে পড়ল। গভীর সমুদ্রের নিচে একটা ঝিনুকের বুকে কারও প্রাণ লুকোনো ছিল। মনে হল ওই দুই কাচের পাত্রের আড়ালে জীবন্ত ফুলটা তার প্রাণ কারণ ওটার দিকে তাকালেই হৃৎপিণ্ডটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে যায়। কোনও চিন্তা মাথায় আসে না, শুধু একটা ভাল লাগায় বিভোর হতে হয়।
কাল সারাটা রাত ঘুম আসেনি। চেষ্টা করেছে স্বপ্নেন্দু, বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে থেকেছে। তবু ঘুমুতে পারেনি। তার চোখের পাতা কিংবা অক্ষিগোলক নেই। শোওয়া অবস্থায় সবসময়ে ঘরের ছাদটায় দৃষ্টি আটকে থেকেছে। এই দৃষ্টি বন্ধ করার কোনও কায়দা তার জানা নেই। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে পরিবর্তিত অবস্থায় তাদের ঘুম আসবে না। ঘুম প্রয়োজন শরীরের। ঘুমন্ত অবস্থায় হৃৎপিণ্ড কাজ করে যায়। তাই শরীর যদি না থাকে তাহলে ঘুমের কী দরকার। অতএব খাবার জল ইত্যাদির মত ঘুমও তার জীবন থেকে চলে গেল।
মাঝরাত্রে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে সারাজীবন ঘুমাতে পারবে না এটা চিন্তা করতেই অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্ক স্বপ্নেন্দু পাশ ফিরে তাকাতেই সেই গোলাপের রঙটা দেখতে পেল। আর অমনি তার চিন্তা স্থির হয়ে মিলিয়ে গেল। সে লক্ষ্য করেছে বেশি উত্তেজিত হলে হৃৎপিণ্ড কাঁপে। ফুলটার দিকে তাকালে সেই কাঁপুনি থেমে যায়। সুন্দর শান্তিতে রাতটা কেটে গেল, ঘুম নেই, কিন্তু ফুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার একটুও কষ্ট হচ্ছিল না সকালে।