☼ অতুলচন্দ্র গুপ্ত ☼
শিক্ষা ও সভ্যতা
অন্নচিন্তা
এক
এক
আমাদের বৈশেষিকেরা বলেছেন অভাব একটী পদার্থ। এমন সূক্ষ্মদৃষ্টি না থাকলে কি আর তাঁদের চোখে পরমাণু ধরা পড়ে! আজ এই ঘোরতর অন্নাভাবের দিনে, অভাব যে একটা অতি কঠিন পদার্থ তাতে কে সন্দেহ করে? অথচ এই তত্ত্বটী প্রাচীন আচার্য্যেরা জেনেছিলেন যোগবলে। কেননা সেকালের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে যে অন্নাভাব ছিল না সে বিষয়ে একালের ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা একমত, আর বিলাতি সভ্যতাই যে দেশের সমস্ত রকম অভাবের মূল, অর্থাৎ ঐ সভ্যতার আমদানির পূর্ব্বে যে দেশে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না, এ তো আমাদের সকলেরই জানা কথা। সুতরাং কি ঘরে কি বাইরে, কোনও স্থানেই বৈশেষিক আচার্য্যেরা অভাবকে প্রত্যক্ষ করেন নাই। কাজেই সে সম্বন্ধে তাঁরা যে তত্ত্বটী প্রচার করেছেন সেটী পুরাণের ভবিষ্যৎরাজবংশাবলীর মত, আর সুশ্রুতের শারীর-স্থান-বিদ্যার মত সম্পূর্ণ ধ্যানলব্ধ সামগ্রী।
কুতার্কিক লোকে হয়তো এইখানে তর্ক তুল্বেন যে, বৈশেষিকেরা যে অভাবকে পদার্থ বলেছেন সে অভাবের অর্থ কেবল negation। আর পদার্থ মানে বস্তু নয়, বিলাতি দর্শনে যাকে বলে category তাই। এবং এই তত্ত্বটীর অর্থ মাত্র এই যে অভাব বা negation মনন-ব্যাপারের অর্থাৎ thought-এর একটা necessary ক্যাটিগরি। কিন্তু এই তর্ক আর কিছুই নয়, এ হ’ল হিন্দু-দর্শনের পবিত্র মন্দিরেও ম্লেচ্ছ সংস্পর্শ ঘটিয়ে তার জাত মারবার চেষ্টা। নিশ্চয় জানি, কোনও খাঁটি হিন্দু এ-সব তর্কে কাণ দেবেন না। সুতরাং এ তর্কের উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।
প্রাচীনকালে যে ভারতবর্ষে অন্নাভাব ছিল না তার একটী অতি নিঃসংশয় প্রমাণ আছে। মাধবাচার্য্য তাঁর সর্ব্বদর্শন-সংগ্রহে ছোট-বড় সমস্ত রকম দর্শনের বিবরণ দিয়েছেন। একটী পাণিনিদর্শনের বর্ণনা আছে, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে ব্যাকরণশাস্ত্রই পরম পুরুষার্থের সাধন; ঐ শাস্ত্রে পারদর্শী না হলে সংসার-সাগর পারের আশা দুরাশা এবং ঐ শাস্ত্রই মোক্ষমার্গের অতি সরল রাজপথ। এমন কি একটী রসেশ্বর-দর্শন আছে, যাতে যুক্তি এবং শ্রুতি উভয় প্রমাণেই প্রতিপাদিত হয়েছে যে রস বা পারদই পরব্রহ্ম। রসার্ণব, রসহৃদয় প্রভৃতি প্রামাণিক দার্শনিক গ্রন্থ থেকে যুক্তি-প্রমাণ উদ্ধৃত হয়েছে: এবং রসজ্ঞেরা শুনে খুশি হবেন, যে শ্রুতি-প্রমাণটী আহৃত হয়েছে সেটী তাঁদের সুপরিচিত ‘রসো বৈ সঃ রসো হ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি’ এই শ্রুতিবাক্য। এমন পুঁথিতেও অন্নদর্শন বলে কোনও দর্শনের বিবরণ দূরে থাক নাম পর্য্যন্ত নেই। এ থেকে কেবল এই অনুমানই সম্ভব যে, প্রাচীনকালে এদেশে অন্নাভাব না থাকায় অন্নচিন্তাও ছিল না, এবং বিষয়টা সম্বন্ধে একবারে চিন্তার অভাবেই এ বিষয়ে কোনও দর্শনের উদ্ভব হয়নি। কেননা ও-বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তা থাকলে যে তার একটা দর্শনও থাকত, তাতে বোধ হয় যে প্রমাণ দেখিয়েছি তারপর আর কোনও বুদ্ধিমান লোকে সন্দেহ করবেন না। এবং আমার এই যুক্তিটী যে সম্পূর্ণরূপে ‘বিজ্ঞানানুমোদিত ঐতিহাসিক প্রণালী সম্মত’ তাও নিশ্চয়ই সকলেই স্বীকার কর্বেন।
কিন্তু যখন বৈজ্ঞানিক-ঐতিহাসিকের উচ্চাসন একবার গ্রহণ করেছি তখন কোনও সত্যই গোপন কর্লে চল্বে না। অপ্রীতিকর হ’লেও সমস্ত কথাই প্রকাশ করে বলতে হবে! অপ্রাচীন দার্শনিক যুগে যে দেশে অন্নাভাব ও অন্নচিন্তা ছিল না এ বিষয়ে সর্ব্বদর্শন-সংগ্রহের প্রমাণ অকাট্য। কিন্তু ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখ্লে দেখা যাবে যে খুব প্রাচীন অর্থাৎ বৈদিক যুগে কিছু কিছু অন্নাভাব ছিল। কেননা শ্রুতিতে অন্ন সম্বন্ধে আলোচনা দেখা যায়। এর বিস্তৃত প্রমাণ দেওয়া অনাবশ্যক। একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ধরুন তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগু-বরুণের উপাখ্যান। বরুণের পুত্র ভৃগু যখন পিতার কাছে ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে উপদেশ জিজ্ঞাসা কর্লেন তখন বরুণ তাঁকে বলেন তপস্যার দ্বারাই ব্রহ্মকে জানা যায়, তুমি তপস্যা কর। তবে সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সম্বন্ধে একটা ‘ফর্মুলা’ বলে দিলেন, ‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’ ইত্যাদি। তপস্যা করে ভৃগু জান্লেন অন্নই ব্রহ্ম। অন্ন থেকেই সকলের জন্ম হয়, জন্মের পর অন্নের বলেই সকলে বেঁচে থাকে, অন্নের দিকেই সকলের গতি এবং শেষে অন্নেই সবাই লীন হয়, অতএব অন্নই ব্রহ্ম। ভৃগু এই জ্ঞানটুকু লাভ করে’ পিতার কাছে গেলে বরুণ তাঁকে আবার তপস্যা কর্তে বল্লেন। দ্বিতীয়বার তপস্যায় ভৃগুর বোধ হ’ল প্রাণই ব্রহ্ম। এইরকমে তৃতীয়বারে জান্লেন মনই ব্রহ্ম। চতুর্থবারে বুঝ্লেন বিজ্ঞানই ব্রহ্ম। অবশেষে শেষবার তপস্যায় এই জ্ঞানে পৌঁছিলেন যে আনন্দই ব্ৰহ্ম। এই হ’ল ভৃগু-বরুণের গল্প, যাকে বলে ‘ভার্গবী বারুণী বিদ্যা’। এই শ্রুতি সম্বন্ধে শঙ্কর ও অন্যান্য ভাষ্যকারেরা নানা তর্ক তুলেছেন, ‘পঞ্চকোষ বিবেক’ ও ঐরকম সব দুর্ব্বোধ্য জটিলতার অবতারণা করেছেন কিন্তু এর প্রকৃত অথচ সহজ ইঙ্গিতটি কেউ ধর্তে পারেননি। এই উপাখ্যানের প্রকৃত তাৎপর্য্য কি এই নয় যে গোড়ায় অন্ন থাকলে তবেই শেষ পর্য্যন্ত আনন্দ পাওয়া যায়! ইহাই যে শ্রুতির প্রকৃত মর্ম্ম ও শিক্ষা তাতে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই এবং একটু বিচার করে দেখলে বোধ হয় পাঠকেরও কোনও সন্দেহ থাকবে না। কেননা উপাখ্যানটী শেষ করে’ই শ্রুতি চারটী পরিচ্ছেদে কেবল অন্নেরই প্রশংসা করেছেন। এবং তার মধ্যে এমন সব শ্রুতি আছে যাতে যে-কোনও ‘ইকনমিস্টের’ প্রাণ আহ্লাদে নৃত্য করে উঠবে। প্রকৃত ব্যাপারটা এই যে উপাখ্যানটী পড়লেই বিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোতে ওর প্রকৃত অর্থটা স্পষ্ট ধরা পড়ে; এবং শঙ্কর প্রভৃতি প্রাচীন দার্শনিকেরা কেন যে ওর যথার্থ মর্ম্ম বুঝতে পারেননি তার কারণও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ব্বেই প্রমাণ করেছি যে ঐ সব দার্শনিকদের সময়ে কোনও অন্নাভাব ও অন্নচিন্তা ছিল না। এবং তাঁদের যে-কোনও historical sense বা ‘ঐতিহাসিক অনুভূতি’ ছিল না তা যাঁর ঐ sense বিন্দুমাত্র আছে তিনিই জানেন। সেইজন্য বৈদিক সময় যে তাঁহাদের সময়ের চেয়ে কিছুমাত্র অন্যরকম ছিল এটা তাঁরা কল্পনাই কর্তে পারতেন না। ফলে বর্ত্তমান কালে আমরা যে higher criticism বা ‘উচ্চতর অঙ্গের সমালোচনা’র বলে প্রাচীনকালের মনের কথাটা একেবারে ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারি, শঙ্কর প্রভৃতির সে সামর্থ্য ছিল না। অবশ্য ঐ সমালোচনা-প্রণালীর নামের higher বিশেষণটা যাঁরা ও প্রণালীটা প্রবর্ত্তন করেছেন তাঁরাই দিয়েছেন, কিন্তু সত্যের খাতিরে বিনয়কে উপেক্ষা করবার মত সৎ সাহস তাঁদের সকলেরই ছিল।
যাহোক পূর্ব্ববর্ত্তী আলোচনার ফলে এটা বেশ জানা গেল যে বৈদিক সময়ের পরে আর অন্নচিন্তায় আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা বড় মাথা ঘামাননি। তাঁরা ব্রহ্মসূত্র রচনা করেছেন এবং কামসূত্রেরও অনাদর করেননি, কিন্তু মাঝখান থেকে অন্নসূত্রটা একেবারে বাদ দিয়েছেন। এর ফলভোগ করছি আমরা, তাঁদের এ যুগের বংশধরেরা। আমাদের অন্নের অভাব অত্যন্ত বেশি, এবং কিসে ও-বস্তুটার কিছু সংস্থান হয় তার একটা মোটামুটী রকম মীমাংসারও বিশেষ প্রয়োজন; কিন্তু বহুযুগের বংশানুক্রমিক অনভ্যাসের ফলে ও-সম্বন্ধে চিন্তা বা আলোচনা কর্তে গেলেই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তখন আমরা কে যে কী বলি তার কিছু ঠিক থাকে না। সেইজন্য আমাদের বাংলাদেশে দেখা যায়, যিনি আইনের বিদ্যা ও বক্তৃতা বেচে টাকা জমিয়েছেন, তিনি সভায় দাঁড়িয়ে বাঙ্গালীর ছেলেকে ইস্কুল-কলেজে বৃথা সময় নষ্ট না করে’ চট্পট্ ব্যবসা-বাণিজ্যে লেগে যেতে খুব জোরালো বক্তৃতা দেন। অবশ্য সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলধনের জন্য তাঁর জমানো টাকার কোনও অংশ পাওয়া যাবে না, কেননা তাঁর যে বংশধর ওকালতি করবে কিন্তু উপার্জ্জন করবে না তার জন্য সেটা সঞ্চিত থাকা নিতান্ত দরকার। এবং বলা বাহুল্য, যে শিল্প-বাণিজ্যে না ঢুকে’ লেখাপড়া শিখে’ চাকুরি খুঁজে বেড়ায় বলে’ বাংলার যুবকেরা লেখায় ও বক্তৃতায় হিতৈষীদের গঞ্জনা শুন্ছে, সেই শিল্প ও বাণিজ্য দেশের কোথায় যে তাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে সেটা তাদের দেখানো কেউ প্রয়োজন মনে করি নে। ভাবটা এই যে না-ই বা থাক্ল বাঙ্গালীর ছেলের মূলধন, না-ই বা থাকল দেশে তাদের জন্য কোনও শিল্প-বাণিজ্য, তারা কেন প্রত্যেকেই বিনা মূলধনে আরম্ভ করে’ নিজের চেষ্টায় এক একটা শিল্পের বড় বড় কারখানা গড়ে’ তোলে না, বড় রকম ব্যবসার মালিক হ’য়ে বসে না। কেননা কোনও কোনও দেশে কোনও কোনও লোক যে কদাচিৎ ঐরকম ব্যাপার করেছে, তা ত পুঁথিতেই লেখা আছে। তারপর আমাদের এই অন্ন-সমস্যার সমাধানের জন্য ইস্কুল-কলেজ সব তুলে’ দিয়ে সে জায়গায় কৃষিপরীক্ষাশালা ও শিল্প-বিদ্যালয় খোলাই যে একমাত্র উপায় সে বিষয়ে কেউ যুক্তি-তর্ক দেখান; আর যাঁরা কাজের লোক তাঁরা যে হয় কোনও ছেলেকে, যা-হোক কিছু একটা শিখে’ আস্বার জন্য, যে একটা হোক বিদেশে যাওয়ার জাহাজ ভাড়া সাহায্যের জন্য চাঁদার খাতায় স্বাক্ষর করাতে আরম্ভ করেন। আর এ যুগের বাঙ্গালীর ছেলেও হয়েছে এক অদ্ভুত জীব। বর্ত্তমানে ধনে-জনে যে জাতি পৃথিবীর মাথায় বসে’ আছেন শোনা যায়, বুকের মধ্যে তাঁদের হৃৎপিণ্ডে পৌঁছিতে হ’লে তাঁদের গায়ের জামার অংশবিশেষের ভিতর দিয়েই তার সোজা, এবং মন্দ লোকে বলে একমাত্র পথ। বাঙ্গালীর ছেলের অবস্থাটা ঠিক উল্টো। নিজের পকেট সম্বন্ধেও খুব বেশি সজাগ ও উৎসাহান্বিত কর্তে হ’লে, এদের একেবারে বুকের মধ্যে ঘা না দিলে কোনঐ ফল পাওয়া যায় না। দেশী শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া যে দেশের ধনবৃদ্ধির ও ধনরক্ষার জন্য একটা ‘টারিফের’ প্রাচীর মাত্র, ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’ নামক বিজ্ঞানশাস্ত্রের যুক্তি-তর্ক এবং মহাজনের খাতার হিসাব-নিকাশেরই বিষয়, তা এরা কিছুতেই বুঝ্তে চায় না, এবং বুঝ্লেও তাতে কোনও ফল হয় না। এরা চায় গান আর কবিতা যার বিষয় হচ্ছে দেশের উত্তরের হিমালয়ের মাথার বরফের মুকুট, দক্ষিণের নীল সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ, এবং যখন সমস্ত পৃথিবী মূক ছিল তখন আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যে সামগানে সিন্ধু সরস্বতীর তীর ধ্বনিত করেছিলেন, সেই কাহিনী। অথচ এরা যে হাতেকলমে কাজে লাগ্তে পারে না বা কাজ উদ্ধার কর্তে পারে না, এমন নয়। এরা অর্দ্ধোদয়-যোগে দেশের দীনতমকেও নারায়ণের পূজায় সেবা করে এবং শৃঙ্খলার সঙ্গেই করে; বন্যার জলে চালের বস্তা পিঠে নিয়ে সাঁতার দেয়, এবং কোনও ‘ডিপার্টমেণ্টের’ বিনা চালনায় অনুষ্ঠানটী যেমন করে’ নির্ব্বাহ করে, তাতে কাজের চেয়ে কাজের শৃঙ্খলাই যাদের গর্ব্বের প্রধান বিষয়, সেই ‘ডিপার্টমেণ্টের’ কর্ত্তাদেরও কতক বিস্ময় কতক সন্দেহের উদ্রেক হয়; জাতির একটা দুর্নাম ঘোচাবার জন্য এরা তুর্কির গুলিতে টাইগ্রিসের তীরে প্রাণ দিতে রাজি হয়, এবং তার শিক্ষানবিশিতে পুব-পশ্চিমের কোনও জাতির চেয়ে কম পটুতা দেখায় না। কিন্তু এ ত অতি স্পষ্ট যে এ সকলই কেবল ভাবের খেলা, এর মধ্যে বস্তুতন্ত্রতা কিছুই নেই। প্রকৃত কাজের বেলায় এদের চরিত্রে কোনও গুণই দেখা যায় না। এরা কিছুতেই উপলব্ধি করে না যে খুব দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা ও একনিষ্ঠার সঙ্গে আরম্ভ করে’, সংসারযুদ্ধে জয়ী হ’য়ে দশের এক হওয়াই সবচেয়ে বড় কাজ, চরিত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সেইজন্য যদিও বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষার পুঁথিতে এদের সেই সব মহাপুরুষদের জীবনী পড়ান হয় যাঁরা খুব হীন অবস্থা থেকে পরিশ্রম, অধ্যবসায় প্রভৃতি বহু সদ্গুণের সদ্ব্যবহারে নিজেদের অবস্থা খুব বেশিরকম ভাল করেছিলেন; এবং ইংরেজি হাতের লেখা লিখ্তে আরম্ভ করে’ই সময় আর টাকা যে একই জিনিস ‘কপিবুক’ থেকেই এরা সে অদ্বৈতজ্ঞান লাভ করে, তবুও কিছু বড় হ’লেই এই পুস্তকস্থা-বিদ্যার ফল এদের স্বভাবে কিছু দেখা যায় না। তখন বাল্যশিক্ষার পুঁথির মহাজনদের অনুরূপ যে সব কৃতকর্ম্মা পুরুষ, সমাজে সশরীরেই বর্ত্তমান এরা তাঁদের কোনও খবরই রাখে না, এমনকী তাঁরা দেশের রাজার কাছে খুব উঁচু সম্মান পেলেও নয়। যারা কেবল কথার সঙ্গে কথা গাঁথ্তে পারে, বা লজ্জাবতীর পাতায় তামার তার জড়ায়, এরা তাদের নিয়েই অসঙ্গতরকম হইচই করে। অন্নচিন্তায় যে এরা কাতর নয়, কি অন্নচেষ্টা যে এদের উত্তেজিত করে না তা নয়। সে চিন্তায় এরা যথেষ্টই ক্লিষ্ট; সে চেষ্টায় এরা অনেক দুঃখ, অনেক অপমানই সহ্য করে । কিন্তু সে সব সত্ত্বেও ঐ চিন্তা আর ঐ চেষ্টাকেই পরমোৎসাহে সমস্ত মন দিয়ে বরণ করে’ নিতে কিছুতেই এদের মন সরে না। এদের ভাব কতকটা এইরকম যে রোগ যখন হয় তখন ডাক্তারও ডাক্তে হয়, ঔষধও গিল্তে হয় এবং হাঙ্গামও কিছু কম হয় না। এবং যে চিররোগী, সমস্ত জীবনই বাধ্য হ’য়ে তাকে এই হাঙ্গাম সইতে হয়। কিন্তু তাই বলে’ রোগের চিকিৎসাকেই সবচেয়ে বড় উৎসাহের ব্যাপার করে তোলা সম্ভবপর নয়।
আমরা বাঙ্গালা দেশের ছেলে বুড়ো অন্নচিন্তার ব্যাপারে সবাই যে এই সব আশ্চর্য্য ও অস্বাভাবিক কাণ্ড করি, পূর্ব্বেই বলেছি এতে আমাদের দোষ কিছু নেই। দোষ পূর্ব্বপুরুষদের যাঁরা ও-সম্বন্ধে সুচিন্তা ও মনের কোনও স্বাভাবিক ঝোঁক রক্ত-মাংসের সঙ্গে আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। এই দায়িত্বহীনতার সাহসেই এই প্রবন্ধও সুরু করেছি। কেননা জানি, বেফাঁস কথা যা কিছু বল্ব তাতে আমার নিজের দায়িত্ব কিছুই নেই। দায়ী সেই পিতৃপুরুষেরা যাঁরা পিণ্ডের আশা করেন কিন্তু পিণ্ডের অন্ন সম্বন্ধে একনিষ্ঠ হ’য়ে চিন্তা কর্বার মতন মনের বা মগজের অবস্থা নিজেদের না থাকায় আমাদেরও দিয়ে যেতে পারেননি।
দুই
দুই
দেশের প্রাচীন আচার্য্যেরা যখন অন্ন সম্বন্ধে চিন্তাই করেন নি, তখন সে চিন্তায় কিছু সাহায্য পেতে হ’লে পশ্চিমের আধুনিক যবনাচার্য্যদের কাছেই যেতে হয়। এঁদের মধ্যে একদল আছেন যাঁরা অন্ন-জিজ্ঞাসারই একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্র গড়ে’ তুলেছেন। কিন্তু অন্ন সম্বন্ধে যিনি সবচেয়ে ব্যাপক অথচ গভীরভাবে চিন্তা করেছেন তিনি এই অন্নশাস্ত্রের শাস্ত্রী নন, তিনি একজন প্রাণতত্ত্ববিদ্ আচার্য্য, নাম চার্লস্ ডার্উইন। ভৃগু-বরুণ প্রসঙ্গের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে অন্নতত্ত্বের এক ধাপ উপরে উঠ্লে পাই প্রাণতত্ত্ব। সুতরাং প্রাণতত্ত্বজ্ঞ ডার্উইন যে তাঁর উপরের ধাপ থেকে অন্নের লীলা ব্যাপকতর ও স্পষ্টতরভাবে প্রত্যক্ষ কর্বেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
ডার্উইন পূর্ব্বাচার্য্যদের কাছ থেকেই অন্নপ্রাণ-বিদ্যার এই বীজমন্ত্রটী পেয়েছিলেন যে পৃথিবীতে যত প্রাণী জন্মে তাদের সকলের প্রাণরক্ষার উপযোগী পর্য্যাপ্ত অন্ন বসুমতী জোগাতে পারেন না। কিন্তু এই প্রাচীন মন্ত্রই বহু বৎসর ধরে’ একান্ত নিষ্ঠা ও কঠোর সংযমেব সঙ্গে জপ কর্তে কর্তে পূর্ব্বে যা কারও ভাগ্যে ঘটেনি তাঁর সেই সিদ্ধি লাভ হ’ল। অন্ন তাঁর অদৃষ্টপূর্ব্ব বিশ্বরূপ ডার্উইনকে দেখালেন। তিনি দেখ্লেন স্থলে, জলে, আকাশে— অরণ্যের ছায়ায়, মরুভূমির প্রান্তে, গাছের শাখায়, পর্ব্বতের গহ্বরে, সমুদ্রের তলে, হ্রদের বুকে— অন্নের জন্য প্রাণের এক অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব চলেছে। অন্ন পরিমিত, তার আকাঙ্ক্ষী জীব সংখ্যাহীন। এই পরিমিত অন্নকে আয়ত্ত করার জন্য প্রাণীতে প্রাণীতে, উদ্ভিদে উদ্ভিদে, উদ্ভিদে প্রাণীতে যে দ্বন্দ্ব, তা যেমন বিরামহীন তেমনি মমতাহীন। এ দ্বন্দ্বে কেহ কারও সহায় নয়। এ হ’ল সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কখনও প্রকাশ হচ্ছে প্রকাশ্য যুদ্ধের রক্তোচ্ছাসে, কখনও নিঃশব্দে চলেছে নীরব রক্তশোষী প্রতিযোগিতার আকারে। কোন্টা বেশি ভয়ানক বলা কঠিন। অন্ন তাঁর মোহিনী মূর্ত্তিতে প্রাণকে আকর্ষণ করেছেন, আর আকৃষ্ট প্রাণীকে মহাকালের মূর্ত্তিতে সংহার কর্ছেন। শেষ পর্য্যন্তও যাদের উপর প্রসন্ন দৃষ্টি রাখ্ছেন সেই ভাগ্যবানদের সংখ্যা অতি সামান্য। মৃত্যুর মরুভূমির উপর দিয়ে অন্ন তাঁর সম্মোহন শঙ্খ বাজিয়ে চলেছেন। প্রতি মুহূর্ত্তে প্রাণের জোয়ারে দুকূল ছাপিয়ে উঠ্ছে, কিন্তু সে উচ্ছ্বাস দু’পাশের তপ্ত বালুতেই শুষে নিচ্ছে। প্রাণের একটা অতি ক্ষীণ ধারা কোনও রকমে শেষ পর্য্যন্ত অন্নের পিছনে পিছনে চলেছে।
অন্নের এই মোহিনীমহাকালের যুগলমূর্ত্তি দর্শন করে’ ডার্উইন কাল জয় করে’ অমর হয়েছেন। কিন্তু প্রাণের সঙ্গে অন্নের লীলার এখানেই শেষ নয়। প্রাণের ধারা চল্তে চল্তে একদিন মানুষে এসে ঠেক্ল। পৃথিবীতে প্রাণের ক্রমবিকাশ হ’তে হ’তে একদিন তা মানুষের মূর্ত্তি নিয়ে প্রকাশ হ’ল। কেমন করে’ হ’ল সে কথা পণ্ডিতদের তর্ক-কোলাহলে অপণ্ডিত সাধারণের কাণে আসা দুঃসাধ্য; তাতে আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এবার যে বিগ্রহে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হ’ল, সে বিগ্রহ অতি মনোরম, অতি বিস্ময়কর। তার সুঠাম, সরল, উন্নত দেহ, তার বন্ধনহীন মুক্ত বাহু, তার সতেজ ইন্দ্রিয়, তার সবল, অনাড়ষ্ট মাংসপেশী সবই যেন স্পষ্ট করে’ বলে’ দিল যে এ বিগ্রহ অরণ্যে পড়ে’ থাক্বার নয়, এর জন্য একদিন সোনার দেউল গড়া হবেই হবে। তবুও প্রাণের এই প্রকাশের সবচেয়ে আশ্চর্য্য ব্যাপার তার এই মূর্ত্তি নয়। তার চেয়েও লক্ষগুণে আশ্চর্য্য এক ব্যাপার সংঘটিত হ’ল। যে মন বোধ হয় পৃথিবীতে প্রাণের যাত্রারম্ভের সঙ্গেই তার সাথে ছিল, অতি ক্ষীণ অদৃশ্যপ্রায় অবস্থা থেকে নানা মূর্ত্তির মধ্য দিয়ে অতি ধীরে ধীরে ক্রমে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠ্ছিল, মানুষের মূর্ত্তিতে পৌঁছে সে একবারে দীপ্ত সূর্য্যের মতন জ্বলে উঠ্ল। তার উজ্জ্বল দীপ্তিতে মানুষ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখ্ল যে এ বিপুল ধরিত্রী তারই রাজত্ব।
অন্ন তাঁর নিজের শক্তি সেইদিন পূর্ণরূপে উপলব্ধি কর্লেন যেদিন এই মানুষও, রাজটীকা ললাটে নিয়ে, কাঙালের মত তাঁর পিছু পিছু পৃথিবীময় ছুটে বেড়াতে লাগ্ল। একটা ফলের জন্য দশটা গাছের তলায়, একটা শিকারের খোঁজে এক অরণ্য হ’তে আর এক অরণ্যে ঘুরে ঘুরে, পরে অন্নকে কিছু সুলভ করে’ একটু সুস্থির হওয়ার চেষ্টায় গোটাকয়েক প্রাণীকে যদি পোষ মানাল, তবে সেই প্রাণীরূপ অন্নের অন্ন খুঁজ্তে এক দেশ হ’তে আর এক দেশে চল্তে চল্তে তার পায়ে ব্যথা ধরে’ উঠ্ল। এই অজ্ঞাতবাসের দুঃসহ দৈন্যে মানুষের বহুযুগ কেটে গেল। শেষে এক দিন পরম শুভক্ষণে ক্লান্তদেহ, ক্ষুব্ধচিত্ত মানুষ বলে’ উঠ্ল আর অন্নের আশায় তার পিছু পিছু ঘুরে’ বেড়াব না,— অন্নকে সৃষ্টি কর্ব, স্বল্প অন্নকে বহু কর্ব। সেদিন নিশ্চয়ই স্বর্গের তোরণে মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠেছিল; দিব্যাঙ্গনারা মর্ত্ত্যচক্ষুর অদৃশ্য হেমঘটে অভিষেকবারি এনে মানুষের মাথায় ঢেলেছিলেন; ইন্দ্রদেব এসে সোণার রাজমুকুট তার মাথায় পরিয়েছিলেন; আর সমস্ত আকাশ ঘিরে দেবতারা প্রসন্ন নেত্রে দীর্ঘ বনবাসের পরে মানুষের নিজ রাজ্যে অভিষেক চেয়ে দেখেছিলেন।
কৃষি আরম্ভ হ’ল। প্রাণের ধাপ থেকে মনের ধাপে উঠে মানুষ দেখ্ল যে এখানে দাঁড়ালে অন্ন এসে আপনিই হাতে ধরা দেয়, তাকে পৃথিবীময় খুঁজে বেড়াতে হয় না। এখানে বসে তপস্যা কর্লে কালো মাটীর বুক চিরে সোণার ফসল বাইরে এসে পৃথিবী ঢেকে ফেলে; দিনের অন্ন দিন খুঁজে প্রাণান্ত হ’তে হয় না। মানুষ জান্ল, ‘পৃথিবী বা অন্নম্’, পৃথিবীই অন্ন। মাটির তলে জলের অফুরন্ত ধারার মত মাটির মধ্যে অন্নেরও অফুরন্ত ভাণ্ডার লুকানো আছে; লাঙলের ফালে তাকে তুলে আন্তে জান্লে অন্নের দৈন্য দূর হয়; যে মন্ত্র ডার্উইন জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার শক্তিকে ব্যর্থ করা যায়। মাটীর সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্বন্ধ স্থাপন হ’ল। মাটির টানে উদ্ভ্রান্ত বনচারী গৃহী হ’ল। সেইদিন মানুষের স্বদেশ, সমাজের প্রতিষ্ঠা হ’ল, মানুষের গ্রাম নগর গড়ে উঠ্ল, শিল্প বাণিজ্যের শুরু হ’ল। পৃথিবীর আদিম অরণ্য কেটে সভ্যতার সোণার মন্দিরে মানুষের প্রতিষ্ঠা হ’ল।
কিন্তু প্রাণের ভূমি থেকে আরম্ভ করে’ মানুষের এই যে যাত্রা, এখানেই তার শেষ হয় নাই। মন যখন সৃষ্টির ক্ষমতায় পরিমিত অন্নকে বহু করে’ অন্নের দাসত্বের লোহার বেড়ি মানুষের পা থেকে খুলে নিল, বিরামহীন অন্নচেষ্টা থেকে তাকে মুক্তি দিল, তখনই মানুষের স্বভাবের যেটী পরমাশ্চর্য্য অংশ, সেটির বিকাশ হ’ল। মানুষ দেখ্ল যে কেবল অন্নে তার তৃপ্তি নাই, তার পরিমাণ যতই অপর্যাপ্ত হোক, তার প্রকার যতই বিবিধ হ’ক। প্রাণের তাড়নায় অন্নের খোঁজে আকাশ, বাতাস, পৃথিবীকে জান্তে আরম্ভ করে’ মানুষ বুঝ্ল যে তার স্বভাবে একটা কি আছে যেটা কেবল জানার দিকে তাকে ঠেলে দেয়। অন্নের সৃষ্টি আরম্ভ করে’ সে জান্ল যে তার প্রকৃতির যেটা অন্তরতম অংশ, সেটা কেবল সৃষ্টির আনন্দেই সৃষ্টি করে’ যেতে চায়। মানুষ যেন প্রাণিরাজ্যের রাজা হ’লেও অপ্রাণ-লোকেরই অধিবাসী। সে যেন বিদেশী রাজপুত্র পরদেশে এসে রাজত্ব পেয়েছে, কিন্তু তার অন্তরাত্মার নাড়ির টান স্বদেশের দিকেই। প্রাণের জগতে মানুষের এই যে উদ্দেশ্যহীন জানা আর অনাবশ্যক সৃষ্টি তাই হ’ল তার বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম্ম, কাব্য, কলা, শিল্প। মানুষের প্রাণ বলে’ এদের মূল্য এক কানা কড়িও নয়; তার অন্তর জানে এরাই তার যথাসর্ব্বস্ব, অন্নের চেয়েও কাম্য, প্রাণের চেয়েও প্রিয়।
এই হ’ল মানুষের সভ্যতার অন্ন আর প্রাণের ভূমি থেকে মনের সিঁড়ি দিয়ে বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে যাত্রার ভ্রমণ-কাহিনী। এই লোকে পৌঁছিলেই অন্নের দাসত্ব থেকে মানুষের যথার্থ মুক্তি। মানুষ যদি কেবল অন্নকে আয়ত্ত করে’ই নিশ্চিন্ত থাক্তে পার্ত তা হলে অন্নদাস হ’লেও মানুষের জীবনে তার সর্ব্বব্যাপী প্রভুত্বের কোনও অপচয় হ’ত না। সোণার শিকলে অন্নকে বাঁধ্লেও শিকলের অন্য দিকটা মানুষের গলাতেই পরান থাক্ত, অন্নের টানে পৃথিবীময় না ঘুর্তে হ’লেও সারাক্ষণ অন্নকে টেনেই পৃথিবীতে চল্তে হ’ত। এই বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে পৌঁছিতে জান্লেই মানুষের গলা থেকে এই অন্নের শিকল খোলার উপায় হয়। আমাদের ঋষিরা সংসারচক্র থেকে জীবের মুক্তির কথা বলেছেন। এই হ’ল মানুষের সভ্যতার অন্নচক্র থেকে মুক্তির পথ।
তিন
তিন
যদি কারু মনে হয় যে মনের বলে মানুষের আয়ত্ত হ’য়ে, তাকে বিজ্ঞান আর আনন্দের পথে যাত্রী দেখে, মানবজীবনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে’, অন্ন চিরদিনের জন্য নিশ্চেষ্ট হ’য়ে গেছে, তবে তিনি অন্নের প্রভাব এবং মাহাত্ম্যের কথা কিছুই জানেন না। মানুষের সভ্যতার যে যে মুক্তির কথা বলেছি সে হ’ল শাস্ত্রে যাকে বলে জীবন্মুক্তি, অর্থাৎ দেহও আছে, মুক্তিও হয়েছে। সুতরাং মানুষের দেহ আর প্রাণ যখন আছে তখন তার অন্নের উপর একান্ত নির্ভর আছেই আছে। এই ছিদ্র ধরে’ অন্ন অতি নিপুণ সেনাপতির মত এক নূতন পথ দিয়ে তার বল চালনা করে’ মানুষকে বন্দী কর্বার চেষ্টা করেছে। প্রাচীন দ্বন্দ্বটা চলেছে, কেবল অবস্থার পরিবর্ত্তনে ‘স্ট্র্যাটেজি’র প্রভেদ ঘটেছে মাত্র।
যতদিন মানুষ কেবল প্রাণী ছিল, তার মনের পূর্ণ বিকাশ হয়নি, বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের বার্ত্তা তার অজ্ঞাত ছিল, ততদিন অন্নের দৃষ্টি ছিল মানুষের প্রাণের উপর। যেমন ইতর প্রাণীকে তেমনি মানুষকেও নিজের রথের চাকায় বেঁধে, অন্ন তার জীবন-মৃত্যুর উপর কর্ত্তৃত্ব কর্ত। এই যুদ্ধে অন্ন জয়ী হয়েছিল নিজেকে বিরল করে’, আপনাকে দুর্লভ করে’। মানুষের মন যখন অন্নকে বহু ও সুলভ করে’ এই উপায়টা ব্যর্থ কর্ল সেইদিন থেকে অন্নের দৃষ্টি পড়েছে মানুষের বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের দিকে। অন্ন জানে যে ওরাই তার প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী। মানুষের জীবনে যদি ওদের আবির্ভাব না হ’ত, তা হ’লে নামে প্রভু হ’লেও রোমের শেষ সম্রাটদের মত মানুষ দাস-অন্নের দাসত্বই কর্ত। কাজেই অন্নের এখন চেষ্টার বিষয় হ’য়েছে মানুষের সভ্যতার ঐ বিজ্ঞান আর আনন্দের লোকটা ধ্বংস করা। আর প্রাণকে আয়ত্ত করার প্রাচীন চেষ্টার ব্যর্থতার মধ্যেই অন্ন এই নূতন যুদ্ধের অস্ত্র খুঁজে পেয়েছে। দুর্লভ অন্নকে বহু করে’ মানুষ সভ্যতা গড়েছে। এই বহু অন্ন অসংখ্য মোহিনী মূর্ত্তিতে মানুষকে ঘিরে তার বিজ্ঞান আর আনন্দলোকের পথরোধের চেষ্টা কর্ছে। বিরলতার ক্ষয়রোগে মানুষের সভ্যতাকে ধ্বংস কর্তে না পেরে বাহুল্যের মেদরোগে তার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াটা বন্ধ কর্বার চেষ্টা দেখ্ছে। অন্ন এখন মহাকালের মূর্ত্তি ছেড়ে কুবেরের মূর্ত্তি ধরেছে। মানুষের কত সভ্যতা মহাকালের করাল দংষ্ট্রা হ’তে উদ্ধার পেয়ে স্থূলোদর ভোগপ্রসন্নমুখ কুবেরের মেদপুষ্ট বাহুর আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্বাসরুদ্ধ হ’য়ে মরেছে!
মানুষের সভ্যতার সঙ্গে অন্নের এই দ্বন্দ্ব নূতন নয়, এ দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। সভ্যতার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই এ দ্বন্দ্বেরও আরম্ভ হ’য়েছে এবং বোধ হয় শেষ পর্য্যন্তই চল্বে। কখনও সভ্যতা জয়ী হ’য়েছে, কখনও বা অন্নেরই জয় হ’য়েছে। মানুষে মানুষে শেষ যুদ্ধের বর্ত্তমান কল্পনার মত এ যুদ্ধের শেষ কল্পনাও হয়তো কেবল স্বপ্ন। হয়তো মানুষের সভ্যতাকে চিরদিনই এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে উঠে পড়ে’ চল্তে হবে।
এই চিরন্তন দ্বন্দ্বের মধ্যে মানুষের সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে, কেননা যুগে যুগে এমন সব জাতি উঠেছে যারা অন্নের মায়াকে অতিক্রম করে আনন্দের পথে চল্তে পেরেছে। ভুল হ’তে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস আধুনিক বাঙ্গালী সেই সব জাতির অন্যতম। সভ্যতার এই প্রাচীন যুদ্ধে নবীন সেনাপতি হবার যোগ্যতা এদের মধ্যে আছে। অন্নের মহাকাল-মূর্ত্তিতে ভয় পেয়ে যাঁরা এই জাতিকে কুবেরের কোলে তুলে’ দিয়ে নিশ্চিন্ত হ’তে চান, তাঁদের মাথায় বুদ্ধি থাক্তে পারে, কিন্তু চোখে দৃষ্টির অভাব। আনন্দলোকের সূর্য্যরশ্মি বিজয়মাল্যের মত এদের মাথায় এসে পড়েছে; হিতৈষীদের শত চেষ্টাতেও সে বরণকে উপেক্ষা করে’ কেবল অন্নকে বহু করার চেষ্টাতেই এ জাতি কখনও জীবন উৎসর্গ কর্তে পার্বে না।
“অন্নং ন নিন্দ্যাৎ”; অন্নেব নিন্দা করিনে। “অন্নং বহুকুর্বীত”; অন্নকে বহু করার যে কত প্রয়োজন তাও জানি। সেই ভিত্তির উপরেই মানুষের সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যা এই, কেমন করে’ অন্নকেও বহু করা যায় আবার তার বাহুল্যকেও বর্জন করা যায়। মহাকালের দর্শনেও ছিন্ন হ’তে না হয়, কুবেরের গদাও চূর্ণ না করে।
এস নূতন যুগের নবীন বাদরায়ণ! ‘অথাতোঽন্ন জিজ্ঞাসা’ বলে’ তোমার অন্নসূত্র আরম্ভ করে’ এই সংশয়ের সমাধান কর। কোন্ মধ্যযান পথের পথিক হ’লে মানুষের সভ্যতাকে আর আনন্দের ব্রহ্মলোক হ’তে ফিরে আস্তে না হয় তার নির্দ্ধারণ কর।
আশ্বিন, ১৩২৪