» » শিক্ষা ও সভ্যতা

বর্ণাকার

অতুলচন্দ্র গুপ্ত

শিক্ষা ও সভ্যতা

রোম

এক

জোর করে লেগে থাক্‌লে দেখ্‌ছি অসাধ্যও সাধন করা যায়। এভ্‌রিম্যানের অনুবাদে চার ভ্যলুম মম্‌সেনের রোমের ইতিহাস শেষ হ’য়ে গেল। অবশ্য এ পুঁথির শেষে পৌঁছে দেখি গোড়ার দিক্‌কার অনেক কথা, মনের মধ্যে ঝাপ্‌সা হ’য়ে এসেছে। কেল্টজাতির স্বাধীনতা রক্ষার নিষ্ফল চেষ্টার করুণ কাহিনী, স্যাম্‌নাইটদের রোমের নাগপাশ থেকে মুক্তির বৃথা প্রয়াসের ইতিহাসকে একরকম ঢেকে ফেলেছে। সিজারের জয়ধ্বনিতে, হ্যানিবালের স্তুতিগানও প্রায় ডুবে গেছে। সন তারিখের ত কথাই নাই। প্রথম থেকেই তার গোলযোগ শুরু হয়েছে, এবং শেষ পর্য্যন্ত সব একাকার হয়ে গোলযোগের সম্ভাবনারও লোপ ঘটেছে। মোট কথা, রোমের ইতিহাসে পরীক্ষা দিতে বস্‌লে যে, সে পরীক্ষাতে ফেল হব এটা নিশ্চয়। তবুও ল্যাটিন জাতির বিজয়যাত্রার এই অধ্যায়গুলি, মম্‌সেনের বর্ণনায় মনের মধ্যে যে দাগ কেটে গেছে, তা সহসা মুছে যাবে না। ভূ-মধ্যসাগরের চার পাশের যে ভূখণ্ডকে আধুনিক যুগের রোমের ঐতিহাসিকেরাও পৃথিবী বলেই উল্লেখ করেন, তার বহু রাজ্য ও বিচিত্র জাতিগুলির রোমের এক-রাট্ ও একছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, মনকে যে দোলা দিয়েছে, তার বেগ শেষ হ’তে কিছু সময় লাগ্‌বে।

পাঠকেরা শঙ্কিত হবেন না। মম্‌সেন থেকে দুটো অধ্যায় ইংরেজি অনুবাদের বাংলা তর্জমা করে’ দিয়ে লব্ধ-প্রতিষ্ঠ ঐতিহাসিকপদ লাভের কোনও চেষ্টাই কর্‌ব না। রোম সম্বন্ধে এখানে যা কিছু বল্‌তে যাচ্ছি তা নিতান্তই এলোমেলো রকমের। তাতে প্রত্নতত্ত্বের পাণ্ডিত্য এবং ইতিহাসের গাম্ভীর্য্য— এ দু’য়েব অত্যন্ত অভাব। সুতরাং যাঁরা প্রবন্ধের নাম দেখে পড়তে শুরু করেছেন তাঁরা হয়ত আর অগ্রসর না হ’লেই ভাল কর্‌বেন। আর যাঁরা নাম দেখেই পাতা উলটে যেতে চাচ্ছেন, তাঁরা একবার শেষ পর্য্যন্ত পড়্‌বার চেষ্টা কর্‌লেও কর্‌তে পারেন।

দুই

প্রাচীন হিন্দুজাতি এবং তাদের সভ্যতা আমাদের পশ্চিমের মাষ্টার ম’শায়দের কাছে অনেক রকম গঞ্জনা শুনেছে। তিরস্কারের একটা প্রধান বিষয় এই যে বংশপরিচয়ে তাঁরাও ছিলেন রোমানদেরই জ্ঞাতি। সুতরাং সেই একই রক্ত শরীরে থাকতে তাঁরা যে কেমন করে হিন্দুসভ্যতার মত এমন দুর্ব্বল ও বিকৃত সভ্যতা গড়ে’ বস্‌লেন, এটা পণ্ডিতদের মনে যেমন বিরাগেরও সঞ্চার করেছে তেমনি জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছে। এবং এই সংশয়ের সমাধানে তাঁরা নানারকম সম্ভব-অসম্ভব, অবশ্য সকলগুলিই ‘বৈজ্ঞানিক’, মতবাদের প্রচার করেছেন। গল্প আছে, ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় চার্লস্ রয়েল সোসাইটীর নতুন প্রতিষ্ঠা করে’ পণ্ডিতদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর্‌লেন যে, মাছ মর্‌লেই ঠিক সেই সময়টা তার ওজন বেড়ে যায় কেন? পণ্ডিতেরা উত্তর খুঁজে গলদঘর্ম্ম হ’য়ে গেলেন। অবশেষে একজন বললেন, আচ্ছা দেখাই যাক্ না ওজন করে’, মাছটা মর্‌লেই তা যথার্থ বেশি ভারী হ’য়ে ওঠে কি না। মম্‌সেনের বিপুলায়তন পুঁথি শেষ করে’ এই কথাটাই বারবার মনে হয়েছে, যে যাঁরা এই রোমান-সভ্যতার তুলনায় প্রাচীন হিন্দু-সভ্যতাকে অতি খাটো ও নিতান্ত হাল্কা বলেছেন, ‘সভ্যতা’ বলতে তাঁরা কী বোঝেন? সভ্যতার কোন্ মাপকাঠিতে তাঁরা এই দুই সভ্যতাকে মাপ করেছেন? কোন্ তৌলে এদের ওজনে তুলেছেন? এই যে রোমানসভ্যতা, যার গৌরবের দীপ্তিতে পণ্ডিতদের চোখ ঝল্‌সে গেছে, এ ত একটা একটানা পরের দেশ জয় ও অন্য জাতির উপর আধিপত্য স্থাপনের ইতিহাস। প্রথম ‘লেশিয়ামের’ উপর রোমের প্রভুত্ব বিস্তার, তারপর তারই সাহায্যে উত্তরের ইট্রাস্‌কানদের ধ্বংস করে ইতালির আর সকল জাতিগুলোকে পিষে ফেলে গোটা দেশটায় নিজের আধিপত্য স্থাপন। আবার মেডিটারেনিয়ানের ওপারের প্রবল রাজ্যটী, সিসিলির সেতু পার হ’য়ে এই আধিপত্যের কোনও বিঘ্ন ঘটায়, এই আশঙ্কাতেই কার্থেজের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বিজিত ইতালির সাহায্যে তাকে সমূলে উচ্ছেদ; এবং কার্থেজের অধিনায়ক ‘হ্যামিলকার বার্‌কা’ বা বিদ্যুতের বংশধর, স্পেন থেকেই যাত্রা সুরু করে’ বজ্র হ’য়ে রোমের মাথায় ভেঙে পড়েছিল বলে’, শত্রুর শেষ রাখ্‌তে নাই এই নীতি অনুসারে স্পেনেও রাজ্যবিস্তার। এম্‌নি করে দক্ষিণ আর পশ্চিমের ভাবনা যখন ঘুচ্‌ল তখন স্বভাবতই দৃষ্টি গেল পূবের দিকে। গায়ে জোর থাক্‌লে এ ‘আশঙ্কা’র ত আর শেষ নাই! পূবে তখন ছিল আলেক্‌জেণ্ডারের ভাঙা সাম্রাজ্যের গোটা কয়েক বিচ্ছিন্ন টুক্‌রা। ওরি মধ্যে যে দুটি একটু প্রবল — ম্যাসিডন আর এসিয়া, তারা তখন রোমেরই মত আশপাশের রাজ্যগুলিকে গ্রাস করে’ নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিল। এ ব্যাপারকে অবশ্য উপেক্ষা কি মার্জ্জনা কিছুই করা চলে না। কেননা পরের দেশ জয় করে’ রাজ্য ও বলবৃদ্ধি জিনিসটি মানুষের ইতিহাসের আদিযুগ থেকে আজ পর্য্যন্ত প্রত্যেক জাতিরই নিজের পক্ষে খুব সুসঙ্গত ও অত্যাবশ্যকীয় এবং অন্য সকলের বেলাই নিতান্ত বিসদৃশ ও অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে’ মনে হ’য়েছে। সুতরাং বাধ্য হ’য়েই রোমকে এ দুটি রাজ্য আক্রমণ কর্‌তে হ’ল; এবং এদের বাহুল্য অংশগুলি ছেঁটে ফেলে যাতে এরা অতঃপর বেশি নড়াচাড়া না করে’ ভদ্রভাবে জীবন যাপন কর্‌তে পারে, তার ব্যবস্থা কর্‌তে হ’ল। এমন কি সঙ্গে সঙ্গে রোম একটা মহানুভবতার পরিচয় দিতেও কসুর কর্‌লে না। ইতালীতে তখন হেলেনিক সভ্যতার স্রোত বইতে আরম্ভ ক’রেছে। তারি গুরুদক্ষিণা হিসাবে গ্রীসের ছোট ছোট নখদন্তহীন নাগরিক রাজ্যগুলিকে ম্যাসিডনের প্রভুত্ব থেকে মুক্ত করে’ রোম তাদের একবারে স্বাধীনতা দিয়ে দিল। কিন্তু দুঃখের কথা মহানুভবতার এ খেলাও রোম বেশিদিন খেল্‌তে পার্‌ল না। কারণ দানে পাওয়া স্বাধীনতার মানেই হ’ল— স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগটা কর্‌তে হবে দাতারই ইচ্ছা অনুসারে। সুতরাং গ্রিসের চপল প্রকৃতির লোকগুলি যখন নিয়মের ব্যতিক্রম করে’, ম্যাসিডনের আবার মাথা তুল্‌বার চেষ্টা দেখে, তাকেই নায়ক ভেবে কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্যের লক্ষণ প্রকাশ কর্‌ল, তখন এই পূবের দেশগুলির আধা স্বাধীনতা আধা অধীনতার বিশ্রী অবস্থাটা ঘুচিয়ে সোজাসুজি এদের করায়ত্ত করে’ নেওয়া ছাড়া রোমের আর গত্যন্তর থাক্‌ল না। এর পর রোমান চোখের দিক্‌চক্রবালে যে দুটি রাজ্য বাকি থাক্‌ল, সিরিয়া আর মিশর, তাদের নিয়ে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হ’ল না। অবস্থা দেখে তারা আপনারাই এসে রোমের পায়ে মাথা ঠেকালে। সাম্রাজ্য যখন গড়ে’ উঠ্‌ল তখন কাজে কাজেই তার ‘বৈজ্ঞানিক চৌহদ্দি’রও খোঁজ পড়্‌ল। কৃষ্ণসাগরতীরের মিথ্‌রেডেটিস-এর রোমের শিকল ভেঙে হাত পা ছড়াবার দুরাকাঙ্ক্ষা দমন উপলক্ষে, রাজ্যের পূব-সীমা ইউফ্রেটিসে গিয়ে ঠেক্‌ল এবং স্বয়ং জুলিয়স কেল্টদের মৃতদেহের উপর দিয়ে রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা আটলাণ্টিক পর্য্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্রাটেরও আবির্ভাব হ’তে খুব বেশি বিলম্ব ঘটল না। কেননা তিন শ’ বছর রাজ্যজয়ে আর রাজ্যভোগে প্রাচীন রোমান বল-বীর্য্য-ঐক্য সকলেরই তখন লোপ হ’য়েছে। প্রকৃতির পরিশোধ! আর পররাজ্যজয়ে যে সাম্রাজ্য ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধজয়ী সেনাপতি তার নায়কত্ব না পেলেই বরং বিস্ময়ের কারণ হ’ত। সিজারের উত্তরাধিকারীরা আরও তিন শ’ বছর ধরে’ এই রোম-সাম্রাজ্য, যাকে কোন রকমেই আর রোমান সাম্রাজ্য বলা চলে না, শাসন ও রক্ষা কর্‌লেন। রাজ্যের সকল জাতির লোকের মধ্যে রোম-নাগরিকের অধিকার ছড়িয়ে দেওয়া হ’ল, কেননা তখন সকলেই রোম সম্রাটের সমান প্রজা, ‘ফেলো সিটিজেনে’র অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘ফেলো সাব্‌জেক্ট’। উঁচু আশা ও বড় আকাঙ্ক্ষার তাড়না না থাক্‌লে যে শান্তি আপনিই আসে, রাজ্যজুড়ে সে শান্তি বিরাজ কর্‌তে লাগ্‌ল। ঘরকন্নার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী পাকা আইন-কানুন এই বহুজাতি ভূয়িষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে গড়ে’ উঠ্‌ল। তারপর মানুষের গড়া অপর সকল রাজ্যের মত রোম সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়্‌ল। ইউরোপের সভ্যতার কেন্দ্র ভূমধ্যসাগর ছেড়ে আটলান্টিক মহাসাগরকে আশ্রয় কর্‌ল। তারি তীরে তীরে নবীন সব জাতির মধ্যে মানুষের সভ্যতার চির-পুরাতন ও চির-নূতন খেলার আরম্ভ হ’ল।

তিন

এই যে ছয় সাত শ’ বছরের রাজ্যজয় ও রাজ্যশাসনের পলিটিক্যাল্ ইতিহাস, রোমান সভ্যতা ও গৌরবের কাহিনীরও এই হ’ল অন্তত চোদ্দ আনা। একে বাদ দিলে রোমান সভ্যতার যা অবশিষ্ট থাকে তার গৌরবের কাছে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার কথা দূরে থাক, তার চেয়ে অনেক ছোট সভ্যতারও মাথা নিচু করার কোনও কারণ দেখা যায় না। হেলেনিক সভ্যতার দৃষ্টান্তটি চোখের সাম্‌নে থাক্‌তে নিজেদের সভ্যতার এই স্বরূপ সম্বন্ধে রোমানদের মনেও সংশয়ের কোনও অবসর ছিল না। আগষ্টাসের সভাকবি তাঁর যুগের আত্মবিস্মৃত রোমানদের প্রকৃত রোমান-গৌরব স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বল্‌ছেন,— ‘জানি আর আর সব জাতি আছে যারা কঠিন ধাতুকে সুষমাময় গড়ন দিতে পারে, পাথরের হিম দেহ থেকে প্রাণের বিপুল উচ্ছ্বাস খুঁড়ে’ বের কর্‌তে পারে, জ্ঞানের আঙুল আকাশে তুলে নক্ষত্রলোকেরও সকল বার্ত্তা এঁকে দেখাতে পারে, কথার সঙ্গে কথা গেঁথে লোকের করতালি নিতেও তারা পটু, কিন্তু রোমান, এসব কাজ তোমার নয়। তোমার কাজ হ’ল— সকল জাতির উপর রাজত্ব করা। সেই হ’ল তোমার শিল্পকলা। তোমার গৌরব হ’ল বিজিত রাজ্যে শান্তি আনা, উঁচুমাথাকে যুদ্ধে নিচু করা, পতিত যে শত্রু তাকে করুণা দেখান।’ ‘এনিড’ যে ইতিহাস নয়, কাব্য, পতিত শত্রুকে করুণা দেখানোর কথা বলে’ ভার্জিল বোধ হয় তারি ইঙ্গিত করেছেন। কেননা রোমের ইতিহাসের প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত এ বস্তুটী কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যা হোক, লাতিন কবির রোমান সভ্যতা ও গৌরবের এই বর্ণনাটী আধুনিক কালের রোমানতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরাও একরকম সকলেই মেনে নিয়েছেন। কারণ না মেনে উপায় নাই। এবং এরি মধ্যে মানুষের সভ্যতা, প্রকৃতি ও শক্তির বিরাট বিকাশ দেখে’ তাঁরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হ’য়ে উঠেছেন। মানি, বহু জাতিকে যুদ্ধে পরাজয় কর্‌তে হ’লে জাতির মধ্যে যে বীর্য্য, যে ঐক্য, যে রাজনৈতিক বুদ্ধি ও বন্ধনের প্রয়োজন, তার মূল্য কিছু কম নয়। কিন্তু এই বস্তুকে সভ্যতার একটা শ্রেষ্ঠ বিকাশ বল্‌লে মানুষের প্রকৃতিকেই অপমান করা হয়। আর জাতির এই বীর্য্য, ঐক্য ও বুদ্ধি যখন পরের দেশ জয় ও পরের উপর আধিপত্যেই নিঃশেষে ব্যয় হয়, তখন তার শক্তি দেখে অবশ্য স্তম্ভিত হ’তে হয়, যেমন কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্ত্তিতে মানুষ স্তম্ভিত হয়। প্রকৃতপক্ষে একটা সমগ্র জাতি, নবীন শক্তি সঞ্চারের আকস্মিক উন্মাদনায় নয়, কিন্তু যেমন মম্‌সেন দেখিয়েছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দীর সূক্ষ্ম লাভ লোকসানের হিসাব গণনা করে’ চোখের সুমুখে যখনি যাকে প্ৰবল বা বর্ধিষ্ণু দেখেছে তারি বুকের উপর পড়ে’ তার জীবনের বল নিঃশেষে শুষে’ নিয়ে নিজেকে পুষ্ট করেছে, রোমান ইতিহাসের এই ব্যাপারটি তার ভীষণতায় মানুষকে স্তম্ভিত না ক’রেই পারে না; খৃষ্টান ও পার্শি পুরাণে যে অন্ধকার ও অমঙ্গলের দেবতার কল্পনা আছে সেটা ভিত্তিহীন নয় বলেই মানুষের বিশ্বাস জন্মায়।

আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, রোমের এই প্রবল পলিটিক্যাল্ সভ্যতা, কেবল সমসাময়িকদেরই মাথা ভয়ে হেঁট করিয়ে রাখেনি, কিন্তু উত্তরকালের ঐতিহাসিকদেরও শ্রদ্ধায় নতমুণ্ড করে’ রেখেছে। প্রাণতত্ত্ববিদেরা হয় ত বল্‌বেন মানুষ পশুরই বংশধর; শক্তির বিকাশ দেখ্‌লেই পূজা না করে’ থাক্‌তে পারে না। মম্‌সেন বলেছেন, এথেন্স যে রোমের মত রাষ্ট্র গড়্‌তে পারেনি, সে জন্য তার দোষ ধরা মূর্খতা। কেননা গ্রিক প্রকৃতির যা কিছু শ্রেষ্ঠত্ব ও যা কিছু বিশেষত্ব, তা ছিল তেমন একটা রাষ্ট্র গড়ে’ তোলার প্রতিকূল। অনিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রকে বরণ না করে’, গ্রীসের পক্ষে জাতীয় একতা থেকে রাষ্ট্রীয় ঐক্যে পৌঁছান সম্ভব ছিল না। সেই জন্য গ্রীসে জাতীয় একত্বের যখনই বিকাশ ঘটেছে সেটা কোনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তির উপর ভর করে’ নয়। অলিম্পিয়ার ক্রীড়াঙ্গন, হোমারের কবিতা, উরিপিডিসের নাটক, এইসবই ছিল হেলাসের ঐক্য-বন্ধন। ঠিক আবার তেমনি ফিডিয়াস্ কি আরিস্টফেনিসের জন্ম দেয়নি বলে’ রোমকে অবহেলা করা অন্ধতা। কেননা রোম স্বাধীনতার জন্য স্বাতন্ত্র্যকে, রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তির ইচ্ছা ও শক্তিকে নির্ম্মমভাবে দমন ক’রেছে। ফলে হয়ত ব্যক্তিগত বিকাশের পথ রুদ্ধ হ’য়েছে, প্রতিভার ফুলও মুকুলেই ঝরে’ পড়েছে; কিন্তু তার বদলে রোম পেয়েছে স্বদেশের উপর এমন মমত্ববোধ ও ‘পেট্রিয়টিজ্‌ম্’, গ্রীসের জীবনে যার কোনদিন প্রবেশ ঘটেনি। এবং প্রাচীন সভ্যজাতিগুলির মধ্যে রোমই স্বাধীন রাজতন্ত্রের ভিত্তির উপর জাতীয়-ঐক্যের প্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য্য হ’য়েছে। সেই জাতীয়-ঐক্যের ফলে কেবল বিচ্ছিন্ন হেলিনিক জাতির উপরে নয়, পৃথিবীর সমস্ত জানা অংশের উপর প্রভুত্ব, তাদের করতলগত হ’য়েছিল।

আমাদের শাস্ত্রে ‘পুরুষের’ শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, তাই শেষ, তাই ‘পরা গতি’। পরিচিত সমস্ত পৃথিবীর উপর অবাধ প্রভুত্ব কি মানবসভ্যতার ‘পুরুষ’, তার ‘কাষ্ঠা’ ও ‘পরা গতি’! এ প্রভুত্ব ত কালে উঠে কিছুকালের পরই বিলোপ হয়; মানুষের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছুই স্থায়ী সম্পদ রেখে যায় না। আমার সুমুখে উরিপিডিসের কয়েকখানি নাটক রয়েছে। এগুলি ত কেবল খৃষ্টপূর্ব্ব পঞ্চম শতাব্দীর হেলাসের ঐক্য-বন্ধন নয়। তেইশ শ’ বছর আগেকার এথেন্সের নাগরিকের মত আমিও যে আজ সে কাব্যের রসে মেতে উঠ্‌ছি। এগুলি যে চিরদিনের জন্য মানব-সভ্যতার অক্ষয় মঞ্জুষায় সঞ্চিত হ’য়ে গেছে। যুগের পর যুগ বিশ্বজন এর সুধা আনন্দে পান কর্‌বে। আর রোমের প্রভুত্ব?— সেটি রয়েছে— ঐ মম্‌সেনের পৃষ্ঠায়। এই যে প্রভেদ, এ ত মম্‌সেনের চার ভল্যুমও মুছে ফেল্‌তে পারে না। একে কেবল মানুষের সভ্যতার প্রকার ভেদ বলে আপস-মীমাংসার চেষ্টায় কোনও ফল নাই। এর একটির চেয়ে আর একটি শ্রেষ্ঠ, নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ; যেমন জড়ের চেয়ে জীবন শ্রেষ্ঠ, প্রাণের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ।

মানুষের সভ্যতার ধারা দুই। এক ধারা ব’য়ে যাচ্ছে— কেবলই কালের মধ্য দিয়ে— জাতিকে, সভ্যতাকে ভাসিয়ে নিয়ে স্মৃতি ও বিস্মৃতির মহাসাগরে মিশিয়ে দিচ্ছে। নূতন জাতি, নূতন সভ্যতার স্রোত এসে ধারার প্রবাহকে সচল রাখছে। আর এক ধারা জন্ম নিয়েছে কালেরই মধ্যে, কিন্তু কালকে অতিক্রম করে’ ধ্রুবলোকে অক্ষয় স্রোতে নিত্যকাল প্রবাহিত হচ্ছে। নুতন স্রোত এসে এ ধারাকে পুষ্ট করছে, কিন্তু এতে একবার যা মিশছে, তার আর ধ্বংস নেই, তা অচ্যুত। কেননা এ লোকে ত পুরাতন কিছু নেই, সবই সনাতন, অর্থাৎ চিরনূতন। সভ্যতার সৃষ্টির এই যে নশ্বর দিকটা এ কিছু তুচ্ছ নয়। এইখানেই বিবিধ মানবের বিচিত্র লীলা, সমাজ গঠনে, রাষ্ট্র নির্মাণে, শৌর্য্যে, বীর্য্যে, মহত্ত্বে, হীনতায় চিরদিন তরঙ্গিত হ’য়ে উঠ্‌ছে। হোক্ না এ মৃত্যুর অধীন, তবুও জীবনের রসে ভরপুর। কিন্তু মানুষ তো কেবল জীব নয়। সে যে মর-অমরের সন্ধিস্থল। মৃত্যুর পথে যাত্রী হ’য়েও সে অমৃতলোকেরই অধিবাসী। তাই তার সৃষ্টির যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা কালের অধীন নয়। তার ইতিহাস আছে কিন্তু তা ঐতিহাসিক নয়। সেখানে যে ফুল একবার ফোটে তার প্রথম দিনের গন্ধ সুষমা চিরদিন অটুট থাকে; যে ফল একবার ফলে, রসে আস্বাদে ত চিরদিন সমান মধুর।

দুই সভ্যতার যদি শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসা কর্‌তে হয়, তবে মানুষের সভ্যতার এই অক্ষয় ভাণ্ডারে কার কতটা দান, তাই হ’ল বিচারের প্রধান কথা। এ মাপকাঠিতে মাপ্‌লে, রোমান সভ্যতা গ্রীক কি হিন্দুসভ্যতার সঙ্গে এক ধাপে দাঁড়াতে পারে না। তাকে নীচে নেমে দাঁড়াতে হয়। যত দিন তার সাম্রাজ্য ছিল, তত দিন তার বলের কাছে— সবারই মাথা নিচু করে থাক্‌তে হ’য়েছে। কিন্তু উত্তরকালের লোকেরা কেন তার কাছে সম্ভ্রমে নতশির হবে? তাদের জন্য ত সে বিশেষ কিছু সঞ্চয় করে’ রেখে যায়নি। তার যা প্রধান দাবী, তার পলিটিক্যাল্ শক্তি ও বুদ্ধি, তার পাওনা ত তার সমসাময়িকেরা একরকম ষোল আনাই মিটিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে সে দাবীর জোর খুব বেশি নয়। তার গৌরবের চৌদ্দ আনা হ’ল তার ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস জীবনের কাহিনী হ’লেও জীবন নয়, কেবলই কাহিনী। তার পৃষ্ঠার সঙ্গে মানুষের আত্মার কোনও সাক্ষাৎ যোগ নাই। একজন ফরাসি পণ্ডিত রোমানদের দার্শনিক আলোচনা সম্বন্ধে বলেছেন যে, সেগুলি এখন বক্তৃতা-শিক্ষার ইস্কুলের ছাত্রদের লেখা প্রবন্ধের মত মনে হ’লেও যাদের জন্য সেগুলি লেখা হয়েছিল তাদের জীবনে ওর প্রভাব ছিল খুব বেশি। সুতরাং এ সব দার্শনিকের মূল্য বুঝ্‌তে হ’লে সেই সময়কার রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সে-সব মিলিয়ে পড়্‌তে হবে। হায় রোম, তোমার দার্শনিক চিন্তারও ইতিহাসের হাত থেকে মুক্তি নাই!

চার

রোমের পলিটিক্যাল্ গৌরবের গুণগান মুখে যতই কেন থাকুক না, রোমান সভ্যতার এই প্রকৃতিটি পণ্ডিতদের মনে অস্বস্তির সঞ্চার না করে’ যায়নি। সেই জন্য ইউরোপের বর্ত্তমান সভ্যতা, রোমের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের কাছে কেমন করে’ কতটা ঋণী, মম্‌সেন তার বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং ছোট বড় মাঝারি সকল পণ্ডিতই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। সে ব্যাখ্যার প্রধান কথাটা এই— রোম সাম্রাজ্যের প্রাচীর যদি বর্ত্তমান ইউরোপীয় জাতিগুলির অসভ্যকল্প পূর্ব্বপুরুষদের ঠেকিয়ে না রাখত, তবে তারা যখন রোম সাম্রাজ্যের উপরে পড়ে তাকে ধ্বংস করেছিল, সে ঘটনাটি ঘটত আরও চার শ’ বছর আগে। এবং তা হ’লে বিস্তীর্ণ রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে— স্পেনে, গলে, ড্যানিউবের তীরে তীরে, আফ্রিকায়, হেলেনিক সভ্যতার নব সংস্করণ মেডিটারেনিয়ন সভ্যতা যে শিকড় বসাতে সময় পেয়েছিল, তা আর ঘটে’ উঠ্‌ত না। আর তার ফল হ’ত এই যে, ঐ অর্দ্ধ-সভ্য জাতিগুলি ঐ সভ্যতার সংস্পর্শে এসে যে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা গড়ে তুলেছে, তা কখনও গড়্‌তে পার্‌ত না।

মানুষের ইতিহাসে যে ঘটনাটা এক রকমে ঘটে গেছে, সেটা সে রকম না ঘটে’ অন্য রকম ঘটলে তার ফলাফল কী হ’ত এ তর্ক নিরর্থক। তাতে ‘স্বপ্নলব্ধ’ ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সুতরাং রোম সাম্রাজ্যকে তার চৌকিদারির প্রাপ্য প্রশংসাটা নির্বিবাদেই দেওয়া যাক্। কিন্তু এ ত’ রোমান সভ্যতার কোনও গৌরবের কাহিনী নয়! এবং রোম সাম্রাজ্যকে যাঁরা চার শ’ বছর ধরে’ রক্ষা করেছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মুখ চেয়ে তা করেননি! আর এটাও যদি গৌরবের কথা হয় তবে রোমকে আরও একটা গৌরবের জন্য পূজা দিতে হয়। সে হচ্ছে ঠিক সময়ে সাম্রাজ্যের প্রাচীরকে রক্ষা কর্‌তে না পারা। কেননা রোম যদি আরও চার শ’ বছর সাম্রাজ্যকে অটুটই রাখ্‌তে পার্‌ত, তবে তো আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা আরও চার শ’ বছর পিছিয়ে যেত এবং হয় ত সে সভ্যতা আর তখন গড়েই উঠ্‌তে পার্‌ত না! ইতিহাসে তার ওজন কত, সেটা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের মাপ নয়।

এই যে চার শ’ বছর ধরে পৃথিবীর একটা বৃহৎ অংশে বিচিত্র সব জাতি পরস্পরের সংস্পর্শে এল তার ফলে সৃষ্টি হ’ল কী? মেডিটারেনিয়ন সভ্যতার এই প্রকাণ্ড শূন্যতা, সমস্ত পলিটিক্যাল্ সভ্যতা— রাজ্য-জয় ও রাজ্য-শাসনের সভ্যতার উপর একটা বিস্তৃত ভাষ্য। বিস্তীর্ণ বাগানের চার পাশে পাথর দিয়ে বেড় দেওয়া হ’ল পাছে আকস্মিক বিপৎপাতে বাগান নষ্ট হয়। পাথরের দেয়াল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু বাগানে ফুলও ফুট্‌ল না, ফলও পাক্‌ল না।

পাঁচ

রোমান সভ্যতার এই যে উচ্চ জয়গান, এ যে কেবল মিথ্যা স্তুতি তা নয়, এর কলরোল পৃথিবীর প্রবল জাতিগুলির মন চিরদিন বিপথের দিকেই টান্‌বে। যেই যখন শক্তিশালী হ’য়ে উঠ্‌বে তারি মনে হবে মানুষের বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে’ পৃথিবীর যতটা অংশের উপর পারা যায়, নিজের আধিপত্যের একরঙা তুলিটা বুলিয়ে নেওয়া কেবল স্বার্থ সিদ্ধির উপায় নয়, সভ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভেরই পথ। এ যে অতিশয়োক্তি নয়, তার প্রমাণ মম্‌সেন থেকেই তুলে দিচ্ছি। সিজারের গল বিজয়ের বর্ণনা মম্‌সেন এই বলে’ আরম্ভ করেছেন— ‘যেমন মাধ্যাকর্ষণ ও আর আর পাঁচটা প্রাকৃতিক নিয়ম যার অন্যথা হবার যো নেই তেমনি এও একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যে জাতি রাষ্ট্র হ’য়ে গড়ে’ উঠেছে সে তার অ-রাষ্ট্রবদ্ধ প্রতিবেশী জাতিগুলিকে গ্রাস কর্‌বে, এবং সভ্যজাতি, বুদ্ধিবৃত্তিতে হীন তার প্রতিবেশীদের উচ্ছেদ কর্‌বে। এই নিয়মের বলে ইতালি জাতি (প্রাচীন জগতের একমাত্র জাতি যে শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল্ উন্নতির সঙ্গে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা মেশাতে পেরেছিল, যদিও শেষ বস্তুটির বিকাশ তাতে অপূর্ণভাবে এবং কতটা বহিরাবরণের মতই ছিল) পূবের গ্রীকদের, যাদের ধ্বংসের সময় পূর্ণ হ’য়ে এসেছিল, তাদের করায়ত্ত কর্‌তে, এবং পশ্চিমের কেল্ট জার্ম্মনদের, যারা সভ্যতার সিঁড়ির নীচের ধাপে ছিল, তাদের উচ্ছেদ সাধন কর্‌তে সম্পূর্ণ অধিকারী ছিল।’

প্রাকৃতিক নিয়ম যে কেমন করে’ অধিকারে পরিণত হয় সে রহস্যের চাবী হয়ত হেগেলের লজিকে’ও মিলবে না। সে যাই হোক এ ‘নিয়ম’ ও ‘অধিকারের’ মুশকিল এই যে এর জন্য পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে সারাক্ষণ নখদন্ত বের করেই থাক্‌তে হয়। কেননা মল্লাঙ্গনই হচ্ছে এ ‘অধিকার’ প্রমাণের একমাত্র স্থান। কারণ বুকের উপর চেপে বস্‌তে পারলেই প্রমাণ হ’ল যে চেপে বসার অধিকার আছে; আর তাই হ’ল এ অধিকার প্রমাণের একমাত্র শাস্ত্রীয় প্রথা। তারপর শক্তি থাক্‌লেই যখন ‘অধিকার’ আছে, তখন শক্তির পরীক্ষার অধিকার থেকেও কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। পরীক্ষা না কর্‌লে ত শক্তিটা ঠিক আছে কি না তা আগে থেকে অমনি জান্‌বার উপায় নেই। শেষ পর্য্যন্ত ফেল হ’লেও ‘হলে’ ঢোকার অধিকার অস্বীকার করা যায় কেমন করে? গেল চার বছর ধরে’ এই পরীক্ষাটা সারা ইউরোপ জোড়া চল্‌ছে। মম্‌সেনের সৌভাগ্য যে বেঁচে থেকে তাঁর প্রণালীর ফলটা দেখে যেতে হয়নি। কিন্তু প্রাচীন রোমের গুণগানে যাঁরা মুখর, আধুনিক জার্ম্মনির উপর মুখ বাঁকানোর তাঁদের কোনও অধিকার নেই। কার্থেজ ও মিশর বিজয় যদি রোমের পক্ষে ছিল গৌরবের, তবে বেলজিয়মকে গ্রাস করা জার্ম্মনির পক্ষে অগৌরবের কিসে? আজকাল পলিটিক্‌সে যা হীন, কালকার ইতিহাসে তা মহৎ হয় কোন ন্যায়ের জোরে?

এই যে পলিটিক্যাল্ শক্তি ও সভ্যতার স্তুতিগান— এ মূলে হ’ল একটা ‘মায়া’। শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন মায়ার প্রকৃতি ‘অধ্যাস’, একের ধর্ম্ম অন্যে আরোপ করা। পৃথিবীর আদিযুগ থেকে যখন জাতিতে জাতিতে লড়াই চলে আসছে আর কোনও ‘লীগ অব নেশনে’-ই তা শেষ হবে বলে’ যখন বোধ হয় না, (কেননা ‘লীগের’ একটা অর্থ হচ্ছে এর ভিতরে যারা আসবে না তারা শত্রু, আর বাইরে যাদের রাখা হবে তাদের এজমালিতে দমন করা চল্‌বে) তখন জাতির রাষ্ট্রীয় শক্তি তার আত্মরক্ষার পক্ষে অমূল্য। জাতির প্রাণই যদি না বাঁচে তবে তার মনের বিকাশও কাজে কাজেই বন্ধ হয়। কিন্তু এই শক্তি যখন আত্মরক্ষায় নয়— পর-পীড়নেই রত থাকে, রক্ষার চেষ্টায় নয়— ধ্বংসের লীলাতেই মেতে ওঠে তখনও যে তার পূজা, তার মূলে হ’ল ‘অধ্যাস’। একের গুণ আর একজনে দেখা, রামের পাওনা শ্যামকে বুঝিয়ে দেওয়া। অবিশ্যি এ দুয়ের সম্বন্ধ অতি নিকট। কিন্তু একান্ত ‘অবিষয়’ হলে তো ‘অধ্যাসে’রও উৎপত্তি হয় না।

আশ্বিন ১৩২৫