» » প্রথম অঙ্ক

বর্ণাকার

পঞ্চম দৃশ্য

[বেণী ঘোষালের বাটীর অন্তঃপুরে বিশ্বেশ্বরীর গৃহ। রমা প্রবেশ করিয়া সম্মুখের দাসীকে দেখিতে পাইল]

রমা। জ্যাঠাইমা কোথায় নন্দর মা?

দাসী। পূজোর ঘর থেকে এখনো বার হয়নি। ডেকে দেব দিদি?

রমা। তাঁর পূজোর ব্যাঘাত করে? না না, আমি বসচি। তিনি বেরুলে তাঁকে খবর দিয়ো যে আমি এসেচি।

দাসী। আচ্ছা দিদি।

[দাসী প্রস্থান করিল, এবং পরক্ষণে অতি সন্তর্পণে পা টিপিয়া যতীন প্রবেশ করিল]

যতীন। দিদি!

রমা। (চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া) অ্যাঁ, তুই কোথা থেকে রে?

যতীন। তোমার পেছনে পেছনে এসেচি, তুমি দেখতে পাওনি!

[এই বলিয়া সে রমাকে জড়াইয়া ধরিল]

রমা। কি দুষ্টু ছেলে রে তুই! বেলা হল ইস্কুলে যাবিনে?

যতীন। আমাদের যে আজ ছুটি দিদি।

রমা। ছুটি কিসের রে? আজ ত সবে বুধবার।

যতীন। হলই বা বুধবার! বুধ, বেস্পতি, শুক্‌কুর, শনি, রবি—এক্কেবারে পাঁচ দিন ছুটি।

রমা। কেন রে যতীন?

যতীন। আমাদের ইস্কুলের চাল ছাওয়া হচ্ছে যে। তার পর চুনকাম হবে, কত বই আসবে,—চার-পাঁচটা চেয়ার-টেবিল এসেচে,—একটা আলমারি, একটা বড় ঘড়ি এসেচে, একদিন তুমি গিয়ে দেখে এসো না দিদি।

রমা। বলিস কিরে?

যতীন। সত্যি দিদি। রমেশবাবু এসেচেন না!—তিনি সব করে দিচ্ছেন। আরও কত কি তিনি করে দেবেন বলেছেন। রোজ দু’ঘণ্টা করে এসে আমাদের পড়িয়ে যান।

রমা। হাঁ রে যতীন। তোকে তিনি চিনতে পারেন?

যতীন। হাঁ—

রমা। কি বলে তাঁকে তুই ডাকিস?

যতীন। ডাকি? আমরা ছোটবাবু বলি।

রমা। (ভাইটিকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া) ছোটবাবু কি রে, তিনি যে তোর দাদা হন।

যতীন। যাঃ—

রমা। যা কি রে? বেণীবাবুকে যেমন বড়দা বলে ডাকিস, এঁকে তেমনি ছোড়দা বলে ডাকতে পারিস নে?

যতীন। আমার দাদা হন তিনি? সত্যি বলচ দিদি?

রমা। সত্যি বলচি রে, তোর ছোড়দা হন তিনি।

যতীন। এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন দিদি?

রমা। এতদিন লেখাপড়া শিখতে বিদেশে ছিলেন। তুই বড় হলে তোকেও এমনি কোরে বিদেশে গিয়ে থাকতে হবে যতীন, আমাকে ছেড়ে পারবি ত থাকতে?

যতীন। (বার দুই-তিন অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িল) ছোড়দার সমস্ত পড়া শেষ হয়ে গেছে দিদি?

রমা। হাঁ ভাই, তাঁর সব পড়া সাঙ্গ হয়ে গেছে।

যতীন। কি করে তুমি জানলে?

রমা। (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া) নিজের পড়া শেষ না হলে কি কেউ পরের ছেলের জন্যে এত দিতে পারে? এটুকু বুঝি তুই বুঝতে পারিস নে?

যতীন। (মাথা নাড়িয়া জানাইল সে পারে) আচ্ছা, ছোড়দা কেন আমাদের বাড়ি আসেন না দিদি, বড়দা ত রোজ রোজ যান?

রমা। তুই তাঁকে ডেকে আনতে পারিস নে?

যতীন। এখুনি যাব দিদি?

রমা। (ভয়-ব্যাকুল দুই হাতে তাহাকে বুকে জড়াইয়া) ওরে, কি পাগলা ছেলে রে তুই! খবরদার যতীন, কখখনো এমন কাজ করিস নে ভাই, কখখনো করিস নে।

যতীন। তোমার চোখে জল এলো কেন দিদি? তুমি বারণ করলে ত আমি কখখনো কিছু করিনে।

রমা। (চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) তা ত কর না জানি। তুমি আমার লক্ষ্মী মানিক ছোট্ট ভাই কিনা,—তাই।

যতীন। বাড়ি চল না দিদি!

রমা। তুই এখন যা, আমি একটুখানি পরে যাবো ভাই।

[যতীন প্রস্থান করিল

[বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিলেন]

রমা। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। এ-সব তোরা কি করেছিস মা? বেণীর চুরি-করার কাজে তুই কি করে সাহায্য করলি রমা?

রমা। আমি ত এ কাজ করতে তাঁকে বলিনি জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। স্পষ্ট বলনি বটে, তবুও অপরাধ তোমার কম হয়নি রমা।
রমা। কিন্তু তখন যে আর উপায় ছিল না জ্যাঠাইমা। ভজুয়া লাঠি-হাতে বাড়ির মধ্যে গিয়ে যখন দাঁড়ালো তখন মাছ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বড়দা তাঁর ভাগ নিয়ে চলে আসছিলেন, পাড়ার পাঁচজনেও দুটো-একটা নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন।

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু আসলে মাছ আদায় করতে ভজুয়া যায়নি রমা। রমেশ নিজে মাছ-মাংস ছোঁয় না, এতে তার প্রয়োজন নেই। সে শুধু তোমারই কাছে জানতে পাঠিয়েছিল কাপাসডাঙার গড়পুকুরে তার অংশ আছে কিনা। নেই, এ কথা তুই বললি কি কোরে মা? (রমা অধোমুখে নিরুত্তর)

বিশ্বেশ্বরী। তোমার পরে যে তার কত শ্রদ্ধা, কত বিশ্বাস, সে তুমি জান না বটে, কিন্তু আমি জানি। সেদিন তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তোমরা দু’ঘরে ভাগ কোরে নিলে; গোপাল সরকারের কথাতেও রমেশ কান দিলে না, বললে, আমার ভাগ থাকলে আমি পাবই। রমা কখনো আমাকে ঠকিয়ে নেবে না, কিন্তু কাল যা করেচ মা, তাতে—একটা কথা তোমাকে আজ বলে রাখি মা। বিষয়-সম্পত্তির দাম যত বেশীই হোক, এই মানুষটির প্রাণের দাম তার অনেক বেশী। কারও কথায়, কোন বস্তুর লোভেই, রমা, চারিদিকের আঘাত দিয়ে এ-জিনিসটি তোমরা নষ্ট কোর না। যা হারাবে তা আর কোনদিন পূর্ণ হবে না।

রমেশ।(নেপথ্যে) জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। কে, রমেশ? আয় বাবা এই ঘরে আয়।

[রমেশ প্রবেশ করিতেই রমা আনতমুখে ঈষৎ আড় হইয়া বসিল]

বিশ্বেশ্বরী। হঠাৎ এমন দুপুরবেলা যে রে?

রমেশ। দুপুরবেলা না এলে যে তোমার কাছে একটু বসতে পাইনে জ্যাঠাইমা। তোমার কত কাজ। হাসলে যে? আচ্ছা, তোমার মনে পড়ে, ঠিক এমনি দুপুরবেলায় ছেলেবেলায় একদিন চোখের জলে তোমার কাছে বিদায় নিয়েছিলাম। আজও তেমনি নিতে এলাম। কিন্তু এই বোধ হয় শেষ নেওয়া জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। বালাই, ষাট! ও কি কথা বাবা? আয় আমার কাছে এসে বোস।

[রমেশ তাঁহার কাছে গিয়া বসিয়া একটুখানি হাসিল, কিন্তু জবাব দিল না। বিশ্বেশ্বরী পরমস্নেহে তাহার মাথায় গায়ে হাত বুলাইয়া দিয়া কহিলেন—]

বিশ্বেশ্বরী। শরীরটা কি এখানে ভাল থাকচে না বাবা?

রমেশ। এ যে খোট্টার দেশের ডাল-রুটির শরীর জ্যাঠাইমা, এ কি এত শীঘ্র খারাপ হয়? তা নয়। তবে, এখানে আমি আর একদিনও টিকতে পারচি নে। আমার সমস্ত প্রাণ যেন কেবলই খাবি খেয়ে উঠচে।

বিশ্বেশ্বরী। শুনে বাঁচলাম বাবা, তোর শরীর খারাপ হয়নি। কিন্তু এই যে তোর জন্মস্থান, এখানে টিকতে পারচিস না কেন বল দেখি?

রমেশ। সে আমি বলবো না। আমি নিশ্চয় জানি, তুমি সমস্তই জান।

বিশ্বেশ্বরী। সব না জানলেও কতক জানি বটে, কিন্তু ঠিক সেই জন্যেই তোকে আমি কোথাও যেতে দেব না রমেশ।

রমেশ। কিন্তু এখানে কেউ আমাকে চায় না জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। চায় না বলেই তোর পালান চলবে না রমেশ। এই যে ডাল-রুটি-খাওয়া দেহের বড়াই করছিলি সে কি শুধু পালানোর জন্যে ! হাঁ রে, গোপাল সরকার বলছিল কি একটা রাস্তা মেরামতের জন্যে তুই চাঁদা তুলছিলি। তার কি হলো?

রমেশ। আচ্ছা, এই একটা কথাই তোমাকে বলি। কোন্ পথটা জান? যেটা পোস্টাফিসের সুমুখ দিয়ে বরাবর স্টেশনে গেছে। বছর-পাঁচেক পূর্বে বৃষ্টিতে ভেঙ্গে এখন একটা প্রকাণ্ড গর্ত হয়ে আছে। লোক পা পিছলে হাত-পা ভেঙ্গে পার হয়, কিন্তু মেরামত করে না। গোটা-কুড়ি টাকা মাত্র খরচ, কিন্তু এর জন্যে আজ আট-দশ দিন ঘুরে ঘুরেও আট-দশটা পয়সা পাইনি। কাল মধুর দোকানের সামনে দিয়ে রাত্রে আসচি, কানে গেল কে একজন আর সকলকে বারণ করে দিয়ে বলচে, তোরা কেউ একটা পয়সাও দিসনে। জুতো পায়ে মসমসিয়ে হাঁটা, দু′ চাকার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো,—ওরই ত গরজ। কেউ কিছু না দিলে ও আপনিই সারাবে। না করে, ‘বাবু-বাবু’ বলে একটুখানি পিঠে হাত বোলানো। বাস্।

বিশ্বেশ্বরী। (হাসিয়া) ওরা অমন বলে। তাই দে না বাপু সারিয়ে। তোর দাদামশায়ের ত ঢের টাকা পেয়েচিস।

রমেশ। (রাগিয়া উঠিয়া) কিন্তু কেন দেবো? আমার ভারী দুঃখ হচ্চে যে, না বুঝে অনেকগুলো টাকা এদের ইস্কুলের জন্যে খরচ করে ফেলেচি। এ-গাঁয়ের কারও জন্যে কিছু করতে নেই। এরা এত নীচ যে এদের দান করলে এরা বোকা মনে করে। ভাল করলে গরজ ঠাওরায়। এদের ক্ষমা করাও অপরাধ। ভাবে, ভয়ে ছেড়ে দিলে।

[শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী হাসিতে লাগিলেন]

রমেশ। হাসচ যে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। না হেসে কি করি বল ত বাছা ? হাঁ রে, রাগ করে তুই এই লোকগুলোকেই ছেড়ে যেতে চাস? আহা, এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্বল, কত অবোধ তা যদি জানতিস রমেশ, এদের ওপর অভিমান করতে তোর আপনিই লজ্জা হোতো। (রমার প্রতি) তুমি যে সেই থেকে ঘাড় হেঁট করে বসে আছ মা,—হাঁ রমেশ, তোরা দুই ভাই-বোনে কি কথা-কোসনে?

রমা। (তেমনি অধোমুখে) আমি ত বিরোধ রাখতে চাইনি জ্যাঠাইমা। রমেশদা—

রমেশ ৷ (চমকিয়া) এ কে, রমা নাকি। একলা এসেচেন না সঙ্গে মাসিটিকেও এনেচেন?

বিশ্বেশ্বরী। এ তোর কি কথা রমেশ? তোদের ভাল করে চেনাশুনা নেই বলেই—

রমেশ। রক্ষে কর জ্যাঠাইমা, এর বেশী চেনাশোনার আশীর্বাদ আর কোরো না। বাড়ি গিয়ে মাসীটিকে যদি পাঠিয়ে দেন ত তোমাকে আমাকে দু’জনকেই চিবিয়ে খেয়ে তিনি ঘরে ফিরবেন! বাপরে, পালাই—

বিশ্বেশ্বরী। যাসনে রমেশ, শুনে যা!

রমেশ। (থমকিয়া দাঁড়াইয়া) না জ্যাঠাইমা, আমি সমস্ত শুনেচি। যারা অহঙ্কারের স্পর্ধায় তোমাকে পর্যন্ত মাড়িয়ে চলতে চায় তাদের হয়ে তুমি একটা কথাও বোলো না। তোমাকে অপমান করা আমার সইবে না।

[দ্রুতপদে প্রস্থান]

রমা। (বিশ্বেশ্বরীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কাঁদিয়া ফেলিল) তোমাকে অপমান করতে আমি মাসীকে পাঠিয়ে দি, এ কলঙ্ক আমার কেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। (রমাকে কাছে টানিয়া লইয়া) তোমাকে ও ভুল বুঝেচে মা, যা সত্যি সে ও একদিন জানবেই জানবে।