চতুর্থ দৃশ্য
[মধু পালের মুদির দোকান। কেনা-বেচা চলিতেছে]
১ম খরিদ্দার। এক পয়সার তেল দিতে কি বেলা কাটিয়ে দেবে নাকি?
মধু। এই যে দিই।
২য় খরিদ্দার। এক পয়সার হলুদ দিতে কি বুড়ো হয়ে যাবে পালদা?
মধু। এই যে রে ভাই দিচ্ছি। একলা মানুষ—
৩য় খরিদ্দার। দু’পয়সার মুশুর ডালের জন্যে দেখচি এবেলা আর রান্না চড়ানো হবে না!
মধু। হবে গো খুড়ো হবে, এই নাও না।
[রমেশের প্রবেশ]
মধু। (গলা বাড়াইয়া দেখিয়া) অ্যাঁ! এ যে আমাদের ছোটবাবু! প্রাতঃপেন্নাম হই। (এই বলিয়া সে একটা মোড়া-হাতে বাহির হইয়া আসিল) আমার সাত-পুরুষের ভাগ্যি যে দোকানে আপনার পায়ের ধুলো পড়লো। বসুন।
রমেশ। শ্রাদ্ধর দরুন দশটা টাকা বাকী পড়ে আছে, তুমিও যাও না, আমারও পাঠানো হয় না। আজ ভাবলেম নিজেই গিয়ে দিয়ে আসি। এই নাও।
মধু। (হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়া) এ ত আমাদের বাপ-দাদারাও কখনো শোনেনি, বাবু, মানুষের বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যায়!
রমেশ। (মোড়ায় উপবেশন করিয়া) দোকান কেমন চলচে মধু?
মধু। কেমন করে আর ভাল চলবে বাবু? দু-আনা চার-আনা এক-টাকা পাঁচ-সিকে করে প্রায় ষাট- সত্তর টাকা বিলেত পড়ে গেছে। এই ও- বেলায় দিয়ে যাচ্চি বলে আর ছ’মাসেও আদায় হবার জো নেই—এ কি, বাঁড়ুয্যেমশাই যে! কবে এলেন? প্রাতঃপেন্নাম হই।
[বাঁড়ুয্যেমশায়ের বাঁ হাতে একটা গাড়ু, পায়ের নখে, গোড়ালিতে কাদার দাগ, কানে পৈতা জড়ানো, ডান হাতে কচুপাতায় মোড়া চারটি কুচো চিংড়ি]
বাঁড়ুয্যে। কাল রাত্তিরে এলাম। তামাক খা’দিকি মধু।
[এই বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের কুচো চিংড়ি মেলিয়া ধরিলেন]
বাঁড়ুয্যে। সৈরুবী জেলেনীর আক্কেল দেখলি মধু, খপ করে হাতটা আমার ধরে ফেললে হে! কালে কালে কি হল বল দিকি রে, এই কি এক পয়সার চিংড়ি? বামুনকে ঠকিয়ে ক’ কাল খাবি মাগী, উচ্ছন্ন যেতে হবে না?
মধু। হাত ধরে ফেললে আপনার?
বাঁড়ুয্যে। আড়াইটি পয়সা শুধু বাকি, তাই বলে খামকা বাজারসুদ্ধ লোকের সামনে হাত ধরবে আমার! কে না দেখলে বল! মাঠ থেকে বসে এসে গাড়ুটি মেজে, নদীতে হাত-পা ধুয়ে মনে করলাম বাজারটা একবার ঘুরে যাই। মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে বসে—স্বচ্ছন্দে বললে কিনা কিচ্ছু নেই ঠাকুর, যা ছিল সব উঠে গেছে। আরে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস? ডালাটা ফস কোরে তুলে ফেলতেই দেখি না,—অমনি খপ কোরে হাতটা চেপে ধরে ফেললে! তোর সাবেক আড়াইটা আর আজকের একটা—এই সাড়ে-তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গাঁ ছেড়ে পালাব? কি বলিস মধু?
মধু। তাও কি হয়!
বাঁড়ুয্যে। তবে তাই বল্ না। গাঁয়ে কি শাসন আছে? নইলে ষষ্ঠে-জেলের ধোপা-নাপতে বন্ধ কোরে চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না? (হঠাৎ রমেশের প্রতি চাহিয়া) বাবুটি কে মধু?.
মধু। আমাদের ছোটবাবু যে! শ্রাদ্ধের দরুন দশটি টাকা বাকি ছিল বলে বাড়ি বয়ে দিতে এসেচেন।
বাঁড়ুয্যে। অ্যাঁ, রমেশ বাবাজী? বেঁচে থাকো বাবা, হাঁ, এসে শুনলাম একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে। এমন খাওয়া-দাওয়া এ-অঞ্চলে কখনো হয়নি। কিন্তু বড় দুঃখ রইলো চোখে দেখতে পেলাম না। পাঁচ শালার ধাপ্পায় পড়ে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে হাড়ীর হাল। আরে ছি, সেখানে মানুষ থাকতে পারে!
মধু। (তামাক সাজিয়া হুঁকা তাঁহার হাতে দিল) তার পরে? একটা চাকরি-বাকরি হয়েছিল ত?
বাঁড়ুয্যে। হবে না? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার? কিন্তু হলে কি হবে। যেমন ধোঁয়া, তেমনি কাদা। বাইরে বেরিয়ে গাড়িচাপা না পড়ে যদি ঘরে ফিরতে পারিস ত জানবি তোর বাপের পুণ্যি। কখনো গিয়েছিলি সেখানে?
মধু। আজ্ঞে না। মেদিনীপুর শহরটা একবার দেখেছি—।
বাঁড়ুয্যে। আরে দূর ব্যাটা পাড়াগেঁয়ে ভুত। কিসে আর কিসে! তোর রমেশবাবুকে জিজ্ঞেস কর্ না সত্যি না মিছে।—না মধু, খেতে না পাই ছেলেপুলের হাত ধরে ভিক্ষে করব,—বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জা নেই,—কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন না কেউ আমার কাছে করে। বললে বিশ্বেস করবি নে,সেখানে শুষনি কলমি চালতা আমড়া থোড় মোচা পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। পারবি খেতে?—এই একটি মাস না খেয়ে খেয়ে যেন রোগা ইঁদুরটি হয়ে গেছি।
[এই বলিয়া তিনি হুঁকাটা মধুর হাতে দিয়া উঠিয়া গিয়া মধুর তেলের ভাঁড় হইতে খানিকটা তেল বাঁ হাতের তেলোয় লইয়া অর্ধেকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্তে ঢালিয়া দিয়া বাকিটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন]
বাঁড়ূয্যে। বেলা হল, অমনি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই। এক পয়সার নুন দে দিকি মধু, পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাব।
মধু। আবার বিকেলবেলা!
[মধু অপ্রসন্নমুখে দোকানে উঠিয়া ঠোঙায় করিয়া নুন দিল]
বাঁড়ুয্যে। (নুন হাতে লইয়া) তোরা সব হলি কি মধু? এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস দেখি। (এই বলিয়া নিজেই এক খামচা নুন ঠোঙায় দিয়া রমেশের প্রতি মৃদু হাসিয়া) ঐ ত একই পথ,- চল না বাবাজী, গল্প করতে করতে যাই।
রমেশ। আমার একটু দেরি আছে।
বাঁড়ুয্যে। তবে থাক।
[এই বলিয়া গাড়ু লইয়া গমনোদ্যত হইলেন]
মধু। বাঁড়ুয্যেমশাই, সেই ময়দার পয়সা পাঁচ আনা কি অমনি—
বাঁড়ুয্যে। হাঁ রে মধু, তোদের কি লজ্জা-শরম, চোখের চামড়া পর্যন্ত নেই? পাঁচ ব্যাটা-বেটীর মতলবে কলকাতা যাওয়া-আসা করতে পাঁচ-পাঁচটা টাকা আমার গলে গেলো, আর, এই কি তোদের তাগাদা করবার সময় হলো? কারো সর্বনাশ, আর কারো পৌষ মাস বটে! দেখলে বাবা রমেশ, এদের ব্যাভারটা একবার দেখলে?
মধু। (লজ্জিত হইয়া) অনেক দিনের—
বাঁড়ুয্যে। হলই বা অনেক দিনের। এমন কোরে সবাই মিলে পিছনে লাগলে ত আর গাঁয়ে বাস করা যায় না।
[এই বলিয়া তিনি একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন। এবং পরক্ষণে বনমালী পাড়ুই ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া রমেশের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন]
রমেশ। আপনি কে?
বনমালী। আপনাদের ভৃত্য, বনমালী পাড়ুই। গ্রামের মাইনার ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।
রমেশ। (সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি ইস্কুলের হেডমাস্টার?
বনমালী। আপনার ভৃত্য। দু’দিন আপনাকে প্রণাম জানাতে গিয়েও দেখা হয়নি।
রমেশ। আপনার ইস্কুলের ছাত্রসংখ্যা কত?
বনমালী। বিয়াল্লিশ জন। গড়ে দু’জন পাস হয়। একবার নারাণ বাঁড়ুয্যের সেজছেলে জলপানি পেয়েছিল।
রমেশ। বটে?
বনমালী। আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু এ-বছর চাল ছাওয়া না হলে বর্ষার জল আর বাইরে পড়বে না।
রমেশ। সমস্তই আপনাদের মাথায় পড়বে?
বনমালী। আজ্ঞে, হাঁ। কিন্তু সে এখনো দেরি আছে। কিন্তু সম্প্রতি আমরা কেউ তিন মাসের মাইনে পাইনি। মাস্টাররা বলচেন, ঘরের খেয়ে বনের মশা আর বেশীদিন তাড়ানো যাবে না।
রমেশ। আপনার মাইনে কত?
বনমালী। ছাব্বিশ। পাই তেরো টাকা পোনের আনা।
রমেশ। ছাব্বিশ টাকা মাইনে, আর পান তেরো টাকা পোনের আনা, এর মানে?
বনমালী। গভর্নমেন্টের হুকুম কিনা। তাই ছাব্বিশ টাকার রসিদ লিখে সব-ইনস্পেকটারকে দেখাতে হয়। নইলে সরকারী সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
রমেশ। এতে ছেলেদের কাছে আপনার সম্মানহানি হয় না?
বনমালী। না, এই দেশাচার। তা ছাড়া ছেলেরা আমাকে বাঘের মত ভয় করে। বিতিয়ে পিঠ লাল করে দিই।
রমেশ। দেবার কথাই। আর সব মাস্টারের মাইনে কত?
বনমালী। তেইশ টাকা।
রমেশ। তেইশ! একজনের না তিনজনের?
বনমালী। তিনজনের। ন’টাকা, আট টাকা আর ছ’টাকা। এও বেণীবাবু দিতে নারাজ। তিনি বলেন, আট টাকাটা সাত টাকা হলেই হয় ভাল।
রমেশ। সে ঠিক। কর্তা বুঝি তিনিই?
বনমালী। হাঁ, তিনিই সেক্রেটারি। কিন্তু কখনো একটি পয়সাও দেন না। যদু মুখুয্যেমশায়ের কন্যা রমা,―সতীলক্ষ্মী তিনি―তাঁর দয়া না থাকলে ইস্কুল অনেক দিন পূর্বেই বন্ধ হয়ে যেত।
রমেশ। বলেন কি? এ ত শুনিনি।
বনমালী। হাঁ, শুধু তাঁর দয়াতেই ইস্কুল চলে ছোটবাবু, আর কারো নয়। একটি ভাইও তাঁর এই ইস্কুলে পড়ে। এ-বছর তিনিই চাল ছাইয়ে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু কেন যে দিলেন না বলতে পারিনে। হয়ত কেউ ভাঙ্চি দিয়েছে।
রমেশ। তাও হয় নাকি? আচ্ছা, আজ আপনি যান, আপনার বেলা হয়ে যাছে, কাল আপনাদের ইস্কুল আমি দেখতে যাব।
বনমালী। যে আজ্ঞে। আপনার দয়া হলে আর আমাদের ভাবনা কি?
[এই বলিয়া সে আর একবার হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া প্রস্থান করিল, এবং অন্য পথ দিয়া গোপাল সরকার ও ভজুয়া দ্রুতপদে প্রবেশ করিল]
রমেশ। হঠাৎ আপনি এমন ব্যস্ত হয়ে যে সরকারমশাই?
গোপাল। বেণীবাবু ত অত্যন্ত অত্যাচার শুরু করে দিলেন। প্রত্যহ এ ত সহা যায় না ছোটবাবু।
রমেশ। ব্যাপার কি?
গোপাল। কাপাসডাঙার বাইশ-বিঘের বন্দটা এখনো ভাগ হয়নি, মুখুয্যেদের সঙ্গে যৌথ আছে। এক অংশ তাঁদের, এক অংশ বেণীবাবুর, আর এক অংশ আমাদের। সেদিন পাড়ের অতবড় তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তাঁরা দু’ অংশে ভাগ কোরে নিলেন, আমাদের একটা টুকরো পর্যন্ত দিলেন না। আপনাকে জানালাম, আপনি বললেন তুচ্ছ একটু কাঠের জন্যে ত আর ঝগড়া করা যায় না!
রমেশ। বাস্তবিক, এত সামান্য জিনিসের জন্যে কি বড়দার সঙ্গে ঝগড়া করা যায় সরকারমশাই?
গোপাল। সেই জোরে আজ বেণীবাবু জোর করে গড়পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে গেছেন। বোধ করি মুখুয্যেবাড়িতে এতক্ষণ তার অংশ ভাগ হচ্চে।
রমেশ। কিন্তু ঠিক জানেন এতে আমাদের অংশ আছে?
গোপাল। তবে কি মিছেই এ কাজে মাথার চুল পাকালাম ছোটবাবু?
রমেশ। কিন্তু সবাই যে বলে রমা বড় ধর্মনিষ্ঠ মেয়ে! তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন না কেন?
গোপাল। শুনলাম তিনি নাকি হেসে বলেচেন, ছোটবাবুকে বোলো বিষয় তাঁর হাতে দিয়ে একটা মাস-হারা নিয়ে যেখানকার মানুষ সেখানে চলে যেতে। জমিদারি রক্ষে করা ভীতু লোকের কাজ নয়।
রমেশ। তবে বুঝি চুরি করাটাই সে মস্ত সাহসের কাজ বলে ঠাউরেচে? ভজুয়া সঙ্গে তোর লাঠি আছে?
ভজুয়া। (লাঠি আস্ফালন করিয়া) হুজুর।
রমেশ। সমস্ত মাছ গিয়ে কেড়ে নিয়ে আয়। একা পারবি ত?
ভজুয়া। (মাথা নত করিয়া) সির্ফ হুকুমকা নোকর হুজুর!
[এই বলিয়া প্রস্থানোদ্যত হইল]
গোপাল। (অকস্মাৎ অত্যন্ত ভয় পাইয়া) এ যে সত্যি সত্যিই ফৌজদারি বেধে যাবে ছোটবাবু।
রমেশ। উপায় কি?
গোপাল। হঠাৎ একটা কাজ করে ফেলা কি ভাল হবে ছোটবাবু?
রমেশ। তবে কি আপনি করতে বলেন?
গোপাল। আমি বলি,—আমি বলি,—থানায় একটা ডাইরি কোরে,—না হয়, ভাল কোরে একবার জিজ্ঞেসা কোরে—
রমেশ। তবে সেই ভাল সরকারমশাই। আমার মত ভীতু লোকের এর বেশী কিছু করা উচিতও নয়। ও-বাড়ির মাইজীকে চিনিস ত ভজুয়া? চিনিস! বেশ, তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে আয় গড়পুকুরের মাছে আমার অংশ আছে কিনা। যদি বলেন—আছে, নিয়ে আসিস। যদি বলেন—নেই, শুধু চলে আসবি। আমার নিশ্চয় বিশ্বাস, সরকারমশাই, সামান্য দুটো মাছের জন্যে রমা মিছে কথা বলবে না।
[ভজুয়ার দ্রুতপদে প্রস্থান]