রিসিভার তুললেন তিনিই, ‘হ্যালো।’
‘স্যার, আমি প্রদীপ বলছি।’
‘নতুন কোনও খবর?’
‘হ্যাঁ স্যার। দ্বিতীয় ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পেয়েছি।’
‘সো নাইস অফ ইউ। থাপা আমাকে ঠিক লোক দিয়েছে। ওর নাম?’
‘এসো কে শর্মা। কলকাতায় বাড়ি, বিজনেসম্যান। এখন গ্যাংটকে নেই।’
‘কোথায় গিয়েছে?’
‘আজই শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গিয়েছে।’
‘কোনও ঠিকানা?’
‘নো স্যার। ঠিকানা নেই। কলকাতার ঠিকানা জোগাড় করতে পারি কিন্তু উনি দার্জিলিং মেলের ফার্স্টক্লাসের প্যাসেঞ্জার। আজকের ট্রেন।’
‘গুড। তোমাকে আর শর্মাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। এবার তিন নম্বর ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। লাইনটা ডেড হয়ে গেল।’
লিটনকে নিয়ে ঘরে এল প্রদীপ। চাবি খুলে খাটে গড়িয়ে পড়ল সে। অত তাড়াতাড়ি যে কাজ উদ্ধার হবে তা কে ভেবেছিল। দুজনের সম্পর্কে তার দায়িত্ব অনেকটা শেষ। শুধু রণতুঙ্গার কাছ থেকে ফিল্মের রোলটা উদ্ধার করতে হবে। তিন নম্বর লোকটি এক্স মিলিটারি ম্যান। সহজ হবে না ব্যাপারটা। লোকটা আজও ওই স্পটে গিয়েছে। চান্স পেয়ে আরও কিছু ছবি তোলার ধান্দা নিশ্চয়ই। যেন ছেলের হাতের মোয়া। লিটনকে বাথরুমে ঢুকে যেতে দেখল সে। এবং তখনই দরজায় শব্দ হল।
প্রদীপ বলল, ‘কাম ইন।’
দরজা খুলল সুজাতা। প্রদীপ উঠে বসল, ‘কী ব্যাপার?’
সুজাতার অবস্থা বেশ উদ্ভ্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে সারারাতের কষ্টকর বাইক-যাত্রার পর সে একটুও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। সুজাতা দুর্বল গলায় বলল, ‘আমি আসতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই।’ প্রদীপ খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকল সুজাতা। তারপর এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
‘কী হয়েছে? পিসির দেখা পেয়েছ?’
‘না। পিসি শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছে। বাড়ি তালা বন্ধ।’
‘ও। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর স্বামীর সঙ্গে গোলমাল, আমাকে থাকতে দিতে ভরসা পেল না। আমি এখন কী করি? কোথায় যাই। আমার সঙ্গে টাকাকড়িও নেই।’ দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা। ওর শরীর কাঁপছিল।
বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল প্রদীপ। লোকটা এলে তিনটে গরম চা আর স্যাণ্ডউইচ আনতে বলল। তারপর সুজাতার দিকে তাকাল, ‘আর যেখানেই যাও নিশ্চয়ই দার্জিলিং-এ যাবে না।’
সুজাতা মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। কিন্তু ওর দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে প্রদীপের মায়া হল। হঠাৎই মেয়েটার অসহায়ত্ব বড় হয়ে দেখা দিল তার কাছে।
সে হুকুম করল, ‘উঠে দাঁড়াও।’
চোখের দৃষ্টি পালটাল সুজাতার। তাতে প্রশ্ন।
এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে দ্বিতীয় খাটের কাছে নিয়ে এল প্রদীপ। সেখানে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুয়ে পড়ো। টেক রেস্ট। খাবার এলে উঠে খেয়ে নিও। তুমি ঘুমাও যতক্ষণ ইচ্ছে। না, যা বলছি তাই করো। আমি রেগে গেলে খুব খারাপ লোক হয়ে যাই।’
সুজাতার চোখে এবার স্বস্তি এল। ধীরে-ধীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়তেই প্রদীপ তার শরীরের ওপর কম্বল টেনে দিল। দার্জিলিং-এর সন্ধেবেলায় যখন ও মতিলালের বাড়িতে এসেছিল তখন সামান্যই শীতবস্ত্র পরেছিল। তাড়াহুড়োতে পালিয়ে আসার সময় তার কিছুটা মতিলালের শোয়ার ঘরে ফেলে আসায় এখন অবস্থা বেশ কাহিল। ফলে কম্বলের আরাম এবং অনেকক্ষণ বাদে শোওয়ার আরাম পেয়ে সুজাতার চোখ জুড়ে এল। ব্যাপারটা লক্ষ করে প্রদীপ কম্বলটাকে আর-একটু টেনে দিতেই বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল লিটন, ‘গুরু আমি শালা কানে বেশি শুনছি।’
‘তাই নাকি?’ প্রদীপ নির্লিপ্ত গলায় বলল।
‘সত্যি বলছি। আমার মনে হচ্ছিল এই ঘরে মেয়ে কথা বলছে। যাক গে, আমি এখন পুরো ফিট। এখন হুকুম করো কী করতে হবে!’
‘গ্যাংটক শহরটায় ঘুরে বেড়াও, আর কী করবে!’
রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়ে বিছানার দিকে নজর যেতেই হকচকিয়ে গেল লিটন। কম্বলে মোড়া থাকায় শরীরের কোনও অংশ সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। প্রদীপের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে জানতে চাইল ‘কে শুয়ে আছে?’ প্রদীপ বলল, ‘যার কথা জিজ্ঞাসা করছিলি সে। বেচারা কাল সারারাত ঘুমায়নি, সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরেছে, খুব টায়ার্ড!’
‘টায়ার্ড?’ লিটন চোখ ছোট করল।
‘তাই তো মনে হল।’
‘ও কি এই ঘরে থাকবে?’
‘ঠিক করেনি এখনও।’
‘মেয়েছেলে এই ঘরে থাকলে আমি এখানে থাকব না।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক।’
‘তার মানে?’
‘ঘরে দুটো খাট আছে। তৃতীয়জনের শোওয়ার ব্যবস্থা তো নেই।’
‘উঃ। তাই বলে তুমি একটা উটকো মেয়েকে এই ঘরে শুতে দেবে?’
‘মেয়েটা যাকে বলে উটকো তা নয়, কিন্তু আমি তোকে বলেছি এখনও ভাবিনি কী করব!’
এই সময় বেয়ারা চা এবং স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এল। লোকটা চলে যাওয়ার পর প্রদীপ দ্বিতীয় বিছানার দিকে ঝুঁকে ডাকল, ‘শুনছ? এই। চটপট চা খেয়ে নাও। শরীর ভাল লাগবে!’
সুজাতা কম্বল সরাল। বোঝা গেল সে একটুও ঘুমায়নি।
লিটনের চোখ বিস্ফারিত।
‘আরে! একে তো আমি দেখেছি! কোথায় যেন দেখেছি!’
মাথায় হাত দিল সে।
প্রদীপ হাসল, ‘কাল রাত্রে মতিলালের বাড়িতে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পিস্তল আনতে গিয়ে পুলিশের ভয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? ওরেব্বাস, তখন থাপার মুখটা একরকম হয়ে গিয়েছিল। অ্যাই, তোমাকে পেলে থাপা চিবিয়ে খেয়ে নেবে। এ জীবনে দার্জিলিং-এ যেও না।’ তারপর প্রদীপের দিকে তাকাল লিটন, ‘ও তোমার সঙ্গে মোটরবাইকে এতটা পথ এসেছে?’
‘হ্যাঁ। তুই চলে যাওয়ার পর ওর দেখা পেয়েছিলাম।’
‘এলেম আছে। আরে হাঁ করে দেখছ কী, খেয়ে নাও।’ স্যাণ্ডউইচের প্লেট এগিয়ে দিল লিটন, ‘পেটে কিছু পড়লে তবেই ঘুম আসবে।’
সুজাতা কথা না বলে খাবার এবং চা খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ওরা ধীরে সুস্থে চা খেয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। লিটন বলল, ‘মেয়েটাকে নিয়ে এখন কী করবে গুরু?’
‘একটা লোকের কাছে তোকে যেতে হবে। লোকটা গতকাল ওর ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছে। মনে হয় ফিল্মটা এখনও ক্যামেরার মধ্যেই আছে। লোকটা উঠেছে হলিডে হোটেলে। সারাদিন ঘরে বসে থাকার লোক ও নয়। যদি ক্যামেরা নিয়ে বের হয় তাহলে ওকে ফলো করে সুবিধে মতন ক্যামেরা ছিনিয়ে নিবি। যদি ঘরে ক্যামেরা রেখে বের হয় তাহলে ওটাকে হাতিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কেউ যেন টের না পায়।’ লিটনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কথাগুলো বলল প্রদীপ। লিটন হাত নাড়ল, ‘কিন্তু এই মেয়েটা কোথায় থাকবে?’
‘আমি তোকে এতক্ষণ যা বললাম তা কানে ঢোকেনি?’
‘ঢুকেছে। লোকটার নাম কী?’
‘রণতুঙ্গা।’ প্রদীপ বলল, ‘লোকটা প্রচণ্ড মোটা। কিন্তু মারপিট করার দরকার নেই। লোকটা যদি পুলিশের কাছে যায় তাহলে যেন তোর নামে কমপ্লেন করার সুযোগ না পায়।’
‘বুঝলাম। ছবিগুলো খুব দামি?’
‘না হলে আমি গ্যাংটকে আসতাম না।’
‘হলিডে হোটেলটা কোথায়?’
‘এখান থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তাটা ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলেই দেখতে পাবি। বড় হোটেল। সাবধানে কাজ করতে হবে।’
‘ঠিক হ্যায়।’
‘কোনও প্রমাণ না রেখে ক্যামেরা নিয়ে চলে আসতে হবে।’ লিটন হাসল, ‘কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি থাকব কোথায়?’
‘থাকতে হবে কি না এখনই বলতে পারছি না। কাজ হয়ে গেলে আজই দার্জিলিং-এ ফিরে যাব। না যেতে পারলে ঘর নেওয়া যাবে।’
‘আমরা দার্জিলিং-এ ফিরে গেলে মেয়েটা কোথায় যাবে?’
‘সেটা আমাদের দুজনের চিন্তার বিষয় নয়।’
‘তুমি কি হোটেলে থাকছ?’
‘না। আমি যেখানেই যাই ঠিক তিনটের সময় হোটেলে ফিরে আসব।’
অসহায় মেয়েদের জন্যে লিটনের সবসময় মায়া হয়। এজন্যে জীবনে কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি তাকে। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে তার অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। ‘হলিডে’ হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে করার চেষ্টা করল। ওরা যখন মতিলালের বাড়িতে ঢুকে লোকটার সঙ্গে কথা বলছিল তখন ওই মেয়েটা বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় কায়দা করে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুরা যাকে বলে খাব-খাব চেহারা, মেয়েটাকে তখন সেইরকম দেখাচ্ছিল। ওর শরীরে পোশাকও ছিল খুব অল্প। পুলিশ আসার আগে মেয়েটা পিস্তল আনতে ঘরে ঢুকেছিল এবং তারপর আর পাত্তা পাওয়া যায়নি। থাপা বলেছিল, ও জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কেন পালাল? ওর যদি কোনও দোষ না থাকে তাহলে পালাতে গেল কেন? তারপর রাস্তায় গুরুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটাও অদ্ভুত ব্যাপার। আচ্ছা, ওরা ওই মতিলালের ঘরে যাওয়ার আগে মেয়েটা অত অল্প পোশাক পরে বেডরুমে কী করছিল? মতিলাল যদিও বলেছে মেয়েটা তার শালি হয়, তবু—। হঠাৎই লিটনের মনে হল সে মেয়েটাকে যতটা অসহায় বলে মনে করছে ততটা ও নয়। হয়ত সম্পূর্ণ উলটো। হয়ত গুরুকে ফাঁদে ফেলার জন্যে মেয়েটাকে ব্যবহার করছে কেউ! গুরুকে সাবধান করে দিতে হবে। এতটা পথ রাত্তিরবেলায় গুরুর পেছনে বাইকে বসে এসেছিল বলে গুরুর একটু দুর্বলতা হতেই পারে। কিন্তু সে নিজে কখনও কোনও মেয়ের শরীরের প্রতি দুর্বল হয়নি। অসহায় বলে সাহায্য করতে গিয়ে ধাক্কা খেলেও ওই বদনাম কেউ দিতে পারবে না। গুরুর সব ভাল, শুধু—।