» » কালোচিতার ফটোগ্রাফ

বর্ণাকার

লোকটার নাম রণতুঙ্গা। এত মোটা মানুষ জীবনে দেখেনি প্রদীপ। রিসেপশনে খবর দিতে ঘরেই ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। কোনওরকম ভনিতা না করে প্রদীপ তাকে সরাসরি বলল, ‘মিস্টার রণতুঙ্গা, আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেগুলো আমার চাই।’

মাংস এবং চর্বিতে লোকটার দুকান প্রায় ঢাকা। সেই অবস্থায় যেভাবে তাকাল তাকে অবাক হওয়া নিশ্চয়ই বলা চলে।

‘এখানে বুঝি চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায়?’

‘তার মানে?’

‘আমি তো অনেক কিছু চাইছি অথচ কিছুই পাচ্ছি না। একটা ক্যাসিনো নেই যে জুয়ো খেলব! এমনকী একটি ভাল মহিলা এসোকর্ট পর্যন্ত পাচ্ছি না। আর আপনি এসে যেই বললেন। ছবিগুলো চাই আর আমি দিয়ে দেব?’

প্রদীপ বুঝল লোকটা বোকা নয়। সে বলল, ‘ওই ছবিগুলো নিয়ে আপনি কী করবেন?’

‘যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।’

‘আপনি কটা ছবি তুলেছেন?’

‘তোলার সময় হিসেব করিনি। তাছাড়া আমার ফিল্ম এখনও শেষ হয়নি।’

‘আপনার পাশে আর এক ভদ্রলোক, খুব নামী ফটোগ্রাফার বসেছিলেন।’

‘কে বলেছে নামী ফটোগ্রাফার? লোকটা ক্যামেরার সি বোঝে না। ওর উচিত হটশটে ছবি তোলা। অ্যাপারচার লেন্স সম্পর্কে কোনও আইডিয়াই নেই।’

‘তাই নাকি?’

‘ইয়েস। আমি একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছি।’ রণতুঙ্গা বলল, ‘ভদ্রলোক ব্যবসাপত্তর করেন। কলকাতায় তো ছবিই তোলেন না।’

‘বাঙালি?’

‘হতে পারে। ড্রিমল্যাণ্ড না কি একটা হোটেলে উঠেছে।’

‘নামটা কী?’

‘জিজ্ঞাসা করিনি। ওরকম নির্বোধ ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।’ রণতুঙ্গার হঠাৎ খেয়াল হল, ‘আমার কথা আপনাকে কে বলল?’

‘আপনাদের বাসে এক বিদেশিনী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম লিসা। উনি বলছিলেন আপনার ক্যামেরা সেন্স খুব ভাল।’

‘বলছিল? অথচ আমি যখন কথা বলতে গেলাম তখন খেঁকিয়ে উঠল।’ গাল চুলকাল রণতুঙ্গা, ‘শুনুন মশাই, আপনি কি পুলিশের লোক?’

‘না। আমি একজন সাংবাদিক।’

‘তা হলে খুব ভালই হল। আমি যে ছবি তুলেছি, মানে আমার কাছে যে ওই ঘটনার ছবি আছে তা ভুলে যান। আমি জানি পুলিশ খবর পেলেই ফিল্মটা নিয়ে যাবে। আমিও ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে যাব। আমার আজ সকালেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। কাল ফিরে আসার সময় আমরা আলোচনা করেছিলাম পুলিশ জানতে পারলে এই ছবির জন্যে আমরা বিপদে পড়ব। আপনাকে বলছি, এই ছবি আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাই আমি।’

প্রদীপ হাসল, ‘আমাদের দেশের পুলিশের মাথা ঘামানোর মত বিষয় অনেক আছে, এটা একধরনের মানুষের কাছে খুব মূল্যবান হলেও আমাদের পুলিশ এ নিয়ে চিন্তিত হবে না।’

‘সে কি?’ রণতুঙ্গা অবাক হয়ে বলল।

‘হ্যাঁ। আমি আপনাকে একটা অফার করছি। ছবিগুলোর জন্যে শ-পাঁচেক দিতে পারি।’

‘অসম্ভব।’

প্রদীপের খুব ইচ্ছে করছিল এই সময় পিস্তলটা বের করতে। লোকটার গোল মুখের ওপর ওটা উঁচিয়ে ধরলে ফিল্ম না দিয়ে পার পাবে না। কিন্তু পরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারে। সে বাইকে চেপে এসেছে। হোটেল থেকে পুলিশে খবর দিলে ওঁরা তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। অতএব তাড়াহুড়ো নয়। ধীরস্থির হয়ে কাজটা করতে হবে।

প্রদীপ হাসল। ‘ঠিক আছে। তা হলে একটা সাহায্য করুন। আপনাদের বাসে তৃতীয় একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তার কথা মনে আছে?’

‘হ্যাঁ। লম্বা। খুব স্বাস্থ্য ভাল। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। নাম জানি না।’

‘কোন হোটেলে উঠেছেন?’

‘তাও জানি না। তবে লোকটা আজকেও একবার ওই স্পটে যাবে বলেছিল।’ বাইরে বেরিয়ে এল প্রদীপ। তারপর পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে রণতুঙ্গার কথা জানিয়ে দিল। এখন কেউ ফোন ধরেনি। আনসারিং মেশিন জানাল তিনি বাড়িতে নেই। প্রদীপ ঘটনাটা বলে আশ্বস্ত করল। পরে আর-একবার চেষ্টা করবে ছবি পেতে।

ড্রিমল্যাণ্ডে ফিরে প্রদীপ দেখল লিটন রিসেপশনের সামনে মুখ কালো করে বসে আছে। তাকে দেখে উঠে এল। ‘তুমি গুরু অবাক করলে!’

‘কেন?’

‘হোটেলে এসে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করতে বলল বেরিয়েছে। ঘরে যেতে চাইলাম কিন্তু ওরা চাবি দিল না। তুমি বলে যাওনি?’

‘সরি লিটন, একদম খেয়াল ছিল না।’ খারাপ লাগছিল প্রদীপের।

‘কিন্তু তোমার ঘরে নাকি একজন মহিলা আছে?’

‘মহিলা?’

‘তোমার সঙ্গে একই বাইকে এসেছে। তুমি মাইরি দার্জিলিং থেকে একা রওনা হলে, পথে আবার মহিলা জোটালে কোত্থেকে?’

‘জোটাইনি, নিজেই জুটে গিয়েছিল, কিন্তু এখন সে চলে গেছে।’ প্রদীপ রিসেপশনে গেল। ‘এক্সকিউজ মি, এক বাঙালি ভদ্রলোক, কলকাতায় থাকেন, ব্যবসা করেন, কোন রুমে আছেন বলুন তো?’

‘বাঙালি কোনও ভদ্রলোক তো এখন হোটেলে নেই স্যার।’

‘গতকাল ছিলেন?’

‘গতকাল? না স্যার।’

‘কলকাতার কোন বিজনেস ম্যান?’

‘হ্যাঁ। এসো. কে. শর্মা। উনি একটু আগে শিলিগুড়ি চলে গিয়েছেন।’

‘শিলিগুড়ি?’

‘হ্যাঁ। আজ সন্ধেবেলার দার্জিলিং মেলে ওঁর ফার্স্টক্লাসে রিজার্ভেশন করা আছে।’

প্ৰদীপ অসহায়ের মত তাকাল। লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন চেষ্টা করলে সে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে লোকটাকে ধরতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে গ্যাংটক ছেড়ে সে যায় কী করে? লিটনকে পাঠানো যায়। সে দূরে বসা লিটনের দিকে তাকাল। লিটন ইতিমধ্যে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। না, ওকে একা পাঠালে কাজ হাসিল না করতে পারলে গায়ের জোর দেখিয়ে ফেলতে পারে। তার চেয়ে দার্জিলিং-এ ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেই হয়। সে রিসেপশনিস্টকে বলল দার্জিলিং-এ একটা টেলিফোন করবে।