» » কালোচিতার ফটোগ্রাফ

বর্ণাকার

পনেরো মিনিট বাদে প্রদীপ যখন স্টেশনের পাশের রাস্তায় বাইক দাঁড় করাল তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। এতটা পথ মোটরবাইকে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। এপাশ ওপাশে তাকাতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল সুজাতা। তার দুই হাত বুকের ওপর। শীতে কাঁপছে সে। প্রদীপ ব্যাকসিটে রাখা ওভারকোট এগিয়ে দিল, ‘এটা পরে নাও। টুপি, মাফলার আছে ওখানে। চটপট।’

কৃতার্থ হয়ে আদেশ মান্য করল সুজাতা। তারপর বাইকের পিছনে উঠে বসল। দার্জিলিং ছাড়িয়ে বাইক এগিয়ে যাওয়া মাত্র সুজাতা ফিসফিস করে বলল, ‘পিস্তলটা নেবেন না?’

‘গ্যাংটকে পৌঁছবার পর নেওয়ার কথা।’

সুজাতা হাসল। তারপর বলল, ‘আপনি খুব ভাল।’

প্রদীপ জবাব দিল না। এ রকম তৈল মর্দন মানুষ কোনও বিপাকে পড়ে করে, সেটা তার জানা আছে।

দার্জিলিং থেকে তিস্তাবাজার হয়ে কালিম্পংকে ডানদিকে রেখে মধ্যরাত্রে গ্যাংটকের দিকে ছুটে যাওয়াটা মোটেই আরামদায়ক নয়। কিন্তু প্রদীপ যাবতীয় প্রাকৃতিক প্রতিরোধকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় ছিল। লিটনকে সঙ্গে না নিয়ে রওনা হওয়া ভুল হচ্ছিল সেটা কিছুটা দূর আসার পরই টের পেয়েছিল। এখন লিটনের বদলে সুজাতা পিছনে থাকায়, কোনও কথা না বলা সত্ত্বেও, তার মনে হচ্ছিল এই কষ্টকর যাত্রায় সে একা নেই। আর একটি মানুষের তপ্ত উপস্থিতি তাকে যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছিল।

পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধে ঘন হয়ে গেলে কেউ গাড়ি চালায় না। নিতান্ত বাধ্য না হলে কোনও গাড়িকে রাতদুপুরে এইসব পথে দেখা যায় না। একটানা যেতে-যেতে বাইক গরম হয়ে উঠেছে বেশ। প্রদীপ রাস্তার পাশে একটা সমান জায়গা পেয়ে বাইক দাঁড় করাল। নিচে পা দিতে গিয়ে বুঝতে পারল পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।

বাইক থেকে নেমে সুজাতা প্রথম কথা বলল, ‘এখানে কেন?’

‘ইনি বিশ্রাম চাইছেন।’ প্রদীপ পায়ে সাড় আনার চেষ্টা করছিল, ‘উঃ কী!’

‘পায়ে কী হয়েছে?’

‘বাঁ পা অবশ-অবশ লাগছে। এক নাগাড়ে—। ঠিক আছে।’

প্রদীপ সোজা হল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?’

‘লাগছে। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।’

‘এইভাবে এককথায় দার্জিলিং ছেড়ে চলে এলে, ওখানে কেউ চিন্তা করবে না?’

‘আমার জন্যে কেউ চিন্তা করে না।’

‘জামাইবাবু? দিদি?’

‘দিদি তো মুক্তি পাবে। জামাইবাবু’, হাসল সুজাতা, ‘আজকের আগে আমার দিকে ভাল করে কখনও তাকাননি। আজ যে আমার মাথায় কী ঢুকল!’

‘নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে!’

‘ঠিক বলেছেন।’

‘আমরা গ্যাংটকে পৌঁছে যাব ভোরের মধ্যে। ওইসময় পিসির বাড়িতে গেলে তিনি অবাক হবেন না? জানতে চাইবেন না কীভাবে এলে?’

‘সেটাই তো স্বাভাবিক। একটা কিছু উত্তর দিতে হবে।’

‘তুমি বিবাহিতা?’

‘একসময় ছিলাম। এখন নই।’

প্রদীপ আর কথা বাড়াল না।

ওরা গ্যাংটকে ঢুকল যখন তখন শহর ঘুমন্ত। ইতিমধ্যে আকাশের চেহারা বদল হয়েছে। সিকিমের আকাশে এখন গুঁড়ি-গুড়ি মেঘ। সূর্যদেবের ওঠার কোনও আয়োজনই নেই। রাস্তার আলোগুলো বুড়ি ডাইনির চোখ হয়ে জ্বলছে। প্রদীপ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় নামবে?’

‘আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন?’ গলা তুলতে হল সুজাতাকেও।

‘হোটেল ড্রিমল্যাণ্ড। বাড়ির কাছাকাছি না নামলে তোমার এখন একা হাঁটা ঠিক হবে না। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আলো ফুটলে পিসির বাড়িতে চলে যেও।’

‘আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?’

প্রদীপ জবাব দিল না।

হোটেল ড্রিমল্যাণ্ড কুলীন নয়। এর আগে দুবার গ্যাংটক এসে এখানেই উঠেছিল প্রদীপ। এই সময়ে কাউণ্টারে লোক থাকার কথা নয় কিন্তু কয়েকজন ট্যুরিস্ট সাইট সিয়িং-এ যাচ্ছে বলে হোটেলের কর্মচারী জেগেছিল। ওদের দেখে লোকটা অবাক, ‘আপনারা বাইকে করে এতটা রাস্তা এসেছেন? এই রাত্রে!’

প্রদীপ হেসে বলল, ‘ঘর হবে?’

‘সিওর। ডাবল বেড?’

লিটন আসবে দুপুরের আগেই। ওর জন্যে ব্যবস্থা রাখা দরকার।

প্রদীপ ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

লোকটি চাবি নিয়ে দোতলায় উঠে ঘর খুলে দিয়ে বলল, ‘পরে একসময় খাতাপত্তরের কাজ করে নেব। চা খাবেন?’

‘সিওর। সেইসঙ্গে কিছু স্ন্যাকস।’

লোকটা চলে গেলে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ডাবল বেড নিলেন কেন?’

এবার খেয়াল হল প্রদীপের। সুজাতা কি তাকে সন্দেহ করছে?

সে হাসল, ‘নিলাম।’

‘আপনি কী করে ভাবলেন এখানে আমি থাকব?’

‘সারারাত ধরে আমার বাইকের পিছনে বসে আসবে এটাও তো কখনও ভাবিনি।’

‘আমি যাচ্ছি।’

‘বসো। আমার এক বন্ধু আসবে সকালের বাসে, যে আমার সঙ্গে তোমার জামাইবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল। ব্যবস্থাটা তার জন্যে।’ প্রদীপ বাথরুমে চলে গেল। গরমজলের কল খুলে মুখে দিল খানিকটা। আঃ, আরাম। বাইকের সাইড ক্যারিয়ারে যে অ্যাটাচিটা রয়েছে সেটা আনিয়ে নিতে হবে। দুদিন চলে যাবে এমন সব কিছু তাতে ঠাসা আছে।

বাইরে বেরিয়ে এসে সে বলল, ‘তুমি তো এক বস্ত্রে এসেছ। এই মুহূর্তে আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। তবু মুখটা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’

এগিয়ে যাওয়ার সময় নিচু গলায় সুজাতা বলে গেল, ‘সরি।’

দুঃখিত হওয়াটা সন্দেহ প্রকাশের কারণে এটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করল প্রদীপ। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। চা এল। চা আর বিস্কুট। তাড়াতাড়ি সেগুলো শেষ করে একটা বিছানায় লম্বা হল প্রদীপ। ‘আমি আটটা পর্যন্ত ঘুমাব। ততক্ষণ কথা না বললে উপকার করা হবে।’

‘তা হলে এটা রাখুন।’ পিস্তলটা বের করে বিছানার ওপর রেখে সুজাতা বাথরুম চলে গেল।

সোওয়া আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙল প্রদীপের। বিছানায় শুয়েই বুঝতে পারল সুজাতা ঘরে নেই। ও চোখ বন্ধ করল। মেয়েদের সম্পর্কে তার কোনও উন্নাসিকতা নেই। ঠিকঠাক প্রেমে পড়ার মত কোনও মেয়ের দর্শন সে এখনও পর্যন্ত পায়নি। মেয়েরা এসেছে জীবনে কিন্তু তারা মেয়ে বলেই প্রেমে পড়তে হবে এমনটা কখনও মনে হয়নি। কেউ-কেউ এসে শরীরের স্বাদ দিয়ে চলে গেছে এবং এই কারণে তার কোনও পাপবোধ নেই। সেইসব মেয়েরা এসেছিল স্বেচ্ছায়, চলে যাওয়ার ব্যবস্থা রেখে। আজ দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকের দীর্ঘপথটা যে মেয়ে পাড়ি দিয়ে এল তার পেছনে বসে, এই হোটেলের বন্ধ ঘরে শুয়ে রইল পাশের বিছানায় সে নিশ্চয়ই তাকে এখন সাধু-সন্ন্যাসী ভাবছে।

প্রদীপ উঠল। এবং তখনই চোখে পড়ল পাশের বিছানার ওপর তার এনে দেওয়া ওভারকোট মাফলার এবং টুপি পড়ে আছে। সে বাথরুমের দরজা খুলে দেখল সেখানেও সুজাতা নেই। সে ওকে শহরে ঢোকার সময় বলেছিল আলো ফুটলে চলে যেতে। সেইমত কাজ করেছে মেয়েটা। শুধু যাওয়ার সময় বলে যেতে পারত। প্রদীপ হাসল, সে নিজেই তো বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিল।

সাড়ে আটটা নাগাদ প্রদীপ পথে নামল। বাইক নিয়ে সোজা চলে এল বাজারের কাছে যেখানে পরপর ট্যুরিস্ট অফিসগুলো রয়েছে। বেশিরভাগ বাস ইতিমধ্যে ট্যুরিস্টদের দ্রষ্টব্য জায়গা দেখাতে চলে গিয়েছে। কিছু বাস তৈরি হচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক ধরে একের পর এক অফিসে ঘুরে প্রদীপ দেখল কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না। কোনও অফিসই বলতে পারছে না কাল সিকিম-তিব্বত বর্ডারে কোন বাস গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রেজিস্টার্ড ট্যুরিস্ট কোম্পানি ছাড়াও বেশ কিছু সংস্থা মিনিবাসে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ওদিকে বেড়াতে যায়। নবম অফিস থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে প্রদীপ যখন ভাবছে কী করা যায় তখন তার মনে পড়ে গেল। যে বাসটা গতকাল ওদিকে গিয়েছিল তার যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ডদের মেটিং দেখেছে। তিনজন ট্যুরিস্ট তার ছবি তুলেছে। এমন বিচিত্র ঘটনার কথা শহরে ফিরে এসে কেউ আলোচনা করবে না এমন হতেই পারে না।

সামনে দাঁড়ানো একটা বাসের দিকে তাকাল সে। কয়েকজন যাত্রী উঠেছে। ড্রাইভার নিচে দাঁড়িয়ে। সে এগিয়ে গেল, ‘আচ্ছা, ব্ল্যাক লেপার্ড দেখা যায় বলে শুনেছি। কোন বাসে গেলে দেখার সুযোগ পাব বলতে পারেন?’

লোকটা অবাক চোখে তাকাল, ‘ব্ল্যাক লেপার্ড?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আমি তো এ জীবনে দেখিনি। দেখা যায় কে বলল আপনাকে?’

‘কালই একটা ট্যুরিস্টবাসের সবাই দেখেছে। টিবেটিয়ান বর্ডারের কাছাকাছি।’

‘আমি তো শুনিনি। আপনাকে কি কমলাপ্রসাদ বলেছে এই গল্পটা?’

‘না। কমলাপ্রসাদ কে?’

‘ড্রাইভার। হিমালয়ান ট্যুরিজমের বাস চালায়। ওর কথায় কান দেবেন না। দিনকে রাত করার মত মিথ্যে কথা ওর জিভে। একদিন তো এসে বলেছিল ইয়েতির বাচ্চাকে দেখেছিল। বেচারা নাকি পথ হারিয়ে কাঁদছিল। হাঃ হাঃ হাঃ।’

গল্পটা গল্পই হতে পারে। কিন্তু ড্রাইভার কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনে খবর দিয়ে গিয়েছিল। সেই পুলিশ স্টেশনের খাতায় নিশ্চয়ই ড্রাইভারের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর মিথ্যে হলে লোকটা পুলিশকে কি ভাওঁতা দেবার মত সাহস পাবে?

হিমালয়ান ট্যুরিজমের অফিসে ঢুকে পড়ল প্রদীপ। টেবিলের ওপাশে একটি মাঝবয়সি সুন্দরী সিকিমিজ মহিলা কাগজপত্র দেখছিলেন, মুখ তুলে হাসলেন, ‘গুডমর্নিং।’

‘গুডমর্নিং। বসতে পারি?’

‘সিওর। বলুন, আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?’

ভদ্রমহিলা এখন একা অথচ আমরা শব্দটি ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ ইনি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। প্রদীপ হাসল, ‘ম্যাডাম, আপনার গলার হার একটু অদ্ভুত রকমের। কিছু মনে করবেন না, ওগুলো কি নীলমুক্তো?’

মহিলা এবার ছড়িয়ে হাসলেন, ‘আপনার চোখ দেখছি জহুরির।’

‘ধন্যবাদ। আপনাদের সংস্থায় কমলাপ্রসাদ নামে কোনও ড্রাইভার আছে?’

‘কেন বলুন তো?’

‘আমি শুনলাম গতকাল কমলাপ্রসাদ যে বাস নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন সেই বাসের যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছেন। ব্ল্যাক লেপার্ড ভারতবর্ষে দেখতে পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করেছে।’

‘কমলাপ্রসাদ ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছে? কই আমরা তো একথা জানি না। এমন একটা খবর চেপে রাখার লোক ও নয়।’

‘আপনি ওর ঠিকানাটা দিতে পারেন?’

প্রদীপ প্রশ্ন করতেই একটা রোগা বেঁটে লোককে অফিসে ঢুকতে দেখা গেল। ভদ্রমহিলা হাসলেন, ‘কমলাপ্রসাদ, কালকে তুমি ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছ?’

‘কালকে দেখিনি।’

‘কবে দেখেছিলে?’

‘মাসখানেক আগে। সিনেমায়। প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখি।’

‘এই ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

কমলাপ্রসাদ প্রদীপের দিকে তাকাল। প্রদীপ হাসল, ‘আমার নাম প্রদীপ গুরুং। গতকাল আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে ট্যুরিস্টদের নিয়ে গিয়েছিলেন?’

‘জী হ্যাঁ।’

‘ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখার পর পুলিশ স্টেশনে জানিয়েছিলেন?’

কমলাপ্রসাদ হেসে উঠল শব্দ করে, ‘লোকে বলে আমি গল্প বানাই। কিন্তু আমাকে নিয়ে যে গল্প বানাতে পারে সে তো আরও বড় গুলবাজ।’

প্রদীপ হতাশ হল, ‘আপনি কিছু দেখেননি?’

‘না স্যার। দেখে থাকলে সেটা অফিসে এসে জানাতাম। না দেখে-দেখে গল্প বানিয়ে এখন আমি ক্লান্ত। সত্যি যদি দেখার মত কিছু পেতাম, সেটা ব্ল্যাক লেপার্ড হোক অথবা ইয়েতি হোক, আমার চেয়ে খুশি কেউ হত না।’

‘আপনি গতকাল কোন রুটে গিয়েছেন?’

কমলাপ্রসাদ দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপটার দিকে তাকাল। একটা স্কেল টেবিল থেকে তুলে সে দেখাল গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে কোন-কোন রাস্তায় সে বাস নিয়ে ঘুরেছে। প্রদীপ উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল।

‘সিকিম-টিবেট বর্ডারটা কোনদিকে?’

‘এদিকে।’ স্কেল সরাল কমলাপ্রসাদ।

‘ওদিকে আপনাদের কোনও বাস গিয়েছিল?’

‘না। ওখানে সাধারণত এভারেস্ট ট্যুরিজমের বাস যায়।’

‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

এভারেস্ট ট্যুরিজমের অফিসে পৌঁছে প্রদীপ দেখল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। সরাসরি প্রশ্ন না করে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ আপনাদের কোনও বাস তিব্বত বর্ডারে যাবে?’

‘না।’

‘গতকাল গিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘গতকাল যিনি বাসটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

‘কেন বলুন তো?’

‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত।’

‘তা ব্যক্তিগত ব্যাপার যখন তখন অফিসে এসেছেন কেন? চন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে দেখা করুন। যত্তসব ঝুটঝামেলা।’

‘চন্দ্রনাথের বাড়িটা কোথায়?’

‘জিজ্ঞাসা করে নিন। বাইরে অনেক লোক আছে তাদের জিজ্ঞাসা করুন।’ লোকটা খেঁকিয়ে উঠল। প্রদীপের মনে হল এই চন্দ্রনাথের সঙ্গে লোকটির সম্পর্ক নিশ্চয়ই ভাল নয়। বাইরে বেরিয়ে আড্ডারত কিছু লোকের কাছে সে চন্দ্রনাথের খবর পেয়ে গেল। এখন এ সময় নাকি চন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকার লোক নয়। তাকে পাওয়া যাবে হংলুর ভাটিখানায়। জায়গাটা কোথায় জেনে নিয়ে বাইকে উঠে বসল প্রদীপ। লোকটা যদি মাতাল হয় তা হলে গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

হংলুর ভাটিখানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। এই সকাল পার হতে-না-হতেই সেখানে মাতালদের ভিড় জমে গেছে। প্রশ্ন করে করে চন্দ্রনাথের সামনে যখন পৌঁছল তখন নেশায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। লোকটার স্বাস্থ্য এখনও ভাল। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। মুখে খোঁচা দাড়ি দাঁড়িয়ে।

প্রদীপ ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ক’গ্লাস খেয়েছেন?’

চোখ না খুলে চন্দ্রনাথ জবাব দিল, ‘এই প্রশ্নের জবাব আমি আমার বউকেও দিই না। তুমি কে?’

‘আমি আপনার খোঁজে এভারেস্ট ট্যুরিজমে গিয়েছিলাম। বুড়োটা খুব খারাপ ব্যবহার করল!’

‘করবেই! শালা আমাকে সহ্য করতে পারে না। গতকাল ফিরে এসে যেই বলেছি আজ আর বেরুতে পারব না অমনি ওর মেজাজ খারাপ হয়েছে। কেন রে শালা, আমি কি তোর বাপের চাকর যে রোজ-রোজ গাড়ি চালাব?’ চোখ খুলে মাথা নাড়ল চন্দ্রনাথ।

‘ঠিক কথা।’

‘কিন্তু ভাই, আমার খোঁজে কেন?’

প্রদীপ বুঝল লোকটার মাথা পরিষ্কার আছে এখনও। সে বলল, ‘কাল আপনি বাস নিয়ে বর্ডারের দিকে গিয়েছিলেন?’

‘গিয়েছিলাম। কিন্তু ও ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। পুলিশ?’

‘না। আমি পুলিশ নই। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি কিছু জানেন না। কিন্তু আপনার বাসে তিনজন ট্যুরিস্ট ছিল যারা ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। তাদের চেনেন?’

‘যাচ্চলে। কত লোক রোজ গ্যাংটকে বেড়াতে আসছে। তারা টিকিট কেটে বাসে ওঠে। আমি সেই বাস নিয়ে এখানে ওখানে যাই। তারা কে কী করে আমি চিনব কী করে?’

‘ঠিক কথা। তবু মনে করে দেখুন, কিছু মনে পড়ে কি না।’ প্রদীপ একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে চন্দ্রনাথের সামনে রাখল। বাঁ-হাতে নোটটা তুলে নিয়ে চন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করল, ‘ক্যামেরা কার কার হাতে ছিল এখন মনে নেই। বিকেলে গ্যাংটকে ফিরে এসে যে যার হোটেলে চলে গেল। তবে একজন লোক খুব মোটা ছিল। আড়াইজন মানুষের মত মোটা। অথচ মাথাটা ছিল আপেলের মত গোল। বাস থেকে নেমে লোকটা একজনকে জিজ্ঞাসা করছিল হলিডে হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটার কথা। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আসতে পারল অথচ যেতে পারছে না কেন?’

‘ওই লোকটা ছাড়া আর কেউ?’

‘একটা বিদেশি বুড়ি ছিল। খুব বকবক করছিল! ওই বুড়িই আমাকে বলেছিল থানায় খবর দিতে। ওখানে তো থানা নেই, একটা পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিয়ে এসেছিলাম।’

‘ওই বুড়ি কোন দেশের?’

‘তা বলতে পারব না। বিদেশিনীদের আমার একরকম লাগে। তবে বুড়ি উঠেছে ট্যুরিস্ট লজে। কারণ ফেরার সময় ওই লজের সামনে ওঁকে নামিয়েছি।’ চন্দ্রনাথ বলল।

‘আপনার বাসে কাল কজন যাত্রী ছিল?’

‘আটজন।’

রাস্তায় বেরিয়ে প্রদীপ নিজের বাইকের গায়ে হাত বোলাল। দুটো নাম পাওয়া গেল। বুড়ি ক্যামেরায় ছবি না তুললেও ক্যামেরাম্যানদের হদিশ দিতে পারেন। যারা সবসময়ে টিকটিক করেন তারা অনেক কিছু মনে রাখেন। সে সোজা ট্যুরিস্ট লজে চলে এল।

ভদ্রমহিলা ঘরে ছিলেন। নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে রিসেপশনে পরিচয় দিয়ে সে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। রিসেপশন ভদ্রমহিলাকে সেকথা জানাতে তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। লাউঞ্জে চেয়ার সাজানো। তার একটায় বসল প্রদীপ। এখন ঘড়িতে যে সময় তাতে লিটনের ইতিমধ্যে এসে যাওয়ার কথা। কাজ প্রথম দিকে মোটেই এগোচ্ছিল না। কিন্তু চন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মনে হচ্ছে আজ বিকেলেই দার্জিলিং-এ ফিরে যেতে সে পারবে। তারপর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে সোজা হোমে চলে যাবে। অবশ্য যদি লোকটা টাকা দিতে ঝামেলা করে তাহলে মুশকিল। সে ঠিক করল ছবিগুলো লিটনের কাছে রেখে সে আগে বাংলোয় গিয়ে দেখা করবে। লোকটা যদি দুনম্বরি করে তা হলে জীবনে ছবি পাবে না। প্রদীপ দেখতে পেল এক মধ্যবয়সিনী বিদেশিনী এদিক ওদিক তাকাতে-তাকাতে এগিয়ে আসছেন। মহিলার পরনে সাদার ওপর নীল বৃত্ত আঁকা সাধারণ গাউন।

প্রদীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যালো।’

ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট নয়, দশ। মুখের চামড়া শুধু বলছে ওঁর বয়স হয়েছে কিন্তু শরীর এখনও মজবুত, ‘ইয়েস?’

প্রদীপ বলল, ‘আমার নাম প্রদীপ গুরুং। আমি একজন সাংবাদিক।’

‘ও। এতক্ষণে খবরটা পেয়েছেন? বসুন-বসুন। আমার নাম লিসা।’ ভদ্রমহিলা বসলেন। কিন্তু ওঁর মুখ আবার চলতে শুরু করল, ‘এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, পুলিশকেও জানানো হল কিন্তু কেউ যে মাথা ঘামাচ্ছে তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। আসলে, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের দেশের ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না।’

‘আপনি কতদিন আছেন এখানে?’

‘কালই চলে যাব। একা-একা এখানে যে কী বোরিং ব্যাপার। সময় কাটাবার কোনও ব্যবস্থাই নেই। অথচ কাঠমাণ্ডুতে কিন্তু অন্য আবহাওয়া।’

‘ম্যাডাম, গতকাল আপনি ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন?’

‘কপাল খারাপ। আমার ক্যামেরাটা হঠাই বিগড়ে গিয়েছিল। নইলে ক্যামেরা ছাড়া আমি কোথাও এক পা যাই না। খুব দামি ক্যামেরা বলে এখানে সারাতে দিতে চাই না।’

‘আপনার বাসে তিনজন লোকের হাতে ক্যামেরা ছিল। তাদের মনে আছে?’

‘না। আমি তো সহযাত্রীদের দেখব বলে এখানে আসিনি। বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির এত কিছু দেখার জিনিস ছেড়ে সহযাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব তেমন বয়স আমার নেই। তবু ওই লোকটা খুব বিরক্ত করছিল।’

‘কোন লোকটা?’

‘তোমাকে কী বলব। অনেক মোটা মানুষ আমি দেখেছি কিন্তু অমন মোটা কখনও দেখিনি। উঃ। শুনেছিলাম বেশি মোটা হয়ে গেলে মানুষের মন থেকে কুচিন্তা চলে যায়। এর তো পুরোমাত্রায় আছে। ও ছবি তুলেছিল। আর পাশের লোকটাকে অনবরত ক্যামেরা সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছিল।’

‘সেই লোকটা কেমন?’

‘আমি লক্ষ করিনি। একে মনে আছে কারণ ওই চেহারা আর দ্বিতীয়ত আমাকে ডিনার খাওয়াতে চেয়েছিল বলে।’

‘আপনি একাই এসেছেন ম্যাডাম?’

‘নিশ্চয়ই। সারা পৃথিবী একা ঘুরে বেড়াই আমি।’

‘অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম।’ প্রদীপ উঠে পড়ল।

‘পুলিশ কোনও অ্যাকশন নিয়েছে?’

‘না। স্পটে গিয়ে পুলিশ কিছুই দেখতে পায়নি।’

‘তা পাবে কী করে? এমন অলস মানুষ আমি কখনও দেখিনি।’

বাইরে বেরিয়ে এসে একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে এসো টি ডি করল প্রদীপ। প্রথমবারেই লাইন পাওয়া গেল। এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে তিনিই রিসিভার তুললেন। ‘স্যার আমি গ্যাংটক থেকে বলছি।’

‘বুঝেছি।’

‘আমি ট্যুরিস্টবাসটাকে খুঁজে বের করেছি।’

‘গুড।’

‘একজন ফটোগ্রাফারের হদিশ পেয়েছি। তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’

‘হু ইজ হি?’

‘এখনও নাম জানি না। ড্রাইভারের কাছে জানতে পেরেছি।’

‘ড্রাইভার কে?’

‘চন্দ্রনাথ লোকটার নাম। এভারেস্ট ট্যুরিজমের গাড়ি।’

‘ঠিক আছে। ক্যারি অন।’