মতিলাল তার বিছানায় শুয়েছিল। আজকের বিকেলের ঘটনার পর থেকে ওর কেবলই মনে হচ্ছিল বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই। স্বামী হয়ে স্ত্রীকে কণ্ট্রোল করতে পারেনি সেটা এক জিনিস, অনেকেই পারে না। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় অনেকের। কিন্তু চোখের সামনে অন্য পুরুষের হাতে মার খেয়ে সুভদ্রা যেভাবে কেঁচো হয়ে গেল তা দেখার পর বেঁচে থেকে কী লাভ। মার খাওয়ার পর সুভদ্রা যদি চিৎকার করে তার সাহায্য চাইত তা হলে সে ছুটে যেত। তা না করে ও ওই লোকটার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করল–এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। সামনের মাস থেকে একটা পয়সাও দেবে না সুভদ্রাকে। সুভদ্রা যদি এখানে এসে ঝগড়া করে তা হলে সে হাত চালাবে। জীবনে কখনও মেয়েমানুষের শরীরে হাত তোলেনি সে, এবার তুলবে। ওই মেয়েকে বাঁচাবার জন্যে সে আগবাড়িয়ে গিয়েছিল বলে এখন আফসোস হচ্ছিল। এই সময় দরজায় শব্দ হল।
দরজা খুলতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু দ্বিতীয়বারের শব্দের সময় চাপা নারীকণ্ঠ কানে এল। অতএব উঠতে হল মতিলালকে। দরজা খুলতে ছিটকে ভেতরে চলে এল সুজাতা। মতিলাল দেখে পুলকিত হল। ওর কাঁধে সেই তিব্বতি ব্যাগ। ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে সুজাতা বলল, ‘এম্মা! কী করে রেখেছ তুমি? ঘরটা যে নরক হয়ে উঠেছে।’
মতিলাল বলল, ‘তাতে কার কী?’
সুজাতা তার শরীর থেকে চাদরটা খুলে টেবিলের ওপর রাখল। ব্যাগটা চাদরের ওপর। মতিলাল দেখল মেয়েটা একটা আঁটো ব্লাউজ ছাড়া কিছু পরেনি।
‘তোমার ঠাণ্ডা লাগে না?’
সুজাতা নিজের শরীরের দিকে তাকাল, ‘ওমা! তোমার এসোব নজরে পড়ে নাকি! শোনো, দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে আমাকে জব্দ করতে যাকে ডেকে এনেছিলি তার কাছে যা। আমি বললাম, যাওয়ার হলে যাব। শুনে বলল, গিয়ে দ্যাখ না। একটা কাঠের পুতুল ছাড়া কিছু না। মেয়েমানুষ আর পাশবালিশের কোনও তফাত বোঝে না। তাই নাকি?’
মতিলাল জবাব দিল না। কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র সুভদ্রা সম্পর্কে তার বিদ্বেষ বাড়ছিল। সে নিজের ঘরে চলে গেল। তার খুব আফসোস হচ্ছিল। আজ দুপুরেও যদি সে সুভদ্রাকে প্রহার করত তা হলে সন্ধেবেলায় ওই দৃশ্য দেখতে হত না।
সুজাতা চলে এল তার শোওয়ার ঘরের দরজায়, ‘কী হল, বাক্যি নেই কেন?’
‘ব্যাগটা এখানে আনো।’
‘ব্যাগে কী ছিল?’
‘সেটা আমি বুঝব।’
‘চিনি, চা আর–!’
মতিলাল তাকাল। নিশ্চয়ই দেখেছে সুজাতা। আর দেখেছে বলে আপনির বদলে তুমি তুমি করে কথা বলছে। সে নিশ্বাস চেপে বলল, ‘আর?’
‘পিস্তল। গুলিভরা পিস্তল। দিদি তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার কাছে পিস্তল কেন? দিদিকে মারবে বলে?’
‘সেটা পারলে খুশি হতাম।’
‘তুমি খুব হিংসেয় জ্বলছ। তার মানে তুমি দিদিকে ভালবাস।’
‘পিস্তলটা কোথায়?’
সুজাতা চলে গেল ওঘরে। ফিরে এল পিস্তল হাতে, কিন্তু দিল না। না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে তোমার খারাপ লাগে?’
‘আমি জানি না।’
‘এখন থেকে আমি এখানে থাকব।’
‘কেন?’
‘আমার ইচ্ছে তাই। তুমি খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’ মিথ্যে কথা বলল।
পিস্তলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে চোখের আড়াল হল সুজাতা। চট করে ওটাকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে আনল মতিলাল। না। মানুষ খুন করতে পারবে না সে। কিন্তু বদলা নিতে হবে। কীভাবে বদলা নেওয়া যায়? পিস্তলটাকে একটা খালি জুতোর বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল সে। এবং তখনই ভুটানি মদের বোতল হাতে সুজাতা ফিরে এল, ‘এই হুইস্কি তুমি খাও?’
‘না।’
‘তা হলে রেখেছ কেন?’
‘একজন দিয়েছিল তাই এনেছিলাম।’
গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে কাঁচা খেল সুজাতা, ‘বড্ড কড়া!’
‘জল ছাড়া খাচ্ছ!’
‘তুমি খাও।’
‘না।’
‘আমার দিব্যি, একটু খাও।’
সুজাতার মুখের দিকে তাকিয়ে মতিলালের হঠাৎ যেন অন্যরকম লাগল। সে সুজাতার বাড়ানো গ্লাসটা নিয়ে মুখে ঢালল। সঙ্গে-সঙ্গে কান গরম, গলা জ্বলতে লাগল। প্রথম ধাক্কা কমে গেলে শরীরে যেন আগুন ছড়াল। সুজাতা দ্বিতীয়বার গ্লাসে ঢেলে নিজের গলায় ঢালল। ঢেলে আর-এক পেগ এগিয়ে দিল। মতিলাল বলল, ‘না। আর না।’
‘কেন?’
‘আমার অভ্যেস নেই।’
‘কী হবে খেলে? বাড়িতেই তো আছ। আমি আছি।’
অতএব দ্বিতীয় গ্লাস মুখে ঢালল মতিলাল। তার শরীরে এখন গরম বাতাস পাক খাচ্ছে। গ্লাস-বোতল একপাশে সরিয়ে রেখে সুজাতা জামার বোতামে হাত দিল। একটু বাদে মতিলালের মনে হল এমন পেলব নারী-শরীর সে কখনও দেখেনি। দু-হাতে সুজাতাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল সে। সুজাতা বলল, ‘আঃ আস্তে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
সমস্ত শরীরে ঝড়। বিছানায় দুটো শরীর যখন পরস্পরকে জানতে-জানতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সুজাতা বলল, ‘দিদি মিথ্যে কথা বলেছে।’
‘ও মিথ্যুক।’
‘তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’ দু-হাতে মতিলালকে আঁকড়ে ধরেছিল সুজাতা।
‘আমি বদলা নেব।’
‘কীসের বদলা?’
উত্তর দিতে পারল না মতিলাল। উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাড়িটাকে চমকে দিয়ে বাইরের দরজার বেলের বোতাম টিপল কেউ। শব্দটা মতিলালের নার্ভে আঘাত করতেই সমস্ত উত্তেজনা উধাও। সুজাতা নিচুস্বরে বলল, ‘বাজাক। মনে হচ্ছে দিদি এসেছে।’
‘ও না।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘ও এভাবে বেল বাজায় না।’
‘বাব্বা! বেল বাজানোর আওয়াজেও মানুষ চিনতে পারো নাকি তুমি। যাও, দ্যাখো।’ সুজাতা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ওর উন্মুক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না মতিলালের। অনেক-অনেক দিনের পর সে যেন এক নতুন স্বাদ পাচ্ছিল একটু আগে। যে স্বাদ সুভদ্রা তাকে এক মুহূর্তের জন্যে কখনও দেয়নি।
নিজেকে ভদ্রস্থ করে দরজা খুলতেই দুটো লোককে দেখতে পেল মতিলাল। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে বেশ হ্যাণ্ডসাম, সিনেমার নায়কের মত দেখতে। পিছনের লোকটা বেঁটে কিন্তু বোঝা যায় শক্তিশালী। বাড়ির সামনে একটা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে আছে।
মতিলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘কী চাই?’
‘আপনার নাম মতিলাল?’ সামনের লোকটি জিজ্ঞাসা করল।
‘জি হ্যাঁ।’
‘ভেতরে আসতে পারি?’
‘কিন্তু আমি যে এখন খুব ব্যস্ত।’
‘এদিকে আমার যে সময় নেই। আমাকে এখনই গ্যাংটকে যেতে হবে।’
‘গ্যাংটকে? এত রাত্রে?’
‘সেটা আমার সমস্যা।’
‘ও। আসুন। তাড়াতাড়ি বলবেন যা বলার।’
প্রদীপ এবং লিটন ঘরে ঢুকল। চারপাশে তাকিয়ে প্রদীপ একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। মতিলাল বুঝতে পারছিল না এদের মতলব। তার মন পড়ে আছে পাশের ঘরে। সেখানে শুয়ে থাকা সুজাতা নিশ্চয় কথাবার্তা শুনে পোশাক পরে নিয়েছে। লোক দুটো আর সময় পেল না এখানে আসার।
‘হ্যাঁ, বলুন!’ মতিলাল বিরক্ত প্রকাশ করল।
‘মতিলালজী। আজ সকালে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত। সেই সময় আপনাকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম যার ফলে আপনার এবং আমার, দুজনের হাত থেকে কিছু জিনিস পড়ে যায়। এখন অনুগ্রহ করে যদি আমার জিনিসটা আমাকে ফেরত দিয়ে দেন তা হলে চলে যাই।’ প্রদীপ শান্ত গলায় বলল।
‘কী জিনিস পড়ে গিয়েছিল?’ মতিলালের বুকে ড্রাম বাজতে লাগল। তার চেহারাটা মনে পড়ল। ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসা যুবকটি যে তার সামনে বসে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রদীপ উঠল। হাঁটতে হাঁটতে ঘরটা দেখল। মতিলালের চোখ তার ওপর ঘুরছিল।
প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি আপনার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে চাই। পিস্তলটা কোথায়?’
অস্বীকার করতে গিয়েও পারল না মতিলাল ‘পিস্তলটা যে আপনার তার প্রমাণ কী?’
এই সময় লিটন বলে উঠল, ‘এ তো আজব চিড়িয়া। তোমাকে এখনও চেনেনি গুরু।’
প্রদীপ হাসল, ‘প্রমাণ লোকে কোর্টে দেয়। শুনুন। আপনি একজন সাধারণ মানুষ। খবর পেলাম আপানর বউ পালিয়ে অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে। পিস্তল নিয়ে আপনি কী করতে পারবেন? তার চেয়ে আমার জিনিস আমাকে দিয়ে দিন।’
‘ওটা আমার কাছে আছে তা আপনাকে কে বলল?’
‘শানবাহাদুর। এখন সে মাতাল হয়ে পড়ে আছে।’
ঠিক তখনই শোয়ার ঘরের দরজায় এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সুজাতা। যতটা পোশাক সংক্ষিপ্তভাবে পরে নেওয়া সম্ভব তাই পরেছে সে। প্রদীপ দেখল মেয়েটাকে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তেমন নয় কিন্তু মেয়েটার শরীর আছে আর সেটাকে ব্যবহার করতে জানে।
‘আমার এই বাড়িতে পুলিশ সার্চ করে গেছে, কিছু পায়নি।’
‘পুলিশ যাতে না পায় সেই ব্যবস্থা আপনি করেছিলেন। ওটা যে পুলিশের হাতে পৌঁছয়নি। সেইজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। তার জন্যে কত টাকা দিতে হবে?’
লিটন চাপা গলায় বলল, ‘বস, সময় নষ্ট করছ।’
পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে টেবিলে রাখল প্রদীপ, ‘দিন।’
মতিলাল আর পারল না। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, ‘সুজাতা, ভেতরের ঘরে খাটের নিচে জুতোর বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে ওকে দিয়ে দাও। ঝমেলা চুকে যাক।’
সুজাতা ঘরে ঢুকে যাওয়া মাত্র বাইরে গাড়ির শব্দ এবং হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে থাপা কয়েকজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। প্রদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি এখানে?’
থাপা দু’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে এত বোকা বলে ভাবিনি প্রদীপ। পিস্তলটার খোঁজে এখানে আসার আগে তোমার চিন্তা করার দরকার ছিল। আমার হাতে এতদিন কোনও প্রমাণ না থাকায় তোমাকে ছুঁতে পারিনি। আজ তুমি ফেঁসে গেলে।’
‘আপনি আজ কী প্রমাণ পেয়েছেন?’
‘ওকে সার্চ করো।’ থাপা হুকুম দিতেই সেপাইরা এসে প্রদীপের শরীর হাতড়ে দেখল। লিটনকেও বাদ দিল না তারা। ওরা কিছু না পেতে থাপা মতিলালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘আজ তোর হাড় ভাঙব আমি। যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব ঠিকঠাক দিবি। ও পিস্তলের খোঁজে এখানে এসেছে, তাই তো?’
মতিলালকে এখন হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল। কোনওরকমে মাথা নাড়ল সে, ‘হ্যাঁ।’ থাপার মুখে হাসি ফুটল, ‘গুড। পিস্তলটা দিয়েছ ওকে?’ চুপ করে রইল মতিলাল। থাপা চিৎকার করল, ‘কথা বল!’
‘না। দিইনি।’ মতিলাল শোওয়ার ঘরের দরজার দিকে তাকাল।
সেখানে কেউ নেই।
‘কোথায় রেখেছ ওটাকে?’
‘আমি রাখিনি।’
‘কে রেখেছে? বাঁচতে চাও তো সত্যি কথা বলো।’
‘আমি জানি না। কিছু জানি না।’
থাপার নজরে পড়ল কিছু টাকা সামনে পড়ে আছে। নোটগুলো তুলে সে গুনল, দুশো। এইসময় প্রদীপ বলল, ‘আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন স্যার।’
‘সেটা আমি বুঝব। তোমাদের এই জুড়িকে যদি হাজতে ঢোকাতে পারি–! এই টাকা কি তুমি দিয়েছ ওকে?’
‘আপনি তো পিস্তল খুঁজতে এসেছেন। টাকার খোঁজ নিয়ে আপনি কী করবেন?’
কিছু বলতে গিয়ে থাপা চুপ করে গেল। তার চোখ মতিলালের ওপর। মতিলাল যেন অনেকক্ষণ থেকে বিপরীত দরজায় দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করার চেষ্টা করছে। থাপা চটপট শোওয়ার ঘরের দরজায় পৌঁছে গেল। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘এই জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কে ছিল এই ঘরে?’
খ্যাপা মোষের মত বেরিয়ে এল থাপা, ‘এই ঘরে মেয়েছেলে ছিল। মেয়েদের পোশাক পড়ে আছে বিছানার ওপর। কে ছিল?’
‘আমার–আমার–।’ মতিলাল ঢোঁক গিলল।
‘তোমার বউ?’ থাপা ধমকে উঠল।
‘না স্যার। বউ না। বউ-এর বোন!’
‘ও বাব্বা। শালির সঙ্গে লীলা করছিলে নাকি? অনেক গুণ আছে দেখছি। কিন্তু জানলা দিয়ে শালি পালাল কেন? পিস্তলটা ওই নিয়ে গেছে?’
‘আমি জানি না স্যার, কিছু জানি না।’
থাপাকে এখন কিংবর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছে। প্রদীপ এগিয়ে গেল, ‘স্যার, আপনি যে কাজটা পাইয়ে দিয়েছেন সেটা করতে হলে আমাকে এখনই গ্যাংটকে রওনা হতে হয়। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি পিস্তলটা পাইনি।’
কথাগুলো কানে গেল না যেন থাপার। মতিলালের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘তোমার শালিকে আমি আজ রাত্রেই তুলে আনছি। তারপর তোমাদের মজা দেখাব।’
প্রায় ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল থাপা তার দলবল নিয়ে। লিটন এতক্ষণ একপাশে সিঁটিয়ে ছিল, এবার বলল, ‘চলো গুরু, কেটে পড়ি।’
প্ৰদীপ মতিলালের দিকে তাকাল। মতিলাল এখন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। ওর শরীর কাঁপছে। প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কী হল?’
‘আমি বুঝতে পারছি না। ও কেন পালাল?’
‘পালিয়ে দার্জিলিং-এর কোথাও থাপার হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না।’ প্রদীপ ঘুরে দাঁড়াল, ‘টাকাটা রইল। যদি পিস্তলটা আপনার হাতে আসে তাহলে ফিরে এসে ওটা নেব আমি।’
বাইরে বেরিয়ে এল সে, পিছনে লিটন।
এখন বেশ ঠাণ্ডা। আকাশ পরিষ্কার। অন্ধকার রাস্তায় মানুষজন নেই। লিটন বলল, ‘শালা বহুৎ হারামি। আমি বদলা নেব।’
‘কার কথা বলছিস?’
‘শানবাহাদুর। ভাবলাম নেশার ঘোরে কথা বলছে, আউট হয়ে গেল। পয়সা দিলাম তবু আমরা চলে আসার পরেই পুলিশকে খবরটা দিয়েছে।’
‘ছুঁচো মেরে এখন লাভ নেই। গ্যাংটকে পিস্তলটা সঙ্গে থাকলে ভাল হত।’ মোটরবাইকে উঠে পড়ল সে, ‘কাল সকালের ফার্স্ট বাস ধরে গ্যাংটকে চলে আসবি, হোটেল ড্রিমল্যাণ্ডে গিয়ে খবর নিবি।’ ইঞ্জিন চালু করল প্রদীপ।
‘তুমি একা এতটা রাস্তা যাবে? আমি পেছনে বসি না।’
‘না। একা যেতে আমার সুবিধে হবে।’ মোটরবাইক চালু করল প্রদীপ। লিটন হাঁটতে শুরু করল বিপরীত দিকে। মোড় ঘুরতেই হেডলাইটের আলোয় একটা মূর্তিকে দৌড়ে মাঝখানে চলে আসতে দেখল প্রদীপ। আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে যে মূর্তিটা হাত নাড়ছে সে স্ত্রীলোক।
কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারল প্রদীপ। সে বাইকটাকে থামাতেই সুজাতা ছুটে এল কাছে, ‘আমাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে বাঁচান।’
‘আমি কীভাবে বাঁচাব?’
‘আপনি তো গ্যাংটকে যাচ্ছেন।’
‘তোমাকে কে বলল?’
‘আমি শুনেছি। বাড়িতে ঢোকার সময় আপনি জামাইবাবুকে বলেছিলেন। আপনি আমাকে গ্যাংটকে নিয়ে চলুন। ওখানে আমার এক পিসি থাকে। ওখানে গেলে এখানকার পুলিশ আমাকে কিছু করতে পারবে না।’
‘কাল সকালের বাস ধরে চলে যেও।’
‘তার সুযোগই পুলিশ আমাকে দেবে না। আপনার পিস্তলটাকে বাঁচাতে গিয়ে এ আমি কী বিপদ ডেকে আনলাম।’ কেঁদে ফেলল সুজাতা।
‘পিস্তলটা বাঁচাতে গেলে কেন?’
‘মনে হয়েছিল ওটা পেলে পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না।’
‘আমাকে তুমি চেনো না। আমাকে পুলিশ ধরলে তোমার কী?’
‘আমি আপনাকে চিনি।’
‘সে কি? কোথায় দেখেছ?’
‘দেখেছি। দার্জিলিং-এই।’
‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তোমার জামাইবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিলে তুমি।’
‘তা হলে পালাতাম না। জানলা দিয়ে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলতাম বাইরে।’
‘ওটা তোমার কাছে আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে দাও।’
‘না। আগে আপনি আমাকে গ্যাংটক নিয়ে যান, তারপর।’
‘তোমাকে কীভাবে নিয়ে যাব? আমি তো এখনই বাইকে রওনা হচ্ছি।’
‘বাইকের পিছনে বসে আমি যেতে পারব।’
‘তোমার ঠাণ্ডা লাগবে। গায়ে তো বেশি জামা কাপড় নেই।’
‘লাগুক। তবু এখান থেকে যেতেই হবে।’
‘ঠিক আছে। তুমি স্টেশনের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। সাবধান, পুলিশ যেন তোমাকে দেখতে না পায়।’
‘আপনি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন না তো?’
প্রদীপ হাসল, ‘তোমাকে ফেলে আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু আমার পিস্তলটাকে নিয়ে যাওয়াটা খুব জরুরি।’