পরনে জিন্স আর জ্যাকেট, গলায় সিল্কের মাফলার, মাথায় আঁটা টুপি, পা ফেলছিল সে হিন্দি ছবির নায়কের মত। এই ভর বিকেলেও তার চোখ রোদ চশমার আড়ালে। দার্জিলিং এ মেঘ না থাকলেও এমন সময় রোদের গায়ে তুলতুলে আনন্দ থাকে, চোখ ঢাকার প্রয়োজন হয় না। তবু সে চোখ ঢেকে রেখেছিল।
ভানুভক্তের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে সে সতর্কভাবে চারপাশে তাকাল। না, সন্দেহজনক কাউকে নজরে পড়ছে না। এখন ট্যুরিস্ট মরশুম। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাল ভরে আছে প্রচুর আদেখলে বাঙালিতে। প্রথম-প্রথম মজা লাগত, এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রোগা খচ্চরের ওপর চল্লিশে পা দেওয়া আমাশা রুগি বাঙালিবাবু তার বেঢপ বউকে কোনওরকমে তুলে ক্যামেরা বাগিয়ে ধরছে ছবির জন্যে। আটপৌরে বউ-এর পরনে ধার করা প্যাণ্ট যা শরীরটাকে আরও কিম্ভূত করে তুলেছে। কিন্তু লোকগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চাঁদের মাটিতে সবে পা দিচ্ছে। এই দৃশ্য এখানে রোজ কতবার কতভাবে অভিনীত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখতে পেল থাপাকে। এমন হারামি পুলিশ অফিসার দার্জিলিং-এ এর আগে কখনও আসেনি। কাউকে কেয়ার করে না। এমনকী এম পি সাহেবের চিঠিকেও পাত্তা দেয়নি একবার। আজ দুপুরে খবর এল থাপার লিস্টে তার নাম উঠেছে। অস্ত্র সমেত তাকে ধরতে পারলে চামড়া ছাড়িয়ে নেবেই। আর খবরটা পাওয়ার পর হঠাৎই লোকটার মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল সে। খুব জোরে কেটে পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছিল বাজারে। নামবার সময় এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে পিস্তলটাকে ফেলে দিয়েছিল সিঁড়ির কোণে। পরে যখন বুঝতে পারল থাপা তার পিছু নেয়নি, তখন আফসোস হয়েছিল খুব। ছুটে গিয়েছিল সিঁড়ি ভেঙে। আশ্চর্য, এরই মধ্যে হাওয়া হয়ে গিয়েছে পিস্তল।
এখন এখানে একটা পিস্তল জোগাড় করতে বেশি কসরত করতে হয় না। কিন্তু টাকা লাগে। কিছু টাকা ফালতু খরচ হবে। সে দেখল থাপা চারপাশে তাকাতে তাকাতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এখন এখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা করা বোকামি। সে চেষ্টা করল সহজ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে। পাশ দিয়ে যেতে-যেতে থাপা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটা তাকে দেখছে। এখনও পর্যন্ত পুলিশের খাতায় দাগি হিসেবে তার নাম ওঠেনি। সন্দেহভাজন হিসেবে যে লিস্ট ও তৈরি করেছে তাতে উঠলেও উঠতে পারে।
‘বহুৎ আচ্ছা!’ চাপা গলায় বলল থাপা।
এবার তাকাতেই হয়। সে মুখ ফিরিয়ে হাসল, ‘ইয়েস স্যার!’
‘নামটা যেন কী?’
‘প্রদীপ, প্রদীপ গুরুং।’
‘আজ দুপুরে তোমার সঙ্গে কি আমার দেখা হয়েছিল?’
‘না, স্যার, আমি তো আপনাকে দেখিনি।’
‘তুমি জানো আমি কে?’
‘ইয়েস স্যার। আপনি দার্জিলিং থানার ওসি।’
‘কী করে জানলে? কোনও ভদ্রলোকের ছেলে পুলিশ অফিসারকে চিনতে পারে না।’
‘আমার বাবা কিন্তু ঠিক ভদ্রলোক নয়।’
‘তার মানে?’
‘বাবা ব্যবসা করে। ইধার কা মাল উধার। দো-নম্বরি।’
‘আচ্ছা। কী নাম তার?’
‘জি, নরবাহাদুর গুরুং।’
‘আচ্ছা। তোমার এই ওপিনিয়নের কথা নরবাহাদুরজি জানেন?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তুমি আর একঘণ্টা পরে থানায় এসো।’
‘থানায়? কেন স্যার?’
উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না থাপা। ছোট ছড়ি হাতে হেঁটে চলে গেল ম্যালের ওপাশে। প্রদীপ ঠোঁট কামড়াল। বেশি কথা বলা হয়ে গেল। এখন কী করবে? থানায় গেলে থাপা তাকে নির্ঘাৎ পুরে দেবে গারদে। ঘুমের রাস্তায় তিন-তিনটি জিপ রবারি হয়ে গেছে। পুলিশ কারও নাম পায়নি। পেতে কতক্ষণ? একঘণ্টা অনেক সময়। তার আগে ঘুরে আসতে হবে। প্রদীপ এগিয়ে গেল অজিত ম্যানসনের পেছনের দিকে। মডার্ন টেলার্সের সামনে দাঁড় করানো তার মোটরবাইকটায় উঠে স্টার্ট দিল। তারপর তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল লেবং রেসকোর্সের দিকে।
টিবেটিয়ান রিফুজিস সেণ্টার ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে ডানদিকের কাঁচা পথ দিয়ে মোটরবাইক তুলতেই সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল, ‘পরম আনন্দ।’ আরও একটু যেতে ছোট ব্যারাকবাড়ি আর তার সামনের চিলতে মাঠ নজরে এল। মোটরবাইকের আওয়াজ কানে যেতেই ব্যারাক থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এল জনা কুড়ি বাচ্চা ছেলে। স্টার্ট বন্ধ করতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রদীপের ওপর। কেউ বাইকে উঠে বসল, কেউ ওর কাঁধে। সবচেয়ে পুচকেটাকে কাঁধে নিয়ে প্রদীপ বাইক থেকে নামল। বাচ্চাগুলো তখন চেঁচাচ্ছে, বাইক-আঙ্কল জিন্দাবাদ, বাইক-আঙ্কল জিন্দাবাদ। প্রদীপ ধমকাল, ‘আরে, চুপ, একদম চুপ। আমি তোমাদের বাইক-আঙ্কল নই, শুধু আঙ্কল। তা আজ পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো সবার?’
সবাই একসঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলল। প্রদীপ বলল, ‘তা হলে একটা গান শোনাও।’
সঙ্গে-সঙ্গে বাচ্চারা শোলে ছবির গান ধরল, ‘এ দোস্তি—।’
প্রদীপ ওদের সঙ্গে গলা মেলাতে-মেলাতে দেখল মিসেস এভার্ট বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রমহিলার মুখ স্বাভাবিক নয়। এই আমেরিকান মহিলা একা কারও কোনও সাহায্য ছাড়া এইখানে হোম বানিয়েছেন পিতৃপরিচয়হীন অসহায় ছেলেগুলোকে মানুষ করার জন্যে। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছে। দুজন সহকারিণীকে নিয়ে উনি যা পরিশ্রম করেন তা দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। তিন-তিনটে জিপ লুঠের অর্ধেক টাকা প্রদীপ ওঁর হাতে তুলে দিয়েছে হোমের খরচ চালানোর জন্যে। অবশ্য সে বলেনি টাকাগুলো কী করে পাওয়া গেল।
গান শেষ হওয়া মাত্র প্রদীপ মিসেস এভার্টের সামনে গিয়ে মাথা নাড়ল, ‘গুড ইভনিং।’
‘গুড ইভনিং প্রদীপ।’
‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনও সমস্যায় পড়েছেন।’
‘সমস্যা ছাড়া তো জীবন নয়।’
‘আমাকে বলুন, যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।’
‘না। এটা আমাদের মত সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে। অনলি গভর্নমেণ্ট ইচ্ছে করলে পারে। আমি এম পি-র কাছে গিয়েছিলাম, দরখাস্ত দিয়ে এসেছি।’
‘আপনার কি সমস্যার কথা বলতে আপত্তি আছে?’
‘না। এই যে বাড়ি, মাঠ, এসোবের জন্যে আমি প্রতিমাসে আড়াইশো টাকা ভাড়া দিই। এ নিয়ে কখনও কোনও ট্রাবল হয়নি। হঠাৎ মিস্টার প্রধান আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি এইসব জমি-জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছেন একজন ব্যবসায়ীকে যিনি এখানে ফ্যাক্টরি খুলবেন। আমাকে উঠে যাওয়ার নোটিস দিয়েছেন উনি।’
‘তারপর?’
‘আমি কোথায় যাব এতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে? আমি ওঁর কাছে অ্যাপিল করলাম। উনি বললেন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে মাড়োয়াড়িকে সম্পত্তিটা বিক্রি না করে আমাকে দিতে পারেন। কিন্তু অত টাকা একসঙ্গে আমি পাব কোথায়? অসম্ভব। তাই সরকারকে লিখেছি যদি তাঁরা সাহায্য করেন।’
‘পঞ্চাশ হাজার টাকা?’
‘ইয়েস।’
‘কোন মাড়োয়াড়ি এই জমিটা নিচ্ছে?’
‘জানি না। এইসব ফুলের মত বাচ্চাদের নিয়ে আমি কোথায় যেতে পারি তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।’
‘আপনার হাতে আর কতদিন সময় আছে?’
‘তিনমাসের একটু কম সময়। তার মানে–।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গে সাতদিন পরে দেখা করব। ততদিন আপনি কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।’
‘এ ব্যাপারে তুমি কী করতে পারো প্রদীপ?’
‘এই বাচ্চাগুলোর জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি ম্যাডাম।’
‘দেখো এমন কিছু করো না যাতে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হন। আগামীকাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, একটা ভাল খবর কাল পাব।’
‘তাহলে তো ভাল কথা। কিন্তু সেটা না হওয়া পর্যন্ত আজকাল আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আচ্ছা, আজ আমি আসছি।’
ম্যাডামের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া যত সহজ, শিশুদের কাছ থেকে তত কঠিন। তবু খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রদীপ বাইক চালু করল। আর মিনিট দশেক সময় আছে। থাপা বলে গেছে এক ঘণ্টার মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে। সে কাঁচা পথটা ধরেই যে গতিতে বাইক চালাচ্ছিল তাতে আচমকা ব্রেক কষে থামানো মুশকিল। এখন এই সন্ধে হয়ে আসার সময়ে পথ পরিষ্কার থাকার কথা। কিন্তু বাঁক ঘুরতেই সে দেখতে পেল রাস্তা বন্ধ। দুটো জিপ ঠিক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ব্রেক করলে ছিটকে যেতে হবে। পাশ দিয়ে রাস্তা নেই যে কাটিয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে জিপের কাছে এসে সামনের চাকা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে তুলল সে। বাইকে গতি এমন প্রবল ছিল যে বাইক উঠে গেল জিপের বনেটে এবং ছাদ ছুঁয়ে লাফিয়ে পড়ল ওপাশের পথে। পড়ার সময় ব্যালেন্স হারাতে-হারাতেও সামলে নিল প্রদীপ। এখন বাইক থামিয়ে ঘুরে গিয়ে লোকগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, কিন্তু সময় নষ্ট হবে তাতে। প্রদীপ শুন্য রাস্তা ধরে দার্জিলিং থানার দিকে বাইক ছোটাল।
এরকম একটা দৃশ্য দেখবে জিপের আরওহীরা কল্পনা করেনি। ওরা ভেবেছিল সামনে বাধা দেখে বাইক থেমে যাবে। কিন্তু ওটা যে গতি বাড়িয়ে সার্কাসের খেলা দেখাবে তা কে জানত। অথচ ওই লোকটাকে ধরতেই তারা এসেছিল। ওদের বস-এর কাছে খবর গেছে একমাত্র একটি বাইকে করা আসা লোকের সঙ্গেই হোমের ম্যাডামের সংযোগ আছে। সেই লোক প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত দু-দিন হোমে আসে। সরকারি মহল নিয়ে বস চিন্তা করে না। এই ছেলেটি কে, কী তার পরিচয়–বের করার দায়িত্ব দিয়েছিল ওদের ওপর। কিন্তু লোকটা যে এমন সার্কাস দেখাবে তা ওরা অনুমান করেনি।
আধঘণ্টা বাদে জলাপাহাড়ের রাস্তায় একটি সুন্দর বাংলো বাড়ির বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে বস্ যখন কাহিনিটা শুনল তখন তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটল, ‘তোমরা কজন ছিলে ওখানে?’
‘স্যার, চারজন।’
‘চারজন যখন একজনকে আটকাতে পারোনি তখন তোমাদের যে টাকা দেওয়া হয়ে থাকে তা ওকে দেওয়া যায়। কী বলো? আমি ঠিক বলছি কি না?’ বস একটুও উত্তেজিত নয়।