বাড়ির সামনে রাস্তার গায়ে একটা দেওয়ালের ওপর বসেছিল শানবাহাদুর। থাপার কাছে মার খাওয়াটা অবশ্য ইতিমধ্যে তেমন মনে পড়ছে না, কিন্তু ওই শুটকো লোকটা কীভাবে যে পিস্তল হাওয়া করে দিল তা বুঝতে না পেরে সে খুব অবাক হচ্ছিল। বাড়িটা বড় নয়। সে যখন থাপাকে টেলিফোন করতে গিয়েছিল তখন যদি কেউ এই বাড়িতে এসে থাকে যার হাতে মতিলাল পিস্তলটা পাচার করতে দিয়েছে তা হলে নিশ্চয়ই বোকা বনতে পারে। কিন্তু যেই আসুক তাকে সতর্ক করতে মতিলাল নিশ্চয়ই এখনই বের হবে।
প্রায় একঘণ্টা বসে থাকার পর শানবাহাদুরের শীত করতে লাগল। মতিলালের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল অনর্থক সময় নষ্ট করছে। পিস্তলটার পিছনে পড়ে না থেকে অন্য কিছুর সন্ধানে গেলে দু পয়সা কামাই হতে পারত। সে পুলিশের খোচড় নয়। কিন্তু অনেকেই তাই মনে করে। এই শহরে যারা অস্ত্র নিয়ে কারবার করে তারা তাকে ভাল চোখে দেখে না। ওদের অস্ত্রের কথা পুলিশ যদি জানতে পারে তা হলে যে শেষ হয়ে যাবে এমন হুমকি সে পেয়েছে। ভুলেও অমন কাজ করবে না সে। বাজারে মতিলালকে দেখে মনে হয়েছিল এ লাইনের লোক নয়। তাই কামানোর ধান্দা হয়েছিল। যে ছেলেটা রিভলভার ফেলে গেছে তাকে বের করতে পারলে রোজগারের আশা আছে। কিন্তু মুশকিল হল, ছেলেটাকে সে দেখেনি। মতিলাল দেখেছে। ওকে দিয়ে যদি ছেলেটাকে বের করা যায়! হঠাৎ শানবাহাদুরের চোখ চকচক করে উঠল। মতিলাল বের হচ্ছে। দরজায় তালা দিল। সন্ধে হয়ে আসছে বলে ফুলহাতা সোয়েটার আর টুপি পরেছে। কোনওদিকে না তাকিয়ে লোকটা হাঁটছে এখন। কিছুটা যেতে গিয়ে শানবাহাদুর ওকে অনুসরণ করল।
উঁচু রাস্তা ভেঙে চিড়িয়াখানার পথ ধরল মতিলাল। ওদিকে যাওয়া মানে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মতলবখানা কী? কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে মতিলালকে অসহায়ের মত তাকাতে দেখল। বাড়িটার সামনে জিপ দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে মতিলাল সেটাকে ধরাল। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। শানবাহাদুর ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। এদিকে বাড়িঘর কম। যা আছে সব কাঠের।
আলো মরে যাওয়া আলোয় মতিলালের মুখের যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে শানবাহাদুরের মনে হল লোকটা বেশ কষ্টে আছে। হয়ত ওই জিপের জন্যেই বাড়িতে ঢুকতে পারছে না। শানবাহাদুরের মায়া হল। সে কাছে এগিয়ে গেল। মতিলাল তাকে দেখে অবাক। শানবাহাদুর হাসল, ‘আবার দেখা হয়ে গেল ভাই।’
‘না। তুমি আমার পিছন পিছন এসেছ।’ মতিলাল রেগে গেল।
‘ আহা! রাগ করছ কেন? আমি তো তোমার উপকারেও লাগতে পারি।’
‘আমার কোনও দরকার নেই। কেটে পড়ো এখান থেকে।’
‘জিপটা কার?’
‘কার আমি কী করে বলব?’
এইসময় একটা চিৎকার ভেসে এল। ওরা দেখল বিপরীত দিক থেকে একটি যুবতী ছুটে আসছে। যুবতী সুন্দরী নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী। মতিলাল অস্বস্তিতে পড়ল।
যুবতী কাছে এসে মতিলালের হাত ধরল, ‘ওমাঃ, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়িতে চলুন।’
মতিলাল বলল, ‘এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই কথা বলছিলাম।’
‘তাই?’ যুবতী শানবাহাদুরের দিকে তাকাতেই সে ঘাড় নেড়ে না বলল।
‘কেন মিছিমিছি দুঃখ পেতে এখানে আসেন আপনি? জানেন তো রোজ এইসময় বলরামদা জিপ নিয়ে এখানে আসে।’ যুবতী বিষণ্ণ গলায় বলল।
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে।’ কথাটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল মতিলাল।
‘মোটেই ঠিক নেই। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। দিদি আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। নিজে আপনাকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে বসে বলরামদার সঙ্গে প্রেম করবে তার বেলা দোষ নেই, আর আমি একটু—’ থেমে গেল যুবতী।
‘শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেলে ভাল করতে না?’ মতিলাল জিজ্ঞাসা করল।
‘ঝি-এর মত খাটাবে। বড় ভাই-এর বিধবা বউকে কে পুষতে চায়? তা ছাড়া, আমার কথাও তো ভাবতে হবে। কী-বা বয়স আমার। যুবতী ঠোঁট ফোলাল।’
এসোব কথা একটা বাইরের লোকের সামনে হোক চাইছিল না মতিলাল। সে সস্নেহে বলল, ‘মানু, যাও, ভেতরে যাও।’
ঠিক তখনই বাড়ির সদর দরজা খুলে গেল। ওরা দেখল বলরাম বেরিয়ে এল, পেছনে সুভদ্রা। শকুনের চোখ বলতে হয়, সেখান থেকেই দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করল সুভদ্রা। ‘অ, তুই ওই মিনসেকে ডেকে এনেছিস? এত বড় স্পর্ধা। মায়ের পেটের বোন হয়েও তুই আমাকে চাকু মারতে চাস। আর তুমিও কেমন পুরুষ? সুড়সুড় করে চলে এলে?’
মতিলাল রেগে গেল। আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়েছেলে! সে চিৎকার করল, ‘আমাকে কেউ এখানে ডেকে আনেনি। মিছিমিছি তুমি সুজাতাকে দোষ দিচ্ছ!’
‘ইস! দরদ যে উথলে পড়ছে। অল্পবয়সের শালি পেয়ে নোলা ঝরছে!’ চিৎকার করল সুভদ্রা। এবার তাকে থামাতে যেন বলরাম কিছু বলল। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সুভদ্রা বলল, ‘তুমি চুপ করো। আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না।’
শানবাহাদুর চাপা গলায় মন্তব্য করল, ‘এ যে আমার বউ-এর এক কাঠি ওপরে।’
কিন্তু ততক্ষণে ওপরে একটা ঘটনা ঘটে গেল। বলরামকে ধমকানো মাত্র সে ঘুরে চড় মারল সুভদ্রার গালে। সুভদ্রা পড়তে-পড়তে সামলে নিল। মতিলাল দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুজাতা চাপা গলায় বলল, ‘দিদি আর চেঁচাবে না।’
ওরা দেখল মার খেয়ে সুভদ্রা চোখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। বলরামকে এবার একটু অপ্রস্তুত দেখাল। সে হাত ধরে সুভদ্রাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আর সুভদ্রাও সুড়সুড় করে অনুসরণ করল তাকে।
সুজাতা এবার হাসল, ‘দিদিকে আপনি কখনও মেরেছেন?’
‘না, কখনও না। কেউ বলতে পারবে না ও কথা।’ প্রতিবাদ করল মতিলাল।
‘ওইটাই ভুল করেছেন।’
‘মানে?’
‘বলরামদার হাতে মার খেলে দিদি কেঁচো হয়ে যায়। তখন খুব ভালবাসে।’
‘সে কি?’
‘হ্যাঁ। যারা মুখে চেঁচায় তাদের ওষুধ ওটা।’
শানবাহাদুর কান খাড়া করে শুনছিল। হঠাৎ সে সোজা হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। তার এভাবে চলে যাওয়াটা অবাক করল ওদের। সুজাতা বলল, ‘আপনার বন্ধু কিছু না বলে চলে গেল কেন?’
মতিলাল মাথা নাড়ল, ‘কী জানি?’
‘আপনি আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
‘তোমার দিদির সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।’
‘এখন কোনও চান্স নেই।’ হাসল সুজাতা, ‘মার খেয়েছে, এবার আদর খাবে।’
মাথা গরম হয়ে গেল মতিলালের, ‘তুমি জানো এটা বেআইনি। এখনও ও আমার বউ।’
‘মোটেই না। সবাই জানে আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।’
‘ছাড়াছাড়ি হলে ও আমার কাছে যায় কেন? প্রতিমাসে আমার কাছে টাকা নেয় কেন?’
‘নরম মাটি পেলে সবাই আঁচড়ায়। আপনার ঘরে আবার বউ এলে ও কি বারবার সেখানে যেত? আপনি শোক-শোক মুখ করে পড়ে থাকেন বলেই যায়!’ সুজাতা হাসল।
মতিলাল ভেবে পাচ্ছিল না তার কী করা উচিত। যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা বলরাম চলে না যাওয়া পর্যন্ত করা যাবে না। আবার নিজের বউ তার বন্ধুর সঙ্গে চোখের সামনে ঘরের দরজা বন্ধ করে আছে এমন দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব। সে বলল, ‘আমি যাচ্ছি।’
‘কী বলতে এসেছিলেন দিদিকে?’
‘বলতে না, করতে!’ দৃঢ় গলায় বলল মতিলাল।
‘করতে মানে?’ হাঁ হয়ে গেল সুজাতা।
‘সাহায্য করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন তার কোনও দরকার নেই।’
‘তার মানে?’
‘এখন তোমার দিদির যে সর্বনাশই হোক না কেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না।’
‘আপনি মনের কথা বললেন না।’
‘বিশ্বাস করো সুজাতা, আমি আর পারছি না।’
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।’
‘তোমার দিদি আমাকে ছেড়ে এখন বলরামের সঙ্গে, উঃ।’
‘যে দিন চলে গেছে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখতে পারবেন? অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকান আপনি। কী করতে এসেছিলেন বলুন।’
কিন্তু কিন্তু করেও না বলে পারল না মতিলাল, ‘তোমার দিদি আজ দুপুরে আমার ওখানে গিয়ে অনেক গালমন্দ করে আমার কেনা মুদির দোকানের জিনিসপত্র একটা তিব্বতি ব্যাগে পুরে নিয়ে এসেছে এখানে। ওই ব্যাগটা আমার চাই, জিনিসপত্র সমেত।’
‘ব্যাগটা দিদির ঘরে। এখন তো পাওয়া যাবে না।’
‘তুমি ওকে ব্যাগটা নিয়ে ফিরতে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ। বলল, চা-চিনি আছে। আর তখনই বলরামদা এসে গেল বলে দিদি ব্যাগটা ঘরের কোণে রেখে দিয়েছে।’
‘জিনিসপত্র বের করেনি?’
‘না। কিন্তু আপনি সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্যে সাহায্য করতে এসেছিলেন, বললেন। ওই ব্যাগটা ফেরত আনলেই সেটা হবে?’
‘না। জিনিসপত্র সমেত ব্যাগটা নিয়ে আসতে হবে। তুমি যেমন করেই হোক কেউ ওর ভেতরে হাত দেওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? প্লিজ!’ মতিলাল কাতর গলায় বলল।
‘কী আছে ব্যাগের ভেতরে?’
‘বলব। সব বলব। আগে তুমি ব্যাগটাকে নিয়ে এসো।’
‘ঠিক আছে। আপনি বাড়ি চলে যান। আমি চেষ্টা করব নিয়ে যেতে।’ সুজাতা বলল।