» » কালোচিতার ফটোগ্রাফ

বর্ণাকার

ডিনারের অর্ডার দিল প্রদীপ। সেই সঙ্গে একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ব্র্যাণ্ডি খাও?’

‘না।’

‘হুইস্কি?’

‘আমি মদ খাই না।’

‘আমি খেলে তোমার আপত্তি আছে?’

‘আমার আপত্তি আপনি শুনবেন কেন?’

‘ইনডাইরেক্ট কথা বলো না। আমার আজ রাত্রে ঘুম দরকার। ব্র্যাণ্ডি না খেলে ঘুম হবে না।’

‘তাহলে তো চুকেই গেল। আমার পোশাক দোকান থেকে এসেছে কি?’

খোঁজ নিল প্রদীপ। না দোকান থেকে কোনও প্যাকেট পাঠায়নি। সুজাতা বিপাকে পড়ল। নতুন শালোয়ার কামিজ পরে রাত্রে শোওয়া অস্বস্তিকর। প্রদীপ বলল, ‘এক কাজ করো। কিছুক্ষণ বাদে আমি বেঘোরে ঘুমাব। তখন জামাকাপড় ছেড়ে তুমি কম্বলের তলায় ঢুকে যেও। ভোরবেলায় উঠে আবার ওসব পরে নিও। এখন দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। লোকটা বোধহয় পাঠাতে ভুলে গিয়েছে।’

রাত বাড়ছিল, সেই সঙ্গে ঠাণ্ডাও। সুজাতার রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। টেবিলে ব্র্যাণ্ডির বোতল নিয়ে বসেছিল প্রদীপ। এই মুহূর্তে ভাবনায় ডুবেছিল সে। ব্ল্যাক লেপার্ড নয়, একটি খুন হয়ে গেছে ওই বর্ডারে। একটি মানুষকে খুন করে তার সঙ্গিনী মহিলাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওখান থেকে। এই খুনের ছবি বা সাক্ষি কেউ থাকুক তা ভদ্রলোক চান না। ওই অবধি ঠিক আছে।

কিন্তু কয়েকটা প্রশ্ন আসছে পরপর। যে মানুষটা খুন হয়েছে সে এত জায়গা থাকতে ওই বর্ডারে একজন মহিলাকে নিয়ে কেন গিয়েছিল? মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? ওরা কীসে গিয়েছিল? যদি নিজস্ব কোনও ট্রান্সপোর্টে গিয়ে থাকে সেটা এখন কোথায়? যারা খুন করতে গিয়েছিল তারা কি জানত ওরা ওখানে যাবে? খুন করার সময় মেয়েটির ক্ষতি কেন করেনি? মৃত লোকটার শরীর কি পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে? যদি যায় তাহলে কেন পুলিশ পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কিছু দেখতে পায়নি? এইসব প্রশ্নের উত্তর তার জানা দরকার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই ভদ্রলোকের স্বার্থ!

মাথা ঝিমঝিম করছিল। একটু-একটু করে ভাবা আর সম্ভব হচ্ছিল না ব্র্যাণ্ডির প্রভাবে।

‘আপনি কি ওখানে সারারাত বসে থাকবেন?’ সুজাতার গলা ভেসে এল।

পাশ ফিরল প্রদীপ। মেয়েটা বসে আছে খাটের ওপর। সে বলল, ‘কী অসুবিধে করছি?’

‘আপনি না ঘুমানো পর্যন্ত আমি শুতে পারছি না।’

‘কে নিযেধ করল?’

‘আমাকে এই পোশাক ছাড়তে হবে।’

‘ও। আমি তাকাচ্ছি না, তুমি আমার পেছনে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করো।’

‘অসম্ভব। এভাবে পারা যায় না।’

‘আশ্চর্য! তুমি পোশাক ছাড়ার পর আমার খাট থেকে পাঁচ ফুট দূরের একটা খাটে কম্বলের তলায় জন্মদিনের পোশাকে শুয়ে থাকতে পারবে অথচ–। আমি জেগে থাকলে তোমার লজ্জা আর ঘুমালে নয়? আমি যদি জোর দেখাই তাহলে তুমি বাধা দিতে পারবে?’ প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ‘ঠিক আছে, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। দয়া করে যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো।’

‘না। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না।’ বলতে-বলতে ব্র্যাণ্ডির বোতলে চোখ পড়ল সুজাতার, ‘ইস, এর মধ্যে কতখানি খেয়ে ফেলেছেন? কী করেছেন আপনি?’

‘কেন? আমি কি মাতলামি করছি?’

‘আপনি বসুন। বসুন বলছি।’ সুজাতা এমনভাবে ধমকে উঠল যে প্রদীপ নিঃশব্দে বসে পড়ল।

‘নিজেকে আপনি খুব সাধুপুরুষ বলে মনে করেন, তাই না?’

‘এত বড় সম্মান লিটনও আমাকে দেবে না।’

‘হ্যাঁ, করেন। নইলে কাল থেকে এমন ব্যবহার করছেন, যেন আমি পাঁচ বছরের মেয়ে।’ সুজাতা রাগত গলায় বলল, ‘আমাকে স্ত্রী সাজিয়ে আপনার লাভ হতে পারে কিন্তু আমার কোন উপকার হল? আপনি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছেন আমার আপত্তি আছে কি না? আপনারা যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। আপনি আমাকে বাজে মেয়েছেলে ছাড়া কিছু মনে করেন না।’

‘সুজাতা। তুমি কীরকম মেয়ে আমি জানি না। তবে না জেনে তুমিও একটা বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। আমি একটা কাজ নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শর্ত ছিল কাজটা করতে পারলে যে টাকা পাব তা দিয়ে আমি দার্জিলিং-এর একটা অনাথ আশ্রমের শিশুদের উপকার করতে পারব। এখানে এসে ক্রমশ জানতে পারলাম আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমাকে দিয়ে কয়েকটা খারাপ কাজ করিয়ে শেষপর্যন্ত আমাকেই সরিয়ে ফেলবে ওরা। এমন হতে পারে আমি আর গ্যাংটক থেকে ফিরে যেতে পারব না। অতএব, বুঝতেই পারছ, আমাকে এখন অনেক ভেবে পা ফেলতে হবে। শত্রুপক্ষ আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।’

‘আমি এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারি না?’

‘জানি না। যদি প্রয়োজন হয় বলব।’

‘আমরা যেভাবে এসেছিলাম সেইভাবে আজই এখান থেকে চলে গেলে কেমন হয়?’

‘না। আমি কখনও হেরে পালাইনি। আমাকে শেষ দেখা দেখতে হবে।’

‘বেশ। এটা করতে হলে রাত জেগে ব্র্যাণ্ডি খেয়ে কী লাভ?’

‘তুমি বুঝবে না।’ প্রদীপ আবার গ্লাসে ব্র্যাণ্ডি ঢালল।

সঙ্গে-সঙ্গে মুখের চেহারা বদলে গেল সুজাতার। কোনও কিছুর পরোয়া না করে সে পোশাক খুলতে লাগল। এতটা আশা করেনি প্রদীপ। একটার পর একটা পোশাক খুলে বিবস্ত্রা সুজাতা চলে গেল তার খাটের কাছে। প্রদীপের মনে হল তার দুটো চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে। পোশাক পরা অবস্থায় যাকে খুব সাধারণ মনে হয়েছিল পোশাক সরতেই সে যেন আগুনের শিখা হয়ে গেল। এমন রূপ সে কখনও দেখেনি।

সুজাতা এখন কম্বলের তলায়। মাত্র কয়েক ফুট দূরে বসে আছে প্রদীপ। ইচ্ছে করলেই সে পৌঁছে যেতে পারে আগুনের কাছে। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ব্র্যাণ্ডির গ্লাসটাকে টেবিলে রাখল। পৃথিবীতে এখন একটুও শব্দ বাজছে না। অন্তত এই বন্ধ ঘরে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।

প্রদীপ নিজের খাটে বসে জুতো খুলল। গরম জামাগুলো সরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। সঙ্গে সঙ্গে তার অন্যরকম আরাম হল। ওই মেয়েটি কে? যাকে কেন্দ্র করেই হয়ত হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গেছে; এই প্রশ্নটি হঠাৎই সব ছাপিয়ে মাথায় ঢুকে পড়ল। এইরকম ভাবতেই তার স্নায়ু শিথিল হয়ে এল। ব্র্যাণ্ডির প্রভাবে এক গভীর ঘুমের ঢেউ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল দ্রুত। এবং এইসময় তার কানে কান্নার শব্দ পৌঁছাল। নিস্তব্ধ রাত্রে খুব নিচু স্বরের কান্নাকেও এড়িয়ে থাকা যায় না। অনেক কষ্টে ঘুমের ঢেউকে সরিয়ে চোখ মেলল সে। তারপর পাশের বিছানার দিকে তাকাল। কান্নাটা আসছে কম্বলের নিচ থেকে। প্রদীপ কোনওমতে উঠল। সুজাতার খাটের একপাশে গিয়ে বসল সে, ‘কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?’

কান্নাটা একটু কমল, সামান্যই।

প্রদীপ বলল, ‘তোমাকে অপমান করার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। আমি সেটা করিওনি।’

মুখ দেখা যাচ্ছে না, সুজাতার গলা শোনা গেল, ‘আমি কাল কী করব? কোথায় যাব? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ প্রদীপের মনে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হল সে বুঝতে পারল না। কম্বলের প্রান্ত ঈষৎ সরিয়ে সে হাত ঢুকিয়ে সুজাতাকে টেনে নিল কাছে।