প্রদীপ হেসে ফেলল, ‘বাঃ। চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে। বেড়াতে যাবে নাকি?’
‘ঠাট্টা করছেন?’
‘মোটেই না।’
‘আমি গতকাল থেকে এই পোশাক পরে আছি। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে।’
‘ঠিক-ঠিক। আমার উচিত তোমাকে একটা ভাল পোশাক কিনে দেওয়া।’ প্রদীপ বলল।
‘কেন? উচিত কেন?’
‘কারণ এখন থেকে সবাই জানবে আমরা স্বামী-স্ত্রী।’
‘কী বলছেন আপনি?’ উঠে দাঁড়াল সুজাতা।
‘উত্তেজিত হয়ো না। এই হোটেলে আজ ভোরে আমরা একই বাইকে চেপে এসেছি। ওই সম্পর্কটা লোকে জানলে সহজে বিশ্বাস করবে। আর বিশ্বাস করলে গ্যাংটকে যতক্ষণ আছি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তুমি যদি ইচ্ছে করো, আমরা কেউ কখনও কাউকে চিনব না। ঠিক আছে?’
‘কিন্তু—’
‘শোনো। এখন যদি পুলিশ এসে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার আইডেণ্টিটি কী, তুমি কী বলতে পারবে? একা মেয়ে অনাত্মীয়া পুরুষের সঙ্গে একঘরে আছে যাকে কাল রাত্রের আগে দ্যাখোনি সেটা পুলিশকে জানালে ওরা তোমাকে সম্মান করবে? আমরা স্বামী-স্ত্রী জানলে ওদের অনেক কৌতূহল থেমে যাবে। ঠাণ্ডা পড়ছে। ওভারকোটটা পরে নাও।’
‘বাইরে যাওয়ার দরকার কী?’
‘কোথাও বেড়াতে এসে স্বামী-স্ত্রী চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকে না। মিনিট দেড়েকের মধ্যে ওরা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল।’ রিসেপশনের কাছে পৌঁছে প্রদীপ গলা তুলে বলল, ‘ডার্লিং, এক মিনিট, প্লিজ।’ তারপর কাউণ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’
‘খুব স্যাড ব্যাপার!’
‘খুব-উ-ব। ওঁর সঙ্গে একটা ব্যবসার ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, হল না। ও হ্যাঁ, আমার ভাইকে আপনি ভুল বুঝছেন। ওর মাথা সম্পূর্ণ নর্মাল নয়। ডাবল-বেড রুমে দাদা বউদির সঙ্গে দেওরের থাকা উচিত নয় এটা চট করে ও বুঝতে পারে না।’
‘তাই বলুন। ওঁর কথাবার্তা—’
‘একটু অ্যাবনর্মাল। যাক গে, আমরা দুজনেই ওই ঘরে থাকব।’
‘তাহলে ওঁর জন্যে।’
‘আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকেন এখানে। তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। একা রাত্রে হোটেলে থাকতে দিতে রাজি নই আমি। নর্মাল নয় তো!’ প্রদীপ বেরিয়ে এল। দরজার বাইরে তার বাইক রয়েছে। ওকে সেদিকে যেতে দেখে সুজাতা বলল, ‘আচ্ছা, এখন ওটা ব্যবহার না করলে অসুবিধে হবে?’
‘না। চলো, হাঁটি। আর শোনো, সবার সামনে তুমি আমাকে আপনি বলবে না।’ সুজাতার কনুই জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল প্রদীপ। ঠিক তখনই সে আবিষ্কার করল মেয়েটি স্মার্ট। সাধারণ মেয়ের মত লাজুক নয়। অবশ্য সেটা যে নয় তার প্রমাণ সুজাতা এর আগে অনেকবার দিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুব হিন্দি ছবি দেখো?’ হেসে মাথা নাড়ল সুজাতা, ‘খুউব।’
‘ফেবারিট হিরোইন কে? শ্রীদেবী?’
‘না। পূজা ভাট।’
প্রদীপ চোখ বড় করল। এখন সন্ধের অন্ধকার নেমেছে সবে। রাস্তায় মানুষের ভিড় কমছে। যদি কেউ অথবা কারা তাকে লক্ষ রাখে তা হলে এখন নিশ্চয়ই একটু ফাঁপরে পড়েছে। বউ নিয়ে বেড়াতে এসে কেউ গোলমাল চায় না।
একটা বড় পোশাকের দোকানে ঢুকল ওরা। ঢোকার আগে প্রদীপ দেখে নিল দোকানের পাশে একটা এসো টি ডি করার সেণ্টার আছে। শালোয়ার কামিজ এবং মোটা পুলওভার দেখাতে বলল সে সেলসম্যানকে। তারপর সুজাতার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘ডার্লিং তুমি পছন্দ করো, আমি এক মিনিট ঘুরে আসছি। উজ্জ্বল কোনও রং নিলে ভাল লাগবে।’
সুজাতা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। মেয়েটা যেন এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
দোকানের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিল প্রদীপ। সন্দেহ করা যেতে পারে এমন কাউকে দেখা গেল না। এসো টি ডি সেণ্টারে ঢুকে সে বুথের দরজা ভেজালো। আজ অন্তত পাঁচবার ডায়াল করতে হল। তারপর ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল, ‘হ্যালো।’
‘বলে যাও।’
‘আমি এখনও তৃতীয় ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পাইনি।’
‘বড্ড বেশি সময় নিচ্ছ। এমন হতে পারে লোকটা গ্যাংটক থেকে নেমে গেছে। এবং সেটা হলে আমি কথা রাখতে বাধ্য নই।’
‘না স্যার। রণতুঙ্গা মারা যাওয়ার আগে বলেছিল লোকটা তিনদিন গ্যাংটকে থাকবে।’
‘কথাটা আগে বলোনি তুমি।’
‘খেয়াল ছিল না স্যার।’
‘রণতুঙ্গা আর কী বলেছিল?’
‘তেমন কিছু বের করতে পারিনি ওর পেট থেকে। শুধু বলে গেছে কোনও ব্ল্যাক লেপার্ড সে দ্যাখোনি। ইন ফ্যাক্ট ওই ট্যুরিস্টবাসটার ড্রাইভারও একই কথা বলেছে।’
‘ওদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। তিন নম্বর লোকটার ব্যাপারে কোনও ক্লু পেয়েছ? কাউকে জিজ্ঞাসা করেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। আজ বিকেলে যারাই ট্যুরিস্ট বাস থেকে নেমেছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এক বৃদ্ধ ট্যুরিস্টকে সন্দেহ হচ্ছে। ভদ্রলোক গতকালও বর্ডারে গিয়েছিলেন।’
‘বৃদ্ধ? কীরকম বৃদ্ধ?’
‘বছর পঁচাত্তর বয়স। বেঁটে ফরসা, গুজরাতি হবে।’
‘কোন হোটেলে উঠেছে?’
‘এখনও বের করতে পারিনি। মনে হয় আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে।’
‘ফাউণ্ড হিম অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। তুমি তাহলে আজ বিকেলে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছ? ভাল। আচ্ছা, তুমি কি একা গিয়েছ গ্যাংটকে?’
‘সত্যি কথা বলব স্যার?’
‘সেটাই আমি পছন্দ করি।’
‘একটি মেয়েকে আমি পছন্দ করতাম। শি ওয়াজ মাই গার্ল ফ্রেণ্ড!’
‘ওয়াজ?’
‘আমি গত সপ্তাহে সই করে ওকে বিয়ে করেছি।’
‘ও। তাই বলো। আমি তোমার কাছে কাল সকালের মধ্যে খবর চাই।’
‘ও কে স্যার। শর্মাটা হাতছাড়া হয়ে গেল।’
‘যে পাখি উড়ে যায় তার জন্যে বোকারাই চিন্তা করে। আসল শিকারি যে সে গাছে বসা পাখির দিকে তাকায়। গুড নাইট।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে লোকাল টেলিফোনে ট্যুরিস্ট লজে ফোন করল প্রদীপ। খোঁজ নিয়ে জানল লিসা হঠাৎই শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছেন। সে মনে-মনে প্রার্থনা করল ভদ্রমহিলার যেন পথে কোনও দুর্ঘটনা না হয়।
দোকানেই পোশাক পরিবর্তন করাল সে সুজাতাকে। ক্লোক রুমে গিয়ে সেটা পরে আসার পর সুজাতাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছিল। পুরোনো পোশাকটা দোকানদারকে দিয়ে প্রদীপ অনুরোধ করল হোটেলে পৌঁছে দিতে। তারপর সুজাতার বাজু ধরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে প্রদীপ বলল, ‘এরকম একজন বান্ধবী আমি খুব চাইতাম।’
‘চাইতেন। এখন চান না।’
‘না পেয়ে-পেয়ে চাওয়াটা ভুলে গিয়েছি।’
‘আপনি মেয়েদের মন রেখে বেশ কথা বলতে পারেন।’
‘ঈশ্বরের দিব্যি, এই মুহূর্তে ওটা করছি না। তবে তোমার ব্যাপারে আমি বুঝতেই পারছ, নিরাসক্ত। এখনও পর্যন্ত দুর্নাম দিতে পারবে না আশা করি।’
‘কারণটা জানতে পারি?’
‘আমার মনে হয় তুমি মতিলালের বান্ধবী।’
‘কীসে এটা মনে হল?’
‘গতরাত্রে তুমি যে পোশাক এবং ভঙ্গিতে ওর বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলে সেটা স্বাভাবিক ছিল না। তাছাড়া থাপা ওর ঘরে ঢুকে কোন মেয়েলি পোশাক দেখেছিল তা জানি না।’
‘না। আমি ওঁর প্রেমিকা নই। জামাইবাবু কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারেন না। বলতে পারেন, গতকাল আমার মতিভ্রম হয়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল জামাইবাবুর বাড়ির কর্তৃত্ব আমি পেতে পারি। সেটা করতে গিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’ সুজাতা অকপটে বলল।
প্রদীপ আর কথা বাড়াল না। এতটা পথ তারা হাঁটল কিন্তু কোনও সন্দেহভাজন মানুষকে সে দেখতে পায়নি। কেউ তাদের অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছিল না। সুজাতার হাত ধরে সে চুপচাপ হেঁটে ফিরছিল। কালকে তৃতীয় ফটোগ্রাফারের নাম জানাতে হবে। সেটা জানালে ভদ্রলোক আর ফিরে যেতে পারবেন না। এবং এইসব জানার জন্যে তাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না।
‘কী ভাবছেন?’ হঠাৎ সুজাতা জিজ্ঞাসা করল।
‘অ্যাঁ। কিছু না।’
‘আমি জানি আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন।’
‘আমি নিজে এত খারাপ যে অন্য কাউকে তার চেয়ে বেশি ভাবতে পারি না।’
ওরা ফিরে এল হোটেলে। দরজা খুলতেই ব্যাপারটা নজরে এল। সমস্ত জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। কেউ যেন ঘরটাকে তছনছ করে খুঁজে গেছে কিছু। সুজাতা প্রদীপের দিকে তাকাল, ‘আপনার পিস্তল? ওটা নিয়ে কি বেরিয়েছিলেন?’
‘না। সঙ্গে নিয়ে শহরের রাস্তায় হাঁটা বোকামি। ওর কোনও লাইসেন্স নেই। পুলিশ যদি ওটা সমেত আমায় ধরে তাহলে আর দেখতে হবে না।’ কথা বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে গেল প্রদীপ। ফিরে এসে বলল, ‘যারা কিছু বেআইনি ভাবে খুঁজতে আসে তারা কেন যে ভাবে জিনিসটা আইনসঙ্গতভাবে রেখে দেওয়া হবে! কী রকম বোকামি। তুমি বসো, আমি একটা নালিশ জানিয়ে আসি।’ প্রদীপ বেরিয়ে গেল।
রিসেপশনে পৌঁছানো মাত্র একজন পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেল প্রদীপ। হোটেলে ঢুকছেন। সে কিছু বলার আগেই অফিসার রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রদীপ গুরুং কত নম্বর রুমে আছে?’
প্রদীপ বলল, ‘আমার নাম প্রদীপ গুরুং।’
‘আচ্ছা!’ লোকটা তাকে আপাদমস্তক দেখে নিল, ‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘বেড়াতে। সেইসঙ্গে একটু কাজও ছিল।’
‘কী কাজ?’
‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।’
লোকটা হকচকিয়ে গেল, ‘আপনি মুখ্যমন্ত্রীকে চেনেন?’
‘নিশ্চয়ই। শিলিগুড়িতে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।’
‘মুখ্যমন্ত্রী এখন দিল্লিতে।’
‘জানি। সেই জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
অফিসারকে একটু ইতস্তত করতে দেখা গেল, মিস্টার গুরুং, দার্জিলিং পুলিশ আপনার সম্পর্কে একটা খবর পাঠিয়েছে। আপনি বেআইনি অস্ত্র ক্যারি করছেন।’
‘আপনি আমাকে এবং আমার ঘর সার্চ করতে পারেন।’
‘বুঝতেই পারছেন, এটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে।’ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। ‘বেশ ভদ্রভাবে তিনি প্রদীপের দেহ তল্লাশি করলেন।’
প্রদীপ হাসল, ‘আপনি এখানে আছেন, খুব ভাল হল। আমি রিসেপশনে এসেছিলাম একটা কমপ্লেন করতে। আমরা যখন ছিলাম না তখন কেউ বা কারা এসে আমার ঘর লণ্ডভণ্ড করে গেছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না কিছু হারিয়েছি কি না।’
‘সে কি? এরকম ঘটনা তো কখনও এখানে ঘটেনি।’ রিসেপশনিস্ট বলে উঠল। ওরা দুজনে এগিয়ে যেতে প্রদীপ সঙ্গ নিল। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। নক করতে সুজাতা খুলল। ঘরে ঢুকে অফিসার বললেন, ‘অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে আপনার কোনও শত্রু আছে?’
‘আমার জ্ঞানত ছিল না।’
‘আপনি যদি ডায়েরি করতে চান তাহলে আমার সঙ্গে থানায় আসতে পারেন।’
‘যতক্ষণ কী হারিয়েছে বুঝতে না পারছি ততক্ষণ ডায়েরি করে কোনও লাভ নেই।’
‘মিস্টার গুরুং, আপনি কি সত্যি মুখ্যমন্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা করবেন?’
‘সেইরকম ইচ্ছে আছে।‘
‘দার্জিলিং পুলিশ আমাকে যা জানিয়েছে তাতে আপনাকে আমি এখানে থাকতে দিতে পারি না। মুশকিল হল মুখ্যমন্ত্রীর নাম বলে আপনি বিপাকে ফেলে দিয়েছেন। ইনি আপনার স্ত্রী?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আপনারা গত সপ্তাহে বিয়ে করেছেন শুনলাম?’
‘খবরটা ঠিক পেয়েছেন। এবং খুব দ্রুত।’
‘মানে?’
‘এ খবর কারও জানার কথা নয়। দার্জিলিং-এর পুলিশ অফিসার থাপার তো নয়ই। আমি কিছুক্ষণ আগে দার্জিলিং-এর এক বন্ধুকে টেলিফোন করে খবরটা দিই। বন্ধু দেখছি এরই মধ্যে থাপার কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছেন।’
‘পুলিশকে এভাবেই দ্রুত কাজ করতে হয়। ঠিক আছে, আপনারা বিশ্রাম নিন। প্রয়োজন হলে আমি যোগাযোগ করব। ও হ্যাঁ, আপনি তাহলে ডায়েরি করবেন না?’
‘আপাতত না।’
ওঁরা চলে গেলেন। সুজাতা বলল, ‘আমি ভয়ে কাঁপছিলাম।’
‘কেন?’
‘হঠাৎ পুলিশকে এঘরে দেখে।’